Tuesday, June 9, 2020

বেদ পরা নাকি অপরা?

বর্তমানে ফেসবুক তথা বাংলাদেশের হিন্দু সমাজে যে নামটা আগ্রাসী হয়ে উঠেছে তার নাম হল ইস্কন। 

১০ বছর আগেও সনাতন সমাজে এত মারামারি বা বিভেদ ছিল না। হিন্দুরা শান্তিমতন সমস্ত কাজ কর্ম করে নিজেদের মতন ধর্ম পালন করতো। কিন্তু বাংলাদেশের এই অবস্থা আর আগের মতন নাই। 

ইস্কন নামক অসুরদের আগমনের কারনে আজ সনাতন ধর্মে যা সৃষ্ট হয়েছে তা দূর করতে কত সময় লাগে কে জানে। 

বৈষ্ণব ধর্মের নামে এই অসুরের দল সনাতন সমাজে যা ছড়াচ্ছে তা হল ঘৃণা। মধ্য যুগে কিছু কাল্পনিক তত্ত্ব এবং জগদ্গুরু আদি শংকরের পরবর্তী কিছু আচার্য্যদের হাস্যকর তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া মতবাদ আজ সনাতন সমাজে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই উন্মাদের দল সনাতন সমাজে নিজেদের বিকৃত গীতার বিক্রি বাড়াতে আমাদের মুল ধর্মগ্রন্থ বেদের বিরোধী হয়ে উঠেছে। 

এদের দাবী অনুযায়ী বেদ হল অপরা বিদ্যা। আসুন তাহলে প্রথম জেনে নেই পরা আর অপরা কি?


পরা বিদ্যাঃ  পরা বিদ্যা, যে বিদ্যার সাহায্যে সর্বশক্তিমান পরমব্রহ্মকে জানা যায় তাকেই বলে পরা বিদ্যা।

অপরা বিদ্যাঃ  পৃথিবী ও তৃণাদি থেকে প্রকৃতি পর্যন্ত সব জড় পদার্থের গুণ জেনে তার সাহায্যে কাজে সিদ্ধ হওয়া যায় যে বিদ্যার সাহায্যে তাকেই বলা হয় অপরা বিদ্যা।

সেই অপরাবিদ্যা পরাবিদ্যালাভের ইঙ্গিত দেয়। যে বিদ্যার ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যা ইহলোকিক

সুখের সন্ধান দেয় এবং পারলৌকিক মুক্তির উপায় তা অপরাবিদ্যা। 

এক কথায় এই বিদ্যা মুক্তি দান করতে পারে না কারণ ইহা জাগতিক বিষয়াদির জ্ঞান দেয়। 


এবার আসুন এই ইস্কন কৃৈষ্ণবদের দাবীতে। এই মুর্খদের দাবী হল এরা বলে গীতা পরা বিদ্যা আর বেদ অপরা বিদ্যা। 

এই প্রমাণ স্বরূপ এই মূর্খরা মুণ্ডকোপনিষৎ ১।১।৫  টেনে নিয়ে আসে যথা 


তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যকরণং নিরুক্তং ছন্দ জ্যোতিষমমিতি। অথ পরা যয়া তদক্ষরসমধিগম্যতে।। অর্থাৎঃ বিদ্যার মধ্যে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প ব্যকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ ইহা অপরা বিদ্যা এবং যাহা দ্বারা সেই অবিনাশী পরমাত্মা প্রাপ্ত হয়, তাহা পরা বিদ্যা।







প্রশ্ন এইখানে ২ টি।

  • এইখানে অঙ্গিরা, শৌনকের উদ্দ্যেশে যা বললেন এতে কি প্রমাণিত হয় যে বেদ শুধুই অপরা?

  • বেদে অপরা বলতে এইখানে গুরু কি বুঝিয়েছেন?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর।

ভাগবত গীতা আমাদেরসকল প্রশ্নের সমাধান। এইসব কৃৈষ্ণবরা আসলে দুঃখজনক হলেও যোগেশ্বর কৃষ্ণের কথাও অমান্য করে।
প্রমান দেখে নিন।

গীতার ১৫ অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে - "বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব বেদ্যো"

অর্থাৎ সমস্ত বেদ দ্বারা আমি (পরমাত্মাই) জানার যোগ্য।



তাছাড়া পরম গুরু এবং সনাতন ধর্মের প্রাণ পুরুষ শঙ্করাচার্য্যও তার ভাষ্যে বলেছেন - "বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব চ পরমাত্মা বেদ্যা বেদিতব্যঃ" অর্থাৎ সর্ব বেদ দ্বারা পরমাত্মাই জানার যোগ্য। গীতার এই শ্লোক স্পষ্ট করে দেয় যে, বেদ দ্বারা পরমাত্মাকে জানা যায়।



কঠোপনিষৎ ১। ২।১৫ তে বলা হয়েছে, 
" সর্বে বেদা যত্ পদমামনন্তি 

তপা্ঁসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি ৷ " 

যদিচ্ছন্তো ব্রক্ষচর্যং চরস্তি

তন্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি_ওমিত্যেতৎ ॥ ১৫ " 


অর্থ্যাৎ (যম বলিলেন) “বেদসমূহ একবাক্যে যে ঈন্সিত বস্ত্র প্রতিপাদন
করেন, অখিল তপস্যাদি কর্মরাশি যাঁহার প্রাপ্তির সহায় এবং যাঁহার কামনায় লোকে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে, আমি তোমায় সেই
প্রাপ্যবস্তর সম্বন্ধেই উপদেশ করিতেছি-_ইঁহা ওম্‌ (শব্দের বাচ্য এবং
ওষ্কার ইহার প্রতীক১)। ১।২।১৫

সহজ বাংলায় চার বেদ যাহার স্বরূপের বর্ণনা করে এবং সকল তপস্যা যাহার বর্ননা করে সেই পদ কে তোমার জন্য সংক্ষেপে বলছি। 




উপনিষদের এই বক্তব্যেও স্পষ্ট যে, চার বেদ সেই পরম পদের বর্ননা করে। 
এবার আসি যোগী কৃষ্ণের প্রামাণ্য জীবনী মহাভারতে। যা আমাদের ইতিহাস বলে খ্যাত। 
মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে,

দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে শব্দব্রহ্ম পরং চ যৎ।
শব্দব্রহ্মণি নিষ্পাতঃ পরং ব্রহ্মাধিগচ্ছতি।। 

অর্থাৎ বেদ ও বেদ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্ম উভয়ই পরিজ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি বেদশাস্ত্র বিশেষরূপে অবগত হইতে পারেন, তিনিই অনায়াসে পরব্রহ্ম লাভে সমর্থ হন। 




এখানে, আরো সুস্পষ্ট যে, বেদশাস্ত্র কেউ বিশেষভাবে অবগত হতে পারলে সে পরমব্রহ্ম লাভ করতে পারে।


বেদ স্বয়ং বলছে -

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্যাতি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়।। (যজু ৩১।১৮)

-- অর্থাৎ আমি সেই মহান পূর্ণ পরমেশ্বর কে সূর্যের সমান তেজস্বী এবং অন্ধকারের পরে জানি। তাকে জেনেই মৃত্যুকে পার করা যায়, এছাড়া মোক্ষলাভের জন্য জন্য অন্য কোন মার্গ নেই।


এরপরেও মূর্খ ইস্কনী কৃৈষ্ণব  বলবে যে না বেদ দ্বারা ব্রহ্ম লাভ করা যায় না। তাহলে বলছি শুনুন। আপনাদের ভন্ড সংঘ ইস্কনের অনুবাদ করা বিখ্যাত যে উপনিষদ তা  হল ঈশোপনিষদ। যার মাঝে ২-৩ টা মন্ত্র আপনারা বিকৃত করেছেন। সে দিকে না যাই কারন বিকৃতি আপনাদের রক্তে মিশে গেছে। 
সে নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করবো।
আজ বাঁশ শুধু পরা - অপরা নিয়ে। 

ঈশোপনিষদ্ পুরোটাই যজুর্বেদের ৪০ তম অধ্যায়। এখানে আপনারা যদি এই উপনিষদকে পরাবিদ্যার গ্রন্থ মান্য করেন তবে তো পরোক্ষভাবে বেদেই পরাবিদ্যা মান্য করলেন। শুধু ঈশোপনিষদ্ নয়, যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় তো অধিকাংশ উপনিষদেরই বিভিন্ন জায়গাতে বেদের মন্ত্র সরাসরি এসেছে। যথাঃ



★ কঠোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২।১।১৮ (ঋগবেদ ৩।২৯।২)
(ii) অধ্যায় ২।১।৯ (অথর্ববেদ ১০।৮।১৯)
(iii) অধ্যায় ২।২।২ (যজুর্বেদ ১০।২৪)

★ শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২। ১-৫ (যজুর্বেদ ১১।১-৫)
(ii) অধ্যায় ৩।১৪-১৫ ( যজুর্বেদ ৩১।১-২)
(iii) অধ্যায় ৩। ৫-৬ (যজুর্বেদ ১৬।২-৩)

★ প্রশ্নোপনিষৎ
(i) প্রথম প্রশ্ন ১১ ( ঋগবেদ ১।৬৪।১২)

★ ঐতেরীয়পনিষৎ

(i) শিক্ষাবল্লী প্রথম অনুবাক (ঋগবেদ ১।৯০।৯)
(ii) শিক্ষাবল্লী দ্বাদশ অনুবাক (যজুর্বেদ ৩৬।৯)

★ বৃহদারণ্যকোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২।৫।১৬ (ঋগবেদ ১।১১৬।১২
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৭ (ঋগবেদ ১।১১৭।২২)
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৯ ( ঋগবেদ ৬।৪৭।১৮)

যে মুণ্ডকোপনিষদে পরা অপরার ভেদ দেখানো হয়েছে সে উপনিষদেও বেদের মন্ত্র এসেছে। যথা,
(i) মুণ্ডক ২।২।১ (অথর্ববেদ ১০।৮।৬)
(ii) মুণ্ডক ৩।১।১ (ঋগবেদ ১।১৬৪।২০) 

এবার আসি আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে

বেদে অপরা বলতে এইখানে গুরু কি বুঝিয়েছেন?


 প্রথমে ৪ সংহিতার আলোচনা নিম্নোক্তঃ

বেদের জ্ঞান কান্ড ও কর্মকান্ড দুটি ভাগ
সংহিতা ভাগকে কর্মকান্ড পরিগনিত করা হয়,
 সংহিতা অংশে কর্মকান্ড বেশী প্রধান্য পেয়েছে তা ব্যাবহারিক ও নিত্য নৈমত্তিক কর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু সংহিতা ভাগের( কর্মকান্ড)  মধ্যেও মোক্ষ বিষয়ক  জ্ঞান আছে যা পরাবিদ্যা। 
যেমন উদাহরণ বলা যায়, চালের  মধ্যে কাকড় থাকলেও  আলাদা করে চাল-কাকড় বলা হচ্ছে না, চালই বলা হয়,  তেমনি কর্মকান্ড ভাগকে আলাদা করে পরা-অপরা বলা হচ্ছে না। 
এবার আসুন  মন্ডুক ১/১/৫  এ  ৬  বেদাঙ্গকে  অপরা বলতে গুরু কি বুঝিয়েছেন:
 বলা বাহুল্য লিখিত সব কিছুই অপরা আর শ্রৌতজ্ঞান (শ্রৌত জ্ঞান মোক্ষদায়ক সেই নিরেখে)  যা পরম্পরার মাধ্যমে আসে তাহা দ্বারা শিষ্য অাত্মদর্শন করলে তার যে জ্ঞান তাহাই  পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞান ( উল্লেখ্য এই জ্ঞান ব্রহ্মদর্শী নিজেই উপলদ্ধি করেন এবং ব্রহ্মই হয়ে যান, ব্রহ্মবিৎ ব্রহ্মৈব ভবতি মুন্ডক ৩/২/৯) 
কিন্তু এই পরাজ্ঞান গুরু ব্যাতীত যদি ভগবানের  মাধ্যমেও শিষ্যের নিকট আসে তবে তা অনেকের পক্ষে একবারে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভবপর নাও হতে পারে। উদাহরণঃ অর্জুন, উনি ২ বার  ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে জ্ঞান প্রাপ্ত হলেও তা অনুধাবন করতে ব্যার্থ হয়েছিলেন তাই উনি স্বর্গ লাভ করেন।
অনেক দার্শনিক শ্রৌত জ্ঞানকে সরাসরি পরা বিদ্যা বলেন কারন তা মোক্ষ প্রাপ্তি ঘটায়, তা শিষ্য হৃদয়ঙ্গম করুক বা না করুক, কিন্তু আমাদের মন রাখতে হবে শ্রৌত জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া মানেই মোক্ষ হয়ে যায় না, তা পুনঃ পুনঃ অভ্যাস করতে হয়,  তাই আমরা শ্রুতিজ্ঞান একবার পাঠ করলেই মুক্তি পায় না তাছাড়া গীতার মতন সংহিতা বা পুরান থেকে শ্রৌত জ্ঞানটুকু আলাদা করলে তাহাও পরাজ্ঞান হবে।
বিঃদ্রঃ গীতা স্বতন্ত্র গ্রন্থ নয় তা মহাভারতের অংশ।
পাঠক নিম্নোক্ত  ৬ বেদাঙ্গের বর্ননা থেকে বুঝতে পারবেন আমরা যা বলি বা লিখি তা এই ৬ বেদাঙ্গের মাধ্যমেই। 

(১) শিক্ষা : প্রাচীনকালে বেদপাঠ ছিল নিত্যকর্ম। এছাড়া যজ্ঞের সময় বেদপাঠ ছিল আবশ্যিক। শিক্ষা গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈদিক সংহিতার বর্ণ, স্বর, প্রভৃতির উচ্চারণ রীতির বিস্তৃত আলোচনা করা। শিক্ষার বিষয়বস্তুকে আরও ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়েছে ব্যাকরণে। যজ্ঞকে সুসম্পন্ন করতে হলে বেদ সংহিতার প্রতিটি বর্ণের খাঁটি উচ্চারণ ও খাঁটি স্বরক্ষেপ অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। মাত্রা ও স্বরের সামান্যতম ভুল একটি বৈদিক শব্দের অর্থ বিপরীতার্থক করে তুলতে পারে তাই এই সাবধানতা।

(২) কল্প : কল্পশাস্ত্র সূত্রাকারে লিখিত। এতে আছে যজ্ঞের প্রয়োগবিধি এবং গার্হস্থ্য জীবনের আচরণীয় সংস্কার। চারভাগে বিভক্ত এই কল্পশাস্ত্র। (ক) শ্রোত সূত্র, (খ) গৃহ্য সূত্র, (গ) ধর্ম সূত্র ও (ঘ) শুল্ব সূত্র।

বেদোক্ত যজ্ঞের প্রয়োগবিজ্ঞান এবং সেই যজ্ঞ-ভাবনার আদর্শে জীবন ও সমাজকে গড়ে তোলা এইগুলো হল কল্পসূত্রের বিষয়বস্তু। প্রাচীন যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন স্থান পেয়েছে শ্রোতসূত্রগুলোয়। গৃহীর জীবনে অবশ্য কর্তব্য আচার অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে গৃহ্যসূত্রে। ভারতীয় সমাজের সবরকম কর্তব্য এবং জ্ঞাতব্য বিষয়ের hand book হচ্ছে ধর্মসূত্র। ধর্মসূত্রগুলোর বিষয় অত্যন্ত ব্যাপক ও বিচিত্র। রাজনীতি, সমাজনীতি, বর্ণাশ্রম ধর্মের নিয়ম, ব্যবহারশাস্ত্র প্রভৃতি অসংখ্য বিষয়ের আবতারণা করা হয়েছে ধর্মসূত্রে। এরপর শুল্বসূত্র। শুল্ব কথার মানে জমি মাপার দড়ি। দড়ির সাহায্যে জ্যামিতিক নক্সা আঁকা হত বলে হয়তো এইসব সূত্রের নাম হয়েছে শুল্বসূত্র। কারণ জ্যামিতির বিভিন্ন উপপাদ্য, সম্পাদ্য ও সিদ্ধান্ত সূত্রাকারে শুল্বসূত্রে নিহিত রয়েছে। যজ্ঞবেদী তৈরির জন্য শুল্বসূত্রের সাহায্য নেওয়া হত।

(৩) ব্যাকরণ : ভাষাকে শুদ্ধ রাখতেই ব্যাকরণের প্রয়োজন। বেদাঙ্গ ব্যাকরণ এখন লুপ্ত। পানিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে চৌষট্টি জন পূর্বাচার্যের নাম করেছেন। বেদমন্ত্রগুলোকে বিভিন্ন যজ্ঞীয় কাজে প্রায়শই লিঙ্গ, বচন ও পুরুষের বিপরিণাম বা রূপান্তর ঘটিয়ে প্রয়োগ বা বিনিয়োগ করতে হত। ব্যাকরণ ছাড়া তা সম্ভব নয়। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির মতে, যিনি বৈদিক মন্ত্রের পদ, অক্ষর, বর্ণ এবং স্বর বিশ্লেষণ করতে সমর্থ, একমাত্র তিনিই বেদবিহিত যজ্ঞের অধিকারী।

(৪) নিরুক্ত : নিরুক্তের সঙ্গে নিঘন্টুর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। নিঘন্টু হল বৈদিক শব্দের সংগ্রহ। যাস্ক নিঘন্টুর শব্দের যে ব্যাখ্যা করেছেন তাই নিরুক্ত নামে প্রচলিত। ব্যাকরণ শব্দকে ভেঙে আলাদা করে দেয় আর নিরুক্ত পদকে ভেঙে তার ব্যাখ্যা করে। ব্যাকরণের সম্বন্ধ শব্দের সঙ্গে, নিরুক্তের সম্বন্ধ অর্থের সঙ্গে। পদকে ভাঙলে তবেই তার অর্থ গ্রহণ করা সহজ হয়। তাই ব্যাকরণ ও নিরুক্ত পরস্পরের পরিপূরক। ব্যাকরণ শব্দানুশাসন আর নিরুক্ত হল অর্থানুশাসন। যাস্ক বলেছেন যে নিরুক্ত পুরোপুরি আয়ত্তে না থাকলে বৈদিক মন্ত্রের অর্থাবধারণ সম্ভব নয়।

(৫) ছন্দ : ছন্দ স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। ঋক ও সাম সংহিতার সব মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। সাম সংহিতার মন্ত্র গীত হত। মন্ত্রের ঋষি, দেবতা ও ছন্দের জ্ঞান অত্যাবশ্যক। এগুলো না জেনে মন্ত্র পাঠ করা, মন্ত্র পড়ানো বা মন্ত্র প্রয়োগ করা সবই দোষাবহ। ছন্দঃ পদ্যে চ বেদে চ। ছন্দ ছাড়া গদ্যের অস্তিত্ব নেই। বেদও ছন্দোময়। সুরসভায় বসে শ্রোতার হৃদয়তন্ত্রীতে যেমন সুরের ঝংকার ওঠে তেমনি অপার কাব্য সংসারে কবি প্রজাপতি যখন সৌন্দর্যের সুরলহরী তোলেন তখন বৈদিক কবি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। তিনিও আবেগ ভরে গেয়ে ওঠেন, ‘কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম’। আমার সম্মুখে এত রূপ, আমি কার পূজো করব? প্রকৃতির এক একটি রূপ সুরে ধরা দেয় তার অন্তরে, ভাব পায় ভাষা। সুরে সুর মিলিয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন এক একটি স্তোত্র গাথা। তাল ও লয়ের সমন্বয়ে অধরা মাধুরী ছন্দোবন্ধনে ধরা পড়ে। তাই বেদ হয় ‘ছন্দস’।

তমসার তীরে গোধূলিছায়ায় ক্রৌঞ্চবিরহের যে করুণ সুর আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে বাল্মীকির মর্মবীণায় আঘাত করেছিল সেই লোকোত্তর করুণাধারা ভাষা-মূর্তি পেল বাল্মীকির মুখে,

‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্‌।।’

অবাক বিস্ময়ে বাল্মীকিও প্রশ্ন করেছিলেন, এ আমি কি বললাম? সৃষ্টি হল ছন্দের, সৃষ্টি হল কাব্যের।

(৬) জ্যোতিষ : বৈদিক যাগযজ্ঞের সঙ্গে জ্যোতিষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতির বিশেষ বিশেষ অবস্থান বা তিথি অনুসারে যজ্ঞ প্রভৃতির অনুষ্ঠানের বিধান ছিল, সুতরাং কাল-বিজ্ঞান শাস্ত্র বা জ্যোতিষের জ্ঞান না থাকলে বেদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। তিনখানা বেদাঙ্গ জ্যোতিষের খোঁজ পাওয়া গেছে। একটি ঋগ্বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, এতে আছে ছত্রিশটা শ্লোক। অন্যটা যজুর্বেদীয় জ্যোতিষ। এতে ঋগ্বেদাঙ্গ জ্যোতিষের ত্রিশটা শ্লোক আছে, বাড়তি আছে আরো তেরোটা শ্লোক। তৃতীয়টা হচ্ছে অথর্ববেদীয় জ্যোতিষ। প্রাচীন ভারতবর্ষে গণিতের সূচনাও জ্যোতিষের সঙ্গে। কারণ জ্যোতিষ (astronomy) গণিত নির্ভর।
তথ্যসুত্রঃ "Vedanga"। Princeton University। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।

পাঠক যিনি উপোরক্ত লেখাটা পড়লেন, বুঝতেই পারছেন যে এই ৬ বেদাঙ্গ ছাড়া জগতে লেখনি বা শব্দ বা বাক প্রকাশ আর কিছুই নেই। পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে কি সবই অপরা? উত্তরঃ সংহিতা, উপনিষদ, ৬ বেদাঙ্গ বা শ্রৌত জ্ঞান দ্বারা যে আত্মজ্ঞান তথা অক্ষর ব্রহ্মকে উপলদ্ধি হয় তাই ই পরাজ্ঞান। অর্থাৎ যা শুনছি বা পড়ছি সেই অপরা জ্ঞান থেকেই পরাতে উন্নত হতে হয়।

এই ক্ষেত্রে দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রীর বেদসার  থেকে ২ টি মন্ত্র দেখে নেই। 

অংতি সম্ভং ন জহাত্যস্তি সম্তং ন পশ্যতি।
দেবস্য পশ্য কাব্যং ন মমার ন জীর্যতি ॥
 অথর্ববেদ ১০/৮/৩২।
বঙ্গানুবাদ *- মনুষ্য সমীপবর্তী পরমাত্বাকে দেখেও না,তাহাকে ছাড়িতেও পারে
না। পরমাত্মার কাব্য বেদকে দেখ; তাহা মরেও না, জীর্ণও হয় না।

এই মন্ত্রে  বেদকে পরমাত্মার কাব্য বলা হচ্ছে, তা কি করে অশ্রেষ্ট হয় বোধগম্য হয় না। 



সুতা ময়া বরদা বেদমাতা প্রচোদয়স্তাং পাবমানী দ্বিজানাম্‌ । 
আয়ুঃ প্রাণং প্রজাং পশুং কীর্ত্তিং  দ্রবিণং ব্রহ্ম বর্চসম‌।
 মহং দত্তা ব্রহ্মলোকম্‌ ॥ অথবর্বেদ ১৯/৭১/১।

বঙ্গানুবাদ - ভক্তের উক্তি- মনের উৎসাহ দাত্রী দ্বিজদের পবিত্র কারিণী, শ্রেষ্ঠ জ্ঞান
দাত্রী বেদ মাতাকে আমি অধ্যায়ন করিযাছি। প্রভুর উক্তি- আয়ু, প্রাণ, প্রজা, পশু, কীর্তি
জ্ঞানতেজ আমাতে অর্পণ করিয়া তুমি মুক্তি প্রাপ্ত হও।
এই মন্ত্রে বেদকে শ্রেষ্ট জ্ঞান বলা হচ্ছে।
 মুন্ডক ১/১/৫ এর রেফারেন্স দিয়ে এবং অপরার অর্থ অশ্রেষ্ট করে যারা গীতাই শ্রেষ্ট জ্ঞান এরুপ প্রচার করতে মরিয়া হয়ে রেফারেন্স চেয়ে থাকেন যে কোথায় বেদকে সরাসরি শ্রেষ্ট বলা হয়েছে? 
এটা তাদের জন্য। আসলে বিধিমুখ শ্রবন না করায় এরা এই ধরণের অপব্যাখ্যা করে। আমরা শ্রুতিতে দেখতে পাই ব্রহ্মবিদ্যা ধারণের জন্য সঠিক আঁধার দরকার। কেন এই কথা বলা হল এর তাৎপর্য  আশা করি বিচক্ষন পাঠক বুঝতে পারবেন। 





একই কথা বেদেও আছে তা আপনারা উক্ত শ্লোকদুটির রেফারেন্সে দেখতে পাচ্ছেন। 
১ নং স্ক্রীনশটে অথর্ব্ববেদ ১০/৮/৩২ এবং 
২ নং স্ক্রীনশটে অথর্ব্ববেদ ১৯/৭১/১ 

তাহলে এতেই প্রমাণিত হচ্ছে যে বেদ শুধু যে অপরা তা একদম না। বরং বেদ পরাও বটে । 
এরা যে হিন্দু বা সনাতনী নামের কলংক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আপনি যদি সনাতন গৃহে জন্ম নিয়ে থাকেন তো এদের বর্জন করুন এবং সনাতন সমাজ থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করুন। 
সবার শুভ বুদ্ধির কামনায়।

হর হর মহাদেব ! 

শিব রাম নাম করেন তাহলে শিব কি রামের থেকে ছোট?

 সম্প্রতি রামায়েতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচুর রামায়েতের দেখা পাওয়া যাচ্ছে যারা শ্রীরাম চন্দ্রকে উপরে তুলতে গিয়ে পরমেশ্বর শিবকে ছোট করছেন...

Popular Posts