Sunday, December 22, 2019

শৈব পবিত্রতা

ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয়পন্থার ভিতরে শৈব ধর্মের ইতিহাস অতি প্রাচীন ।।
এই কথা বেদ সমূহের রচনাক্রম,বয়স আর কোন বেদে কোন দেবতাকে মুখ্য করা হয়েছিল তার থেকেই সম্যক নির্ণয় করা যায়। শৈব দর্শনের মতে শিব সমগ্র জগতের মূল,উনিই জগতের কারণ, কর্তা   এবং বীর্যোৎপাদনের অধিকারী । পরম বীর্যপুরুষ যেইজন সেইজনই শিব।ঋগবেদোক্ত পরম ব্রহ্ম, অলক নিরঞ্জনই শিব ।



শিবই বিশাল চৈতন্যের আধার আর সমগ্র চরা--
চরের 'নাথ'।। ঋগ্বেদের দেবতা ব্রহ্মা রজোগুণা-
-ন্বিত এবং যথাক্রমে সাম এবং যজুর্বেদের দেবতা শিব-বিষ্ণু সত্বগুনধারী এবং প্রকৃত্যাতীত পরম পুরুষ।গণ ধর্মে উপাস্য পরম পুরুষ হিসাবে শিব এবং বিষ্ণুর প্রাধান্যতাই বেশী। রুদ্রদেবতার আর এক নাম শিব। রুদ্র  সংহারকারী ।ব্রহ্ম বৈবর্তপুরাণে উনাকে কালাগ্নি রুদ্র বলা হয়েছে ।কালাগ্নিরুদ্র একাদশ
রুদ্রের মধ্যে  একজন।উনিই ত্বমোগুণান্বিত এবং সৃষ্টি সংহারকারী।প্রকৃতই শিব পরম পুরুষ এবং
পরম ব্রহ্মে শুভ্র,শুদ্ধ এক সাকার রূপ মাত্র ।। তিনিই সর্ব্ব ব্যাপ্ত এবং সর্ব্ব শক্তিমান,"যত্র জীব তত্র শিব" । সুতরাং শিব আর বিষ্ণুর মধ্যে কোন
গুণগত পার্থক্য নাই।।

শিব কহে  শুন শুন  পার্বতী সুন্দরী ।
জিজ্ঞাসিলে যাহা তাহা কহিব বিস্তারি ।।
আমাতে বিষ্ণুতে ভেদ নাহিকো কখন।
যেই আমি   সেই বিষ্ণু   স্বরূপ বচন ।। আমাতে বিষ্ণুতে ভেদ কভু না করিবে।
কর্তব্য   হইবে তবে জানিবে এ ভবে।।
অভেদে বিষ্ণুর সহ   করিয়া বিচার   ।
আমারে  পূজিবে সদা সংসার মাঝার।।
                            (শিব পুরাণ, আত্মবোধ খন্ড)

Tuesday, December 10, 2019

অদ্বৈতবাদে জগৎ মিথ্যা বলতে কি বুঝিয়েছে?

আজ একটা গুরুতর বিষয়ে আলোচনা করব।
অনেকে এই একটা ধারণা পোষণ করে আসতেছেন যে,ভগবান শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদে জগৎ অসত্য,মিথ্যা বলে উড়ে দেওয়া হয়েছে।এই যে আমরা নগ-নদাদিসঙ্কুল বিচিত্র জগৎ দেখতেছি;এই যে আমরা প্রতি নিয়ত সুখ-দুঃখ হর্য-বিষাদাদি অনুভব করতেছি,--এ সকলই মায়াময়,অসত্য,অলীক।সকলই ভ্রান্ত-প্রতীতি মাত্র।একমাত্র ব্রহ্মই সত্য,আর সবই অসত্য।অনেকের চিত্তে,পাষাণে অঙ্কিত রেখার ন্যায়,এই সংস্কারটা,এই ধারণাটা,বদ্ধমূল হয়ে পড়েছে।শঙ্করাচার্য নাকি,তাঁর অদ্বৈতবাদে তাই শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন!এখন আমরা এই কথাটা ঠিক কিনা,প্রকৃতই শঙ্কর এই জগৎটাকে অলীক,মায়াময়,অসত্য বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কিনা,--তাই পরীক্ষা করে দেখতে অগ্রসর হব।শঙ্করাচার্য্য স্পষ্টবাক্যে,অনেক স্থানে জগৎকে অসত্য,মিথ্যা,অসার,মায়াময় বলে নির্দ্দেশ করেছেন,দেখতে পাওয়া যায়।কিন্তু তিনি কি ভাবে এই শব্দ গুলির ব্যবহার করেছেন,তা পরীক্ষা করে দেখা নিতান্তই আবশ্যক।






(১) কিন্তু এই বিষয়টির পরীক্ষা পূর্ব্বে,আমরা একটি তত্ত্ব পাঠকবর্গের মনে জাগিয়ে দিতে ইচ্ছা করি।দর্শনশাস্ত্রে "কার্য্য ও কারণ" শব্দটি পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হয়েছে।বস্তু বা জীব হতে "অভিব্যক্ত ধর্ম বা বিকারগুলি,এক অবস্থা হতে অবস্থান্তর ধারণ করে থাকে।বিকারগুলির প্রকৃতি এই প্রকার।পূর্ববর্তী অবস্থা বিনষ্ট হলে,পরবর্তী অবস্থায় পরিণত হয়।এই পূর্ববর্তী অবস্থাকে কারণ শব্দে নির্দেশ করা যায়।জড় বিজ্ঞান ও মনো-বিজ্ঞান এই অর্থেই 'কারণ' শব্দটিকে ব্যবহার করে থাকে।শঙ্করাচার্য অতি স্পষ্ট কথায় আমাদেরকে বলে দিয়েছেন যে,তিনি তাঁর ভাষ্যে কোথাও এরুপ অর্থে 'কারণ' শব্দের ব্যবহার করবেন না।বস্তুই বল,আর জীব বল,বা ব্রহ্মই বল,--সকলেরই এক একটা 'স্বভাব' বা 'স্বরুপ' আছে।এই স্বভাব হতেই কতকগুলি ধর্ম বা গুণ বা ক্রিয়ার অভিব্যক্তি হয়ে থাকে।অবশ্য এই ধর্ম বা গুণগুলি পুনঃপুন রুপান্তর ধারণ করে;এক অবস্থা হতে অপর অবস্থা গ্রহণ করে।পূর্ব্বাবস্থা বিনষ্ট হয়ে,বর্তমানাবস্থায় আসে।শঙ্কর বলেছেন যে যে স্বরুপ হতে ঐ সকল ধর্ম্ম বা গুণ উৎপন্ন হচ্ছে;সেই স্বরুপটি সকল অবস্থানন্তরের মধ্যেই আপনার স্বরুপ,আপন একত্ব বজায় রাখে।পূর্ব্বাবস্থা নাশের সঙ্গে,ঐ স্বরুপটা বিনষ্ট হয় না।পূর্ব্বাবস্থার মধ্যেও ঐ স্বরুপটা অনুগত ছিল:আবার বর্তমানাবস্থার মধ্যেও সেই স্বরুপটাই অনুগত রয়েছে।শঙ্কর বলে দিয়েছেন যে,তিনি এই স্বরুপটাকেই 'কারণ' শব্দে নির্দ্দেশ করবেন।এই 'কারণের' যত অবস্থান্তরই হোক না কেন,তা কোন অবস্থান্তরের মধ্যেই নিজকে হারায় না;তার স্বাতন্ত্র্য ও একত্ব(identity) ঠিক থাকে।তিনি এই স্বরুপ বা স্বভাবটাকেই 'কারণ' বলবেন।এই নিয়ম স্থির করে নিয়ে,শঙ্করাচার্য্য এই কারণ এবং তা হতে অভিব্যক্ত কার্য্য বা বিকার বা ধর্মগুলির মধ্যে সম্বন্ধ কিরুপ তার আলোচনা করেছেন।আমরা দেখতে পাই,তিনি এই সম্বন্ধটা বুঝাবার জন্য বেদান্তদর্শনের একটা সমগ্র 'পাদ' ব্যয়িত করেছেন।এত পরিশ্রম তিনি কেন করলেন?এই বিকারগুলি,ধর্মগুলি,ক্রিয়া ও গুণগুলি যদি তাঁর মতে মিথ্যা,অলীক,অসত্যই হয়;তা হলে একটা অলীক বস্তুর সম্বন্ধই বা কিরুপে হবে এবং সেই তথা-কথিত সম্বন্ধ নির্ণয়ের জন্য তিনি শ্রমই বা কেন করতে গেলেন?তিনি নিজেই এই মন্তব্য প্রকাশ করেছেন যে,---
"দুইটা বস্তুই যদি অলীক হয়,তা হলে সেই দুই অলীক বস্তুর মধ্যে পরস্পর কোন সম্বন্ধ হতে পারে না।আবার যদি,একটা অলীক বস্তু;আর,অপরটি সত্য বস্তু;---এরুপ হয়;তা হলেও উভয়ের সম্বন্ধ হতে পারে না।পরস্পর সম্বন্ধ হতে হলেই,দুইটা বস্তু আবশ্যক; এবং এই দুইটা বস্তুই সত্য হওয়া চাই।
(২) আমরা এই জগৎটাকেই সর্ব্বদা আমাদের ইন্দ্রিয়-পথে বিস্তারিত দেখতে পাই।অসংখ্য নাম-রুপাত্মক বিকার নিয়েই এই জগৎ।এই বিকারগুলোকে আমরা দেশে ও কালে অভিব্যক্ত দেখতে পাই।বিকারগুলো সর্ব্বদা পূর্ব্ববর্ত্তী একটা অবস্থা ত্যাগ করে,পরবর্তী অপর একটা অস্থানন্তর গ্রহণ করতেছে,দেখতে পাই।এইরুপে তারা পরস্পর কার্য্য-কারণ-সূত্রে আবদ্ধ হয়ে ক্রিয়া করে।সুতরাং আমরা এই নামরুপাত্মক জগৎকে,এই বিকার-গুলিকে স্বাধীন,স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলেই বিবেচনা করি।কিন্তু এই জগৎ যখন দেশে ও কালে অভিব্যক্ত,তখন তা অবশ্যই এমন একটা বস্তুর বিকাশ,যে বস্তুটি দেশ ও কালের অতীত।জগৎটা যখন আমাদের সম্মুখে অভিব্যক্ত দেখতেছি।তখন তা অবশ্যই এমন একটা বস্তুর বিকাশ,যে বস্তুটি দেশ ও কালের অতীত।জগৎটা যখন আমাদের সম্মুখে অভিব্যক্ত দেখতেছি,তখন তা অবশ্যই কোন বস্তু হতে অভিব্যক্ত হয়েছে।তা 'শূন্য'হতে আসে নাই।--এই প্রকাণ্ড কথাটা আমরা একেবারে ভুলে যাই।এই কথাটা ভুলে গিয়ে আমরা জগৎটাকে একটা স্বতন্ত্র বস্তু,স্বাধীন বস্তু,স্বতঃসিদ্ধ বস্তু বলেই গ্রহণ করি।আমরা মনে করে থাকি যে,জগতের বিকারগুলি অনন্তদেশে ও অনন্তকালে বিস্তৃত রয়েছে এবং এই প্রকারেই পরস্পর কার্য্য-কারণ-শৃঙ্খলে বদ্ধ হয়ে ক্রিয়া করে চলেছে।শঙ্করাচার্য আমাদেরকে বলে গিয়েছেন যে জগৎকে যদি এইরুপ স্বাধীন,স্বতন্ত্র,স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলে গ্রহণ কর,তা হলে তুমি প্রকাণ্ড ভুল করলে।এ প্রকার স্বাধীন জগৎ 'অসত্য','মিথ্যা'।এ জগৎ ব্রহ্মবস্তু হতে অভিব্যক্ত।ব্রহ্ম এই জগতের কারণ।যিনি দেশ,কালাতীত,এই জগৎ তাঁরই দেশ-কালে বিকাশ।এই জগৎ তাঁর স্বরুপের অভিব্যক্তি সুতরাং এই জগৎ,তা হতে স্বতন্ত্র হয়ে তাঁকে ছেড়ে স্বাধীন-ভাবে থাকতে পারে না।
এই কথাগুলো শিবাবতার ভগবান শঙ্করাচার্য্য কি প্রকারে বলে দিয়েছেন,নিম্নে আমরা তা প্রদর্শন করতেছি।তা হতে পাঠক দেখতে পাবেন যে ভাষ্যকার এই জগৎকে,নামরুপাত্মক বিকারগুলোকে,কিভাবে 'অসত্য' 'মিথ্যা' বলে নির্দ্দেশ করেছেন।
(১)জগতের নাম-রুপাত্মক বিকারগুলো আপনা আপনি আসে নাই।সুতরাং এই বিকার-গুলিও যে স্বয়ংসিদ্ধ,স্বাধীন 'বস্তু' তা হতে পারে না।যেখানেই কোন বিকার দেখবে সেখানেই দেখবে ঐ বিকার কোন বস্তুর বা জীবেরই বিকার।--কোন বস্তু বা জীবের স্বরুপ হতেই তা অভিব্যক্ত।সুতরাং তা কোন বস্তুবিশেষ হতে বা কোন জীব-বিশেষ হতে অভিব্যক্ত গুণ বা ধর্ম।তা হলেই,তুমি ঐ বিকার-গুলিই যে স্বতঃসিদ্ধ,স্বাধীন,বস্তু,তা বলবে কিরুপে?যেটি প্রকৃত বস্তু,তা হতেই অভিব্যক্ত হয়েছে এবং তাকেই আশ্রয় করে রয়েছে।
(২)যে বস্তু বা জীবের স্বরুপ হতে ঐ গুণ বা বিকার-গুলি অভিব্যক্ত হয়েছে,তাকে ছাড়িয়া,তা হতে 'বিভক্ত' হয়ে তা হতে স্বতন্ত্র হয়ে তা থাকতে পারে না।
(৩)বিকারগুলো যখন কোন বস্তু বা জীবের 'স্বরুপ' হতে অভিব্যক্ত,তখন তাদের নিজের কোন স্বতন্ত্র স্বরুপ থাকতে পারে না।এই জন্যই বিকারগুলি নিয়ত চঞ্চল,অস্থির,পুনঃপুন রুপান্তর প্রাপ্ত হয়।তারা যে বস্তু বা জীবের ধর্ম্ম বা গুণ,তারাই স্বরুপের পরিচয় প্রদান করে থাকে।কাজেই,সেই স্বরুপটাকে বাদ দিয়ে সেগুলোকে বুঝা যায় না।সুতরাং সেগুলোকে সেই স্বরুপ হতে 'স্বতন্ত্র' বস্তু বলবে কি প্রকারে?
এই প্রকারে শঙ্করাচার্য্য,এই জগৎকে বা এই জগতে অভিব্যক্ত বিকারগুলোকে,স্বতন্ত্র,স্বাধীন,স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলে গ্রহণ করতে পারেন নাই।এই জগৎ যাঁর অভিব্যক্তি,তা হতে এই জগৎকে স্বতন্ত্র করে নেওয়া যায় না।"মরুভুমি হতে স্বতন্ত্র করে নিয়ে কি মরীচিকাকে ভাবতে পারা যায়"?তাই,এ জগৎ ব্রহ্ম হতে স্বতন্ত্র বস্তু না।
(৪)এই সকল আলোচনা হতে বুঝতে পারা যাচ্ছে যিনি দেশ,কালাতীত ব্রহ্ম,---এ জগৎ তাঁর 'কার্য্য'।শঙ্কর এই কারণ ও কার্য্যের সম্বন্ধকে "অনন্য"শব্দে নির্দ্দেশ করেছেন।জগৎ যখন ব্রহ্ম হতে 'স্বতন্ত্র' হয়ে থাকতে পারে না,তখন জগৎ নিশ্চয়ই ব্রহ্ম হতে 'স্বতন্ত্র' বা অন্য কোন স্বাধীন স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু হতে পারতেছে না।এই জন্যই এই জগৎ--ব্রহ্ম হতে 'অনন্য'।শঙ্করের সিদ্ধান্ত এই যে,এই জগৎটা-ব্রহ্ম হতে অভিব্যক্ত।জগৎ--ব্রহ্মেরই অবস্থাবিশেষ,রুপান্তর।এজগৎ--তাঁরই স্বরুপের পরিচয় দিবে বলে অভিব্যক্ত হয়েছে।সুতরাং জগৎ ব্রহ্ম অপেক্ষা একটা একান্ত স্বতন্ত্র বস্তু,ভিন্ন বস্তু হবে কি প্রকারে?সুতরাং জগৎকে স্বতন্ত্র,স্বাধীন,স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলে মনে করলে ভুল হলো।তা হতে স্বতন্ত্র করে নিলে,এই জগৎ মিথ্যা হলো,অসত্য হলো।এই রুপেই ভাষ্যকার সর্ব্বত্র জগৎকে মিথ্যা বলেছেন।এইজন্যই শঙ্কর বলেছেন।
"কার্য্যস্য কারণাত্মত্বং নতু কারণস্য কার্যাত্মত্বং"--কার্য্য,তার কারণের অভিব্যক্তিমাত্র এবং সেই কারণটি--কার্য্যের মধ্যে আপন স্বরুপের স্বাতন্ত্র‍্য ঠিক রাখে।
(৫)শঙ্করাচার্য্য এইভাবে কারণ ও কার্য্যের সম্বন্ধ নির্ণয় করেছেন।পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ এই "অনন্য"শব্দটিকে "identical" শব্দ দ্বারা অনুবাদ করেছেন।আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে,এই অনুবাদ অত্যন্ত অসঙ্গত ও ভ্রমপূর্ণ অনুবাদ।এই অনুবাদ গ্রহণ করলে,কার্য্য ও কারণ এক হয়ে উঠে।ব্রহ্ম ও জগৎ এক হয়ে উঠে।মূলে এই ভ্রম করাতেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ,শঙ্করের অদ্বৈতবাদকে Pantheism বলে বুঝেছেন।জগৎগুরু বারংবার বলে দিয়েছেন যে,'কারণ ও কার্য্য' তার সম্বন্ধ বুঝতে দুইটা কথা মনে করে রাখতে হবে।যদি 'কারণ ও তার কার্য্যকে--'এক'ই বস্তু বল--উভয়কে "identical" বল,-তা হলে,কারণ ও কার্য্য এই শব্দ দুইটির ভেদ উঠে যায়।পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা আজ যে ভুল করতেছেন,শঙ্করের টীকাকারগণও বহুশতাব্দী পূর্ব্বে এই আশঙ্কা করেছিলেন।কি জানি যদি লোকে,কার্য্য ও কারণকে identical বা এক বলেই মনে করে,এই আশঙ্কায় টীকাকারও বলে দিয়েছিলেন যে,
"কারণাৎ পৃথক-সত্তা-শূন্যত্বং সাধ্যতে,
ন ঐক্যাভিপ্রায়েণ"
"কার্য্য বা বিকার গুলি তাদের 'কারণ' হতে স্বতন্ত্র না।" শঙ্কর বলে দিয়েছেন যে কার্য্য ও কারণের সম্বন্ধ বুঝতে হলে এই একটা অংশ মনে রাখতে হবে।আবার,আর একটা অংশও মনে রাখতে হবে;সেই অংশটা এই "কারণ,তার কার্য্যগুলি হতে স্বতন্ত্র"।"কার্য্য গুলি কারণ হতে স্বতন্ত্র না"।এই দুটি কথা একত্র মনে রাখতে হবে।এমন স্পষ্ট কথা বলাতেও কেমন করে বড় বড় পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতেরা--কারণ ও কার্য্যের সম্বন্ধকে "identical" বলে ব্যাখা করলেন তা আমরা বুঝতে নিতান্তই অসমর্থ।শঙ্করের এই সিদ্ধান্তটা মনে রাখলে বেদান্তের সর্ব্বত্র ব্যবহৃত "সর্ব্বং খলিদ্বং ব্রহ্ম""ব্রহ্মবৈদং সর্ব্বং" "ইদং সর্ব্বং যদয়মাত্মা,""আত্মৈব ইদং সর্ব্বং" এই সকল বাক্যের অর্থ,এই এই সকল কথার প্রকৃত অভিপ্রায়,--অনায়াসে বুঝতে পারব।
যেখানেই বেদান্তে "সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম" এই প্রকারের উক্তি আছে,ভাষ্যকার সেখানেই বলে দিয়েছেন যে,এই প্রকার উক্তির তা অর্থ না যে,ব্রহ্মই এ বিশ্ব বা জগৎ;ব্রহ্মে ও জগতে কোন ভেদ নাই।এ সকল উক্তির অর্থ এই যে,--
(১)কার্য্য বা বিকারগুলি কারণ হতে স্বতন্ত্র না ও স্বতন্ত্র হয়ে থাকতে পারে না।
আর--
(২)কারণটি কিন্তু,তার কার্য্য হতে স্বতন্ত্র,ভিন্ন।কার্য্যাকার ধারণ করলেও কারণটি আপন স্বাতন্ত্র্য হারায় না;কোন স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে উঠে না।সকল বিকারের মধ্যে,সকল অবস্থান্তরের মধ্যে,কারণের একত্ব ঠিক থাকে।তবেই পাঠক দেখুন--ভগবান শঙ্করের মতে ঐ সকল উক্তির সেই অর্থ পাওয়া যাচ্ছে যে এই জগৎ ব্রহ্মেরই অবস্থান্তর,আকার-বিশেষ,রপান্তর মাত্র;তা ব্রহ্ম হতে কোন স্বতন্ত্র স্বাধীন বস্তু না।কিন্তু এই জগদাকার ধারণ করাতেও,এই জগতের মধ্যে ব্রহ্ম,আপন স্বাতন্ত্র্য ও একত্ব হারান নাই;কেননা তিনি জগৎ হতে স্বতন্ত্র।ভাষ্যকার বলেছেন যে, যারা ব্রহ্ম ও জগৎকে এক মনে করে তারা অবিদ্যাচ্ছন্ন।অবিদ্যাচ্ছন্ন লোকেরাই পরমাত্মার স্বাতন্ত্র্য ভুলে গিয়ে পরমাত্মা ও জগৎকে এক বা identical বস্তু বলে মনে করে।ভগবান কেন এ সকল লোকলে "অবিদ্যাচ্ছন্ন" বললেন এখন আমরা তাই দেখব।
(৬)অনেকের মুখে এরুপ একটা কথা সর্ব্বদাই শুনতে পাওয়া যায় যে,ভগবান শঙ্করাচার্য্য তাঁর ভাষ্যে আমাদের জাগরিতাবস্থাকে 'স্বপ্নাবস্থার' সঙ্গে তুলনা করলেন,উভয় অবস্থা তুল্য বলে নির্দ্দেশ করেছেন।সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে তাঁর মতে এ জগৎটা অসত্য,মিথ্যা,অলীক।তারা বলেন এই যে জাগরিতকালে বৃক্ষ,লতা,মনুষ্য,পশু প্রভৃতি বস্তুর আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি,এবং শব্দ স্পর্শ সুখ দুঃখাদির জ্ঞান লাভ করে থাকি।স্বপ্ন দর্শনকালে আমরা,এই জাগরিত কালের মত কত বস্তু প্রত্যক্ষ করি।এবং কত বিষয়ের জ্ঞান আমাদের হয়ে থাকে।তাঁরা বলেন যে,ভগবান এই দুই কালের অনুভূত বস্তুগুলি ও তদ্বিষয়ক জ্ঞানকে তুল্য বলে মীমাংসা করেছেন।কিন্তু তা কারোই অবিদিত নাই যে,স্বপ্ন-দৃষ্ট বস্তুগুলি অসত্য-মিথ্যা।তা হলেই দাঁড়াইতেছে যে,শঙ্কর মতে জাগরিতকালের বস্তুগুলিও তবে অসত্য মিথ্যা হচ্ছে।অনেকের নিকট এই কথাটা শুনতে পাওয়া যায়।আমরা পাঠকবর্গের সম্মুখে এ বিষয়ে ভগবান কি মীমাংসা করেছেন তা উপস্থিত করতেছি।পাঠক দেখতে পাবেন যে,এই তুলনায় বৃক্ষ,লতাদি বস্তুকে অলীক বলে উড়ে দেবার কোন কথা বলা হয় নাই
লোকে,ভাল করে শঙ্করের মন্তব্যগুলো তলিয়ে দেখে না।উপর উপর দেখেই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়!তাই এই প্রকার ধারণা প্রচলিত হয়ে পড়েছে।বৃহদারণ্যকে "অজাতশত্রু ও বালাকির" উপাখ্যানে জাগবিতাবস্থা ও স্বপ্নাবস্থার বিস্তৃত বিবরণ আছে।শঙ্করাচার্য্য এই উভয় অবস্থার তুলনা করে যা মীমাংসা করেছেন তাতে তিনি জগৎকে যে অর্থে মিথ্যা,অসত্য বলেছেন তা আপনারা সুস্পষ্ট বুঝতে পারবেন।তিনি বলছেন--স্বপ্নে,আমি রাজা হয়ে সিংহাসনে উপবিস্ট হয়ে আছি;সম্মুখ দাস দাসী প্রভৃতি পরিজনবর্গ আমার সেবা করতেছে;আমি নানারুপ সুখদুঃখাদি অনুভব করতেছি;--এই প্রকার বোধ করে থাকি।এস্থলে প্রশ্ন এই যে,স্বপ্নদর্শনকালে এই যে আত্মা,আপনাকে রাজা বলে বোধ করে পরিজনাদি দ্বারা পরিবৃত দেখতে পায়;সুখদুঃখাদি অনুভব করতে থাকে--এই সকল সুখ দুঃখাদি নানা ধর্মবিশিষ্ট বলেই ত তখন আত্মাকে বুঝা যায়।তবে কি আত্মার তাই স্বরুপ?অথবা,এই সকল সুখদুঃখাদি ধর্ম্ম বা অবস্থা হতে আত্মার একটি 'স্বতন্ত্র' স্বরুপ আছে?শঙ্কর বলেছেন যে কেউ কেউ মনে করেন যে,এই সকল অবস্থা বিশিষ্ট যে সেইত আত্মা রাজা বলে বোধ,দাস দাসী প্রভৃতির দর্শন,সুখ দুঃখাদির অনুভব এই সকল ধর্ম্ম বিশিষ্ট সেই ত আত্মা।এ সকল ছাড়া আবার আত্মার একটা স্বতন্ত্র স্বরুপ কোথায়?এগুলো নিয়েই তো আত্মা।ভগবান এই কথার উত্তরে সিদ্ধান্ত করেছেন যে 'না এই সকল সুখ দুঃখাদি বিবিধ ধর্ম,কখনই আত্মার স্বরুপ হতে পারে না।এই সকল দাস-দাসী প্রভৃতি পরিজন,রাজ্য ধনাদি বস্তু,সুখ দুঃখাদি বিবিধ ধর্ম কখনই আত্মার স্বরুপ হতে পারে না।স্বপ্নে এই সকল বস্তুর যে জ্ঞান হয়,এই সকল বস্তু ও বস্তুর বোধকে যদি আত্মার স্বরুপ বলে মনে কর;তা হলে আমরা বলব যে আত্মার স্বরুপ ভাবে এ সকল বস্তু সত্তা নাই তারা আত্মার উপরে মিথ্যা আরোপিত হয়ে থাকে মাত্র।আত্মার যেটি প্রকৃত স্বরুপ তা এই সকল বস্তু ও বস্তুর বোধ হতে স্বতন্ত্র।জাগরিতকালের বস্তু ও বস্তুর বোধ সম্বন্ধেও তাই বুঝতে হবে।তারও আত্মার স্বরুপ না।আত্মার স্বরুপ যেটা তা ঐ সকল ধর্ম্ম বা অবস্থান্তরের মধ্যেও আপন সাতন্ত্র‍্য ঠিক রাখে।পাঠক শঙ্করের এই সকল কথা হতে দেখছেন যে,শঙ্কর জাগরিতাবস্থায় দৃষ্ট বা অনুভূত বস্তু বা বস্তুর জ্ঞানকেই 'মিথ্যা' বা অবিদ্যমান বলতেছেন না।স্বপ্ন দৃষ্ট বস্তু বা বস্তুর বোধকেও তিনি অসত্য মিথ্যা বলতেছেন না।এস্থলে আর একটা বিষয় লক্ষ্য করা কর্তব্য।আত্মার স্বরুপটি যে ঐ সকল সুখ-দুঃখাদি বিবিধ ধর্ম্ম বা অবস্থা হতে স্বতন্ত্র;তারাই যে আত্মার স্বরুপ না,তা বলতে গিয়ে ভগবান শঙ্কর তিনটি সুন্দর যুক্তি দিয়েছেন।যুক্তি কয়েকটি এই--
(ক) "ব্যভিচারদর্শনাৎ"।--স্বপ্নে আত্মায় যে সকল ধর্ম উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছে;সেগুলোকে আত্মার স্বরুপ বলা যায় না।কেননা, তারা পরিবর্তিত হয়,রুপান্তরিত হয়।স্বপ্নে তাদের যে আকার,যে রুপ দেখতেছ জেগে উঠলে আর সেরুপ,সে আকার থাকবে না।কিন্তু যেটা যার স্বভাব বা স্বরুপ তা পরিবর্তন করা যায় না।সুতরাং তাদেরকে আত্মার স্বরুপ বলতে পার না।
(খ)দৃশ্যত্বাৎ:--ঐ সকল সুখ দুঃখাদি ধর্মকে আত্মা স্বপ্নে নিজের বিষয় রুপে object দৃশ্যরুপে,অনুভব করে থাকে।দৃশ্য বস্তু হতে তা 'দ্রষ্টা' অবশ্যই স্বতন্ত্র।সুতরাং তাদেরকে আত্মার স্বরুপ বলতে পার না।
(গ) বস্তুন্তর সম্বন্ধ জনিতত্বাচ্চ:--ঐ সকল ধর্ম বা বিকার যে আত্মাতে উদ্রিক্ত হয়েছে তা অন্য বস্তুর সহিত সংসর্গের ফলে কারণান্তর যোগে।যা অন্য কোন কারণের সর্ম্পলে আসায় উৎপন্ন হয় ,তাতো অনিত্য সেই কারণটি চলে গেলে আর তাও থাকবে না।সুতরাং ঐ ধর্ম-গুলিকে আত্মার স্বরুপ বলতে পারা যায় না।আমাদের জাগরিত কালেও,বিষয়ে ইন্দ্রিয়যোগে যে সকল ধর্ম্ম বা ক্রিয়া উদ্রিক্ত হয়,সেগুলিও এই সকল হেতুতে আত্মার স্বরুপ হতে পারে না।
শঙ্কর স্বপ্নদৃষ্ট বস্তুগুলিকে বা জাগ্রত দৃষ্ট বস্তুগুলিকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন নাই।আত্মার যেটি প্রকৃত স্বরুপ সেটা সকল ধর্ম বা গুণ হতে স্বতন্ত্র।যারা অবিদ্যাচ্ছন্ন তারাই ঐ ধর্ম্ম বা গুণ গুলিকে আত্মার উপরে "আরোপিত" করে নিয়ে এবং তাদেরকে আত্মার স্বরুপ বলে মনে করে।কারণান্তর যোগে আত্মায় যে সকল ধর্ম্ম বা ক্রিয়া বা গুণ উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে সে সকলের মধ্যে আত্মার একত্ব ও স্বাতন্ত্র‍্য পরিস্ফুট থাকে।তা ভুলে অবিদ্যাচ্ছন্ন লোকেরা সেগুলোকে আত্মার স্বরুপ বলে মনে করর।তাকেই বেদান্তে "অধ্যারোপ" বলে।তা মিথ্যা,অসত্য।সর্ব্বত্র ভাষ্যকার এই ভাবেই ধর্ম্মগুলিকে মিথ্যা,অসত্য বলেছেন।
(৬) কার্য্য ও কারণের সম্বন্ধ নির্ণয় করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য্য বলে দিয়েছেন যে প্রত্যেক বস্তু বা জীবের একটি স্বতঃসিদ্ধ 'স্বরুপ';এবং তার একটি 'সম্বন্ধি রুপ' আছে।যখন একটা বস্তু বা জীবের,অপর একটা বস্তুর সহিত বা অবস্থার সহিত বা কোন ব্যক্তির সহিত সম্বন্ধ হয়,সেইটাই তার সম্বন্ধি রুপ।অপর কারও সাথে সম্পর্ক হলেই যে তদযোগে বস্তুর বা ব্যক্তির স্বরুপটা একটা স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে উঠে তা না।ঐ স্বরুপটির কোন হানি হয়।সুতরাং প্রত্যেক বস্তু বা জীব অপর কারোও সাথে সর্ম্পকে আসলেও তার আপন স্বরুপটি ঠিকই থেকে যায়।
শঙ্করাচার্য্য এই মূল্যবান তত্ত্বটি এরকম ভাবে বলেছেন
**রেখা বা বিন্দু ত একি রকম।কিন্তু স্থানের ভেদে,স্থানের সম্বন্ধে পড়ে--ঐ একই রেখাকে কখন লোকে একশ,কখন এক সহস্র শব্দে নির্দ্দেশ করে থাকে।
অতএব এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারা যাচ্ছে যে ব্রহ্ম আপন স্বরুপ পরিত্যাগ করে,এই নাম -রুপাদি বিকারের সর্ম্পকে ,একটা স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে উঠেন নাই।নাম রুপাদি বিকারগুলি,ব্রহ্ম হতেই অভিব্যক্ত হয়েছে।কিন্তু তাদের সর্ম্পকে তাঁর স্বরুপের কোন হানি হয় নাই।
নামরুপাদি বিকারের মধ্যে,সকল পরিবর্তনের মধ্যে-ব্রহ্মের স্বরুপটি ঠিকই থাকছে।তাঁর স্বরুপের একত্ব ও স্বাতন্ত্র‍্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছেযদি মনে কর আর নাম-রুপাদি সর্ম্পকে এসে তার স্বরুপ অন্যরুপ হয়ে উঠল এও মনে কর তবেই ভুল করলে।
যদি মনে কর যে,এই জগৎটা যখন অভিব্যক্ত হল তখন,ব্রহ্ম আপন স্বরুপ ত্যাগ করে এই জগৎ নামক একটা স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে উঠলেন তাও ভুল করলে এই প্রকার জগৎ অসত্য,মিথ্যা।
অবিদ্যাচ্ছন্ন লোকেরাই এই জগৎকে ব্রহ্মের উপর আরোপিত করে তাঁর স্বাতন্ত্র‍্য ভুলে মনে এই জগৎ একটা স্বতন্ত্র বস্তু।প্রকৃত কথা এই যে অপর কারও সাথে সর্ম্পক হলেও স্বরুপ ঠিকই আছে।ব্রহ্মের স্বরুপ হতেই নাম-রুপাদি বিকারগুলো অভিব্যক্ত হয়েছে তাই বলে ব্রহ্ম আপন স্বরুপ হারিয়ে একটা স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে উঠল না।
শঙ্করাচার্য এই প্রকার জগৎকে অসত্য,মিথ্যা বলে নির্দ্দেশ করেছেন।এত নির্দ্দেশ স্বত্তেও লোকে জগৎগুরুকে বুঝতে পারে নাই।
(৮) শঙ্কর ভাষ্যে অনেকস্থলে কতক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।অনেকে এই শব্দগুলি দেখে মন করে শঙ্করে যেন জগৎকে ও জগতের বিকারগুলিকে অলীক বলে উড়ে দিয়েছেন।এই শব্দগুলি পরীক্ষা করে দেখা অবশ্যই প্রয়োজন।
শঙ্কর কি অর্থে এই শব্দগুলির ব্যবহার করেছেন তা তিনি নিজেই সে সকল স্থানে বলে দিয়েছেন।যে ব্যক্তি যে শব্দ বা যে কথাকে নিজে যে অর্থ ব্যবহার করেন,সেই শব্দের ও সেই কথার সেই অর্থটিই গ্রহণ করা কর্তব্য তা না করে নিজের মনোমত অর্থ করা উচিত না।আমরা এখন শঙ্করের ব্যবহৃত শব্দগুলির উল্লেখ করতেছি।এই সকল শব্দদ্বারা শঙ্কর এই জগৎটাকে উড়িয়ে দিয়েছেন কিনা একটু বিচার করে দেখবেন
(a) শঙ্কর ভাষ্যে অনেক স্থলে দেখতে পাই যে এই জগৎ অবিদ্যাকল্পিত;নামরুপগুলি অবিদ্যা প্রত্যুপস্থাপিত,নামরুপাদির ভেদ অবিদ্যাকল্পিত,নাম-রুপাদি উপাধির পরিচ্ছেদ অবিদ্যাত্মক।এই প্রকার উক্তি আছে।এই অবিদ্যাকল্পিত কথাটার ব্যবহার দেখেই অনেকে এই জগৎকে অলীক বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু শঙ্করের অভিপ্রায় তা না।
কি অর্থে শঙ্কর,অবিদ্যা শব্দ ব্যবহার করেছেন?
বিষয়েন্দ্রিয় যোগে আত্মায় কতগুলি গুণ,ধর্ম বা বিকারে অভিব্যক্তি হয়ে থাকে এবং এই সকল গুণ বা ধর্মের মধ্যে আত্মার যেটি স্বরুপ সেটি অবিকৃত থেকে তার স্বাতন্ত্র্য ও একত্ব পরিস্ফুট থাকে।এই ধর্ম বা বিকার গুলি আত্মায় 'জ্ঞেয়' রুপেই অনুভূত হয়ে থাকে।স্বরুপটি স্বতন্ত্র বলে আত্মা তাদের জ্ঞাতা।কিন্তু সেই ধর্ম বা বিকারগুলি আত্মার উপরে অধ্যারোপিত করে সেই স্বাতন্ত্র‍্য টাকে বিলুপ্ত করে ঐ ধর্ম বা বিকারগুলিকেই আত্মা বলে ধরে নেওয়া হয় তখন সেটার নাম অবিদ্যা।অবিদ্যার প্রভাবে আমরা এইরুপ মনে করি।
Paul Deussen প্রভৃতি ইউরোপীয় পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতরা শঙ্করের এই অবিদ্যা শব্দের অর্থ ভুলে, মিথ্যা অর্থ Unreal অর্থ করেছেন।যা একদম ভুল।
অবিদ্যার প্রভাবে আমরা ব্রহ্মের স্বাতন্ত্র‍্যটা ভুলে যাই।ভুলে যায় যে ব্রহ্ম এ জগৎ হতে স্বতন্ত্র।এই নাম-রুপাদি বিকারের মধ্যেও সকল পরিবর্তনের মধ্যেও তিনি স্বতন্ত্রই রয়েছেন।
শঙ্কর বলেন যে অবিদ্যার কাণ্ডই এইরুপ।জগৎটা যখন ব্রহ্ম হতে অভিব্যক্ত হল।তখন আমাদের মনে হয় যেন এই অভিব্যক্ত জগতের যোগে ব্রহ্ম--একটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে উঠলেন।অন্য বস্তুর যোগে তিনিও যেন অন্য হয়ে উঠলে ।একটা ভিন্ন বস্তু হয়ে উঠলেন।আমরা মনে করি যে তাঁর স্বরুপটি মরে গিয়ে একটা সর্ম্পূণ নতুন বস্তু (এই জগৎটা) যেন উপস্থিত হল।এরুপ আমাদের দৃষ্টি কেবল বিকারগুলোতেও আবদ্ধ হয়ে পড়ে।ব্রহ্ম হতে যেন স্বতন্ত্র বস্তু বলে মনে হতে থাকে।এই প্রকারে তিনি যেন প্রত্যেক বিকারের একটা একটা স্বতন্ত্র নানারুপে দেখা দিল।শঙ্কর সেটাকেই অবিদ্যার কল্পনা মিথ্যাজ্ঞান বলে নির্দ্দেশ করেছে।।
এই জগৎ স্বতন্ত্র স্বাধীন বস্তু হতে পারে না।ব্রহ্মকে ছেড়ে তা হতে স্বতন্ত্র হয়ে থাকতে গেলে জগতের বিকারগুলি ধুলিচূর্ণবৎ খসে পড়বে।তা হলে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে শঙ্কর কিভাবে জগৎকে অসত্য মিথ্যা বললেন।তিনি কোথাও এই জগৎকে,জগতের বিকারগুলিকে উড়ে দেন নাই।
এ সকলের অর্থ এই যে জগতের কোন বস্তুই প্রকৃত পক্ষে ব্রহ্ম হতে স্বতন্ত্র না।কোন বস্তুকেই ব্রহ্ম হতে স্বতন্ত্র করে নেওয়া যায় না।ব্রহ্ম হতে স্বতন্ত্র হতে গেলেই তাঁকে ছেড়ে থাকতে গেলে জগৎ চূর্ণ হয়ে পড়বে।
অবিদ্যার টা বুঝলাম আরো একটি শব্দ আছে তা হলো নেতি নেতি শব্দ।কোথাও বা নানাত্ব নাই বলা হয়েছে।যে ব্যক্তি ব্রহ্মকে নানাত্বকে দেখে অনেককে দেখে সে মৃত্যু হতেও মৃত্যুকে প্রাপ্ত হয়।এ কথা বলাও আছে।অনেকে মনে করে শঙ্করাচার্য্য এই নানাত্বপূর্ণ জগৎটাকে উড়িয়ে দিয়েছেন।
বেদান্তে ব্যবহৃত নেতি নেতি শব্দের তাৎপর্য্য নির্ণয় করতে গিয়ে বলতেছেন যে জগতে সূক্ষ্ম ও স্থুলাকারে যে সকল গুণ,ধর্ম বা ক্রিয়াদি অভিব্যক্ত হয়েছে সেইগুলি নিয়ে ত সংসার।শব্দ স্পর্শ রুপ রসাদি বাহ্য বিষয় এবং ইন্দ্রিয় মন প্রাণ প্রভৃতি আন্তর শক্তি এইগুলি দ্বারাই ত জগতের তাবৎ বস্তু নির্ম্মিত।সুতরাং যাকে ব্রহ্ম বলতেছ তারাই ত সেই ব্রহ্মের রুপ বা আকার।এ সকল ছাড়া আবার ব্রহ্ম কোথায়?শঙ্কর বলতেছেন যে এই প্রকারে ব্রহ্মের স্বতন্ত্রতা ভুলে যদি ব্রহ্মকে এই সকল গুণ বা ধর্মবিশিষ্ট বলে মনে করা হয় তাহলে ভুল হল।বেদান্তে নেতি নেতি শব্দদ্বারা ব্রহ্মের এই প্রকার আকার নিষিদ্ধ হয়েছে।জগতে অভিব্যক্ত সর্ব্বপ্রকার গুণ বা ধর্ম হতে ব্রহ্ম স্বতন্ত্র;তিনি এই সকল গুণ বা ধর্ম বিশিষ্ট না।সকল প্রকার গুণ বা ধর্ম মধ্যে তাঁর স্বাতন্ত্র‍্য ও একত্ব ঠিক রয়েছে।সুতরাং তাঁকে এই সকল ধর্ম বিশিষ্ট মনে করা যেতে পারে না।শঙ্কর এই কথা আমাদেরকে বলে দিয়েছেন।তাহলে আপনারা আবারও দেখলেন নেতি নেতি শব্দদ্বারা জগতের কোন বস্তুকে উড়ে দেওয়া হয় নাই।নানাত্ব নাই বলতে ভগবান বুঝিয়েছেন যে একটা বস্তুকে যুগপৎ 'এক' অথচ 'অনেক' বলতে পারা যায় না।যা অনেক বা নানা হয়েছে যা নানা আকারে আকারিত নানা ধর্ম বিশিষ্ট তা আবার একত্ব থাকল কোথায়?সুতরাং ব্রহ্মকে এই জগদাকার বিশিষ্ট,জগদাকারধারী একটা স্বতন্ত্র বস্তু বলতে পারা যায় না।কেন না তিনি ত আপন স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে এই জগদাকার ধারণ করেন নাই।এই জগতের মধ্যেও তাঁর স্বরুপের স্বাতন্ত্র‍্য ও একত্ব ঠিক আছে।এই প্রকারে শঙ্করাচার্য্য ব্রহ্মে নানাত্ব নাই বলেছেন।আপনারা আশা করি বুঝতে পারলেন নানাত্ব শব্দ দিয়েও জগতের কোন বস্তুকেই উড়িয়ে দেওয়া হয় নাই।
বিশেষ প্রতিষেধ বা বিশেষ নিরাকরণ বেদান্তে আরো একটা শব্দ আছে এখানে ব্রহ্মে কোন প্রকার গুণ,ধর্ম্ম,ক্রিয়া,জাতি বা ভেদ নাই।ব্রহ্ম সর্ব্বপ্রকার বিশেষত্ব-বর্জ্জিত।এ নিষেধ দেখে অনেকে মনে করে জগতে নাম-রুপাদি সকল বিশেষ বস্তুই উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।শঙ্কর বলেছেন অবিদ্যাচ্ছন্ন লোকেরা ব্রহ্মের স্বাতন্ত্র‍্য ও একত্ব ভুলে তাঁকে এই সকল শক্তি গুণাদি বিশিষ্ট বলেই মনে করে।"বিশেষ নিরাকরণ" শব্দ দ্বারা ব্রহ্মকে জগদাকার বিশিষ্ট মনে করাটাই নিষিদ্ধ হয়েছে জগৎ বা জগতের বস্তুগুলি নিষিদ্ধ করেন নাই।অনেকে জীবাত্মাকেও দেহেন্দ্রিয়াদি ধর্ম বিশিষ্ট বলে মনে করে সর্ব্বত্র তাই নিষিদ্ধ হয়েছে।
আরো সহজ কথায় মানে বাচ্চা লেভেলে যদি বলতে চাই শঙ্কর কোথাও জগৎকে অলীক বলে উড়িয়ে দেন নাই।
শঙ্করের জগৎ মিথ্যা বলতে ব্রহ্মের মতো সৎ ও না আবার আকাশকুসুমের মতো অসৎ ও না।তাই মিথ্যা বলতে অনির্বচনীয় বুঝিয়েছেন।

হিন্দু সমাজে পদবী প্রচলন

হিন্দুধর্ম অতি প্রাচীন বলেই বিভিন্ন সময় এর পথ পরিক্রমায় বিচিত্র পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যা বাস্তবক্ষেত্রের ধর্মীয় নিয়ম নীতির সাথে কোন সামঞ্জস্যতা নেই। সনাতনী হিন্দু সমাজে  তথাকথিত পদবী প্রচলন হওয়ায় পর থেকে বর্ণভেদের চেয়ে আরও অধিকতর ভেদাভেদ বিভিন্ন পদবী ভেদের লোকরাই সৃষ্টি করতে শুরু করে। পদবী ব্যবহারের ঐতিহাসিক প্রমাণ ও তথ্য --- ১৫১০ খ্রীস্টাব্দে আনন্দ ভট্ট রচিত 'বল্লাল চরিত' যা ১৯০৪ খ্রীস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। এই বল্লাল চরিত পুস্তকে হিন্দু সমাজে পদবী প্রচলন সর্ম্পকে বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে। উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে গৌড়ের বৈদ্য বংশীয় রাজা বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯) নিজ সহধর্মিনী থাকা অবস্থায় অধিক বয়সে পদ্মিনী নাম্মী এক সুন্দরী ডোম নর্তকীকে বিবাহ করেন। এতে দেশজুড়ে রাজার সুনাম নষ্ট হয় এবং এ কুকীর্তি নিয়ে প্রজারা সমালোচনা শুরু করে দেন। রাজা এ কলংক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য রাজ্য মধ্যে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের প্রজাদের এক সম্মিলিত ভোজ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু প্রায় সকল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা উপস্থিত থাকলেও নমঃশূদ্র পারশব বিপ্রগণ এই ভোজ অনুষ্ঠানে যোগদানে বিরত থাকেন। অর্থাৎ রাজার এ কুকীর্তিকে সমর্থন করে ভোজ সভায় অংশ নেন নি। নমঃশূদ্র বংশের কিছু পরিচয় এখানে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। মহামুনি কশ্যপের পুত্র ছিল নমস্। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে ব্রহ্মজ্ঞ মুনিবর নমস্ এর পত্নী (ব্রহ্মার মানসপুত্র রুচির কন্যা) সুলোচনা গর্ভজাত পুত্র কীর্তিবান ও উরুবান নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের পিতা। মুনিবর নমস্ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তিনটি বরও লাভ করেছিলেন ।
এগুলো হচ্ছে --- 1> তার পুত্রগণ বেদাচার ব্রাহ্মণাচার অধিকারী হবে এবং পরবর্তীতে হোমযজ্ঞ ও পূর্জাচনায় অধিকারী হয়ে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করবে।
2> তাঁর বংশ তাঁরই নামে খ্যাত হবে। পুত্রদ্বয় শূদ্রাকে বিয়ে করায় নমস্ নামের সাথে শূদ্র যোগ হয়ে নমঃশূদ্র নামে খ্যাত হবে।
3> তাঁর বংশধরদের চরিত্রগুন ও কীর্তি গৌরবে তাঁর নামের মহিমা ক্রমোজ্জ্বল হবে।
নমঃশূদ্র সম্প্রদায় বল্লাল সেনের পদবীভেদ করার আগে কুলীন ব্রাহ্মণ ও জ্ঞানী ছিলেন। যেহেতু নমঃশূদ্ররা বল্লাল সেনের ভোজসভার অংশ গ্রহণ করেন নি, সেহেতু রাজা তাঁদের ব্যবহারে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হন এবং নিজেকে অপমানিত বোধ করেন। রাজার আদেশে সকল নমঃশূদ্র লোকদের চাকুরীচ্যুত করা হলো এবং এমনকি নতুন নিয়োগও বন্ধ করে দেয়া হলো। শুধু তাই নয় তাঁদের যজ্ঞসূত্র ছিন্ন করে চন্ডাল বলে গালাগাল দিয়ে নগর বন্দর থেকে উৎখাত করা হল। অনন্যোপায় হয়ে এই নমঃশূদ্ররা সেদিন পাহাড়, বনাঞ্চলে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে অনেকটা নিভৃত জীবনযাত্রা শুরু করলেন এবং প্রকৃতি নির্ভর বৃত্তি অবলম্বন করেন। অন্যদিকে রাজার আয়োজিত উক্তভোজ  অনুষ্ঠানে যোগদানকারী সম্প্রদায়ভুক্তরা নমঃশূদ্রগণের প্রতি রাজার এই ব্যবহারে উৎসাহিত হয়ে নিজেদের নিম্ন সামাজিক মর্যাদা ঢাকবার চেষ্টায় তাঁদের প্রতি অধিক মাত্রায় দুর্ব্যবহার শুরু করে। তারা রাজার সকল কর্মকে নির্বিচারে সমর্থন করে রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে যত্নবান হয়।  রাজাও এসব সম্প্রদায়কে সাহায্য করেন এবং অনেক সম্প্রদায়কে কৌলিন্য তথা পদবী দান করেন।
বল্লাল সেনের আগে পাল রাজাদের আমলে বাংলাতে বৌদ্ধ এবং লোকায়েত অনেক ধর্মই ছিল-যার মধ্যে তান্ত্রিক, কালীভক্ত এবং নানান স্থানীয় 'যোগী' সংস্কৃতিই পাওয়া যাবে। বৌদ্ধ ছিল রাজধর্ম। কিন্ত কোন জাতিভেদ পাওয়া ছিল না।




বল্লাল সেনের (1160–1179) আগে বাংলায় বৈদিক ধর্মের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। কোন ব্রাহ্মনই ছিল না বাংলায়।
বল্লালসেন সেন রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা। ১১৬০ খ্রিষ্টাব্দে সেন রাজবংশের প্রথম রাজা বিজয়সেন (১০৯৭-১১৬০ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মৃত্যুর পর বল্লালসেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজলাভের পর তিনি রাজ্য বিস্তারের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ সংস্কারকার্যে অধিকতর মনোনিবেশ করেন। তিনি পিতার মতোই ‘অরিরাজনিশঙ্ক শঙ্কর’ এবং অন্যান্য সম্রাটসুলভ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় জগদেকমল্লের কন্যা রামাদেবীকে বিবাহ করে সেনবংশের সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। বল্লালসেনের রাজত্বকালের ইতিহাস পুনর্গঠন করার জন্য কয়েকটি মূল্যবান উপকরণ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে যথাক্রমে ‘নৈহাটি তাম্রশাসন’ ও ‘সানোখার মূর্তিলিপি’, বল্লালসেন কর্তৃক রচিত ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ ছাড়াও বল্লাল চরিত নামে দু’খানি গ্রন্থ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথমটি বল্লাল সেনের অনুরোধে তাঁর শিক্ষক (গোপাল ভট্ট) ১৩০০ শকাব্দে দুই খণ্ডে রচনা করেন এবং বল্লাল চরিতের তৃতীয় খণ্ড নবদ্বীপাধিপতির আদেশে গোপালভট্টের বংশধর আনন্দভট্ট ১৫০০ শকাব্দে রচনা করেন। উপরোক্ত বইগুলি সমসাময়িক।
সেন রাজারা এসে প্রথমে বাংলার সব প্রজাদের শুদ্র বানালেন! কনৌজ থেকে ব্রাহ্মন ধরে এনে তাদের দিয়ে বাংলায় ব্রাহ্মন্য ধর্ম, বৈদিক মতে পূজা অর্চনা চালু করলেন। ব্রাহ্মনদের বংশ বৃদ্ধি করতে এদেরকে অনেকগুলি গ্রাম দিলেন। কুলীন ব্রাহ্মনদের অসংখ্য বিবাহে উৎসাহ দেওয়া হল যাতে ব্রাহ্মনদের বংশ বৃদ্ধি হয়। এরাই আজকের তথাকথিত 'ব্রাহ্মণ'। এক অদ্ভুত হিন্দু যুগের সুচনা হল বাংলায়। কিছু ব্রাহ্মণ, বাকী সবাই শুদ্র, বাংলাতে আজো ক্ষত্রিয় বৈশ্য নেই। বাংলার ব্যবসায়ী শ্রেনী সাহারাও শুদ্র আবার ঘোষ-বোসের মতন রাজকরনিক শ্রেনীও শুদ্র!! ...... বাংলার জনগন তখন এই বহিরাগত ব্রাহ্মন আর সেনদের প্রতি বেজায় বিক্ষুব্ধ। ফলে মাত্র দুহাজার সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার খিলজি যখন নবদ্বীপ আক্রমন করলেন (১২০২), লক্ষন সেনের পালানো ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। এর পরবর্তীকালে বাংলায় লোকজন দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে থাকে ব্রাহ্মন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণায় আবার চতুর ইসলামিক ফকিরদের শঠতা ও জংগী ইসলামিক শাসকের দমনপীড়নে। হজরত শাহ জালালের (১৩০৬) মতন সুফীদের প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালী দলে দলে ইসলাম গ্রহন করতে থাকে চোদ্দশ শতক পর্যন্ত।

রুদ্রাষ্টধ্যায়ী এর সপ্তম অধ্যায় হতে লিখিত সংক্ষিপ্ত বংগানুবাদ

দূঃখ দূরকারী ও জ্ঞান প্রদানকারী হে রুদ্র তোমার ক্রোধের প্রতি নমষ্কার; তোমার বাণের প্রতি নমষ্কার; এবং তোমার দুই ভুজার প্রতি নমষ্কার। (১)


কৈলাসে থেকে সংসারের প্রতি কল্যাণকারী হে রুদ্র! তোমার যে মঙ্গলদায়ক, সৌম্য, কেবল পূণ্যপ্রকাশক শরীর, সেই অনন্ত সুখকারক শরীর দ্বারা আমাদের প্রতি কৃপাকর তথা আমাদের রক্ষা কর। (২)


কৈলাসে থেকেও সংসারের কল্যাণকারী তথা মেঘে স্থিত থেকে বৃষ্টির দ্বারা জগতের রক্ষাকারী হে সর্বজ্ঞ রুদ্র! শত্রুর নাশ করার জন্য যে বাণকে তুমি নিজ হস্তে ধারণ কর তা কল্যাণকারক হোক এবং তুমি আমার পুত্র-পৌত্র তথা গো, অশ্বাদির বিনাস কর না। (৩)


কৈলাসে শয়নকারী হে রুদ্র! তোমাকে প্রাপ্ত করার জন্য আমি মঙ্গলময় বাক্যে তোমার স্তুতি করছি। আমাদের সমস্ত পুত্র-পৌত্র তথা পশু সমূহও যেন নিরোগ থাকে এবং নির্মল মনের হয়, তুমি এমনটাই কৃপা কর। (৪)


অত্যধিক বন্দনশীল, সমস্ত দেবতাদের মূখ্য, দেবগণের হিতকারী তথা সমস্ত রোগের নাশকারী হে রুদ্র! আমার সাথে সবচেয়ে বেশী বাক্যালাপ কর, যাতে আমি সর্বশ্রেষ্ঠ হতে পারি। হে রুদ্র! তোমাকে নমষ্কার (৫)

সমুদ্রপুত্র রাজা গৌড় গোবিন্দ ও শ্রীহট্ট

  সিলেটের   ‎ গৌড় গোবিন্দ এবং আজকের   ‎ শাহজালাল বিভিন্ন তথ্যপঞ্জী এবং পরবর্তিতে আবিষ্কৃত তাম্রফলক ও শিলালিপি থেকে সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস স...

Popular Posts