Sunday, June 8, 2025

শিবতত্ত্বে সৃষ্টি, সংহার ও রক্ষা – শ্রীকণ্ঠ ও পুরাণসমূহের আলোক

শৈব দর্শনে শিব কেবল একজন উপাস্য দেবতা নন—তিনি নিজেই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পরম ব্রহ্ম। তিনিই এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূল কেন্দ্র। শ্রীকণ্ঠাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে একথাই প্রমাণ করেন এবং পুরাণসমূহও এই তত্ত্বকে পূর্ণ সমর্থন দেয়। এই প্রবন্ধে আমরা শৈব দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্ব, সংহারতত্ত্ব ও রক্ষাতত্ত্বের এক গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরব।

✦ শিব: কারণ ও কার্য উভয়ের আধার

◼ শ্রীকণ্ঠাচার্যের অভিমত

ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে (১.১.২) শ্রীকণ্ঠাচার্য বলেন:

"জগতকারণং শম্ভুরেভ"
(এই জগতের একমাত্র কারণ শম্ভু বা শিব।)

এই একটি বাক্যই শৈব দর্শনের মূলমন্ত্র—শিব কেবল কার্যকারণ নন, তিনিই উপাদান কারণ, নিমিত্ত কারণ এবং উপনির্মাতা। তিনি ছাড়া আর কেউ সৃষ্টির মালিক হতে পারে না।

◼ ব্যাখ্যা

শ্রীকণ্ঠ বলেন, শিব আত্মতত্ত্ব, বস্তুতত্ত্ব ও চেতনাতত্ত্ব—এই তিন ক্ষেত্রেই সর্বত্র বিস্তৃত। ত্রিমূর্তিতত্ত্বকে তিনি অব্যক্ত, ব্যক্ত এবং প্রব্যক্ত এই তিন অভিব্যক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চান।

✦ পুরাণসমূহে শিবের ত্র্যর্থরূপ

◼ লিঙ্গ পুরাণ (১.৬৯.৬৪)

“শিবাত্ প্রজাস্রষ্টা ব্রহ্মা, শিবাত্ পালনহরি:।
শিবাত্ সংহারকারী রুদ্রঃ, শিব: সর্বং প্রপঞ্চতে॥”

বাংলা অনুবাদ:
“শিব হতেই সৃষ্টি করেন ব্রহ্মা, শিব হতেই পালন করেন হরি, শিব হতেই সংহার করেন রুদ্র। শিবই সর্বভৌতিক জগতের মূল।”

এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, তিন দেবতা আসলে তিনটি কার্যরূপ মাত্র, মূলতত্ত্ব হলেন এক ও অদ্বিতীয় শিব।

◼ শিবপুরাণ: সর্বেশ্বরতত্ত্ব

শিবপুরাণে বলা হয়েছে:

"ন ত্বদ্ব্যতিতমস্ত্যন্যৎ, জগতঃ কারণং পরম্।"
(তোমার বাইরে এই জগতের আর কোনো কারণ নেই।)

এখানে শিবকে তত্ত্বগত “সর্বেশ্বর” হিসেবে দেখানো হয়েছে—তিনিই অনাদি ও অনন্ত, চৈতন্য ও স্থিতির উৎস।

AI created 


✦ ঈশ্বর গীতায় শিবতত্ত্বের আত্মপ্রকাশ

ঈশ্বর গীতা, যা কূর্ম পুরাণের অন্তর্গত, তাতে শিব নিজেই নিজের সর্বজ্ঞ ও সর্বব্যাপক রূপ তুলে ধরেন:

“অহং বিশ্বস্য কারণং, সৃষ্টিস্থিতিলয়ক্রিয়াঃ।
মম দ্বারা প্রসরন্তি, না অন্যঃ কারণমুচ্যতে॥”

অনুবাদ:
"আমি বিশ্বজগতের কারণ। সৃষ্টি, রক্ষা ও সংহার—এই কর্মসমূহ আমার দ্বারাই ঘটে; অন্য কোন কারণ নেই।"

এই শ্লোকটির ভাষ্য অনুসারে, শিবের ইচ্ছা বা ‘সঙ্কল্প’ থেকেই সৃষ্টি হয়, এবং তাঁর ‘নিশ্চয়’ থেকেই সংহার সংঘটিত হয়।

✦ শিবসূত্র: অভ্যন্তরীণ সৃষ্টি ও লয়ের ব্যাখ্যা

শিবসূত্রে (১.১):

“চিত্তং মন্ত্রঃ”
(“চৈতন্যই মন্ত্র।”)

শিবসূত্র (৩.১):

“জ্ঞানং বন্ধঃ।”
(“জ্ঞানই বন্ধন, যদি তা মুক্তিচেতনায় অভিজ্ঞ না হয়।”)

এখানে ‘সৃষ্টি’ বলা হয়েছে চেতনার অঙ্কুরোদ্গম, ‘সংহার’ বলা হয়েছে চেতনার নির্লিপ্ত অবস্থা, এবং ‘স্থিতি’ হচ্ছে ধারাবাহিক সত্তার অভিজ্ঞান।

✦ উপনিষদীয় আলোকে: গণপতি অথর্বশীর 

গণপতি অথর্বশীর উপনিষদে বলা হয়েছে:

“ত্বং ভূমিরাপোऽনলোনিলোনাভঃ।
ত্বং চত্বারী বাক্ পদানি॥”

অনুবাদ:
“তুমি ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—তুমি বাণীর চার রূপ।”

এখানে শিবরূপ গনেশকে বলা হয়েছে উপাদান ও উপনির্মাতা—এবং ভাষা বা শব্দতত্ত্বের উৎস।

✦ শৈব ত্র্যর্থতত্ত্ব বনাম ত্রিমূর্তি দর্শন

প্রচলিত ত্রিমূর্তি:

  • ব্রহ্মা – সৃষ্টি

  • বিষ্ণু – রক্ষা

  • রুদ্র – সংহার

শৈব বিকল্প:

এই তিন রূপই আসলে একক পরমতত্ত্ব শিব–এর তিনটি গুণপ্রকাশ (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ)। তাই তিনজন আলাদা ঈশ্বর নন, বরং এক শিব তিনভাবে প্রকাশমান।

লিঙ্গপুরাণে বলা হয়:
“ত্রিধা ভবতি শম্ভু:—ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও ঈশ্বর।”

✦ সৃষ্টি, রক্ষা ও সংহার: দার্শনিক ব্যাখ্যা

সৃষ্টি:

শিবের “ইচ্ছা শক্তি” (ইচ্ছে), “জ্ঞান শক্তি” (জ্ঞাতা) ও “ক্রিয়া শক্তি” (কর্তা)—এই ত্রিশক্তি থেকেই জগতের উৎপত্তি।

রক্ষা:

রক্ষাকর্ম হচ্ছে সেই সৃষ্টির নিয়ম রক্ষা করা। এই ধারাবাহিকতার জন্য শিব স্বয়ং নিজেকে ‘ধর্ম’ বলে ঘোষণা দেন ঈশ্বর গীতায়।

সংহার:

সংহার মানে ধ্বংস নয়, বরং মূলত্বে প্রত্যাবর্তন। সব সৃষ্টি যখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠে তখন তা তার উৎসে মিলিয়ে যায়—এই ধারণাই হল সংহারতত্ত্ব।

✦ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ: আত্মসৃষ্টি ও আত্মসংহার

মানব চেতনায় এই তিনটি কর্ম প্রতিফলিত হয়:

  • সৃষ্টি – জ্ঞান ও ধারণার উদ্ভব

  • রক্ষা – চর্চা ও অভ্যাস

  • সংহার – অহংকার ও ভ্রান্ত ধারণার বিলয়

এই প্রসঙ্গে শিবরূপ হলেন আত্মজ্ঞান, সত্ত্ব ও নির্গুণতত্ত্বের পূর্ণ প্রতীক

✦ উপসংহার

শিব কেবল সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবতা নন—তিনিই সৃষ্টি, তিনিই ধ্বংস, তিনিই ধ্রুবতা।
তিনি কোনো নির্দিষ্ট কালের বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঈশ্বর নন—তিনি হলেন সর্বজনীন চেতনা
শিবতত্ত্বের এই সৃষ্টি-স্থিতি-লয় চক্র শুধু পৌরাণিক আখ্যান নয়, বরং সমগ্র জীবনচক্র, জ্ঞানচক্র ও চৈতন্যচক্রের চিত্র

রেফারেন্স তালিকা:

  1. ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য – শ্রীকণ্ঠাচার্য (১.১.২, ২.১.১৪)

  2. লিঙ্গপুরাণ – অধ্যায় ১, ৬৯, ৭৫

  3. শিবপুরাণ – বিদ্যেশ্বর সংহিতা

  4. গণপতি অথর্বশীর্ষ উপনিষদ – শ্লোক ৫, ৮

  5. শিবসূত্র – সূত্র ১.১, ৩.১, ৩.৫

  6. ঈশ্বরগীতা – অধ্যায় ১, শ্লোক ১০-১৫

  7. স্কন্ধপুরাণ – কৈলাসখণ্ড, শিবগীতা অংশ

  8. দর্শন ও চৈতন্যতত্ত্ব – স্বামী চিন্ময়ানন্দের পাঠ্যভাষ্য

  9. Modern Physics & Advaita Comparison – Dr. Kapil Kapoor

শিবতত্ত্বে সৃষ্টি, সংহার ও রক্ষা – শ্রীকণ্ঠ ও পুরাণসমূহের আলোক

শৈব দর্শনে শিব কেবল একজন উপাস্য দেবতা নন—তিনি নিজেই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পরম ব্রহ্ম । তিনিই এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূল কেন্দ্র...

Popular Posts