শিবলিঙ্গ
নিয়ে সাধারণ মানুষের একটা ধারণা আছে যে এইটি ভগবান শিবের জননাঙ্গ
লিঙ্গ শব্দের
অর্থ সংস্কৃতে ‘চিহ্ন
বা প্রতীক’। ব্যাকরণ বইয়ে নিশ্চয়
সবাই লিঙ্গ বিষয়টা পড়েছ যা স্ত্রী বা পুরুষ বুঝায়। কিন্তু তোমরা লিঙ্গ দিয়ে যে
জননাঙ্গ বুঝাও তা যদি বলি তাহলে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটা কোথা থেকে আসলো? তাহলে
কি স্ত্রীরও কি লিঙ্গ আছে?
“না,
নেই।” তাই না? তাহলে বাংলা বা হিন্দিতে
যে ব্যাকরণগুলো লেখা হয়েছে তাতে লিঙ্গ শব্দটা কেন এই বিষয়ে প্রয়োগ হয়েছে?
ব্যবহার
হওয়ার কারণ এই যে, এগুলো এখন পর্যন্ত সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরনের উপর নির্ভরশীল। সংস্কৃতে
প্রত্যেক শব্দ সুগঠিত। এতে প্রত্যেক শব্দের মূল শব্দ বা ধাতু, প্রত্যয় এবং বিভক্তিআদিতে ভাগ করা যায়। এতে লিঙ্গ শব্দ বলতে বুঝানো
হয়েছে সেই সব চিহ্নকে অর্থাৎ প্রত্যয়কে বা প্রত্যয়যুক্ত শব্দকে যা স্ত্রী বা পুরুষ
চিহ্নিত করে।
এই
থেকে তো এইটুকু প্রমাণিত হলো যে লিঙ্গ শব্দটা কোন জননাঙ্গকে বুঝায় না।
তাহলে
লিঙ্গটা কি? কেনই বা এর পূজা করা হয়?
হিন্দুদের
ইতিহাস লেখা এমন অনেকগুলো বই আছে যেগুলো ‘পুরাণ’ নামে প্রসিদ্ধ। তার মধ্যে ১৮টি
পুরাণ অতি প্রাচীন। ওই অষ্টাদশ মহাপুরাণের মধ্যে অন্যতম ‘লিঙ্গপুরাণ’, যাতে
লেখা আছে লিঙ্গের রহস্য ও এর তথ্যাবলি।
লিঙ্গ
পুরাণে দুই প্রকার শিবের বিষয় লিখিত আছে– অলিঙ্গ ও লিঙ্গ। যেমন–
জগদ্যোনি
মহাভূতং স্থূলং সূক্ষ্মমজং বিভূম্ ।
বিগ্রহং
জগতাং লিঙ্গং অলিঙ্গাদভবত্ স্বয়ম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ তৃতীয় অধ্যায়)
অর্থাৎ
: স্থূল, সূক্ষ্ম, জন্ম-রহিত ও সর্ব-ব্যাপী
মহাভূত-স্বরূপ লিঙ্গ শিব জগতের কারণ ও বিশ্ব-রূপ। তিনি অলিঙ্গ-শিব হইতে উৎপন্ন
হইয়াছেন।
অন্যদিকে
বিদ্যেশ্বর সংহিতার মতে–
শিব
একো ব্রহ্মরূপত্বান্নিষ্কলঃ পরিকীর্তিতঃ।
রূপিত্বাৎ
সকল স্তদ্বৎ তস্মাৎ সকল নিষ্কলঃ।।
নিষ্কলত্বান্নিরাকারং
লিঙ্গং তস্য সমাগতম্ ।
সকলত্বাৎ
তথা রেবং সাকারং তস্য সঙ্গতম্ ।। (বিদ্যেশ্বর-সংহিতা)
অর্থাৎ
: ব্রহ্ম যেমন নির্গুণ ও সগুণ দুই প্রকারই হন, তেমনি নিষ্কল শিব নিরাকার
লিঙ্গরূপী এবং সগুণ শিব সাকার রূপধারী।
লী’
ধাতুর অর্থ লয় পাওয়া এবং ‘গম’ ধাতুর অর্থ বহির্গত হওয়া। কৌলজ্ঞাননির্ণয়ে তাই বলা
হয়েছে–
যস্যেচ্ছয়া
ভবেৎ সৃষ্টির্লয়স্তত্রৈব গচ্ছতি।
তেন
লিঙ্গন্তু বিখ্যাতং যত্র লীনং চরাচরম্ ।।’ (কৌলজ্ঞাননির্ণয়-৩/১০)
অর্থাৎ
: যে পরম সত্তার থেকে জগতের উৎপত্তি হয় এবং যাঁর মধ্যে জগৎ লীন হয় সেই পরম কারণই
লিঙ্গ।
স্কন্দপুরাণেও
প্রায় একইরূপ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়–
আকাশং
লিঙ্গমিত্যাহুঃ পৃথিবী তস্য পীঠিকা।
আলয়ঃ
সর্বদেবানাং লয়নাল্লিঙ্গমুচ্যতে।।
শিবপুরাণের
বায়বীয় সংহিতার মতে–
লিঙ্গঞ্চ
শিবয়োর্দেহস্তাভ্যাং যস্মাদধিষ্টিতং। (বা. স. উত্তরভাগ- ২৭/১২)
অর্থাৎ
: শিবশক্তি লিঙ্গেতে নিত্য অধিষ্ঠান করেন।
লিঙ্গপুরাণ, শিবপুরাণ
ও স্কন্দপুরাণেই শিব ও শিবলিঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হওয়া যায়। পুরাণের
স্বাভাবিক ধারা অনুসারে লিঙ্গপুরাণে বিভিন্ন প্রকার শিবমূর্তির বর্ণনা এলেও এবং
সেই সব মূর্তির পূজাদির কথা বলা হলেও লিঙ্গার্চনার উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে বেশি।
শিবের লিঙ্গমূর্তির পূজা না করার জন্যই যে তারকাসুরের ধ্বংস হয়েছিল সেকথা জানিয়ে
পিতামহ ব্রহ্মা অতঃপর বলছেন–
পূজনীয়ঃ
শিবো নিত্যং শ্রদ্ধয়া দেবপুঙ্গবৈঃ।
সর্বলিঙ্গময়ো
লোকঃ সর্বং লিঙ্গে প্রতিষ্ঠিতম্ ।।
তস্মাত্সম্পূজয়েল্লিঙ্গং
যইচ্ছেৎ সিদ্ধিমাত্মনঃ।
সর্বে
লিঙ্গার্চনাদেব দেবাদৈত্যাশ্চদানবাঃ।।
যক্ষা
বিদ্যাধরাঃ সিদ্ধা রাক্ষসাঃ পিশিতাশনাঃ।
পিতরো
মুনয়শ্চাপি পিশাচাঃ কিন্নরাদয়ঃ।।
অর্চয়িত্বালিঙ্গমূর্তিং
সংসিদ্ধানাত্র সংশয়ঃ।
তস্মাল্লিঙ্গং
যজেন্নিত্যং যেনকেনাপিবা সুরাঃ।। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৩/৬-৯)
অর্থাৎ
: যে নিজের অভিষ্ট সিদ্ধি করতে চায়, সে লিঙ্গ পূজা করবে। কারণ সমস্ত জগৎ
লিঙ্গাধীন এবং লিঙ্গে সমগ্র জগৎ অধিষ্ঠিত। দেব, দৈত্য,
দানব, যক্ষ, বিদ্যাধর,
সিদ্ধ, রাক্ষস, পিতৃপুরুষগণ, মুনি, কিন্নর
সকলেই লিঙ্গমূর্তি মহাদেবকে পূজো করে সিদ্ধ হবে। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ
নেই।
ওই
পুরাণের তৃতীয় অধ্যায়ের একেবারে প্রথমেই এই লিঙ্গের বর্ণনা আছে
এইভাবে-
“জ্ঞানীগণ
নির্গুণ ব্রহ্মকেই লিঙ্গ বলে। মহাদেব সেই নির্গুণ ব্রহ্ম, তার থেকেই অব্যক্ত আবির্ভূত হয়েছে। শ্রেষ্ঠ লিঙ্গ প্রধান ও প্রকৃতি
নামে প্রসিদ্ধ। রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শব্দ বর্জিত পরমেশ্বর শিবই অলিঙ্গ(চিহ্নহীন)।
আবার তিনি নিজেই পঞ্চভূত(জল-তরলের
প্রতীক, বায়ু-বায়বীয় পদার্থের প্রতীক, পৃথিবী-কঠিন পদার্থের প্রতীক,অগ্নি-শক্তির
প্রতীক, আকাশ- অন্তরীক্ষ, শূন্য
ও স্থানের প্রতীক ), পঞ্চতন্মাত্র(রূপ,
রস, গন্ধ, স্পর্শ
ও শব্দ) সকল গুণ ভূষিত লিঙ্গ রূপ উৎপন্ন হয়েছেন। এবং তার থেকেই সৃষ্টির কারণ
শিবস্বরূপ প্রধান দেবত্রয়(সৃষ্টিকর্তা-ব্রহ্মা, পালনকর্তা-বিষ্ণু
ও সংহারকর্তা-শিব) আবির্ভূত হয়েছেন।”
এবার
দেখা যাক বেদ কি বলে-
“সর্বপ্রথম
কিছুই ছিল না, একেবারে কিছুই না। একমাত্র পরমেশ্বর ছিলেন
আত্মারূপে, চিহ্ন বর্জিত। তার মধ্যে ইচ্ছার(সংস্কৃতে
কাম/কামনা) সৃষ্টি এবং তা হতে সকল কিছুর সৃষ্টি।“
(ঋগ্বেদ মণ্ডল-১০, সুক্ত-১২৯ - নাসদীয়
সুক্তম্)
অর্থাৎ
প্রথমে সবকিছু একস্থানে ঘনীভূত ছিল যা হতে সব উৎপন্ন হয়েছে। এবং এই জিনিসটিকেই
ঈশ্বরের প্রথম চিহ্ন ধরা হয় যাকে লিঙ্গ বলে, যা স্বয়ং ‘স্রষ্টা ও সৃষ্টি’।
(যোগশিখা উপনিষদ)
বেদের
একই সুক্তে বলা হয়েছে,
"এবার সেই কারণ সলিল নির্মিত পিণ্ড উপরে ও নিচে উঠতে লাগলো।
আর মধ্যেও তার বিস্তার হতে থাকে। এই স্তম্ভকেই বলে লিঙ্গ।"
কেবল
সেখানেই নয়, লিঙ্গপুরাণের লিঙ্গোদ্ভব অধ্যায়েও
তাই বলা হয়েছে।
লিঙ্গের
আকৃতি দেখলে আসা করি শুধু একটা উপবৃত্তাকার-স্থম্ভ দেখবে না! তার সঙ্গে নিচে বেদী
আকৃতির একটি অংশ ও দেখবে। এটি আবার কি? মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগবে। তাহলে সেই
উত্তরের সমাধান নিশ্চয়ই আছে। আর এর উত্তর সর্বদা লিঙ্গের পাশে বিদ্যমান থাকে।
সমগ্র
শিবলিঙ্গের আকৃতির তিন ভাগ আছে। যদি শিবলিঙ্গ দেখে থাকো তাহলে নিশ্চয়ই দেখবে তার
পাশে ত্রিশূল বসানো। তার তিনটি শূল তিন গুণের প্রতীক, যথা-
১।
সত্ত্ব,
২। রজ,
৩। তম
এই
তিন গুণ সৃষ্টির তিন কারণকে (সৃষ্টিকর্তা- ব্রহ্মা, পালনকর্তা- বিষ্ণু ও
সংহারকর্তা- শিব) বুঝায়। আর এই তিন প্রধান দেবতা নিচ থেকে সম্পূর্ণ লিঙ্গটা সৃষ্টি
করে এই ভাবে-
১।
সবার নিচের অংশ বা ভুমি ভাগ-
এই
ভাগ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার অংশ। এটি আমাদের বুঝায় সব কিছুর মুলেই সৃষ্টিকর্তা
বিদ্যমান। আর সবকিছুর সাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন শান্তিময় স্থান এটি। অর্থাৎ ঈশ্বরের
ছত্রতলেই জগতের সব শান্তি।
২।
পীঠ বা মধ্য ভাগ-
এটা
সেই অংশ যাতে পালনকর্তা বিষ্ণু অবস্থান করে। এই অংশ বুঝায় বিষ্ণু নিজে আমাদের ধারণ
করেছেন তার মধ্যে এবং সুরক্ষা দিচ্ছেন। এইটি রজগুণকে বুঝায় যা সত্ত্ব আর তমের
মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। আবার এই অংশ বিষ্ণুর বৈশিষ্ট্যকেও বোঝায়। বিষ্ণু মোক্ষ
দানে সহায়তা করে, যা শিব লিঙ্গে ঢালা জলের মধ্যে প্রকাশ পায়। জল যা জীবনের প্রতীক তা
জগতে ঈশ্বরের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতিতে এসে আবার বিলীন হয়ে যায়।
এই
দুই ভাগকে মিলে আবার প্রকৃতি ভাগও বলে, যা পুরুষ বা পরমাত্মাকে ধারণ করে।
জগতমাতা দুর্গা এই প্রকৃতি। বিশেষ উল্লেখ্য এই যে শিব বেদে রুদ্র বলে বর্ণিত যে
সর্বদা শান্ত থাকে শম্ভু রূপে যা শক্তি অর্থাৎ দেবী দুর্গার কারণে। লিঙ্গের এই অংশ
তাই তিনি বিরাজ করেন। আর শিবের যে বিগ্রহগুলো থাকে তার বেশিরভাগই রুদ্র মূর্তি যা
সংহারের ইঙ্গিত করে। তাই যুদ্ধ ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই শিবকে লিঙ্গে পূজা করা হয়।
৩।
সর্বোপরি রুদ্র ভাগ-
এই
অংশ মূল লিঙ্গকে বলে। একে পূজা ভাগও বলে। এতে পুরুষ(বেদে বর্ণিত পরমাত্মা, বা
ঈশ্বর) বা শিব অবস্থান করে। যা সর্বশক্তির উৎস ও কেন্দ্র। লিঙ্গপুরাণের
পূর্বভাগের অধ্যায়-১৭ তে এর বর্ণনা দেওয়া আছে এইভাবে যে শিব নিজে এই ভাগে ধ্যান
অবস্থায় আছেন। যা হতে তিনি প্রথম আবির্ভূত হয়েছেন। অথর্ববেদের দশম
কাণ্ডে তো সুস্পষ্ট ভাবে স্তম্ভের মধ্যে পরমেশ্বরের আরাধনার কথা লেখা আছে।
এই
লিঙ্গ যে শুধু সৃষ্টি স্থিতি আর লয় বা পুরুষ ও প্রকৃতির কিম্বা পরমেশ্বরের কথা বলে
তাই না। এটি আমাদের আত্মাকে ও জ্ঞানকে জাগ্রত করে। কিভাবে?
এভাবে- ইরা, পিঙ্গলা আর সুষুম্না। যদি কেউ
যোগশাস্ত্র(অনেকে যাকে ইয়োগা বলে চিনো সেই বিষয়টা) পড়ে থাকো তাহলে এই তিনটা শব্দ
নিশ্চয়ই শুনে থাকবে। ইরা আর পিঙ্গলাকে নদী বলে যা প্রাণীর দেহে প্রবাহিত হয়। মূলত
এগুলো দেহের স্নায়ু তন্ত্রের দুইভাগকে বুঝায়, যা দুটি সাপ দিয়ে দেখানো হয়। আর
সুষুম্না হলো মেরুদণ্ডে অবস্থিত মধ্য সুষুম্না। যোগশাস্ত্র মতে, এই সুষুম্নার মধ্যে সাতটি চক্র আছে, যা আমাদের
জীবনের সঞ্চালক শক্তি। এগুলো যদি সম্পূর্ণ রূপে সক্রিয় হয় তাহলে মানুষ আধাত্মিক ও
আত্মিক ভাবে জাগ্রত হবে, শান্তি এবং আনন্দ অনুভব করবে,
বুদ্ধি বৃদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক ভাবে সংযোগ বৃদ্ধিসহ আরও অনেক লাভ
পাবে। আর শিবলিঙ্গ এর সম্পূর্ণ জাগ্রত প্রতীক। কিভাবে?
মূল
লিঙ্গের ভেতরে সক্রিয় সাতটি চক্র বিদ্যমান এবং শিবলিঙ্গে সাপ দেখবে যা কুণ্ডলিনী
চক্রের মতো সাড়ে তিন প্যাঁচ দিয়ে উপরে উঠে। এবং এই শক্তি আমাদের মন স্থির করতে
সাহায্য করে, তাই এটি আমাদের আধ্যাত্মিক ভাবে জাগ্রত এবং মানসিক ভাবে শান্ত করে।
বিশ্বাস হচ্ছে না?
এটার
প্রমান আমি দিবো না, তুমি নিজেই একটা নিস্তব্ধ শিব মন্দিরের গর্ভগৃহের(মন্দিরের সেই ঘর যাতে
দেবতা থাকে) সামনে যাও, কোন কিছু করতে হবে না, না তাকে নমস্কার করতে হবে, না পূজা করতে হবে,
শুধু চুপ করে একবার শান্ত হয়ে লিঙ্গটির দিকে দেখ আর চোখ বন্ধ করে
আশেপাশের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করো। নিজেই বুঝতে পারবে এর তাৎপর্য।শেষ একটা উদাহরণ
দিতে গেলে দেখা যায় ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়, কারণ জগতপালক
শ্রীবিষ্ণু নিজেই একবার মানবকূল রক্ষা করতে একটা স্থম্ভ হতে আবির্ভূত হয়েছিলেন দেব
নৃসিংহ রূপে। যা বিষ্ণু আর শিবকে দুইজন হয়েও এক করে দেয়।
(নৃসিংহ পুরাণ)
“সাকার হয়েও নিরাকার এই শিবলিঙ্গ আবার
নিরাকার হয়েও সাকার।” কারণ-
শিব
সাকার কিন্তু লিঙ্গের মধ্যে তার আকার নেই, কিন্তু পরমেশ্বর নিরাকার কিন্তু
লিঙ্গে তিনি লিঙ্গ আকৃতিতে অবস্থিত। এবং এই জন্যই সকল প্রকার আরাধনাই এই শিবলিঙ্গে
সম্ভব, যা একই সঙ্গে সাকার ও নিরাকার এবং সমগ্র জগতের প্রাণ
কেন্দ্র।আবার এর আশেপাশে থাকা সবকিছুই জ্ঞানের প্রতীক। ত্রিশূল যেমন
আমাদের সৃষ্টির তিন কারণ যা এক পরমেশ্বর বুঝায়, তেমনি তার প্রক্রিয়াও বুঝায়।
যা তার তিন শূল থেকে ঝুলতে থাকা ডমরু হিসাবে থাকে। এইভাবে- তিন ঈশ্বর এক হয় যখন
তখন এক মহাজাগতিক কম্পন বা নাদ সৃষ্টি করে যা হতে সবকিছুর সৃষ্টি। এর গায়ে আঁকা হয়
মঙ্গল-তিলক যা ত্রিপুণ্ড্র নামে পরিচিত তা ঈশ্বরের
সৃষ্টির তিন লোক(স্বর্গ মর্ত আর পাতাল) বুঝায়।
১৯০০ সালে প্যারিসে
ধর্মীয় আলোচনায় রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, "শিবলিঙ্গ
ধারণাটি এসেছে অথর্ববেদ সংহিতা গ্রন্থে যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ নামে একপ্রকার বলিদান
স্তম্ভের স্তোত্র থেকে, কারণ এখানেই প্রথম শিবলিঙ্গ পূজার
কথা জানা যায়। এই স্তোত্রে আদি ও অন্তহীন এক স্তম্ভ বা স্কম্ভ-এর বর্ণনা পাওয়া
যায়। এই স্তম্ভটি চিরন্তন ব্রহ্মের স্থলে স্থাপিত। যজ্ঞের আগুন, ধোঁয়া, ছাই, সোম লতা
এবং যজ্ঞকাষ্ঠবাহী ষাঁড়ের ধারণাটির থেকে শিবের উজ্জ্বল দেহ, তাঁর জটাজাল, নীলকণ্ঠ ও বাহন বৃষের একটি ধারণা
পাওয়া যায়। তাই মনে করা হয়, উক্ত যূপস্তম্ভই কালক্রমে
শিবলিঙ্গের রূপ ধারণ করেছে। লিঙ্গপুরাণ গ্রন্থে এই স্তোত্রটিই উপাখ্যানের আকারে বিবৃত
হয়েছে। এই উপাখ্যানেই কীর্তিত হয়েছে সেই মহাস্তম্ভ ও মহাদেব রূপে শিবের
মাহাত্ম্য"।
জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ গুস্তাভ ওপার্ট শালগ্রাম শিলা ও
শিবলিঙ্গের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রে এগুলিকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে
সৃষ্ট প্রতীক বলে উল্লেখ করলে তারই প্রতিক্রিয়ায় স্বামী বিবেকানন্দ এই কথাগুলো
বলেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, শালগ্রাম শিলাকে
পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গ বলাটা এক কাল্পনিক আবিষ্কার মাত্র। তিনি আরও বলেছিলেন,
শিবলিঙ্গের সঙ্গে পুরুষাঙ্গের তুলনা বৌদ্ধধর্মের পতনের পর বিদেশ
হতে আগত ভারতের অন্ধকার যুগে কিছু অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি ও শাসকের মস্তিস্কপ্রসূত
উদ্ভট বানোয়াট গল্প।
শ্রী স্বামী শিবানন্দও
শিবলিঙ্গকে যৌনাঙ্গের প্রতীক বলে স্বীকার করেননি। ঔপন্যাসিক ক্রিস্টোফার ইসারউড
লিঙ্গকে যৌন প্রতীক মানতে চাননি। ১৮৪০ সালে এইচ. এইচ. উইলসনও এই একই কথা বলেছিলেন।
ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়ায় "Lingam/Lingham"
ভুক্তিতেও শিবলিঙ্গকে যৌন প্রতীক বলা হয়নি। যদিও অধ্যাপক ডনিগার
পরবর্তীকালে তাঁর দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি বইতে নিজের বক্তব্য
পরিষ্কার করে লিখেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো কোনো
ধর্মশাস্ত্রে শিবলিঙ্গকে ঈশ্বরের বিমূর্ত প্রতীক বা দিব্য আলোকস্তম্ভ বলে উল্লেখ
করা হয়েছে। এইসব বইতে লিঙ্গের কোনো যৌন অনুষঙ্গমূলক অর্থ নেই। তাই শিবলিঙ্গ
কোনক্রমেই স্ত্রী-পুরুষের মিলিত অঙ্গ বা পুরুষাঙ্গ নয়।
প্রকৃতপক্ষে শিবলিঙ্গে
এমন এক নিগূঢ় ও অনির্বচনীয় শক্তি আছে,
যা সহজেই ভক্তবৃন্দের ভেতর মহাদেবের প্রতি ভক্তি আরও বেশি
নিবিষ্ট করে। বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে এই ভক্তি ভাব অনুধাবন করা যায়। আর এজন্যই,
শিবলিঙ্গের এমন সুন্দর তাৎপর্য একমাত্র বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী
ও ধর্মচারী ভক্তবৃন্দরাই বুঝতে পারে।
শিবলিঙ্গ সম্পর্কে কিছু উল্টাপাল্টা কথার বিশ্লেষণ-
শিবলিঙ্গ কোন যৌন
ইন্দ্রিয়ের পূজা নয়, কেন
নয় তাই জানুন—
প্রথমেই দেখা যাক লিঙ্গ
শব্দের প্রকৃত অর্থ কি। সংস্কৃত लिङ्गं,(লিঙ্গ); শব্দের অর্থ হলো "প্রতীক" বা চিহ্ন। কিন্তু লিঙ্গ অর্থে
অনেকেই সাধারণত পুরুষের জননেন্দ্রিয় বুঝে থাকে; কিন্তু
এটি একটি মারাত্মক ভুল ধারণা। লিঙ্গ শব্দের অর্থ যদি জননেন্দ্রিয়-ই হয়, তাহলে বাংলা ব্যাকরণে আমরা যে লিঙ্গ নামক অধ্যায় পড়েছিলাম সেটার কি
হবে...?!
আমরা সবাই জানি; লিঙ্গ চার প্রকারের
যথা-পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, উভয়লিঙ্গ,
ক্লীবলিঙ্গ।
এই চার প্রকার লিঙ্গের
কথা আমাদের সবারই মনে আছে। হ্যা,
এখান থেকেই আমাদের বোঝা উচিত; ভাষাগত যে
তথ্যের দ্বারা কোন মানুষকে ও প্রাণীকে পুরুষ বা স্ত্রী প্রজাতি হিসেবে, কিংবা কোন প্রাণহীন জিনিসকে বস্তুগত বিষয় হিসেবে সনাক্ত করা যায় তাই
লিঙ্গ।।
কিন্তু এই বিষয়ে আপনার যদি এখনো সন্দেহ থেকে থাকে তবে MP3
George’s বাংলা বইতে লিঙ্গ নামক অধ্যায় খুলে দেখুন, কারণ এখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে 'লিঙ্গ শব্দের
অর্থ চিহ্ন'।
এবার অন্য যুক্তিতে
আসুন, ছোটবেলায় আমরা সবাইতো
বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ পরিবর্তন শিখেছি..... যেমন ধরুন--- বাবা(পুং
লিঙ্গ)-মা(স্ত্রী লিঙ্গ); বর(পুং লিঙ্গ)-কনে(স্ত্রী
লিঙ্গ); স্বামী(পুং লিঙ্গ)-স্ত্রী(স্ত্রী লিঙ্গ); সিংহ(পুং লিঙ্গ)-সিংহী(স্ত্রী লিঙ্গ) ইত্যাদি। আপনিই বলুন এভাবে
শিখেছেন কিনা....?? এবার নিজেকে জিজ্ঞাস করুন, লিঙ্গ মানে কি...?? চিহ্ন না Penis....??
লিঙ্গের অর্থ Penis; এই ধরনের কথা যে
বলে থাকে, সে একটা মূর্খ এবং তার মায়ের একটা Penis
আছে। কারণ, বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী 'মা' স্ত্রীলিঙ্গ। আর তাই, লিঙ্গ অর্থ Penis বলা ব্যাক্তির 'মা' একটা হিজড়া। এই যুক্তিতে একইভাবে কনেরও Penis
আছে, বোনেরও Penis আছে, এমনকি স্ত্রীরও Penis আছে এবং সিংহীরও Penis আছে।
এবার আরও একটি যুক্তিতে
আসুন; লিঙ্গ শব্দের অর্থ Penis
হলে বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ পরিবর্তন বিষয়টি থাকত না। কারণ লিঙ্গ
মানে যদি Penis-ই হয়, তবে লিঙ্গ
পরিবর্তন হতো কিভাবে....? এটা কি প্র্যাক্টিক্যালি
পরিবর্তন করা সম্ভব??? হিজরাদের কথা বাদ দেন, কারণ হিজরারা আদৌ ইচ্ছাকৃতভাবে থিওরেটিকালি বা প্র্যাক্টিক্যালি লিঙ্গ
পরিবর্তন করে না। সব হিজরারাই হচ্ছে হরমোনাল ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পন্ন মানুষ। এরা
লিঙ্গ পরিবর্তন করে না, এরা আসলে হরমোন ইমব্যালান্স
দুর্ঘটনার শিকার।কিন্তু লিঙ্গ পরিবর্তন যদি করতেই হয়, তবে
প্র্যাক্টিক্যালি একটা ছেলের লিঙ্গ কেটে অন্য কোন মেয়ের মধ্যে লাগানো ছাড়া
সম্ভব না। একইভাবে সিংহের Penis অপারেশন করে কাটার পর
সিংহীর মধ্যে না লাগানো পর্যন্ত লিঙ্গ পরিবর্তন সম্ভব না !! মূর্খদের দাঁতভাঙা
জবাব দিন।।
আশা করি, এতক্ষণে আপনারা বুঝতে পেরেছেন,
লিঙ্গ মানে Penis নয়, এর আভিধানিক অর্থ হলো চিহ্ন। সংস্কৃতে পেনিসের সঠিক প্রতিশব্দ হল
শিশ্ন।
অন্যান্য কিছু নিয়ে আলোচনা-
শিব সম্পর্কে আরো অনেক
উল্টা পাল্টা কথা শোনা যায় যেমন শিব মদ গাজায় আসক্ত--
কিন্তু, আসলেই কি তাই... আমার এই লেখাটী পড়তে পারেন ( https://avijitprataproy.blogspot.com/2017/09/blog-post_13.html )
সর্বক্ষণের জন্য
মহাদেবের কাছে আছে দুজন অনুচর,
তাদের নাম নন্দী এবং ভৃঙ্গী। নন্দী শব্দের উৎপত্তি নন্দ ধাতু
থেকে, যার মানে আনন্দ। ভৃঙ্গী এসেছে ভৃ-ধাতু থেকে,
যার মানে ভরণ, পোষণ ও ধারণ করা। আর এটা
তো স্বাভাবিক; যেখানে মঙ্গল যাবে সেখানে তার প্রিয় অনুচর
আনন্দ, ভরণ-পোষণ ও ধারণ চলে যাবে। নন্দীর আগমনের সাথে আসে
প্রেরণা; অর্থ্যাৎ মানুষের মধ্যে বেড়ে ওঠে সহ্য, ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের মত গুণগুলো।
অপরপক্ষে ভৃঙ্গী হল
কারক। সমাজ সংসারে চলতে হলে মানুষের মধ্যে এইসব গুণ থাকা একান্ত প্রয়োজন; কারণ এসব না থাকলে তার
কপালে সাফল্য জুটবে না।
বিভিন্ন নাটক বা ছবিতে
দেখা যায় নন্দী এবং ভৃঙ্গী শিবের কাছে বসে সিদ্ধি ও গাঁজা টানছে। আপনাদের মনে
প্রশ্ন আসতে পারে, যিনি
মঙ্গলের প্রতীক; তার দুই অনুচর কিনা সিদ্ধি ও গাঁজা
খাচ্ছে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ??
আসলে এটাতেও আমাদের
বোঝার ভুল আছে। এখানে সিদ্ধি ও গাঁজা হল কর্মে কৃতার্থ হওয়ার পরমান্দ তথা
আত্মপ্রসাদের প্রতীক, যা
কখনোই পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া কোনো মাদক দ্রব্য নয়। নন্দী যিনি আনন্দদায়ীর কারক ও
ভৃঙ্গী যিনি ভরণ-পোষণের কারক; এই দুই বিহিত ব্যাবহার ও
অনুশীলনের ভিতর দিয়েই জেগে ওঠে কার্যসিদ্ধির সৌন্দর্য্য। আর প্রকৃত শিবভাব
সম্পন্ন ব্যাক্তিত্বই হল কার্যসিদ্ধির উৎস। তাই, প্রকৃত
শিবভাব বিশিষ্ট ব্যাক্তি কর্মে কৃতার্থ হওয়ার পরমান্দ তথা আত্মপ্রসাদকে সেবন করে
আনন্দ লাভ করে।
শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা হয় কেনো ?
সমুদ্র মন্থনের সময়
হলাহল নামক মারাত্মক বিষ উত্থিত হয়েছিল,
যেটার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জীবের
জীবন বিপন্ন করার ক্ষমতা ছিল অত্যধিক। ভগবান শিব সকল দেবতাদের অনুরোধে এই মারাত্মক
বিষ থেকে সবাইকে রক্ষা করার ঐশ্বরিক দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব সম্পন্নের জন্যই তিনি
সমস্ত বিষ পান করেন এবং তার কন্ঠে সংরক্ষণ করে রেখে দেন; আর
এজন্যই মহাদেবের কণ্ঠদেশ নীলবর্ণ।
হলাহল বিষের বিষাক্ততা
মাত্রা ছিল প্রচণ্ড রকমের বেশি,
যদিও এটি ভগবান শিবের উপর কোন প্রভাব ফেলে নাই। কিন্তু হলাহল
বিষের তাপমাত্রা ছিল অসম্ভব বেশি। এই তাপমাত্রার প্রভাব প্রশমিত করার জন্য দেবতারা
মহাদেবের জন্য গঙ্গা অভিষেক করেন, আর এই গঙ্গা অভিষেকের
মাধ্যমে দেবতারা শিবকে প্রসন্ন করেছিলেন। ভগবান শিবের সেই গঙ্গা অভিষেকে শুধুমাত্র
সাপ এগিয়ে এসেছিল এই ঐশ্বরিক কারণ সমর্থনের জন্য। তারা নিজেরাও বিষের কিছু অংশ
পান করে ও তাদের বিষদাঁতে কিছু বিষ গ্রহণ করে। এজন্য সেদিন থেকেই কিছু সাপ বেশি
বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
সমুদ্র মন্থনের সময় যে
গঙ্গা অভিষেক করা হয়েছিল, শিবের
উপাসকদের দ্বারা শিবলিঙ্গে জল বা দুধ ঢালার কারণ হচ্ছে শিবের প্রতি ভক্তদের ভক্তি
ও ভালোবাসা প্রতিভাস (প্রকাশ) করার জন্য।
শিবের পূজায় শিবলিঙ্গে
এরকম জল বা দুধ ঢালা খুবই গুরুত্বপূর্ণ;
অভিষেক ছাড়া শিবের পূজা অসম্পূর্ণ। অভিষেকের সময় এই জল বা দুধ
ঢালা খুবই পবিত্র। কারণ অভিষেকের দ্বারাই শিবের প্রতি ভক্তদের গভীর অনুরক্তি
প্রকাশিত হয়, আর এর মাধ্যমেই ভক্তিপরায়ণতা ফুটে উঠে।
এখানে অনেকে বলে থাকে,
শিবলিঙ্গে দুধ ঢেলে দুধ
অপচয় করা হচ্ছে, কিন্তু
এটা মোটেও সঠিক কথা নয়। কারণ এই দুধের বেশ খানিকটা অংশ চরণামৃত বানানোর জন্য
ব্যবহার করা হয় এবং যা পূজা শেষে ভক্তদের মাঝে প্রসাদরূপে বিতরণ করা হয়। তাই দুধ
ঢালা কোনক্রমেই অপচয় নয়, বরং এটা নিষ্কলুষ ভক্তিরই
বহিঃপ্রকাশ।
দুঃখের বিষয় এই যে, শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা
নিয়ে অনেকেরই এখনো চুলকানি আছে। শিবলিঙ্গে দুধ ঢালার কথা শুনলেই যেন তারা কান্না
শুরু করে দেয়। তাদের ভাবখানাটা এমন; যেন ৩৬৪ দিন
শিবলিঙ্গে অনেক অনেক পরিমাণে দুধ ঢেলে দুনিয়ার সব দুধ উজার করে দেয়া হচ্ছে।
এখানে চুলকানি রোগে
আক্রান্ত ব্যাক্তিরা মড়াকান্না জুড়বে যে,
শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা হচ্ছে কিন্তু অভুক্ত শিশুরা দুধ পাচ্ছে না
ইত্যাদি ইত্যাদি।
আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন
ও ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন,
আসলে চুলকানি রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা সবসময় সবকিছু একটু
বাড়িয়েই বলে। তাই তাদের উদ্ভট কথায় আমাদের ঘাবড়ানো উচিত নয়।
এই পৃথিবীতে আমরা সবাই
নিতান্তই তুচ্ছ, আমাদের
নিজের কোন কিছুই নেই। আমাদের শরীর, শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার
বাতাস, গাছপালা, মাটি ইত্যাদি
সবকিছুই ভগবানের দান। তাই শিবলঙ্গে দুধ ঢালা নিয়ে কৈফিয়ত তলব করা আমাদের মানায়
না।
শিবতত্ত্বঃ
জ্ঞানের রাজ্য পার
হয়েই জানা যায় শিবকে। জ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী পূজার পরই আসে শিবরাত্রি। এরও
একটি গভীর তাৎপর্য আছে। দেবী সরস্বতী হংসরূঢ়া। হংসটি কিন্তু সাধারণ হংস নয়।
মানুষের কূটস্থে যে দ্বিদলপদ্ম আছে,
এতে “হং” এবং “সঃ” দুইটি বীজ। এই দুইটি বীজে দৃষ্টি স্থির রাখতে
পারলেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞানক্ষেত্র খুলে যায়। আবার জ্ঞানক্ষেত্রে চতুর্বেদ
রাগিনী সরস্বতী উপবিষ্ট। তাই ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধিকে সুসংযত করে কুটস্থে রাখতে
পারলে সরস্বতীর কৃপা লাভ সম্ভব। জ্ঞানক্ষেত্র পার হলে পৌঁছা যায় ব্যোমক্ষেত্রে
আমাদের কূটস্থের পর দহরাকাশ, চিদাকাশ, পরাকাশ, মহাকাশ ও আত্মাকাশ। এই পঞ্চ আকাশেই
ব্যোমক্ষেত্র বা শিবক্ষেত্র। এ জন্যই শিবের অপর নাম পঞ্চানন। মানুষ সাধন ক্রিয়া
দ্বারা এই ব্যোমক্ষেত্রে পৌছালে শিব শীঘ্র তুষ্ট হন। এ জন্য শিবের আর এক নাম
আশুতোষ।
এছাড়াও শিব আরও যে যে রূপে মূর্ত হন তা নিম্নরূপ
:
০১। চন্দ্রনাথদেবেরই আর এক নাম শিব। শিব অর্থ মঙ্গল বা শুভ।
পুনর্জন্ম নিরোধ করে অর্থাৎ মোক্ষ দান করে তিনি জীবের মঙ্গলই করেন। তিনি আবার
পঞ্চানন নামেও খ্যাত। পঞ্চ আনন (মুখ) যাঁর তিনিই পঞ্চানন। পঞ্চমুখ দেবতাই শিব।
০২। ‘ওঁ’-তত্ত্বের ত্রিদেবতা- ব্রহ্মা, বিষ্ণু
ও মহেশ্বর। পঞ্চানন শিবই এই মহেশ্বর। মহেশ্বরী শক্তির অধিকারী তিনি। মহাপ্রলয়ের
নটরাজ তিনি। তিনি ঈশান নামেও খ্যাত। ঈশান-ই বিষাণে অর্থাৎ শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে তিনি
মহাপ্রলয় ঘোষণা করবেন।
০৩। মহাশক্তির দেবতা মহেশ্বর। সকল দেবতা ঐক্যশক্তি দিয়ে যা করতে
পারেননা, মহেশ্বর একাকী তা সম্পন্ন করতে সমর্থ। দেবতার
মাঝে বিচিত্র অদ্ভূতকর্মা দেবতা তিনি।
০৪। মৃত্যুকে জয়
করেছেন বলে তিনি মৃত্যুঞ্জয়। তাইতো তিনি অকাতরে সমুদ্র মন্থনের হলাহল অর্থাৎ বিষ
কণ্ঠে ধারণ করেছেন। বিষের ক্রিয়ায় তার কণ্ঠদেশ হয়েছে নীল। সে কারণে তার নাম নীলকণ্ঠ।
০৫। বাঘের চামড়াকে বলে কৃত্তি। কৃত্তি পরিধান করে নাম ধরেছেন
কৃত্তিবাস।
০৬। বিচিত্রকর্মা মহেশ্বর। অর্থাৎ তার সকল কর্মই অদ্ভূত ও
বৈচিত্র্যময়। গঙ্গার ধারা ধারণকালে ত্রিশূল হাতে তিনি হিমালয়ের পাদদেশে থমকে
দাঁড়িয়েছেন এবং মস্তকের জটাজুটকে উত্থিত করে দিয়েছেন ব্যোমে অর্থাৎ আকাশের দিকে
এবং নাম ধরেছেন ব্যোম্কেশ। তার সেই উত্থিত জটাজুটের মাধ্যমে গঙ্গার ধারা পৃথিবীতে
নেমে আসে। তবেই না মর্ত্যের মানুষ গঙ্গার পূত-পবিত্র সলিলে অবগাহন করে নিষ্পাপ
হচ্ছে এবং মরণের পরে স্বর্গবাসী হচ্ছে।
০৭। ‘ধূর’ শব্দের অর্থ জটাভার বা ত্রিলোকের চিন্তাভার। মহাদেব
চন্দ্রনাথই শিরে জটাভার ধারণ করেন অথবা ত্রিলোকের চিন্তাভার ধারণ ও বহন করেন। এসকল
ভার বহন ও ধারণের কারণে তারই নাম ধূর্জটি।
০৮। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-‘কোন গুণ নাই
তার কপালে আগুন’। এখানে ‘গুণ নাই’-এর অর্থ সত্ত্বঃ, রজ ও
তম গুণের অতীত। মহাদেব ত্রিগুণাতীত। তিনটি নেত্র বা লোচন তার। একারণে দেব
ত্রিলোচনও বলা হয় তাকে। তার ললাটের তৃতীয় নয়ন দিয়ে সর্বদাই ধক্ ধক্ করে আগুন
জ্বলতে থাকে। ‘কপালে আগুন’ বলতে অন্নপূর্ণা দেবী ইঙ্গিতে মহাদেবের ললাট নেত্রের
কথাই বলেছেন। আগুন আলোর প্রতীক। অন্ধকার দূর করতে আলোরই প্রয়োজন। তার ত্রিনেত্রের
অগ্নি জ্ঞানরূপে আলো জ্বালানোর প্রতীক। অর্থাৎ মানুষকে জ্ঞান-চর্চা করতে হবে।
০৯। ত্রিগুণাতীত বলে শিব সর্বদাই নির্বিকার নির্বিকল্প। তাই
শবরূপে তিনি শ্রীকালী মাতার চরণতলে শায়িত। শবরূপে শিব মানুষকেও বিকার রহিত হওয়ার
শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ শবেরইতো কোন বিকার নেই। তার ত্রিশূলও ত্রিগুণের প্রতীক।
তিনি নিজে ত্রিগুণাতীত হয়ে মানুষকেও তার হস্তধৃত ত্রিশূল দেখিয়ে ত্রিগুণাতীত
হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
১০। শিব ‘হর’ এবং ‘শম্ভু’ নামেও খ্যাত। তিনি জীবের চিত্তকে,
তাদের পাপকে হরণ করেন এবং কালপূর্ণ হলে জীবের জীবনকেও হরণ করেন।
এসকল হরণ করার কারণে তার নাম ‘হর’। আবার তিনিই জীবের যম-ভয় অর্থাৎ শঙ্কা হরণ করে
তাদের কল্যাণ সাধন করেন। তার নাম গ্রহণ করলেই আর কোন শঙ্কাই থাকে না। এ কারণে শংকর
তার নাম। আবার ‘শম্’ শব্দের অর্থও কল্যাণ। যেহেতু তিনি কল্যাণ দান করেন, সেহেতু ‘শম্ভু’ নামেও তিনি বিশ্বখ্যাত।
১১। ত্রিপুর নামক অসুরের অত্যাচারে ত্রিপুরাবাসী অর্থাৎ
স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালবাসী দেবতা, মানব এবং যক্ষকুল অতীষ্ট
হয়ে উঠেছিলেন তখন শিব শরাসন থেকে শর নিক্ষেপ করে ত্রিপুরাসুরকে নিধন করেন। আর এই
ত্রিপুরাসুরকে নাশ করে নাম ধরেছেন দেব ত্রিপুরারি।
১২। শিব অল্পেই বা শীঘ্রই সন্তুষ্ট হন। এ কারণে তাঁর এক নাম
আশুতোষ।
১৩। শিব দেব, মানব, অসুর, রাক্ষস, গান্ধর্ব,
কিন্নর সকল কতৃক বন্দিত। তিনি হলেন সকল দেবতাদের আদি তাই তাঁর
নাম মহাদেব।
১৪। শিব সকল জীবের প্রভু, তাই তিনি
ঈশান।
১৫। শিবের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী কেউ নেই, তাই তিনি স্বয়ম্ভু।
১৬। প্রতিকল্পে আপন লীলা মহিমায় তিনি ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংস সাধন
করেন এবং কাল উনার অধীন, তাই তিনি মহাকাল।
সত্যই জগতের প্রতিটি বস্তুকণায় শিবের
অস্তিত্ব বর্তমান। “যত্র জীব-তত্র শিব”-পরমপুরূষ শ্রীরামকৃষ্ণ কঠোর সাধনায়
সিদ্ধিলাভ করে এ সত্যই উপলব্ধি করেছেন। সুতরাং আমাদের সকলের উচিৎ জীব সেবার
মাধ্যমে শিব সেবায় ব্রতী