Wednesday, May 27, 2020

মহাভারতে কি শুধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন?

মনে রাখতে হবে বিশ্বরূপ কোন ব্যাক্তি বিশেষ দেখান না । ইহা ব্রহ্মের বিশালতা বোঝাতে ব্যাবহৃত করা হয়।
মনে রাখতে হবে শুধু মহাভারত ছাড়াও পুরো সনাতন শাস্ত্রে অনেকেই বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন। দধীচি শ্রীবিষ্ণুকে দেখিয়েছেন, কৃষ্ণ অর্জুনকে, পরমেশ্বর শিব রাম এবং কৃষ্ণ ২ কেই দেখিয়েছেন।
সনাতন ধর্মের মাঝে মধ্যযুগীয় কিছু বিভেদকারী যারা পশ্চিমা মদতে সনাতন সমাজে শুধু বিভেদ ছড়িয়ে যাচ্ছে তাঁদের দাবী, একলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব দাস। কারন উনি ছাড়া নাকি আর কেউ বিশ্বরূপ দেখায় নাই। যা সম্পূর্ণ রূপে একটা ভ্রান্ত এবং মূর্খতার প্রমান আসুন দেখে নেই মহাভারত থেকে পরমেশ্বর ভগবান শিব কিভাবে উনার প্রিয় ভক্ত শ্রীকৃষ্ণকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।

 মহাভারতে পরমেশ্বর দেবাদিদেব মহাদেব শিবের বিশ্বরূপঃ-

মহাভারতের ভীষ্মপর্বে অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন- একথা আমরা সবাই জানি কিন্তু এদিকে অনুশাসন পর্বে পাওয়া যায় যে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম ভগবান মহাদেব বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, যা স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কাছে বর্ণনা করেন। রুক্মিনীর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ পুত্র লাভ করার জন্য মহাদেবের তপস্যা করেছিলেন। তার পূর্বে উপমন্যুর নিকট দীক্ষা গ্রহন করেছিলেন। এই সকল বিষয় হরিদাসসিদ্ধান্তবগীশ অনুবাদিত মহাভারত (বাংলা সংস্করণে যেটি সর্ববৃহৎ মহাভারত) থেকে রেফারেন্স সহ হুবুহু নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ

শ্রী কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কাছে বর্ণনা করতে লাগলেন,
ভারত নন্দন (যুধিষ্ঠির) মহর্ষি উপমন্যু এইভাবে মহাদেবের বিষয়ে কথা বলিতেছিলেন, তাহাতে আমাদের আটদিন যেন মূহুর্ত কালের ন্যায় অতীত হইয়া গেল। অষ্টম দিনে ব্রাহ্মণ উপমন্যু যথাবিধানে আমাকে দীক্ষিত করলেন এবং দণ্ডধারণ, মস্তকমুণ্ডন, কুশাসনোপবেশন, কৌপীনপরিধান, ঘৃতস্নান ও মেখলাবন্ধন করাইলেন। (মহা: অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৭৬-৩৭৭)

ভারতনন্দন! ফলমাত্র ভোজন করিয়া এক মাস, জল মাত্র পান করিয়া দুই মাস এবং বায়ু মাত্র গ্রহন করিয়া তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চমমাস অতিবাহিত করিয়া একপদে দাঁড়াইয়া, ঊর্দ্ধবাহু ও সতর্ক হইয়া আকাশে সহস্র সূর্য্যের তেজ দেখিতে পাইলাম। (মহা: অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৭৮-৩৭৯)

পাণ্ডুওনন্দন! সেই তেজের মধ্যবর্তী ইন্দ্রধনুতে পরিবেষ্টিতাঙ্গ, গাবাক্ষতুল্য, বিদ্যুন্মালা যুক্ত, নীলপর্ব্বতসদৃশ, বকপংক্তিদ্বাবাহি যেন আকাশবশোভা জনক একটা তেজঃপুঞ্জ দেখিতে পাইলাম।
(মহা: অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৮০)

“তপস্যা, তেজ ও কান্তিদ্বারা উজ্জ্বলা ভার্য্যা পার্ব্বতীর সহিত মহাতেজা ভগবান মহাদেব সেই তেজঃপুঞ্জের মধ্যে অবস্থান করিতেছিলেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৮১)

“চন্দ্রের সহিত সন্ধ্যাবাগবঞ্জিত, মেঘস্থিত সূর্য্যের ন্যায় পার্ব্বতীর ভগবান মহাদেব সেই তেজঃপুঞ্জের মধ্যে শোভা পাইতেছিলেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৮২)

“কুন্তিনন্দন! দেবগনের অবলম্বন ও পীড়ানাশক মহাদেবকে আমি দেখিতে পাইলাম, তৎকালে আমার দেহ রোমাঞ্চিত ও বিস্ময়ে নয়নযুগল উৎফুল্ল হইল।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৮৩)

“বর্ষাকাল অতীত হইলে মানুষ যেমন পরিবেশমধ্যবর্ত্তী পূর্ণচন্দ্র দর্শন করে, আমিও সেইরূপ মহাদেবকে দর্শন করিলাম। তৎকালে তাঁহার মস্তকে কিবীট ও জটা, হস্তে গদা, শূল, দণ্ড, পিনাক ধনু ও বজ্র, বাহুতে কেষুব, কণ্ঠদেশে সর্পের ন্যায় যজ্ঞোপবীত, বক্ষে গুলফদেশপর্য্যন্তপাতিনী একবর্ণ দিব্যমালা এবং সুন্দর দন্ত তিনি ধারণ করিতেছিলেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৮৪-৩৮৫

“তৎকালে মহাদেব সকল দিকে প্রথমগনে পরিবেষ্টিত হওয়ায় শরৎকালে পরিবেশমধ্যবর্ত্তী সূর্যের ন্যায় তিনি অত্যন্ত দুর্দ্দর্শনীয় ছিলেন। আর একাদশ রূদ্রস্থানে একাদশশত রুদ্র তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিয়াছিলেন এবং তিনি দয়া প্রকাশে শুভকর্ম্মী ও ভত্তাকৃষ্টচিত্ত ছিলেন। এই অবস্থায় আমি মহাদেবের স্তব করিলাম।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৮৬-৩৮৭)

“আদিত্যগণ, বসুগন৷ সাধ্যগন, বিশ্বদেবগ ও অশ্বিনীকুমারদ্বয় ব্রহ্মবিষয়া স্তুতিদ্বারা সেই মহাদেবকে স্তব করিতেছিলেন”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৮৮)

“আদিতিনন্দন ইন্দ্র ও ভগবান বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা বথন্তব নামক সামবেদাংশ মহাদেবের নিকট পাঠ করিতেছিলেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৮৯)

“রাজা (যুধিষ্ঠির)! বহুতব প্রধান যোগী, পুত্রগনের সহিত ব্রহ্মর্ষিগ, দেবর্ষিগন পৃথিবী, আকাশ, নক্ষত্রগন, গ্রহগন, মাস, পক্ষ, ঋতু, রাত্রি, বৎসর, ক্ষণ, মুহুর্ত, নিমেষ, যুগসমূহ, বহুতল অলৌকিক বিদ্যা ও সত্ত্বাদিগুনজ্ঞ লোকেরা, যোগশক্তিদাতা জগৎপিতা ও জগদগুরু মহাদেবকে নমস্কার করিতেছিলেন৷”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৯০-৩৯২)

“রাজা যুধিষ্ঠির! সনৎকুমার, বেদ, ইতিহাস, মরীচি, অঙ্গিরা, অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রত, সপ্ত, মনু, চন্দ্র, অথর্ব্বা, বৃহস্পতি, ভৃগু, দক্ষ, কশ্যপ, বসিষ্ঠ, কাশ্যচ্ছন্দ, দীক্ষা, যজ্ঞ, দক্ষিণা, অগ্নি, হবি ও যজ্ঞোপকরণ দ্রব্য, সমস্ত প্রজাপালক, নদী, সর্প, বৃক্ষ, সমস্ত দেব মাতা, দেবপত্নী, দেবকন্যা, সহস্র সহস্র, অযুত অযুত ও অর্বুদ অর্বুদ মুনি, পর্বত, সমুদ্র ও দিকসকল শান্তমূর্তি প্রভু মহাদেবকে নমস্কার করিতেছিলেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৯৩-৩৯৭)

“গান ও বাদ্য সুনিপুণ গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরারা দিব্যতালে ও অদ্ভুতভাবে গান করিতে লাগিল এবং মহাদেবের স্তব করতে থাকিল।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৯৮)

“মহারাজ (যুধিষ্ঠির)! বিদ্যাধর, দানব, গুহ্যক ও রাক্ষসগন এবং সমস্ত স্থাবর ও জঙ্গম প্রাণিগন বাক্য মন ও কর্মদারা মহাদেবকে নমস্কার করিতে লাগিল।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৩৯৯)

“ভারতনন্দন (যুধিষ্ঠির)! তৎকালে দেবেশ্বর মহাদেব আমার সম্মুখে অবস্থিত ছিলেন। মহাদেব আমার সম্মুখে অবস্থিত দেখিয়া, ব্রহ্মা ও ইন্দ্রপ্রভৃতির সহিত সমগ্র জগৎ আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করিল, কিন্তু তখন মহাদেবের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে আমার শক্তি হইলো না।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪০০-৪০১)

“তাহার পর মহাদেব আমাকে বলিলেন,
কৃষ্ণ! তুমি আমাকে দর্শন কর এবং তোমার অভিলাষ বল, তুমি শত শত ও সহস্র সহস্র ভাবে আমার আরাধনা করিয়াছ। ত্রিভুবনে তোমার তুল্য অন্যকেহ আমার প্রিয় নাই।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪০২)

“এই সময়ে আমি (কৃষ্ণ) মস্তকদ্বারা মহাদেবকে প্রণাম করিলে, উমাদেবী সন্তুষ্ট হইলেন। তদনস্তর আমি (কৃষ্ণ) ব্রহ্মাদিদেবগনস্তুত মহাদেবকে বলিতে লাগিলাম..
নিত্য জগৎকারণ (মহাদেব) আপনাকে নমস্কার। ঋষিরা আপনাকে ব্রহ্মারও অধীশ্বর বলেন এবং সাধু পুরুষেরা আপনার তপ, সত্ত্ব, রজ, তম ও সত্য, বলিয়া থাকেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪০৩-৪০৪)

“আপনি ব্রহ্মা, রুদ্র, বরুণ, অগ্নি, মনু, শিব, ধাতা, বিধাতা, ও হষ্টা এবং আপনি সর্ব্বদর্শী প্রভু। স্থাবর ও জঙ্গম সমস্ত প্রাণী আপনা হইতে জন্মিয়াছে, এবং আপনিই এই সমগ্র সচরাচর ত্রিভুবন সৃষ্টি করিয়াছেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪০৫-৪০৬)


যে সমস্ত ইন্দ্রিয়, যে সমস্ত মন, যে সমস্ত বায়ু, যে সপ্ত অগ্নি, যে সকল দেবর্ষি ও যে সমস্ত দেবতা আছেন, ঋষিরা আপনাকে সে সমস্ত হইতেই প্রধান বলেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪০৭)

“ভগবান (মহাদেব)! বেদ, যজ্ঞ, সোমরস, দক্ষিণা, অগ্নি, হবি, এবং যা কিছু যজ্ঞের উপকরণ, সে সমস্তই আপনি, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪০৮)

“মহাদেব! যজ্ঞ, দান, অধ্যয়ন, ব্রত, যে সকল নিয়ম এবং যে লজ্জা, কীর্ত্তি, শ্রী, দ্যুতি, তুষ্টি ও সিদ্ধি অছে, সে সমস্তি আপনাতে অর্পণ করা উচিত।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪০৯)

“ভগবান! মহাদেব! কাম, ক্রোধ, ভয়, লোভ, মত্ততা, স্তব্ধতা, মাৎসর্য্য, মনের পীড়া ও দেহের রোগ এ সমস্তই আপনার মূর্তি।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪১০)

“প্রকৃতি, বিকৃতি, হেতু, জগতের কারণ, অবিনশ্বর, মূল প্রকৃতি, মননের পরম কারণ, তত্ত্ববোধ ও চিবন্তন ঐশ্বর্য এই সমস্তই আপনি।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪১১)

“অস্পষ্ট চিম্ময়, পাবন, অচিন্তনীয়, সূর্য্যের ন্যায় মহাতেজা, সমস্ত পর্দার্থের আদি এবং জীবাত্মা আপনি।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪১২)

“পরমব্রহ্ম, বুদ্ধি, ব্রহ্মা, বিশ্বব্যাপী শম্ভু, স্বয়ম্ভূ, ভ্রান্তি, প্রমা, প্রত্যক্ষ, চৈতন্য, প্রতিজ্ঞা, যশ, ধৈর্য ও স্মৃতি এই সকল আপনি।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪১৩)

“জ্ঞানীরা এই সকল পর্য্যায় শব্দদ্বরা আপনাকে পরমাত্মা বলিয়া মনেকরেন এনং ব্রাহ্মণ বেদপাঠপূর্বক আপনাকে জানিয়া মোহকে দূরীভূত করেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪১৪)

“ঋষিস্তুত আপনি, সমস্ত প্রাণীর হৃদয়স্থিত জীবাত্মা। জগতে সকল দিকেই আপনার হস্ত ও পদ, সকল দিকেই চক্ষু, মস্তক, ও মুখ, এবং সকল দিকেই আপনার কর্ম্ম বহিয়াছে। আর আপনি সমস্ত ব্যাপিয়া অবস্থান করিতেছেন। বিশেষতঃ জীবাত্মার স্পন্দনাদি কর্য্যের ফল জীবনও আপনিই।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪১৫-৪১৬)

“মহাদেব! আপনি আলোক, শিখা, সাংখ্যপ্রসিদ্ধ পুরুষ, সমস্ত প্রাণীর হৃদয়স্থিত জীবাত্মা, অণিমা, লঘিমা ও প্রাপ্তিশালী জগতের ঈশ্বর, পরমাত্মা, অবিনশ্বর।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪১৭)

“মহাদেব! যাহাদের বুদ্ধি ও মন আপনাতে থাকে এবং যে সকল লোক আপনার শরণাপন্ন ও আশ্রিত, আর ধ্যানী, যোগী, অধ্যবসায়ী ও জিতেন্দ্রিয় হয়, তাহারাই ধন্য।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪১৮)

“মহাদেব! যিনি আপনাকে হৃদয়স্থিত, জীবাত্মা, প্রভু, পুরাণপুরুষ, মূর্ত্তিমান পরব্রহ্ম ও জ্ঞানীগনের পরম গতি বলিয়া নিশ্চিত ভাবে জানেন, সেই জ্ঞানীলোক লৌকিক বুদ্ধি অতিক্রম করিয়া থাকেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪১৯)

“যিনি যোগাবলম্বনে থাকেন, তিনি আপনাতেই প্রবেশ করেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪২০)

“পৃথানন্দন (যুধিষ্ঠির)! জগতের পীড়ানাশক মহাদেবের প্রতি আমি (কৃষ্ণ) এইরূপ বলিলে, তখন স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমগ্র জগত সিংহনাদ করিয়া উঠিল।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪২১)

“সেই সময়ে, দেবগন, মহর্ষিগন, ব্রাহ্মণগন, অসুরগন, নাগগন, পিশাচগন, পিতৃগন, পক্ষিগন, রাক্ষসগন ও সমস্ত ভূতগন মহাদেবকে নমস্কার করিলেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪২২)

“ক্রমে ক্রমে আমার (কৃষ্ণের) মস্তকে স্বর্গীয় সুগন্ধি পুষ্পরাশি নিপতিত হইতে লাগিল এবং অত্যন্ত সুখজনক বায়ু বহিতে থাকিল।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪২৩)

“তখন জগতের হিতকারী ভগবান মহাদেব, পার্ব্বতীদেবী আমার (কৃষ্ণ) ও ইন্দ্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া স্বয়ং আমাকে বলিলেন।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪২৪)

“(মহাদেব বললেন) শত্রুহস্তা কৃষ্ণ! সকলেই আমার প্রতি তোমার পরমভক্তির বিষয় জানেন। তুমি এখন নিজের মঙ্গল বিধান কর। তোমার উপরে আমার পরম প্রীতি জন্মিয়াছে।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪২৫)

“সাধুশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ! তুমি আটটী বর প্রার্থনা কর। আমি তাহা তোমাকে দান করিব। অতএব যদুবংশশ্রেষ্ঠ! অতি দুর্লভ যে সকল বর তুমি ইচ্ছা কর, তাহা বল।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৩/৪২৬)

“কৃষ্ণ বলিলেন- তাহার পর আমি অত্যন্ত আনন্দ লাভ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইয়া মস্তকদ্বারা প্রণাম করিয়া, তেজোরাশির মধ্যবর্ত্তী ভগবান মহাদেবকে বলিলাম-
ধর্ম্মানুষ্ঠানে দৃঢ়তা, যুদ্ধে শত্রুসংহার, উত্তম যশ, উৎকৃষ্ট বল, যোগানুষ্ঠানে প্রীতি, আপনার সান্নিধ্য এবং দশসহস্র পুত্র আমি বরণ করি।”
(মহাভারতঃ অনুশাসন পর্ব, ১৪/১-২)

[এইখানে আরো কিছু বর চান কৃষ্ণ এবং সেগুলো প্রদানের পর মহাদেব ও মহাদেবী অন্তর্নিহিত হইলেন]
সনাতন সমাজকে অনুরোধ এই বিভেদকামী পশ্চিমা মদতপুষ্ট অসুরদের বর্জন করুন এবং সনাতন সমাজকে আশু ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করুন।
নমস্কার।
হর হর মহাদেব। 

Thursday, May 21, 2020

শ্রীকৃষ্ণ কে?

আমার প্রাণ প্রিয় ভ্রাতা পশ্চিম বঙ্গের শ্রী জয় বিশ্বাসের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার এই লেখা।
শ্রীকৃষ্ণ কি সাধারণ মানব?

শ্রীকৃষ্ণ কি ভক্তের উপাস্য?

শ্রীকৃষ্ণ কি পরমাত্মা?

শ্রীকৃষ্ণ কি পরমেশ্বর??

বেদান্তবাদীদের দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক এরূপ প্রশ্নের উত্তর।

*ওঁ নমঃ ভগবতে বাসুদেবায়*

সনাতন ধর্মের এক কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রীকৃষ্ণ।

সনাতন ধর্মের এমন কোন আচার্য্য, পন্ডিত, মহাপুরুষ, যোগী, সসম্প্রদায়, মতবাদ কিংবা সাধারণ ব্যাক্তিবর্গ নেই যারা শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে মন্তব্য করেন নি। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার কৃষ্ণ চরিত্র গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণ এর এক শুদ্ধ চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।

যেহেতু সকল সম্প্রদায় এবং ব্যাক্তিবর্গ শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে মন্তব্য করেছেন সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ যে এক বিশেষ চরিত্র এবং চর্চার বিষয় ইহাতে সন্দেহ নাই। আমি বেদান্তবাদী দৃষ্টিকোণ হতে শ্রীকৃষ্ণ কে বর্ণনা করার প্রয়াস করছি।

আচার্য্য শ্রীমৎ শংকরাচার্য শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে একাধিক স্ত্রোত্র রচনা করেছেন। সেই স্ত্রোত্র এর দ্বারা শুরু করছি।

অচ্চ্যুতং কেশবং রামনারায়ণং

কৃষ্ণদামোদরং বাসুদেবং হরিম্।।

শ্রীধরং মাধবং গোপিকাবল্লভং

জানকীনায়কং রামচন্দ্রং ভজে।।

অচ্চ্যুতং কেশবং সত্যভামাধবং

মাধবং শ্রীধরং রাধিকারাধিতম্।।

ইন্দিরামন্দিরং চেতসা সুন্দরং

দেবকীনন্দনং নন্দজং সন্ধধে।।

বিষ্ণবে জিষ্ণবে শংখিনে চক্রিণে

রুক্মীণিরাগীনে জানকীজানয়ে।।

বল্লবীবল্লভায়ার্চিতায়াত্মনে

কংসবিদ্ধংসিনে বংশিনে তে নমঃ।।

কৃষ্ণগোবিন্দ হে রামনারায়ণ

শ্রীপতে বাসুদেবজিতশ্রীনিধে।।

অচ্চ্যুতানংত হে মাধবাধোক্ষজ

দ্বারকানায়ক দ্রৌপদীরক্ষক।।

(অচ্চ্যুতাষ্টকম -আদি শংকরাচার্য স্ত্রোত্রম্)।

ব্রহ্ম নির্গুণ এবং সগুণ এই কথা শাস্ত্র সিদ্ধ। সেহেতু সগুণ ব্রহ্ম বিশেষ কোন যোগীর মধ্যে প্রকট হয়ে জগৎ কল্যাণ নিমিত্তে অবশ্যই অবতীর্ণ হতে পারেন। তার সৃষ্টি, তার কার্য, তার লীলা তিনি চাইলে যা খুশি করতে পারেন।

ব্রহ্মসূত্র ২-১-৩৩ বলছে –

লোকবত্তু, লীলাকৈবল্যম্।

অর্থাৎ ব্রহ্মের সৃষ্টি কার্যাদি তাঁহার লীলা মাত্র যাঁহা সাধারণ লৌকিক দৃষ্টান্তেও দেখা যায়।

গীতা ৪/৬ বলা হচ্ছে

অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতনামীশ্বরোহপি সন্।

প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।

অর্থাৎ আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই।

ব্রহ্মসূত্র ১-২-২৯

অভিব্যক্তেরিত্যাশ্মরথ্যঃ

অর্থাৎ আশ্মরথ্য মুনি বলেন, পরমাত্মা অসীম হলেও ভক্তের প্রতি কৃপা পরবশ হয়ে বিশেষ বিশেষ রূপে প্রকাশিত হন।

গীতা ৪/৭-৮ বলা হচ্ছে

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।

পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।

অতঃপর গীতা ৪র্থ অধ্যায়ের ৯ম ও ১০ম শ্লোকে এমনও বলা হচ্ছে,

“হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না। একাগ্রচিত্তে আমার শরণাপন্ন হইয়া, আমার জন্মকর্মের তত্ত্বালোচনা রূপ জ্ঞানময় তপস্যা দ্বারা পবিত্র হইয়া অনেকে আমার পরমানন্দে চিরস্থিতি লাভ করিয়াছেন।”

★শ্রুতি এই মায়াবী শক্তিসমূহের সাহায্যে জগৎ শাসন করা এবং একই রূপ ভাবে সেই তত্ত্ব জানায় অমৃতলাভ এর কথা স্বীকার করেন৷ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩-১ দ্রষ্টব্য।

বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ১-৪-(৫-৬) নং শ্লোক

সোহবেদহং বাব সৃষ্টিরস্ম্যহং হীদং সর্বমসৃক্ষীতি ততঃ সৃষ্টির ভবৎ সৃষ্ট্যাং হাস্যৈতস্যাং ভবতি য এবং বেদ।।

অর্থঃ তিনি অবগত হইলেন, “আমিই সৃষ্টিরূপে বিদ্যমান; কারণ আমিই এই সমস্ত সৃজন করিয়াছি”। সেই জন্যই তাঁহার নাম হইল সৃষ্টি। যিনি এই সৃষ্টিকে জানেন তিনিও সৃষ্টা।

আর শ্রীকৃষ্ণ অবশ্যই সমগ্র সৃষ্টিকে জানতেন। এবং তিনি জানতেন বলেই সৃষ্টি বিষয়ক সমস্ত জ্ঞান ব্যাক্ত করেছেন।

কিন্তু শ্রুতিতে ঈশ্বর জন্ম রহিত বলে উল্লেখিত হয়েছে কিন্তু গীতায় আবার জন্মপ্রাপ্ত হওয়া বিরুদ্ধ আচরণ নয় কি?

আচার্য্য শংকর তার গীতা ভাষ্য ৪-৬-১ এ বলেছেন,

“শংকরভাষ্যঃ ‘অজঃ অপি’ জন্মরহিতঃ অপি ‘সন্’ তথা ‘অব্যয়াত্মা’ অক্ষীণজ্ঞানশক্তিস্বভাবঃ অপি সন্ তথা ‘ভূতানাং’ ব্ৰহ্মাদিস্তম্বপর্যন্তানাম্ ‘ঈশ্বরঃ’ ঈশনশীলঃ ‘অপি সন্, প্রকৃতিং স্বাং’ মম বৈষ্ণবীং মায়াং ত্রিগুণাত্মিকাং যস্যা বশে সর্বং জগৎ বর্ততে যয়া মোহিতং সৎ স্বম্ আত্মানং বাসুদেবং ন জানাতি, তাং প্ৰকৃতিং স্বাম্ ‘অধিষ্ঠায়’ বশীকৃত্য ‘সস্তবামি’ দেহবান্ ইব ভৰামি জাত ইব ‘আত্মমায়য়া’ আত্মানো মায়য়া ন পরমার্থতো লোকবৎ।। (৬/১)

ভাষ্যানুবাদঃ আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হয়েও, অব্যয়াত্মা অক্ষীণজ্ঞানশক্তি-স্বভাব হয়েও এবং ব্রহ্মা থেকে তৃণ পর্যন্ত ভূত সকলের ঈশ্বর অর্থাৎ নিয়ামক হয়েও স্বীয়া প্রকৃতি অর্থাৎ আমার ত্ৰিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, যাঁর বশে সমস্ত জগৎ বর্তমান, যার দ্বারা মোহিত হয়ে লোকে নিজের আত্মা বাসুদেবকে জানতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে অর্থাৎ তাঁকে বশীভূত করে সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহ ধারণ
করে জন্ম গ্রহণ করি, কিন্তু পরমার্থতঃ নয় ।

ভাষ্যবিবৃতিঃ “মম বৈষ্ণবীং মায়া” এখানে স্বীয় শক্তির অভেদ সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণ নিজের অবতরণের কথা বলছেন, কারণ সদসদাত্মিকা
অনির্বচনীয়া মহামায়াই ব্ৰহ্মাশ্রয়ে সব করেন ও হন, পরন্ত ব্ৰহ্ম ত্ৰিকালে অচ্যুত ভাবেই অবস্থান করেন। আবার শ্রীরামকৃষ্ণদেব ঐ অভেদ সম্বন্ধেই বলেছেন, “বেদে যাকে ব্ৰহ্ম বলেছে, আমি তাঁকেই ‘মা’ বলে উপাসনা করি।”

এখন অনেকেই আছেন যারা অবতারবাদ স্বীকার করেন না। সেহেতু তাদের ক্ষেত্রেও শ্রীকৃষ্ণ বেদান্তমতে পূজনীয় হতে পারেন এমন কিছু প্রমাণ দিচ্ছি।

মহর্ষি ব্যাস তার ব্রহ্মসূত্রের ১-১-৩০ নং সূত্রে বলেছেন-

শাস্ত্রদৃষ্ট্যা তূপদেশো বামদেববৎ

অর্থাৎ ইন্দ্রের উপদেশ এখানে বামদেব ঋষি বলেছিলেন। এইরূপ বলা শাস্ত্রসম্মত হয়েছে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের দ্বারা।

ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পর বলেছিলেন, “আমিই ছিলাম মনু, এবং আমিই ছিলাম আদিত্য”- ইত্যাদি। এই উক্তিতে শ্রুতির দ্বারা সমর্থন করা হচ্ছে। কারণ শ্রুতিতে বলা আছে,

“দেবগণের মধ্যে যিনিই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন তিনিই ব্রহ্ম হয়ে গেলেন। ”

বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ১-৪-১০

অহং ব্রহ্মাস্মীতি। তস্মাৎ তৎ সর্বমভবৎ তদ্ যো যো দেবানাং প্রত্যবুধ্যত স এব তদভবৎ তথর্ষীণাং তথা মনুষ্যাণাং তদ্ধৈতৎ পশ্যন্নৃষির্বামদেবঃ প্রতিপেদেহহং মনুরভবং সূর্যশ্চেতি।

মুণ্ডক উপনিষদ ৩-২-৯

স যো হ বৈ তৎ পরমং ব্রহ্ম বেদ

ব্রহ্মৈব ভবতি

অর্থাৎ যে কেহ সেই পরব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে থাকেন।

যেহেতু শ্রুতি ব্রহ্মজ্ঞানবিৎকে ব্রহ্মই আখ্যায়িত করেছেন। আর শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মজ্ঞানী ছিলেন না এমন কথা কেউ বলেন নাই। কারণ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যাতীত কেউই গীতার ন্যায় ব্রহ্মশাস্ত্র মুখনিঃসৃত করতে পারবে না।

★অনেকেই মনে করেন গীতা জ্ঞান শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে বলেছেন। গীতার শেষ অধ্যায়েও সঞ্জয় শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর সম্বোধন করেছেন। এখন

যোগ+ ঈশ্বর = যোগেশ্বর

যদি বলে হয় যোগী ঈশ্বরে যুক্ত কিংবা যোগ যুক্ত ঈশ্বর অথবা ঈশ্বর যোগীর সাথে যোগে যুক্ত উভয় ভাবেই যোগেশ্বর কথাটি সিদ্ধ। কোন সাধারণ মানব চাইলেই এরূপ যুক্ত হতে পারেন না। কেবল ব্রহ্মজ্ঞ বা সিদ্ধ যোগীর দ্বারা এরূপ যুক্ত হওয়া সম্ভব। সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ যে ব্রহ্মজ্ঞ ছিলেন এতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আর এরূপ ব্রহ্মজ্ঞকে শ্রুতি ব্রহ্ম বলে আখ্যায়িত করেছে। সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ অবশ্যই সকলের পূজনীয় এবং আরাধ্যও বটে।

অর্জুনও শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। তাই কেউ যদি যোগেশ্বর হিসেবেও শ্রীকৃষ্ণকে মান্য করে তাতেও দোষ নাই।

গীতা ১১/৪

মন্যসে যদি তচ্ছক্যং ময়া দ্রষ্টুমিতি প্রভো।

যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মানমব্যয়ম্।।

অর্থাৎ হে প্রভো, যদি তুমি মনে কর যে আমি সেই রূপ দর্শনের যোগ্য, তাহলে হে যোগেশ্বর, আমাকে তোমার সেই অক্ষয় আত্মরূপ প্রদর্শন করাও।

উল্লেখ্য যে কোন সিদ্ধ যোগী তার আত্মরূপ এর দ্বারা এরূপ বিশ্বরূপ দেখাতেও সক্ষম। কারণ ব্রহ্মনির্বাণপ্রাপ্ত যোগী স্বয়ং ব্রহ্মই হয়ে যান।

এবার আসি পরমাত্মা প্রসংগে। শ্রীকৃষ্ণকে পরমাত্মা সম্বোধন করা যাবে কিনা?

উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।

পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ।। (গীতা ১৩/২২)

অর্থাৎ এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলেও উক্ত হন।

ব্ররহদারণ্যক ৪-৪-৫ বলছে-

অয়মাত্মা ব্রহ্ম (আত্মাই ব্রহ্ম)

এছাড়াও মহর্ষি ব্যাস তার ব্রহ্মসূত্রে বলেছেন জীব আত্মাকে যথার্থরূপে জানলে তিনি পরমাত্মাই হন।

আত্মা, প্রকরণাৎ (ব্রহ্ম সূত্র ৪-৪-৩)

তিনি পরমাত্মা, কারণ ইহা প্রকরণ এর আলোচ্য বিষয় হতে বুঝা যায়।

অবিভাগেন, দৃষ্টত্বাৎ (ব্রহ্ম সূত্র ৪-৪-৪)

মুক্ত অবস্থায় জীব ব্রহ্মের সহিত অভিন্নভাবে বর্তমান থাকে। অর্থাৎ মুক্ত জীব ও পরমাত্মা একই। কারণ শাস্ত্রে আছে তত্ত্বমসি। ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মই হয়ে যান৷ অর্থাৎ যিনি পরমাত্মাকে জানেন তিনিই পরমাত্মা। এই অবস্থায় পরমাত্মার ন্যায় মুক্ত পুরুষ সর্বভুতে সমদর্শী হন। এবং সমস্ত ব্রহ্মান্ড নিজের হতে অভেদ দর্শন করেন।

পরম পুরুষ শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী মুক্তি লাভ এর পর বলেছিন-

আমার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আমি নিত্য, শুদ্ধ, মুক্ত। আমিই গীতায় বর্ণিত পরমাত্মা।

সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ আত্মতত্ত্ব অবগত ছিলেন এবং তিনিই পরমাত্মা ইহাতে সন্দেহ নাই। কারণ এরূপ পুরুষ ও পরমাত্মাতে কোন ভেদ দর্শিত হয় না।

আত্মানং চেদ্ বিজানীয়াদয়মস্মীতি পূরুষঃ

কেহ পরমাত্মাকে ‘আমিই ইনি (পরমাত্মা)’ এই রূপে জানেন। (বৃঃউপঃ ৪-৪-১২)

যিনি এইভাবে নিজেকে পরমাত্মা জানেন তিনি বিশ্বের কর্তা; কারণ তিনিই সকলের কর্তা, সকলেই তাঁহার আত্মা এবং তিনিই সকলের আত্মা। (বৃঃউপঃ ৪-৪-১৩)

গীতা ১১/৪১-৪৪ অর্জুন বলছেন-

তোমার এই বিশ্বরূপ এবং ঐশ্বর্যমহিমা না জেনে তোমাকে সখা ভেবে অজ্ঞানবশতঃ বা প্রণয়বশতঃ “হে কৃষ্ণ, হে যাদব, হে সখা”, এইরূপ তোমায় বলেছি; হে অচ্যুত, আহার, বিহার, শয়ন ও উপবেশনকালে একা অথবা বন্ধুজনসমক্ষে পরিহাসচ্ছলে তোমার কত অমর্যাদা করেছি; অচিন্ত্যপ্রভাব তুমি, তোমার নিকট তজ্জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

হে অমিতপ্রভাব, তুমি এই চরাচর সমস্ত লোকের পিতা, তুমি পূজ্য, গুরু ও গুরু হতে গুরুতর; ত্রিজগতে তোমার তুল্য কেহ নাই, তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ থাকবে কি প্রকারে?

হে দেব, পূর্বোক্তরূপে আমি অপরাধী, সেই হেতু দণ্ডবৎ প্রণাম পূর্বক তোমার প্রসাদ প্রার্থনা করছি। সকলের বন্দনীয় ঈশ্বর তুমি; পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, তুমিও তদ্রুপ আমার অপরাধ ক্ষমা কর।

★এক এক করে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বেদান্ত সিদ্ধান্ত সিদ্ধ হওয়ায় আমি শ্রীকৃষ্ণকে উপাস্য রূপে মান্য করছি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভক্ত অবশ্যই ভজনা করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণ তথা পরমাত্মার প্রতি শরণাগতিই জীবের পরমগতি। সমস্ত কিছু শ্রীকৃষ্ণে বা গোবিন্দে সমর্পণ করে কর্ম করাই প্রকৃত ভক্তের চিত্ত শুদ্ধির অন্যতম উপায়। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এর প্রকৃতি পরিচয় দেহধারী কৃষ্ণ নয়। কারণ যিনি মুক্ত ও পারমার্থিক সত্য তিনি কোন দেহের অধীন নন। পরমাত্মাকে দেহধারী মনে করে সেই দেহরূপ কৃষ্ণকে একমাত্র ঈশ্বর বা কারণ মনে করা বেদান্ত সম্মত নয়।

কারণ শ্রীকৃষ্ণ নিজেই গীতায় বলেছেন –

অব্যক্তং ব্যাক্তিমাপন্নং মন্যস্তে মামবুদ্ধয়ঃ।

পরং ভাবমজানস্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্।। (গীতা ৭/২৪)

অর্থাৎ অল্পবুদ্ধি ব্যাক্তিগণ আমার নিত্য, অব্যাক্ত, সর্বোৎকৃষ্ট পরম স্বরূপ না জানায় অব্যাক্ত আমাকে প্রাকৃত মনুষ্যবৎ ব্যাক্তিভাবাপন্ন মনে করে।

বেদান্ত ইহাই স্বীকার করে যে ব্রহ্ম এর নির্গুণ ও অব্যাক্ত অবস্থা নিত্য। কোন মনুষ্য দেহধারীকে বেদান্ত মায়া দ্বারা আখ্যায়িত করেন। সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ এর মনুষ্য দেহের নয় বরং সেই নির্গুণ পরমাত্মাকে চৈতন্য রূপে আরাধনা করাই বুদ্ধিমান এর কাজ। যারা কৃষ্ণকে দেহধারী মনে করে সেই মায়াময় দেহেরূপ এর ভজনা করে তারা মুর্খ এবং পরমেশ্বর এর পরম ভাব তাদের জ্ঞাত হয় না।

ওঁ গোবিন্দায় নমঃ

ভজ গোবিন্দং ভজ গোবিন্দং, গোবিন্দং ভজ মূঢ়্মতে।

সম্প্রাপ্তে সন্নিহিতকালে মরণে, নাহি নাহি রক্ষতি ডুকৃঞকরণে

সমুদ্রপুত্র রাজা গৌড় গোবিন্দ ও শ্রীহট্ট

  সিলেটের   ‎ গৌড় গোবিন্দ এবং আজকের   ‎ শাহজালাল বিভিন্ন তথ্যপঞ্জী এবং পরবর্তিতে আবিষ্কৃত তাম্রফলক ও শিলালিপি থেকে সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস স...

Popular Posts