প্রথমে ৪ সংহিতার আলোচনা নিম্নোক্তঃ
বেদের জ্ঞান কান্ড ও কর্মকান্ড দুটি ভাগ
সংহিতা ভাগকে কর্মকান্ড পরিগনিত করা হয়,
সংহিতা অংশে কর্মকান্ড বেশী প্রধান্য পেয়েছে তা ব্যাবহারিক ও নিত্য নৈমত্তিক কর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু সংহিতা ভাগের( কর্মকান্ড) মধ্যেও মোক্ষ বিষয়ক জ্ঞান আছে যা পরাবিদ্যা।
যেমন উদাহরণ বলা যায়, চালের মধ্যে কাকড় থাকলেও আলাদা করে চাল-কাকড় বলা হচ্ছে না, চালই বলা হয়, তেমনি কর্মকান্ড ভাগকে আলাদা করে পরা-অপরা বলা হচ্ছে না।
এবার আসুন মন্ডুক ১/১/৫ এ ৬ বেদাঙ্গকে অপরা বলতে গুরু কি বুঝিয়েছেন:
বলা বাহুল্য লিখিত সব কিছুই অপরা আর শ্রৌতজ্ঞান (শ্রৌত জ্ঞান মোক্ষদায়ক সেই নিরেখে) যা পরম্পরার মাধ্যমে আসে তাহা দ্বারা শিষ্য অাত্মদর্শন করলে তার যে জ্ঞান তাহাই পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞান ( উল্লেখ্য এই জ্ঞান ব্রহ্মদর্শী নিজেই উপলদ্ধি করেন এবং ব্রহ্মই হয়ে যান, ব্রহ্মবিৎ ব্রহ্মৈব ভবতি মুন্ডক ৩/২/৯)
কিন্তু এই পরাজ্ঞান গুরু ব্যাতীত যদি ভগবানের মাধ্যমেও শিষ্যের নিকট আসে তবে তা অনেকের পক্ষে একবারে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভবপর নাও হতে পারে। উদাহরণঃ অর্জুন, উনি ২ বার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে জ্ঞান প্রাপ্ত হলেও তা অনুধাবন করতে ব্যার্থ হয়েছিলেন তাই উনি স্বর্গ লাভ করেন।
অনেক দার্শনিক শ্রৌত জ্ঞানকে সরাসরি পরা বিদ্যা বলেন কারন তা মোক্ষ প্রাপ্তি ঘটায়, তা শিষ্য হৃদয়ঙ্গম করুক বা না করুক, কিন্তু আমাদের মন রাখতে হবে শ্রৌত জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া মানেই মোক্ষ হয়ে যায় না, তা পুনঃ পুনঃ অভ্যাস করতে হয়, তাই আমরা শ্রুতিজ্ঞান একবার পাঠ করলেই মুক্তি পায় না তাছাড়া গীতার মতন সংহিতা বা পুরান থেকে শ্রৌত জ্ঞানটুকু আলাদা করলে তাহাও পরাজ্ঞান হবে।
বিঃদ্রঃ গীতা স্বতন্ত্র গ্রন্থ নয় তা মহাভারতের অংশ।
পাঠক নিম্নোক্ত ৬ বেদাঙ্গের বর্ননা থেকে বুঝতে পারবেন আমরা যা বলি বা লিখি তা এই ৬ বেদাঙ্গের মাধ্যমেই।
(১) শিক্ষা : প্রাচীনকালে বেদপাঠ ছিল নিত্যকর্ম। এছাড়া যজ্ঞের সময় বেদপাঠ ছিল আবশ্যিক। শিক্ষা গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈদিক সংহিতার বর্ণ, স্বর, প্রভৃতির উচ্চারণ রীতির বিস্তৃত আলোচনা করা। শিক্ষার বিষয়বস্তুকে আরও ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়েছে ব্যাকরণে। যজ্ঞকে সুসম্পন্ন করতে হলে বেদ সংহিতার প্রতিটি বর্ণের খাঁটি উচ্চারণ ও খাঁটি স্বরক্ষেপ অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। মাত্রা ও স্বরের সামান্যতম ভুল একটি বৈদিক শব্দের অর্থ বিপরীতার্থক করে তুলতে পারে তাই এই সাবধানতা।
(২) কল্প : কল্পশাস্ত্র সূত্রাকারে লিখিত। এতে আছে যজ্ঞের প্রয়োগবিধি এবং গার্হস্থ্য জীবনের আচরণীয় সংস্কার। চারভাগে বিভক্ত এই কল্পশাস্ত্র। (ক) শ্রোত সূত্র, (খ) গৃহ্য সূত্র, (গ) ধর্ম সূত্র ও (ঘ) শুল্ব সূত্র।
বেদোক্ত যজ্ঞের প্রয়োগবিজ্ঞান এবং সেই যজ্ঞ-ভাবনার আদর্শে জীবন ও সমাজকে গড়ে তোলা এইগুলো হল কল্পসূত্রের বিষয়বস্তু। প্রাচীন যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন স্থান পেয়েছে শ্রোতসূত্রগুলোয়। গৃহীর জীবনে অবশ্য কর্তব্য আচার অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে গৃহ্যসূত্রে। ভারতীয় সমাজের সবরকম কর্তব্য এবং জ্ঞাতব্য বিষয়ের hand book হচ্ছে ধর্মসূত্র। ধর্মসূত্রগুলোর বিষয় অত্যন্ত ব্যাপক ও বিচিত্র। রাজনীতি, সমাজনীতি, বর্ণাশ্রম ধর্মের নিয়ম, ব্যবহারশাস্ত্র প্রভৃতি অসংখ্য বিষয়ের আবতারণা করা হয়েছে ধর্মসূত্রে। এরপর শুল্বসূত্র। শুল্ব কথার মানে জমি মাপার দড়ি। দড়ির সাহায্যে জ্যামিতিক নক্সা আঁকা হত বলে হয়তো এইসব সূত্রের নাম হয়েছে শুল্বসূত্র। কারণ জ্যামিতির বিভিন্ন উপপাদ্য, সম্পাদ্য ও সিদ্ধান্ত সূত্রাকারে শুল্বসূত্রে নিহিত রয়েছে। যজ্ঞবেদী তৈরির জন্য শুল্বসূত্রের সাহায্য নেওয়া হত।
(৩) ব্যাকরণ : ভাষাকে শুদ্ধ রাখতেই ব্যাকরণের প্রয়োজন। বেদাঙ্গ ব্যাকরণ এখন লুপ্ত। পানিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে চৌষট্টি জন পূর্বাচার্যের নাম করেছেন। বেদমন্ত্রগুলোকে বিভিন্ন যজ্ঞীয় কাজে প্রায়শই লিঙ্গ, বচন ও পুরুষের বিপরিণাম বা রূপান্তর ঘটিয়ে প্রয়োগ বা বিনিয়োগ করতে হত। ব্যাকরণ ছাড়া তা সম্ভব নয়। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির মতে, যিনি বৈদিক মন্ত্রের পদ, অক্ষর, বর্ণ এবং স্বর বিশ্লেষণ করতে সমর্থ, একমাত্র তিনিই বেদবিহিত যজ্ঞের অধিকারী।
(৪) নিরুক্ত : নিরুক্তের সঙ্গে নিঘন্টুর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। নিঘন্টু হল বৈদিক শব্দের সংগ্রহ। যাস্ক নিঘন্টুর শব্দের যে ব্যাখ্যা করেছেন তাই নিরুক্ত নামে প্রচলিত। ব্যাকরণ শব্দকে ভেঙে আলাদা করে দেয় আর নিরুক্ত পদকে ভেঙে তার ব্যাখ্যা করে। ব্যাকরণের সম্বন্ধ শব্দের সঙ্গে, নিরুক্তের সম্বন্ধ অর্থের সঙ্গে। পদকে ভাঙলে তবেই তার অর্থ গ্রহণ করা সহজ হয়। তাই ব্যাকরণ ও নিরুক্ত পরস্পরের পরিপূরক। ব্যাকরণ শব্দানুশাসন আর নিরুক্ত হল অর্থানুশাসন। যাস্ক বলেছেন যে নিরুক্ত পুরোপুরি আয়ত্তে না থাকলে বৈদিক মন্ত্রের অর্থাবধারণ সম্ভব নয়।
(৫) ছন্দ : ছন্দ স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। ঋক ও সাম সংহিতার সব মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। সাম সংহিতার মন্ত্র গীত হত। মন্ত্রের ঋষি, দেবতা ও ছন্দের জ্ঞান অত্যাবশ্যক। এগুলো না জেনে মন্ত্র পাঠ করা, মন্ত্র পড়ানো বা মন্ত্র প্রয়োগ করা সবই দোষাবহ। ছন্দঃ পদ্যে চ বেদে চ। ছন্দ ছাড়া গদ্যের অস্তিত্ব নেই। বেদও ছন্দোময়। সুরসভায় বসে শ্রোতার হৃদয়তন্ত্রীতে যেমন সুরের ঝংকার ওঠে তেমনি অপার কাব্য সংসারে কবি প্রজাপতি যখন সৌন্দর্যের সুরলহরী তোলেন তখন বৈদিক কবি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। তিনিও আবেগ ভরে গেয়ে ওঠেন, ‘কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম’। আমার সম্মুখে এত রূপ, আমি কার পূজো করব? প্রকৃতির এক একটি রূপ সুরে ধরা দেয় তার অন্তরে, ভাব পায় ভাষা। সুরে সুর মিলিয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন এক একটি স্তোত্র গাথা। তাল ও লয়ের সমন্বয়ে অধরা মাধুরী ছন্দোবন্ধনে ধরা পড়ে। তাই বেদ হয় ‘ছন্দস’।
তমসার তীরে গোধূলিছায়ায় ক্রৌঞ্চবিরহের যে করুণ সুর আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে বাল্মীকির মর্মবীণায় আঘাত করেছিল সেই লোকোত্তর করুণাধারা ভাষা-মূর্তি পেল বাল্মীকির মুখে,
‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।’
অবাক বিস্ময়ে বাল্মীকিও প্রশ্ন করেছিলেন, এ আমি কি বললাম? সৃষ্টি হল ছন্দের, সৃষ্টি হল কাব্যের।
(৬) জ্যোতিষ : বৈদিক যাগযজ্ঞের সঙ্গে জ্যোতিষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতির বিশেষ বিশেষ অবস্থান বা তিথি অনুসারে যজ্ঞ প্রভৃতির অনুষ্ঠানের বিধান ছিল, সুতরাং কাল-বিজ্ঞান শাস্ত্র বা জ্যোতিষের জ্ঞান না থাকলে বেদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। তিনখানা বেদাঙ্গ জ্যোতিষের খোঁজ পাওয়া গেছে। একটি ঋগ্বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, এতে আছে ছত্রিশটা শ্লোক। অন্যটা যজুর্বেদীয় জ্যোতিষ। এতে ঋগ্বেদাঙ্গ জ্যোতিষের ত্রিশটা শ্লোক আছে, বাড়তি আছে আরো তেরোটা শ্লোক। তৃতীয়টা হচ্ছে অথর্ববেদীয় জ্যোতিষ। প্রাচীন ভারতবর্ষে গণিতের সূচনাও জ্যোতিষের সঙ্গে। কারণ জ্যোতিষ (astronomy) গণিত নির্ভর।