Tuesday, June 30, 2020

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিত বর্গের ইতিহাস

আত্রেয় পুনর্বসুঃ

প্রাচীন যুগের গান্ধার প্রদেশেরৎ তক্ষশিলার অধ্যাপকরা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। খ্যাতনামা চিকিৎসক আত্রেয় এখানেই চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যাপনা করতেন। ঐতিহাসিকরা আত্রেয়কে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার পথিকৃৎ বলে থাকেন।

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠশতকের চিকিৎসাবিদ্যার এই অধ্যাপকের আসল নাম ছিল আত্রেয় পুনর্বসু। ঋষি অত্রির পুত্র ছিলেন তিনি। ঋষি ভরদ্বাজের শিষ্যদের মধ্যে আত্রেয় ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি চিকিৎসাবিদ্যার বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এর মধ্যে ‘আত্রেয় সংহিতার’ নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই গ্রন্থটি পাঁচটি খন্ডের।
আত্রেয় রোগকে দুভাবে ভাগ করেছিলেন। একভাগে আছে আরোগ্য করা যায় এমন সব রোগ আর আরেকভাগে আছে আরোগ্যের অতীত বিভিন্ন ধরণের রোগ।
আরোগ্য সম্ভব এমন সব রোগকেও তিনি দুভাগে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে প্রথমভাগে আছে সেইসব রোগ যা সহজেই যাদুর মত নিরাময় করা সম্ভব।
অন্যভাগে আছে সেইসব রোগ যা অত্যন্ত জটিল এবং কদাচিৎ সারানো সম্ভব। রোগীদেরও তিনি রোগের জটিলতা অনুসারে ভাগ করে তাদের চিকিৎসা আদৌ সম্ভব কিনা তা নির্ধারণ করতেন।

তিনিই প্রথম মানুষের বয়স ও স্বভাবের উপর বাতাস, মাটি এবং ঋতুর প্রভাব বর্ণনা করেন এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন রোগের সম্পর্কের কথা বলেন যা পরবর্তীকালে মহামারী সম্বন্ধীয় রোগের কারণ হিসাবে অনেক চিকিৎসক উল্লেখ করেছেন।

আত্রেয়র আরেকটি বড় কৃতিত্ব হল স্বাদকে মিষ্টি, তেতো, টক, নোন্‌তা, ঝাল ও সংকোচক (astringent) এই ছয় ভাগে বিভক্ত করা এবং মানুষের শরীরের উপর এই স্বাদগুলির প্রত্যেকটির প্রভাব সম্বন্ধে তাঁর গবেষনা ও পর্যবেক্ষণকে প্রতিষ্ঠিত করা।
গরম ও ঠান্ডা পানি বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করেছেন তিনি। বিভিন্ন প্রকারের দুধ, আখের রস, ভাতের ফ্যান, বার্লি, তেল, ফল, গুড়, মধু প্রভৃতি জিনিষের ভৌত ও ওষধি ধর্মের বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর লেখায়।

বিভিন্ন ধরণের প্রাণী, পাখি, মাছ ও সাপের মাংসের গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে এগুলি খাওয়ার ব্যাপারে একটি নিয়মনীতি তৈরি করেন তিনি। জ্বর, পেটখারাপ, রক্তআমাশা, রক্তস্রাব প্রভৃতি রোগের কারণ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া গিয়েছে তাঁর লেখায়। বিভিন্ন ধরণের বিষের প্রতিষেধক সম্বন্ধেও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে তাঁর রচনায়।

এইসব কারণে অনেক বিজ্ঞানের আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মূলভিত্তি ‘ত্রিদোষ ভাবনা’ বৈদিকযুগ থেকে চালু থাকলেও, আত্রেয়ই প্রথম এই ভাবনাকে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেন ও বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় তার প্রয়োগ করেন। চরক সংহিতায় উল্লিখিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি ও তার চিকিৎসায় বিভিন্ন ঔষধের ব্যবহারের একটি বড় অংশের দান আত্রেয়র।

আত্রেয়র চিকিৎসা পদ্ধতির কথা তাঁর শিষ্যরা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর শিষ্য অগ্নিবেশ রচিত ‘অগ্নিবেশ তন্ত্র’ কে অবলম্বন করেই চরক ও দৃঢ়বল ‘চরক সংহিতা’ রচনা করেন। আত্রেয়র আরও দুই শিষ্য ভেল ও হারীত রচিত ‘ভেল সংহিতা’ ও ‘হারীত সংহিতা’ অতি মূল্যবান প্রাচীন চিকিৎসা গ্রন্থ। ঐ সময়ের বিশিষ্ট চিকিৎসক জতুকর্ণ, পরাশর ও ক্ষরপাণিও ছিলেন আত্রেয়র শিষ্য।


জীবকঃ গৌতম বুদ্ধের চিকিৎসক

জীবক এমনই এক মহামানব যিনি ছিলেন গৌতম বুদ্ধের চিকিৎসক। তার নাম – জীবক কোমার ভচ্চ (খ্রীঃ পূঃ ৫৬৬ – ৪৮৬) । বুদ্ধকে কয়েকবার তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সারিয়ে তোলেন। কথিত আছে, একবার গৌতম বুদ্ধের চিকিৎসায় জীবক তাঁকে কোন ওষুধ সেবন করতে না দিয়ে, শ্বেত পদ্মের মধ্যে ওষুধ রেখে তার ঘ্রাণের সাহায্যে তাঁকে সারিয়ে তোলেন।

জীবক মগধের রাজা বিম্বিসারের সভায় রাজবৈদ্য নিযুক্ত হন। তাঁর চিকিৎসায় রাজা বিম্বিসার অনেক সময় অনেক কঠিন ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করেন। অবন্তীর রাজা প্রসেনজিৎ ও জীবকের চিকিৎসায় রোগমুক্ত হয়েছিলেন।

জীবককে বুদ্ধ এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে তিনি তাঁর অনুগামীদের মধ্যে জীবককে প্রধান অনুগামী বলে ঘোষনা করেছিলেন। এছাড়া জীবকের কথা শুনে বুদ্ধ তাঁর অনুগামী সন্ন্যাসীদের রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ব্যায়াম করার নির্দ্দেশ দিয়েছিলেন।

জীবকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিয়ে একটি গল্প আছে। তখনকার মগধের রাজধানী রাজগৃহের সভাসদ ছিলেন শালাবতি। জীবক ছিলেন এই শালাবতির পুত্র। জন্মের পর তাঁকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল এক আবর্জনার স্তুপে। কিন্তু তাঁকে জীবিত দেখে পথচারীরা মগধের রাজা বিম্বিসারের পুত্র রাজকুমার অভয়কে খবর দেন। তিনিই এই শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে মানুষ করেন এবং ‘জীবক’ নাম দেন।

বড় হলে চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের জন্য জীবক সেই সময়ের আয়ুর্বেদ শিক্ষার পীঠস্থান তক্ষশিলায় যান। সেখানে তিনি ছিলেন সাত বছর। তক্ষশিলায় জীবক গুরু হিসাবে পেয়েছিলেন আত্রেয়কে। ভেষজ বিদ্যায় জীবকের গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় জাতকের একটি গল্পে।

শিক্ষা শেষ করার পর তক্ষশীলার এক বিখ্যাত আচার্য জীবক ও অন্যান্য শিষ্যদের প্রত্যেককে তক্ষশীলার চারিদিকে এক যোজনের (১২ মাইল) মধ্যে নির্গুন কোন উদ্ভিদ বা গুল্ম পাওয়া যায় কি না তা অনুসন্ধান করতে বলেন। অন্যান্য শিষ্যরা প্রত্যেকেই একাধিক নির্গুণ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে আনলেও, অনেক চেষ্টার পরেও খালি হাতে ফেরেন জীবক। এর থেকে ভেষজের প্রয়োগ ও ভেষজের গুণ সম্পর্কে জীবকের জ্ঞানের গভীরতা আচার্য বুঝতে পারেন এবং জীবকের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে বলে ঘোষণা করেন।

তক্ষশিলার চিকিৎসা বিদ্যার অধ্যাপক আত্রেয় যে চিকিৎসা পদ্ধতির পত্তন করেন তা হল কায় চিকিৎসা (সাধারণ চিকিৎসাবিদ্যা)জীবক আত্রেয়র শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও কায় চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে শল্য চিকিৎসাতেও অসাধারণ কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। কথিত আছে বহুবার তিনি মাথার করোটি কেটে ক্ষতস্থান থেকে ক্রিমি বের করে রোগীর শিরঃপীড়া দূর করেন।

রাজগৃহে একবার এক ধনীর স্ত্রীর উদরে অস্ত্রোপচার করে অন্ত্রগুলি তিনি বের করেন এবং তার মধ্যে যে গ্রন্থিগুলি জড়িয়ে গিয়েছিল সেগুলিকে ছাড়িয়ে আবার সঠিক স্থানে সংস্থাপন করেন।
তক্ষশিলা থেকে ফেরার পথে তিনি শুনতে পান যে এক ধনী ব্যক্তির স্ত্রী সাত বছর ধরে এক কঠিন মাথা ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছেন। জীবক কয়েক ধরণের গাছের মূল ও পাতা ঘিয়ের মধ্যে ফুটিয়ে সেও ওষুষ রোগিনীর নাকের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করিয়ে তাঁর মাথা ব্যাথার উপশম করেন।খুশী হয়ে তাঁর স্বামী জীবককে ১৬০০০ স্বর্ণমুদ্রা দান করেন।

তক্ষশিলা থেকে ফিরে মগধে অবস্থানকালে জীবকের চিকিৎসার খ্যাতি সে সময়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। বৈশালী, বারাণসী, সাকেত, উজ্জয়িণী থেকেও রোগীরা মগধে আসতো জীবকের কাছে চিকিৎসার জন্য।
মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে জীবক ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ভোজরাজার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে তাঁকে রোগমুক্ত করেছিলেন জীবক। স্নায়ুতন্ত্রের উপর শল্য চিকিৎসায় যে সব চিকিৎসকরা পথিকৃৎ ছিলেন, জীবক ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

শিশুরোগের চিকিৎসায় জীবক ছিলেন সে সময়ে অদ্বিতীয়। তাঁর রচিত ‘কাশ্যপ সংহিতা’য় বিবিধ শিশুরোগ ও তার প্রতিকারের বিধান উল্লেখ করা আছে। রচিত ‘কাশ্যপ সংহিতা’ চিকিৎসাবিদ্যার এক বিরাট গ্রন্থ। এই গ্রন্থে ন-টি অধ্যায় আছে। (১) সূত্রস্থান, (২) নিদানস্থান, (৩) বিমানস্থান, (৪) শারীরস্থান, (৫) ইন্দ্রিয়স্থান, (৬) চিকিৎসাস্থান, (৭) সিদ্ধিস্থান, (৮) কল্পস্থান ও (৯) খিলস্থান।


চরক( কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের ব্যক্তিগত চিকিৎসক)

২০০ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করা চরক চিকিৎসা শাস্ত্রে তক্ষশীলার আরেক বিস্ময়কর অবদান। যোগ সাধনা চর্চার জন্য অনেকে আবার তাকে চরক মুনি বা ঋষি হিসাবে ডেকে থাকেন। তাঁর অনেক অনুসারী ছিল। ছিলেন তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্র “চরক সংহিতা” রচনা করে।

আয়ুর্বেদ চিকিৎসাকে এই বই এনে দিয়েছে বৈপ্লবিক ছোঁয়া। প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে প্রথম প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয় এই “চরক সংহিতা”এই গ্রন্থে তিনি ৫০০ ঔষধের বর্ননা লিপি বদ্ধ করেছেন।চরক-সংহিতায় মতে “তাকেই বলে ভেষজ যাতে হয় আরোগ্য”।

চরক ও সুশ্রম্নত সংহিতায় উল্লেখ আছে কাঁচা আমলকির রসের সাথে ২/১ কোয়া রসুন বাটা খেলে যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয়। কোন রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনাও একেবারে শুন্যের কোঠায়।
আধুনা বিশ্বে চিকিৎসা শাস্ত্রে যে অংগপ্রতিস্থাপন বা প্লাস্টিক সার্জারি হচ্ছে তার জনক এই মহান চরক।




চাণক্য (অর্থনীতিবিদ)।

চাণক্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০- খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ ) প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রাচীন তক্ষশীলা বিহারের অর্থনীতি ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যক্ষ ছিলেন। মৌর্য রাজবংশের প্রথম রাজা চন্দ্র গুপ্তের মৌর্য তার সাহায্য নিয়ে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত চন্দ্র গুপ্ত রাজ্য শাসন করেন তিনি চন্দ্র গুপ্ত ও পরবর্তীতে তার ছেলে বিন্দুসারের প্রধানমন্ত্রী ও রাজ উপদেষ্টা ছিলেন।

চাণক্য সম্বন্ধে খুব সামান্যই ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়, অধিকাংশ উৎসে ঐতিহাসিকতার তুলনায় কল্প কথা স্থান করে নিয়েছে। থমাস ট্রটমান চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সম্পর্ক নিয়ে চারটি উৎস চিহ্নিত করেছেন।এগুলি হল সিংহলী বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশ ও তার পালি টীকা বংসট্ঠপ্পকাসিনি, হেমচন্দ্র রচিত জৈন গ্রন্থ পরিশিষ্টপর্ব, সোমদেব রচিত কথাসরিৎসাগর ও ক্ষেমেন্দ্র রচিত বৃহৎকথামঞ্জরী নামক দুইটি কাশ্মীরি গ্রন্থ এবং বিশাখদত্ত রচিত সংস্কৃত নাটক মুদ্রারাক্ষস।

এই বিজ্ঞ ও প্রতিভাধর ব্রাহ্মণের জন্ম সেকালের তক্ষশীলার ‘চানকা’ গ্রামে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে , যা থেকে তার অপর নাম ‘চানক্য এর উদ্ভব । বিষ্ণু গুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। কারণ এ নামটিই দিয়েছিলেন তার বাবা মা। এছাড়া তার ছদ্মনাম ‘কৌটিল্য’, যা তিনি তার বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’ এ গ্রহণ করেছেন।তিনি ‘কূটিলা গোত্র’ থেকে উদ্ভূত ছিলেন, অতএব তা টিকিয়ে রাখার জন্যে তিনি ‘কৌটিল্য’ ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন।

প্রথম জীবনঃ
প্রাচীন ভারতীয় পন্ডিত, দার্শনিক, ও রাজউপদেষ্টা কৌটিল্য বা বিষ্ণু গুপ্ত ( খ্রি: ৩৭১-২৮৩)। তিনি চানক্য নামে অধিক পরিচিত। তার জন্ম নিয়ে রয়েছে মতান্তর। কারো মতে তার জন্ম পাকিস্তানের পান্জাব প্রদেশপর তক্ষষশীলায়। আবার কারো মতে কৌটিল্য বা চাণক্যের জন্ম চনক নামে একটি গ্রামে, ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।তার জন্মস্থান সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে।বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশটীকা অনুসারে, তক্ষশীলায় তার জন্ম হয়।জৈন পুঁথি অদ্বিধন চিন্তামণি চানোক্যকে দ্রমিলা নামে অভিহিত করা হয়েছে, যার অর্থ তিনি দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী ছিলেন।হেমচন্দ্র রচিত পরিশিষ্টপর্ব গ্রন্থানুসারে, চাণক্য চণক নামক গ্রামে চণিন নামক এক ব্রাহ্মণ ও তার পত্নী চণেশ্বরীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন।অন্য উৎস মতে, চণক তার পিতার নাম ছিল।

চন্দ্র গুপ্তের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতিঃ
তার অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী নন্দ বংশের শাসন উৎখাত করে সম্রাট অশোকের পিতামহ চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যকে ভারতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা।চন্দ্র গুপ্ত মগধের পাটালিপুত্রকে তার রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। পাটালিপুত্র বর্তমান বিহারে অবস্থিত।।চন্দ্র গুপ্তের দরবারে গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস তার ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে লিখেছেন তার সময়কালে সমগ্র রাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিল, প্রজাদের প্রতি তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিল সমৃদ্ধিতে।কথিত আছে নন্দ বংশের সর্বশেষ রাজা চাণক্যকে অপমান করেছিলেন। চাণক্য এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করেন। এদিকে তরুণ চন্দ্র গুপ্ত, যিনি নন্দ রাজার সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, তিনিও ষড়যন্ত্র করছিলেন সিংহাসন দখলের। তার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় এবং জীবন বাঁচাতে তাকে পালাতে হয়। চন্দ্র গুপ্ত যখন বিন্ধানের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন তখন ঘটনাচক্রে চাণক্যের সাথে তার সাক্ষাত হয়। চন্দ্র গুপ্ত তার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য চাণক্যকে তার গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে মেনে নেন। পরবর্তীতে তিনি চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী হন।আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুতে গ্রিক শাসনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে বিদ্রোহের সূচনা হয় এবং এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চন্দ্র গুপ্ত গ্রিক বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত করেন ও পাঞ্জাবকে নিজ শাসনাধীনে আনেন। পরে চন্দ্র গুপ্ত একে একে পশ্চিম ভারতের সকল রাজ্য বিজয় করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস নাম্মক সংস্কৃত নাটকে নন্দ সাম্রাজ্য পতনে চাণক্যের ভূমিকা বর্ণিত রয়েছে। এই গ্রন্থানুসারে, হিমালয়ের একটি পার্বত্য রাজ্যের অধীশ্বর পর্বতেশ্বরের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা চাণক্য কূটনৈতিক মিত্রতা স্থাপন করে নন্দ সাম্রাজ্যকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু এই সময়, পর্বতেশ্বরকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হলে মলয়কেতু তার স্থানে সিংহাসনে আরোহণ করেন। নন্দ সাম্রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রাক্ষসের সঙ্গে মিলিত ভাবে মলয়কেতু নন্দ সাম্রাজ্যের অধিকৃত এলাকা দাবি করেন। শেষ নন্দ সম্রাট ধননন্দের হত্যার প্রতিশোধ নিতে মলয়কেতুর সহায়তায় রাক্ষস রাজধানী আক্রমণ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এই পরিস্থিতিতে চাণক্য যেন তেন প্রকারে রাক্ষসকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাতে চেয়েছিলেন। রাক্ষসের প্রতীক মুদ্রাটি হস্তগত করে চাণক্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে উদ্দেশ্য করে একটি নকল চিঠি প্রস্তুত করেন। এই চিঠিতে রাক্ষসের মুদ্রার ছাপ (সীলমোহর) দিয়ে লেখা হয় যে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের শিবিরে যোগ দিতে ইচ্ছুক। চাণক্য প্রথমেই মলয়কেতুর নিকট এই চিঠির বিষয়ে বার্তা পাঠালে তাতে বিশ্বাস করে মলয়কেতু রাক্ষসের সঙ্গত্যাগ করেন। এই ভাবে চাণক্য রাক্ষসকে তার সঙ্গীদের থেকে দূরে সরিয়ে দেন। পরবর্তী কৌশল হিসেবে তিনি রাক্ষসের বন্ধু চন্দনদাসের মৃত্যুদণ্ড দিলে রাক্ষস তাকে বাঁচাতে, আত্মসমর্পণে ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হন।

বিন্দুসারের সঙ্গে সম্পর্কঃ
জৈন প্রবাদানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের উপদেষ্টা চাণক্য শত্রু দ্বারা বিষপ্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টার বিরুদ্ধে শারীরিক প্রতিষেধক তৈরী করার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যকে তার অজান্তে অল্প মাত্রায় বিষ পান করাতেন। একদিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য তার বিষযুক্ত খাবার অন্তঃসত্ত্বা দুর্ধরার সঙ্গে ভাগ করে খেলে, দুর্ধরার মৃত্যু হয়। তার সন্তানকে বাঁচাতে চাণক্য সদ্যমৃত দুর্ধরার পেট কেটে তাকে বের করে আনলে বিন্দুসারের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে বিন্দুসার মৌর্য্য সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করলে চাণক্য তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হেমচন্দ্রের পরিশিষ্টপর্ব অনুসারে, বিন্দুসারের একজন মন্ত্রী সুবন্ধু চাণক্যকে অপছন্দ করতেন। তিনি বিন্দুসারকে জানান যে তার মাতা দুর্ধরার মৃত্যুর জন্য চাণক্য দায়ী ছিলেন। এই ঘটনার কথা জানতে পেরে বিন্দুসার প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলে বৃদ্ধ চাণক্য জৈন আচার সল্লেখনা বা স্বেচ্ছা-উপবাস করে দেহত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই সময় চাণক্য যে তার মাতার মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী ছিলেন না, তা অনুসন্ধান করে বিন্দুসার জানতে পেরে নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং সুবন্ধুকে চাণক্যের নিকট পাঠান যাতে, চাণক্য তার মৃত্যু সঙ্কল্প ত্যাগ করেন। কিন্তু সুযোগসন্ধানী সুবন্ধু এই সময় চাণক্যকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন।




চাণক্যের অর্থশাস্ত্রঃ
চাণক্যের বিরাট সাহিত্য কর্ম ‘অর্থশাস্ত্র’, যার শব্দগত অর্থ ‘পৃথিবীতে সাধারণ কল্যাণ বিষয়ক বিবরণী।’ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে কিভাবে একজন শাসককে তার প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবন মান উন্নত করার জন্যে কাজ করবেন এবং কিভাবে আরও ভূখণ্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে হবে। চাণক্য উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম প্রবক্তা এবং তার কিছু নীতি বিশ্বজনীনভাবে প্রযোজ্য।হাজার বছরের অধিক সময়ের ব্যবধানেও সেগুলো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেনি।

চাণক্য তার কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রে’ রাজাকে পরামর্শ দিয়েছেন, “যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।”
অর্থনৈতিক দুর্নীতি সর্বকালেই ছিল এবং চাণক্যের যুগেও তা নতুন কোন বিষয় ছিল না। সে কারণে তিনি লিখেছেন, “সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সেজন্যে সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরুপ বা অর্থ আত্মসাতের চল্লিশটি পদ্ধতি আছে।

চাণক্য তার নীতিকথায় বলেছেন, “বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নিচ কারো থেকে জ্ঞান এবং নিচু পরিবার থেকে শুভলক্ষণা স্ত্রী – এসব গ্রহণ করা সঙ্গত।”
“মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।”
“যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্যে কোনকিছু হাসিল করা অসাধ্য কিছু নয়। শিক্ষিত কোন ব্যক্তির জন্যে কোন দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোন শত্রু নেই।”
“মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।”

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মতোই চাণক্যের চেহারাও সুন্দর বা আকর্ষণীয় ছিলনা এবং দৈহিক গড়নও ছিল আকর্ষণহীন। দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি, যদিও সক্রেটিসের মতোই পণ্ডিত ও দার্শনিক ছিলেন। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে, “দেহের সৌন্দর্যের চাইতে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব যাদুতুল্য।” অন্যদিকে চাণক্য ছিলেন দক্ষ পরিকল্পনাবিদ। সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন অটল এবং অর্থহীন আবেগের কোন মূল্য ছিল না তার কাছে। নিজস্ব পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।


পাণিনিঃ

পাণিনি প্রখ্যাত সংস্কৃত ব্যাকরণ রচয়িতা। তিনি তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন।পানিনি সম্পর্কে বলতে গেলে সাধারন ভাবে বলা যায় – আমরা আজকে যে বাংলা ভাষায় কথা বলছি তার উতস সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরনবিদ এই বিদ্যান ।

পাণিনির জন্মকাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। এই সকল মতভেদ অনুসারে ধরা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-৪০০ অব্দের মধ্যে পাণিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গান্ধার রাজ্যের শালাতুর (বর্তমান লাহোরের নিকটবর্তী একটি স্থান) নামক পল্লীকে তাঁর জন্মগ্রহণ জন্মস্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জন্মস্থানের নামে তাঁকে অনেক সময় ‘শালতুরীয়’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

পণি বা পাণিন্‌ একটি গোত্র নাম। সংস্কৃত সাহিত্যে পণি নামে একটি গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, তিনি ফিনিসীয় জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা একসময় ভারত মহাসাগরের উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিল। এদেরকে পণি, ফিনিকিয়, পিউনিক ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো।

পাণিনির পিতা ছিলেন ফিনিকিয় বা পণি গোষ্ঠীর মানুষ। তাঁর নাম ছিল শলঙ্ক। এই কারণে অনেক সময় তাঁকে শলাঙ্কি বলা হয়। পাণিনির মা ইলেন দক্ষ জাতির কন্যা। অনেকের মতে পাণিনির মায়ের নাম ছিল দাক্ষী। এই সূত্রে অনেকে ক্ষেত্রে তাঁকে দাক্ষীপুত্র বা দাক্ষেয় নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পাণিনি পারিবারিক সূত্রে বেদোত্তর সনাতন পৌরাণিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। মূলত তিনি ছিলেন অহিগলমালার (শিব) উপাসক। সেইজন্য তাঁকে আহিক বলা হয়েছে।




তাঁর শিক্ষকের নাম ছিল উপবৎস। তাঁর রচিত ব্যাকরণের নাম– অষ্টাধ্যায়ী। কথিত আছে, মহাদেবের ঢাকের শব্দে চৌদ্দটি ধ্বনি উৎপন্ন হয়। এই ধ্বনি অনুসারে তিনি শব্দসূত্র তৈরি করেন। একে বলা হয়েছে শিবসূত্রজাল অথবা মাহেশ্বর সূত্র। মূলত এই সূত্রগুলি পাণিনির ব্যাকরণের চাবিকাঠি। শিবসূত্রের প্রত্যেকটির নাম সংজ্ঞা বা সংজ্ঞাসূত্র। এই ১৪টি শিবসূত্র হলো—
১. অ ই উ ণ্
২. ঋ ৯ ক্
৩. এ ও ঙ্
৪. ঐ ঔ চ্
৫. হ য ৱ র ট্
৬. ল ণ্
৭. ঞ্ ম ঙ্ ণ ন ম্ ৮. ঝ ভ ঞ
৯. ঘ ঢ ধ ষ্
১০. জ ব গ ড দ শ্
১১. খ র্ফ ছ ঠ থ চ ট ত ৱ্
১২. ক প য্
১৩. শ ষ স র্
১৪. হ ল্ ।
মনে রাখার সুবিধার জন্য পাণিনি এই সূত্রগুলোকে আরও সংক্ষিপ্ত করে নাম দিয়েছিলেন প্রত্যাহার (সংক্ষেপিত) সূত্র। এক্ষেত্রে প্রতিটি সূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণ যুক্ত করে সংক্ষিপ্ত বা প্রত্যাহার সূত্র হয়েছিল।
প্রত্যহার সূত্র তৈরির বিধি
১. শিবসূত্রের বিচারে প্রত্যাহার সূত্র তৈরি হয়েছে।
২. প্রতিটি প্রত্যাহারের নামকরণ করা হয়েছে শিবসূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণ দ্বারা। যেমন— প্রথম শিবসূত্রটি হলো — অ ই উ ণ্ । এক্ষেত্রে প্রত্যাহরটির নাম হবে অণ্।
৩. ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শেষ ব্যঞ্জনবর্ণটি ইৎ হবে, অর্থাৎ অগ্রাহ্য হবে। যেমন প্রথম চারটি শিবসূত্র হলো—
১. অ ই উ ণ্
২. ঋ ৯ ক্
৩. এ ও ঙ্
৪. ঐ ঔ চ্
এই চারটি শিবসূত্রের মিলিত সূত্র প্রত্যাহর হবে অচ্ । এর শেষ বর্ণ চ্ বাদ দিলে পাওয়া যাবে— অ ই উ ণ্ ঋ ৯ এ ও ঐ ঔ। এই বর্ণগুলোই হবে সংস্কৃত ভাষার স্বরধ্বনি। অর্থাৎ অচ্ প্রত্যাহর সূত্র দ্বারা স্বরধ্বনির সংখ্যা পাওয়া গেল। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে এই সূত্রে দীর্ঘ, হ্রস্ব, প্লুত স্বরধ্বনির উল্লেখ নাই।

একই ভাবে ৫ম শিবসূত্র থেকে ১৪শ শিবসূত্র থেকে পাওয়া যায় প্রত্যাহার সূত্র হল্। এর অর্থ হলো সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ। পাণিনি ব্যাকরণে প্রত্যাহার সূত্র মোট ৪৩টি। তাঁর সমগ্র রচনাটি আটটি অধ্যায়ে বিভাজিত এই সূত্রে এই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে- অষ্টাধ্যয়ী। এই ব্যাকরণের অন্যতম ভাষ্যকার ছিলেন পতঞ্জলি।

পাণিণি সংস্কৃত ভাষার সমন্বিত ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেন। সংস্কৃত ছিল তৎকালীন সময়ে ভারতীয় আর্যদের ধর্ম ও সাহিত্যের ধ্রুপদী ভাষা । পাণিণিকে একাধারে সংস্কৃত ভাষার জনক ও প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দেওয়া হয়। অনেকেই আধুনিক ইউরোপীয় ভাষাবিজ্ঞানের জনক ফার্দিনান্দ সাসুরের ওপর পাণিণির প্রভাব লক্ষ করেছেন । আরেক কীর্তিমান ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি তাঁর গবেষণায় পাণিণির ঋন সরাসরি স্বীকার করেছেন।

পঞ্চতন্ত্র মতে, তিনি সিংহের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।



কাশ্মীরে প্রাপ্ত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধর্মকীর্তি কর্তৃক ১৬৬৩ সালে প্রতিলিপিকৃত পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে বার্চ গাছের ছালে লিখিত পাণ্ডুলিপি।
কাশ্মীরে প্রাপ্ত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধর্মকীর্তি কর্তৃক ১৬৬৩ সালে প্রতিলিপিকৃত পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে বার্চ গাছের ছালে লিখিত পাণ্ডুলিপি।


Wednesday, June 17, 2020

সনাতন ধর্মে মানব ছাড়াও অন্য জাতি সম্পর্কে জানতে চাই

আমরা অনেক সময় যক্ষিণী, কিন্নর, বিদ্যাধর, অপ্সরা নাম শুনি। এনারা কিন্তু উপদেবতা। এনাদের সাধনা আছে। অঘোরী সাধুরা এই সব সাধনায় সিদ্ধ। এদের সাধনায় বশ করতে পারলে তারা সাধকের উপকার/ অপকার দুই করতে পারে। যে সাধক যেমন ভাবে এদের সাধনা করবেন- তেমন ভাবেই পাবেন।



 প্রথমে আসি যক্ষিণী সম্বন্ধে। যক্ষ, যক্ষিণী খুবুই কামুক স্বভাব হয়। অনেক সময় এরা মানব মানবী রূপ ধরে ভূলোকের মানব মানবীর সাথে কামপিপাসা চরিতার্থ করে। অনেক সময় সঙ্গী/ সঙ্গিনীর দেহে ভর করে কাম তৃষ্ণা মেটায়। কামকলায় এরা সিদ্ধহস্ত। আবার এনাদের কৃপায় কবিত্ব ভাব, নাট্যশৈলী, কামকলার মূর্তি নির্মাণের শিল্পীকে অলক্ষ্যে শক্তি যোগায়। ‘যক্ষিণী সাধনা’ খুবুই শক্তিশালী। তবে যক্ষিণী দের মাতৃরূপে, ভগিনী রূপে সাধন করাই শ্রেয়। প্রেমিকা রূপে করলে সর্বনাশের আর কিছু বাকী রাখে না এরা। যক্ষদের ওপরে মা লক্ষ্মীর কৃপা অনেক। যক্ষরাজ কুবের হলেন দেবরাজ ইন্দ্রের সম্পদভাণ্ডারের কোষাধ্যক্ষ। যক্ষদের মধ্যে একটা জাতি হল “গুহ্যক”। এরা আবার ভগবান শিবের ভক্ত। সাধুদের বিশ্বাস বিভিন্ন পবিত্র তিথিতে এই যক্ষ যক্ষিণী, গুহ্যকেরা মানব মানবীর ছদ্দবেশে বিভিন্ন শিবমন্দির গিয়ে ভগবান শিবের পূজা করেন। মহাভারতের শিখণ্ডীর সাথে স্থূনাকর্ন নামক এক যক্ষের দেখা হয়েছিল। এরা লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে। আবার যক্ষেরা অনেক জ্ঞানী হয়। মহারাজ যুধীষ্ঠির কে প্রশ্ন করেছিলেন এক যক্ষ। দীপাবলির সন্ধ্যায় যক্ষেরা বের হয়। যে গৃহে সে সময় প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়, যক্ষেরা সেই গৃহে ধন সম্পদ প্রদান করে। হিমালয়ের বিভিন্ন পবিত্র তীর্থে এখনও কুবের তাঁর অনুচরদের নিয়ে বিশেষ তিথিতে রাতে আসেন। ভারতের অনেক সাধু সন্ত এঁদের দর্শন পেয়েছে। তবে উপযুক্ত গুরু ব্যাতীত কেও এই সাধনা করলে বেঘোরে পতন হবার চান্স আছে।



এর পর আসে “গন্ধর্ব”। এদের শরীর থেকে সুন্দর দিব্য সুগন্ধ পাওয়া যায়। এরা কোথাও থাকলে সেখানে বিভিন্ন সুগন্ধি পুস্পের গন্ধ পাবেন। অপূর্ব সুন্দর হয় এরা। স্বর্গলোকে নৃত্যের সময় বাজনা বাজান এরা। এরা নানা সুন্দর অলঙ্কার পরে। অনেক সঙ্গীতজ্ঞকে আড়ালে থেকে শক্তি দান করে। বাদ্যযন্ত্রের ওপর এদের প্রবল আকর্ষণ। এরা আকাশে ভ্রমণের বিদ্যাও জানে। ভারতের অনেক সাধু গন্ধর্ব সাধনায় সিদ্ধ। আবার কেও কেও প্রাণ হারিয়েছে এই সাধনায়। এরাও ভগবান শিবের ভক্ত। শিবরাত্রিতে বিভিন্ন শিবমন্দিরে মানবের ছদ্দবেশে এসে ভগবান শঙ্করের পূজা করেন। কাশী বিশ্বনাথ, উজ্জয়নীর মহাকালে অনেক সাধু সন্ত এদের দেখা পেয়েছেন। গন্ধর্বসাধনায় সিদ্ধ সাধক সঙ্গীত ও বাদ্যশিল্পে  সিদ্ধ হন। এছাড়াও বহু প্রকার সিদ্ধ হন।তবে উপযুক্ত গুরু ব্যাতীত কেও এই সাধনা করলে বেঘোরে পতন হবার চান্স আছে।



এরপর আসে “কিন্নর”। কিন্নর বলতে আমরা ভূলোকের ‘হিজড়া’ বুঝি। হ্যাঁ এনারাও তাই। তবে একটু তফাৎ। কিন্নরদের মধ্যে কিন্নর ও কিন্নরী দুই আছে। এরা স্বর্গে থাকে। সুগন্ধি পারফিউম, ফুল এদের খুব পছন্দ। অনেক সময় এরা মানব শরীরে জন্ম নেয়। তখন এদের শরীরের পুরুষ ভাব স্ত্রী ভাব দুই থাকে। তাই “হিজরা” দের শাপ আর আশীর্বাদ দুই ফলিত হয়। তাই শুভ কাজে এদের উপস্থিতি শুভ। এঁদের আশীর্বাদও শুভ। আর এঁদের অভিশাপ জীবন ধ্বংস করতে যথেষ্ট। তাই হিজরাদের কখনো খারাপ কিছু বলবেন না। এঁদের সাধনায় বহু প্রকার সিদ্ধি লাভ হয়। তবে উপযুক্ত গুরু ব্যাতীত কেও এই সাধনা করলে বেঘোরে পতন হবার চান্স আছে।



“বিদ্যাধর” স্বর্গে থাকে। নানা প্রকার বিদ্যা জানেন। স্থাপত্য বিদ্যা এদের করায়ত্ত। প্রাচীন কালে যজ্ঞশালা নির্মাণে মুনি ঋষিরা যজ্ঞের আগে সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে রচনা করতে এদের আহ্বান জানাতেন। কারণ যজ্ঞ ঠিকঠাক ভাবে না হলে বা ভুলভাল হলে অগ্নিদেবতা  ক্রুদ্ধ হয়ে যজ্ঞের ঋত্বিককে ধ্বংস করেন। যজ্ঞাগ্নির সময় মন্ত্র উচ্চারন নির্ভুল হওয়া চাই। নিয়ম ও বেদী নির্মাণ সঠিক হওয়া উচিৎ। বিদ্যাধরেরা শিল্পীদের আড়ালে থেকে স্থাপত্যকলায় সাহায্য করেন। অনেক সময় সিদ্ধ সাধুদের এরা নানাভাবে সাহায্য করে সাধারন মানুষের উপকার করে। তন্ত্রে এই বিদ্যাধর দের সিদ্ধ করার নানা মন্ত্র ও বিধান আছে।  তবে উপযুক্ত গুরু ব্যাতীত কেও এই সাধনা করলে বেঘোরে পতন হবার চান্স আছে।




“অপ্সরা” স্বর্গে থাকে। দেবতাদের মনোরঞ্জন করে এমন নর্তকী। এদের রূপ লাবণ্য এত সুন্দর যে অসুর থেকে শুরু করে বড় বড় মুনি ঋষিরা সাধন ভুলে যান। অপ্সরা দের মধ্যে সবাই সুন্দর। মেনকা, রম্ভা, ঘৃতাচী, গন্ধকালী, অনুপমা, মনোরমা , সুদেষ্ণা  সকলেই এত সুন্দর যে , একজনের সাথে অপরজনের রূপের তুলনা করা কঠিন। সবচেয়ে সুন্দরী হল “উর্বশী”। অপ্সরাদের ডানাও থাকে। এরা আকাশ মার্গে যথেচ্ছা ভ্রমণ বিদ্যায় সিদ্ধ। এরা সাজতে খুব ভালোবাসে। কোন কুৎসিত কেও এই বিদ্যা রপ্ত করলে অনায়েসে সুন্দর হয়। অপ্সরা রা লম্বা, রোগা, হালকা, সুগঠিত স্তন, গজগামিনী ( মানে গজের ন্যায় ধীরে ধীরে কমোর দুলিয়ে চলে ) । এদের কেশ নিতম্ব স্পর্শ করে, সুন্দর টাণা নয়ন, কপালে কুন্তল রেখা খেলা করে। এরা লোকের ভ্যবিষ্য জানে। অনেক জ্যোতিষী এই বিদ্যায় সিদ্ধ হয়ে মানুষের ভাগ্য বলতে পারেন। এরা স্বর্গেই থাকে। তবে বিশেষ তিথিতে চন্দ্রালোকে এরা হিমালয়ে বিভিন্ন পবিত্র তীর্থে আসে। অনেক সাধু সন্ত এদের দেখেছে। তবে ইন্দ্রিয়বিজয়ী সাধুদের এরা কোন ক্ষতি করতে পারে না। নর-নারায়ণ ঋষির (যারা পরে কৃষ্ণ আর বলরাম হয়েছেন) আশ্রমে, মার্কণ্ড মুনির আশ্রমে এসে এরা কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। তবে উপযুক্ত গুরু ব্যাতীত কেও এই সাধনা করলে বেঘোরে পতন হবার চান্স আছে। 

শাস্ত্রে এমন ভাবেই এদের বর্ণনা আছে। কিছু অঘোরী সাধক ও কাপালিক ও তান্ত্রিক এইসব বিদ্যায় পারদর্শী। ইউটিঊব সার্চ করলে এদের সাধনার মন্ত্রও পাবেন। তবে সাবধান, সামান্য ভুল কিন্তু আপনার জীবন শেষ করতে পারে এঁনারা। যদি চান ত , উপযুক্ত গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে, গুরুর নির্দেশমতো এই সকল সাধনা করতে পারেন। তবে সাধনা করলেই যে এরা আসবে আর আপনি সফল হবেন এমন নাও হতে পারে। অনেকে কিন্তু এসব সাধনা করতে গিয়ে মারাও গেছে বা পাগল হয়ে গেছে। আবার অনেকে সফল হয়ে এই সব বিদ্যায় সিদ্ধ হয়েছে।

Tuesday, June 16, 2020

মহাভারতের কুরুবংশ কিভাবে শুরু হয়েছিল

প্রথমে ভগবান বিষ্ণুর নাভি থেকে পরমপিতা ব্রহ্মার উৎপত্তি হয়।

ব্রহ্মা তার নেত্র থেকে 'মহর্ষি আত্রিকে' সৃষ্টি করেন, আত্রি সপ্তর্ষির একজন।

মহর্ষি আত্রির পত্নি 'অনুসুয়ার' গর্ভে 'চন্দ্রদেবের' জন্ম হয় এবং চন্দ্র দেব এর 'বুধ' নামক পুত্র হয়, বুধ নবগ্রহের একজন।

বুধের পুত্র মহারাজ 'পুরুরবা' পৃথিবীতে 'চন্দ্রবংশ' স্থাপন করেন।

পুরুরবার 'আয়ু', আয়ুর 'নহুশ' এবং নহুষের 'যযাতি' নামক পুত্র হয়।

যযাতির পাঁচ পুত্র হয় তাদের নাম - ' যদু, তুর্বসু, দ্রুহু, অনু ও পুরু।'

যযাতির জেষ্ঠপুত্র যদুর থেকে 'যদু বংশ' এবং কনিষ্ঠ পুত্র পুরু থেকে 'পুর বংশের' স্থাপনা হয়। এই যদু বংশেই দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হন। যযাতির অন্য তিন পুত্রের বংশ কালক্রমে বিলুপ্ত হয়।

পুরুর বংশে তার বহু পুরুষ পরে 'দুষ্মন্ত' নামে এক রাজা হয়, দুষ্মন্তের পর তার পুত্র 'ভরত' চক্রবর্তী সম্রাট হন। এই ভরতের নামেই আমাদের দেশের নাম হয় 'ভারতবর্ষ'।

ভরতের বংশে অনেক পুরুষ পর 'হস্তি' নামে এক রাজা হলেন, তার নামানুসারে তার রাজ্যের নাম হয় 'হস্তিনাপুর'।

হস্তির চার পুরুষ পর 'কুরু' নামক রাজা হলেন, যার তপঃভূমি 'কুরুক্ষেত্র' নামে খ্যাত।

কুরুর সাত পুরুষ পর 'প্রতীপ' নামে এক রাজা হলেন, প্রতীপের পুত্র ছিলেন 'শান্তনু'

শান্তনুর তিন পুত্রের নাম 'ভীষ্ম, চিত্রাঙ্গদ ও বিচীত্রবীর্য।'

বিচীত্রবীর্যের দুই পুত্র 'ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু।' যাদের থেকে শত কৌরব ও পঞ্চপান্ডব গনের জন্ম হয়।

Tuesday, June 9, 2020

বেদ পরা নাকি অপরা?

বর্তমানে ফেসবুক তথা বাংলাদেশের হিন্দু সমাজে যে নামটা আগ্রাসী হয়ে উঠেছে তার নাম হল ইস্কন। 

১০ বছর আগেও সনাতন সমাজে এত মারামারি বা বিভেদ ছিল না। হিন্দুরা শান্তিমতন সমস্ত কাজ কর্ম করে নিজেদের মতন ধর্ম পালন করতো। কিন্তু বাংলাদেশের এই অবস্থা আর আগের মতন নাই। 

ইস্কন নামক অসুরদের আগমনের কারনে আজ সনাতন ধর্মে যা সৃষ্ট হয়েছে তা দূর করতে কত সময় লাগে কে জানে। 

বৈষ্ণব ধর্মের নামে এই অসুরের দল সনাতন সমাজে যা ছড়াচ্ছে তা হল ঘৃণা। মধ্য যুগে কিছু কাল্পনিক তত্ত্ব এবং জগদ্গুরু আদি শংকরের পরবর্তী কিছু আচার্য্যদের হাস্যকর তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া মতবাদ আজ সনাতন সমাজে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই উন্মাদের দল সনাতন সমাজে নিজেদের বিকৃত গীতার বিক্রি বাড়াতে আমাদের মুল ধর্মগ্রন্থ বেদের বিরোধী হয়ে উঠেছে। 

এদের দাবী অনুযায়ী বেদ হল অপরা বিদ্যা। আসুন তাহলে প্রথম জেনে নেই পরা আর অপরা কি?


পরা বিদ্যাঃ  পরা বিদ্যা, যে বিদ্যার সাহায্যে সর্বশক্তিমান পরমব্রহ্মকে জানা যায় তাকেই বলে পরা বিদ্যা।

অপরা বিদ্যাঃ  পৃথিবী ও তৃণাদি থেকে প্রকৃতি পর্যন্ত সব জড় পদার্থের গুণ জেনে তার সাহায্যে কাজে সিদ্ধ হওয়া যায় যে বিদ্যার সাহায্যে তাকেই বলা হয় অপরা বিদ্যা।

সেই অপরাবিদ্যা পরাবিদ্যালাভের ইঙ্গিত দেয়। যে বিদ্যার ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যা ইহলোকিক

সুখের সন্ধান দেয় এবং পারলৌকিক মুক্তির উপায় তা অপরাবিদ্যা। 

এক কথায় এই বিদ্যা মুক্তি দান করতে পারে না কারণ ইহা জাগতিক বিষয়াদির জ্ঞান দেয়। 


এবার আসুন এই ইস্কন কৃৈষ্ণবদের দাবীতে। এই মুর্খদের দাবী হল এরা বলে গীতা পরা বিদ্যা আর বেদ অপরা বিদ্যা। 

এই প্রমাণ স্বরূপ এই মূর্খরা মুণ্ডকোপনিষৎ ১।১।৫  টেনে নিয়ে আসে যথা 


তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যকরণং নিরুক্তং ছন্দ জ্যোতিষমমিতি। অথ পরা যয়া তদক্ষরসমধিগম্যতে।। অর্থাৎঃ বিদ্যার মধ্যে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প ব্যকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ ইহা অপরা বিদ্যা এবং যাহা দ্বারা সেই অবিনাশী পরমাত্মা প্রাপ্ত হয়, তাহা পরা বিদ্যা।







প্রশ্ন এইখানে ২ টি।

  • এইখানে অঙ্গিরা, শৌনকের উদ্দ্যেশে যা বললেন এতে কি প্রমাণিত হয় যে বেদ শুধুই অপরা?

  • বেদে অপরা বলতে এইখানে গুরু কি বুঝিয়েছেন?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর।

ভাগবত গীতা আমাদেরসকল প্রশ্নের সমাধান। এইসব কৃৈষ্ণবরা আসলে দুঃখজনক হলেও যোগেশ্বর কৃষ্ণের কথাও অমান্য করে।
প্রমান দেখে নিন।

গীতার ১৫ অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে - "বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব বেদ্যো"

অর্থাৎ সমস্ত বেদ দ্বারা আমি (পরমাত্মাই) জানার যোগ্য।



তাছাড়া পরম গুরু এবং সনাতন ধর্মের প্রাণ পুরুষ শঙ্করাচার্য্যও তার ভাষ্যে বলেছেন - "বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব চ পরমাত্মা বেদ্যা বেদিতব্যঃ" অর্থাৎ সর্ব বেদ দ্বারা পরমাত্মাই জানার যোগ্য। গীতার এই শ্লোক স্পষ্ট করে দেয় যে, বেদ দ্বারা পরমাত্মাকে জানা যায়।



কঠোপনিষৎ ১। ২।১৫ তে বলা হয়েছে, 
" সর্বে বেদা যত্ পদমামনন্তি 

তপা্ঁসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি ৷ " 

যদিচ্ছন্তো ব্রক্ষচর্যং চরস্তি

তন্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি_ওমিত্যেতৎ ॥ ১৫ " 


অর্থ্যাৎ (যম বলিলেন) “বেদসমূহ একবাক্যে যে ঈন্সিত বস্ত্র প্রতিপাদন
করেন, অখিল তপস্যাদি কর্মরাশি যাঁহার প্রাপ্তির সহায় এবং যাঁহার কামনায় লোকে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে, আমি তোমায় সেই
প্রাপ্যবস্তর সম্বন্ধেই উপদেশ করিতেছি-_ইঁহা ওম্‌ (শব্দের বাচ্য এবং
ওষ্কার ইহার প্রতীক১)। ১।২।১৫

সহজ বাংলায় চার বেদ যাহার স্বরূপের বর্ণনা করে এবং সকল তপস্যা যাহার বর্ননা করে সেই পদ কে তোমার জন্য সংক্ষেপে বলছি। 




উপনিষদের এই বক্তব্যেও স্পষ্ট যে, চার বেদ সেই পরম পদের বর্ননা করে। 
এবার আসি যোগী কৃষ্ণের প্রামাণ্য জীবনী মহাভারতে। যা আমাদের ইতিহাস বলে খ্যাত। 
মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে,

দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে শব্দব্রহ্ম পরং চ যৎ।
শব্দব্রহ্মণি নিষ্পাতঃ পরং ব্রহ্মাধিগচ্ছতি।। 

অর্থাৎ বেদ ও বেদ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্ম উভয়ই পরিজ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি বেদশাস্ত্র বিশেষরূপে অবগত হইতে পারেন, তিনিই অনায়াসে পরব্রহ্ম লাভে সমর্থ হন। 




এখানে, আরো সুস্পষ্ট যে, বেদশাস্ত্র কেউ বিশেষভাবে অবগত হতে পারলে সে পরমব্রহ্ম লাভ করতে পারে।


বেদ স্বয়ং বলছে -

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্যাতি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়।। (যজু ৩১।১৮)

-- অর্থাৎ আমি সেই মহান পূর্ণ পরমেশ্বর কে সূর্যের সমান তেজস্বী এবং অন্ধকারের পরে জানি। তাকে জেনেই মৃত্যুকে পার করা যায়, এছাড়া মোক্ষলাভের জন্য জন্য অন্য কোন মার্গ নেই।


এরপরেও মূর্খ ইস্কনী কৃৈষ্ণব  বলবে যে না বেদ দ্বারা ব্রহ্ম লাভ করা যায় না। তাহলে বলছি শুনুন। আপনাদের ভন্ড সংঘ ইস্কনের অনুবাদ করা বিখ্যাত যে উপনিষদ তা  হল ঈশোপনিষদ। যার মাঝে ২-৩ টা মন্ত্র আপনারা বিকৃত করেছেন। সে দিকে না যাই কারন বিকৃতি আপনাদের রক্তে মিশে গেছে। 
সে নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করবো।
আজ বাঁশ শুধু পরা - অপরা নিয়ে। 

ঈশোপনিষদ্ পুরোটাই যজুর্বেদের ৪০ তম অধ্যায়। এখানে আপনারা যদি এই উপনিষদকে পরাবিদ্যার গ্রন্থ মান্য করেন তবে তো পরোক্ষভাবে বেদেই পরাবিদ্যা মান্য করলেন। শুধু ঈশোপনিষদ্ নয়, যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় তো অধিকাংশ উপনিষদেরই বিভিন্ন জায়গাতে বেদের মন্ত্র সরাসরি এসেছে। যথাঃ



★ কঠোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২।১।১৮ (ঋগবেদ ৩।২৯।২)
(ii) অধ্যায় ২।১।৯ (অথর্ববেদ ১০।৮।১৯)
(iii) অধ্যায় ২।২।২ (যজুর্বেদ ১০।২৪)

★ শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২। ১-৫ (যজুর্বেদ ১১।১-৫)
(ii) অধ্যায় ৩।১৪-১৫ ( যজুর্বেদ ৩১।১-২)
(iii) অধ্যায় ৩। ৫-৬ (যজুর্বেদ ১৬।২-৩)

★ প্রশ্নোপনিষৎ
(i) প্রথম প্রশ্ন ১১ ( ঋগবেদ ১।৬৪।১২)

★ ঐতেরীয়পনিষৎ

(i) শিক্ষাবল্লী প্রথম অনুবাক (ঋগবেদ ১।৯০।৯)
(ii) শিক্ষাবল্লী দ্বাদশ অনুবাক (যজুর্বেদ ৩৬।৯)

★ বৃহদারণ্যকোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২।৫।১৬ (ঋগবেদ ১।১১৬।১২
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৭ (ঋগবেদ ১।১১৭।২২)
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৯ ( ঋগবেদ ৬।৪৭।১৮)

যে মুণ্ডকোপনিষদে পরা অপরার ভেদ দেখানো হয়েছে সে উপনিষদেও বেদের মন্ত্র এসেছে। যথা,
(i) মুণ্ডক ২।২।১ (অথর্ববেদ ১০।৮।৬)
(ii) মুণ্ডক ৩।১।১ (ঋগবেদ ১।১৬৪।২০) 

এবার আসি আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে

বেদে অপরা বলতে এইখানে গুরু কি বুঝিয়েছেন?


 প্রথমে ৪ সংহিতার আলোচনা নিম্নোক্তঃ

বেদের জ্ঞান কান্ড ও কর্মকান্ড দুটি ভাগ
সংহিতা ভাগকে কর্মকান্ড পরিগনিত করা হয়,
 সংহিতা অংশে কর্মকান্ড বেশী প্রধান্য পেয়েছে তা ব্যাবহারিক ও নিত্য নৈমত্তিক কর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু সংহিতা ভাগের( কর্মকান্ড)  মধ্যেও মোক্ষ বিষয়ক  জ্ঞান আছে যা পরাবিদ্যা। 
যেমন উদাহরণ বলা যায়, চালের  মধ্যে কাকড় থাকলেও  আলাদা করে চাল-কাকড় বলা হচ্ছে না, চালই বলা হয়,  তেমনি কর্মকান্ড ভাগকে আলাদা করে পরা-অপরা বলা হচ্ছে না। 
এবার আসুন  মন্ডুক ১/১/৫  এ  ৬  বেদাঙ্গকে  অপরা বলতে গুরু কি বুঝিয়েছেন:
 বলা বাহুল্য লিখিত সব কিছুই অপরা আর শ্রৌতজ্ঞান (শ্রৌত জ্ঞান মোক্ষদায়ক সেই নিরেখে)  যা পরম্পরার মাধ্যমে আসে তাহা দ্বারা শিষ্য অাত্মদর্শন করলে তার যে জ্ঞান তাহাই  পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞান ( উল্লেখ্য এই জ্ঞান ব্রহ্মদর্শী নিজেই উপলদ্ধি করেন এবং ব্রহ্মই হয়ে যান, ব্রহ্মবিৎ ব্রহ্মৈব ভবতি মুন্ডক ৩/২/৯) 
কিন্তু এই পরাজ্ঞান গুরু ব্যাতীত যদি ভগবানের  মাধ্যমেও শিষ্যের নিকট আসে তবে তা অনেকের পক্ষে একবারে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভবপর নাও হতে পারে। উদাহরণঃ অর্জুন, উনি ২ বার  ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাধ্যমে জ্ঞান প্রাপ্ত হলেও তা অনুধাবন করতে ব্যার্থ হয়েছিলেন তাই উনি স্বর্গ লাভ করেন।
অনেক দার্শনিক শ্রৌত জ্ঞানকে সরাসরি পরা বিদ্যা বলেন কারন তা মোক্ষ প্রাপ্তি ঘটায়, তা শিষ্য হৃদয়ঙ্গম করুক বা না করুক, কিন্তু আমাদের মন রাখতে হবে শ্রৌত জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া মানেই মোক্ষ হয়ে যায় না, তা পুনঃ পুনঃ অভ্যাস করতে হয়,  তাই আমরা শ্রুতিজ্ঞান একবার পাঠ করলেই মুক্তি পায় না তাছাড়া গীতার মতন সংহিতা বা পুরান থেকে শ্রৌত জ্ঞানটুকু আলাদা করলে তাহাও পরাজ্ঞান হবে।
বিঃদ্রঃ গীতা স্বতন্ত্র গ্রন্থ নয় তা মহাভারতের অংশ।
পাঠক নিম্নোক্ত  ৬ বেদাঙ্গের বর্ননা থেকে বুঝতে পারবেন আমরা যা বলি বা লিখি তা এই ৬ বেদাঙ্গের মাধ্যমেই। 

(১) শিক্ষা : প্রাচীনকালে বেদপাঠ ছিল নিত্যকর্ম। এছাড়া যজ্ঞের সময় বেদপাঠ ছিল আবশ্যিক। শিক্ষা গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈদিক সংহিতার বর্ণ, স্বর, প্রভৃতির উচ্চারণ রীতির বিস্তৃত আলোচনা করা। শিক্ষার বিষয়বস্তুকে আরও ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়েছে ব্যাকরণে। যজ্ঞকে সুসম্পন্ন করতে হলে বেদ সংহিতার প্রতিটি বর্ণের খাঁটি উচ্চারণ ও খাঁটি স্বরক্ষেপ অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। মাত্রা ও স্বরের সামান্যতম ভুল একটি বৈদিক শব্দের অর্থ বিপরীতার্থক করে তুলতে পারে তাই এই সাবধানতা।

(২) কল্প : কল্পশাস্ত্র সূত্রাকারে লিখিত। এতে আছে যজ্ঞের প্রয়োগবিধি এবং গার্হস্থ্য জীবনের আচরণীয় সংস্কার। চারভাগে বিভক্ত এই কল্পশাস্ত্র। (ক) শ্রোত সূত্র, (খ) গৃহ্য সূত্র, (গ) ধর্ম সূত্র ও (ঘ) শুল্ব সূত্র।

বেদোক্ত যজ্ঞের প্রয়োগবিজ্ঞান এবং সেই যজ্ঞ-ভাবনার আদর্শে জীবন ও সমাজকে গড়ে তোলা এইগুলো হল কল্পসূত্রের বিষয়বস্তু। প্রাচীন যাগযজ্ঞের নিয়মকানুন স্থান পেয়েছে শ্রোতসূত্রগুলোয়। গৃহীর জীবনে অবশ্য কর্তব্য আচার অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে গৃহ্যসূত্রে। ভারতীয় সমাজের সবরকম কর্তব্য এবং জ্ঞাতব্য বিষয়ের hand book হচ্ছে ধর্মসূত্র। ধর্মসূত্রগুলোর বিষয় অত্যন্ত ব্যাপক ও বিচিত্র। রাজনীতি, সমাজনীতি, বর্ণাশ্রম ধর্মের নিয়ম, ব্যবহারশাস্ত্র প্রভৃতি অসংখ্য বিষয়ের আবতারণা করা হয়েছে ধর্মসূত্রে। এরপর শুল্বসূত্র। শুল্ব কথার মানে জমি মাপার দড়ি। দড়ির সাহায্যে জ্যামিতিক নক্সা আঁকা হত বলে হয়তো এইসব সূত্রের নাম হয়েছে শুল্বসূত্র। কারণ জ্যামিতির বিভিন্ন উপপাদ্য, সম্পাদ্য ও সিদ্ধান্ত সূত্রাকারে শুল্বসূত্রে নিহিত রয়েছে। যজ্ঞবেদী তৈরির জন্য শুল্বসূত্রের সাহায্য নেওয়া হত।

(৩) ব্যাকরণ : ভাষাকে শুদ্ধ রাখতেই ব্যাকরণের প্রয়োজন। বেদাঙ্গ ব্যাকরণ এখন লুপ্ত। পানিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে চৌষট্টি জন পূর্বাচার্যের নাম করেছেন। বেদমন্ত্রগুলোকে বিভিন্ন যজ্ঞীয় কাজে প্রায়শই লিঙ্গ, বচন ও পুরুষের বিপরিণাম বা রূপান্তর ঘটিয়ে প্রয়োগ বা বিনিয়োগ করতে হত। ব্যাকরণ ছাড়া তা সম্ভব নয়। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির মতে, যিনি বৈদিক মন্ত্রের পদ, অক্ষর, বর্ণ এবং স্বর বিশ্লেষণ করতে সমর্থ, একমাত্র তিনিই বেদবিহিত যজ্ঞের অধিকারী।

(৪) নিরুক্ত : নিরুক্তের সঙ্গে নিঘন্টুর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। নিঘন্টু হল বৈদিক শব্দের সংগ্রহ। যাস্ক নিঘন্টুর শব্দের যে ব্যাখ্যা করেছেন তাই নিরুক্ত নামে প্রচলিত। ব্যাকরণ শব্দকে ভেঙে আলাদা করে দেয় আর নিরুক্ত পদকে ভেঙে তার ব্যাখ্যা করে। ব্যাকরণের সম্বন্ধ শব্দের সঙ্গে, নিরুক্তের সম্বন্ধ অর্থের সঙ্গে। পদকে ভাঙলে তবেই তার অর্থ গ্রহণ করা সহজ হয়। তাই ব্যাকরণ ও নিরুক্ত পরস্পরের পরিপূরক। ব্যাকরণ শব্দানুশাসন আর নিরুক্ত হল অর্থানুশাসন। যাস্ক বলেছেন যে নিরুক্ত পুরোপুরি আয়ত্তে না থাকলে বৈদিক মন্ত্রের অর্থাবধারণ সম্ভব নয়।

(৫) ছন্দ : ছন্দ স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। ঋক ও সাম সংহিতার সব মন্ত্রই ছন্দোবদ্ধ। সাম সংহিতার মন্ত্র গীত হত। মন্ত্রের ঋষি, দেবতা ও ছন্দের জ্ঞান অত্যাবশ্যক। এগুলো না জেনে মন্ত্র পাঠ করা, মন্ত্র পড়ানো বা মন্ত্র প্রয়োগ করা সবই দোষাবহ। ছন্দঃ পদ্যে চ বেদে চ। ছন্দ ছাড়া গদ্যের অস্তিত্ব নেই। বেদও ছন্দোময়। সুরসভায় বসে শ্রোতার হৃদয়তন্ত্রীতে যেমন সুরের ঝংকার ওঠে তেমনি অপার কাব্য সংসারে কবি প্রজাপতি যখন সৌন্দর্যের সুরলহরী তোলেন তখন বৈদিক কবি নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। তিনিও আবেগ ভরে গেয়ে ওঠেন, ‘কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম’। আমার সম্মুখে এত রূপ, আমি কার পূজো করব? প্রকৃতির এক একটি রূপ সুরে ধরা দেয় তার অন্তরে, ভাব পায় ভাষা। সুরে সুর মিলিয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন এক একটি স্তোত্র গাথা। তাল ও লয়ের সমন্বয়ে অধরা মাধুরী ছন্দোবন্ধনে ধরা পড়ে। তাই বেদ হয় ‘ছন্দস’।

তমসার তীরে গোধূলিছায়ায় ক্রৌঞ্চবিরহের যে করুণ সুর আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে বাল্মীকির মর্মবীণায় আঘাত করেছিল সেই লোকোত্তর করুণাধারা ভাষা-মূর্তি পেল বাল্মীকির মুখে,

‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্‌।।’

অবাক বিস্ময়ে বাল্মীকিও প্রশ্ন করেছিলেন, এ আমি কি বললাম? সৃষ্টি হল ছন্দের, সৃষ্টি হল কাব্যের।

(৬) জ্যোতিষ : বৈদিক যাগযজ্ঞের সঙ্গে জ্যোতিষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতির বিশেষ বিশেষ অবস্থান বা তিথি অনুসারে যজ্ঞ প্রভৃতির অনুষ্ঠানের বিধান ছিল, সুতরাং কাল-বিজ্ঞান শাস্ত্র বা জ্যোতিষের জ্ঞান না থাকলে বেদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। তিনখানা বেদাঙ্গ জ্যোতিষের খোঁজ পাওয়া গেছে। একটি ঋগ্বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, এতে আছে ছত্রিশটা শ্লোক। অন্যটা যজুর্বেদীয় জ্যোতিষ। এতে ঋগ্বেদাঙ্গ জ্যোতিষের ত্রিশটা শ্লোক আছে, বাড়তি আছে আরো তেরোটা শ্লোক। তৃতীয়টা হচ্ছে অথর্ববেদীয় জ্যোতিষ। প্রাচীন ভারতবর্ষে গণিতের সূচনাও জ্যোতিষের সঙ্গে। কারণ জ্যোতিষ (astronomy) গণিত নির্ভর।
তথ্যসুত্রঃ "Vedanga"। Princeton University। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।

পাঠক যিনি উপোরক্ত লেখাটা পড়লেন, বুঝতেই পারছেন যে এই ৬ বেদাঙ্গ ছাড়া জগতে লেখনি বা শব্দ বা বাক প্রকাশ আর কিছুই নেই। পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে কি সবই অপরা? উত্তরঃ সংহিতা, উপনিষদ, ৬ বেদাঙ্গ বা শ্রৌত জ্ঞান দ্বারা যে আত্মজ্ঞান তথা অক্ষর ব্রহ্মকে উপলদ্ধি হয় তাই ই পরাজ্ঞান। অর্থাৎ যা শুনছি বা পড়ছি সেই অপরা জ্ঞান থেকেই পরাতে উন্নত হতে হয়।

এই ক্ষেত্রে দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রীর বেদসার  থেকে ২ টি মন্ত্র দেখে নেই। 

অংতি সম্ভং ন জহাত্যস্তি সম্তং ন পশ্যতি।
দেবস্য পশ্য কাব্যং ন মমার ন জীর্যতি ॥
 অথর্ববেদ ১০/৮/৩২।
বঙ্গানুবাদ *- মনুষ্য সমীপবর্তী পরমাত্বাকে দেখেও না,তাহাকে ছাড়িতেও পারে
না। পরমাত্মার কাব্য বেদকে দেখ; তাহা মরেও না, জীর্ণও হয় না।

এই মন্ত্রে  বেদকে পরমাত্মার কাব্য বলা হচ্ছে, তা কি করে অশ্রেষ্ট হয় বোধগম্য হয় না। 



সুতা ময়া বরদা বেদমাতা প্রচোদয়স্তাং পাবমানী দ্বিজানাম্‌ । 
আয়ুঃ প্রাণং প্রজাং পশুং কীর্ত্তিং  দ্রবিণং ব্রহ্ম বর্চসম‌।
 মহং দত্তা ব্রহ্মলোকম্‌ ॥ অথবর্বেদ ১৯/৭১/১।

বঙ্গানুবাদ - ভক্তের উক্তি- মনের উৎসাহ দাত্রী দ্বিজদের পবিত্র কারিণী, শ্রেষ্ঠ জ্ঞান
দাত্রী বেদ মাতাকে আমি অধ্যায়ন করিযাছি। প্রভুর উক্তি- আয়ু, প্রাণ, প্রজা, পশু, কীর্তি
জ্ঞানতেজ আমাতে অর্পণ করিয়া তুমি মুক্তি প্রাপ্ত হও।
এই মন্ত্রে বেদকে শ্রেষ্ট জ্ঞান বলা হচ্ছে।
 মুন্ডক ১/১/৫ এর রেফারেন্স দিয়ে এবং অপরার অর্থ অশ্রেষ্ট করে যারা গীতাই শ্রেষ্ট জ্ঞান এরুপ প্রচার করতে মরিয়া হয়ে রেফারেন্স চেয়ে থাকেন যে কোথায় বেদকে সরাসরি শ্রেষ্ট বলা হয়েছে? 
এটা তাদের জন্য। আসলে বিধিমুখ শ্রবন না করায় এরা এই ধরণের অপব্যাখ্যা করে। আমরা শ্রুতিতে দেখতে পাই ব্রহ্মবিদ্যা ধারণের জন্য সঠিক আঁধার দরকার। কেন এই কথা বলা হল এর তাৎপর্য  আশা করি বিচক্ষন পাঠক বুঝতে পারবেন। 





একই কথা বেদেও আছে তা আপনারা উক্ত শ্লোকদুটির রেফারেন্সে দেখতে পাচ্ছেন। 
১ নং স্ক্রীনশটে অথর্ব্ববেদ ১০/৮/৩২ এবং 
২ নং স্ক্রীনশটে অথর্ব্ববেদ ১৯/৭১/১ 

তাহলে এতেই প্রমাণিত হচ্ছে যে বেদ শুধু যে অপরা তা একদম না। বরং বেদ পরাও বটে । 
এরা যে হিন্দু বা সনাতনী নামের কলংক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আপনি যদি সনাতন গৃহে জন্ম নিয়ে থাকেন তো এদের বর্জন করুন এবং সনাতন সমাজ থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করুন। 
সবার শুভ বুদ্ধির কামনায়।

হর হর মহাদেব ! 

Saturday, June 6, 2020

শিব লিঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত পর্ব ২

শিবলিঙ্গ নিয়ে সাধারণ মানুষের একটা ধারণা আছে যে এইটি ভগবান শিবের জননাঙ্গ
লিঙ্গ শব্দের অর্থ সংস্কৃতে ‘চিহ্ন বা প্রতীকব্যাকরণ বইয়ে নিশ্চয় সবাই লিঙ্গ বিষয়টা পড়েছ যা স্ত্রী বা পুরুষ বুঝায়। কিন্তু তোমরা লিঙ্গ দিয়ে যে জননাঙ্গ বুঝাও তা যদি বলি তাহলে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটা কোথা থেকে আসলো? তাহলে কি স্ত্রীরও কি লিঙ্গ আছে?
না, নেই।” তাই না? তাহলে বাংলা বা হিন্দিতে যে ব্যাকরণগুলো লেখা হয়েছে তাতে লিঙ্গ শব্দটা কেন এই বিষয়ে প্রয়োগ হয়েছে?
ব্যবহার হওয়ার কারণ এই যে, এগুলো এখন পর্যন্ত সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরনের উপর নির্ভরশীল। সংস্কৃতে প্রত্যেক শব্দ সুগঠিত। এতে প্রত্যেক শব্দের মূল শব্দ বা ধাতু, প্রত্যয় এবং বিভক্তিআদিতে ভাগ করা যায়। এতে লিঙ্গ শব্দ বলতে বুঝানো হয়েছে সেই সব চিহ্নকে অর্থাৎ প্রত্যয়কে বা প্রত্যয়যুক্ত শব্দকে যা স্ত্রী বা পুরুষ চিহ্নিত করে।
এই থেকে তো এইটুকু প্রমাণিত হলো যে লিঙ্গ শব্দটা কোন জননাঙ্গকে বুঝায় না।
তাহলে লিঙ্গটা কি? কেনই বা এর পূজা করা হয়?
হিন্দুদের ইতিহাস লেখা এমন অনেকগুলো বই আছে যেগুলো ‘পুরাণ’ নামে প্রসিদ্ধ। তার মধ্যে ১৮টি পুরাণ অতি প্রাচীন। ওই অষ্টাদশ মহাপুরাণের মধ্যে অন্যতম ‘লিঙ্গপুরাণ’, যাতে লেখা আছে লিঙ্গের রহস্য ও এর তথ্যাবলি। 
লিঙ্গ পুরাণে দুই প্রকার শিবের বিষয় লিখিত আছে– অলিঙ্গ ও লিঙ্গ। যেমন–
জগদ্যোনি মহাভূতং স্থূলং সূক্ষ্মমজং বিভূম্ ।
বিগ্রহং জগতাং লিঙ্গং অলিঙ্গাদভবত্ স্বয়ম্ ।। (লিঙ্গপুরাণ তৃতীয় অধ্যায়)
অর্থাৎ : স্থূল, সূক্ষ্ম, জন্ম-রহিত ও সর্ব-ব্যাপী মহাভূত-স্বরূপ লিঙ্গ শিব জগতের কারণ ও বিশ্ব-রূপ। তিনি অলিঙ্গ-শিব হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন।
অন্যদিকে বিদ্যেশ্বর সংহিতার মতে–
শিব একো ব্রহ্মরূপত্বান্নিষ্কলঃ পরিকীর্তিতঃ।
রূপিত্বাৎ সকল স্তদ্বৎ তস্মাৎ সকল নিষ্কলঃ।।
নিষ্কলত্বান্নিরাকারং লিঙ্গং তস্য সমাগতম্ ।
সকলত্বাৎ তথা রেবং সাকারং তস্য সঙ্গতম্ ।। (বিদ্যেশ্বর-সংহিতা)
অর্থাৎ : ব্রহ্ম যেমন নির্গুণ ও সগুণ দুই প্রকারই হন, তেমনি নিষ্কল শিব নিরাকার লিঙ্গরূপী এবং সগুণ শিব সাকার রূপধারী।
লী’ ধাতুর অর্থ লয় পাওয়া এবং ‘গম’ ধাতুর অর্থ বহির্গত হওয়া। কৌলজ্ঞাননির্ণয়ে তাই বলা হয়েছে–
যস্যেচ্ছয়া ভবেৎ সৃষ্টির্লয়স্তত্রৈব গচ্ছতি।
তেন লিঙ্গন্তু বিখ্যাতং যত্র লীনং চরাচরম্ ।।’ (কৌলজ্ঞাননির্ণয়-৩/১০)
অর্থাৎ : যে পরম সত্তার থেকে জগতের উৎপত্তি হয় এবং যাঁর মধ্যে জগৎ লীন হয় সেই পরম কারণই লিঙ্গ।
স্কন্দপুরাণেও প্রায় একইরূপ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়–
আকাশং লিঙ্গমিত্যাহুঃ পৃথিবী তস্য পীঠিকা।
আলয়ঃ সর্বদেবানাং লয়নাল্লিঙ্গমুচ্যতে।।
শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার মতে–
লিঙ্গঞ্চ শিবয়োর্দেহস্তাভ্যাং যস্মাদধিষ্টিতং। (বা. স. উত্তরভাগ- ২৭/১২)
অর্থাৎ : শিবশক্তি লিঙ্গেতে নিত্য অধিষ্ঠান করেন।
লিঙ্গপুরাণ, শিবপুরাণ ও স্কন্দপুরাণেই শিব ও শিবলিঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হওয়া যায়। পুরাণের স্বাভাবিক ধারা অনুসারে লিঙ্গপুরাণে বিভিন্ন প্রকার শিবমূর্তির বর্ণনা এলেও এবং সেই সব মূর্তির পূজাদির কথা বলা হলেও লিঙ্গার্চনার উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে বেশি। শিবের লিঙ্গমূর্তির পূজা না করার জন্যই যে তারকাসুরের ধ্বংস হয়েছিল সেকথা জানিয়ে পিতামহ ব্রহ্মা অতঃপর বলছেন–
পূজনীয়ঃ শিবো নিত্যং শ্রদ্ধয়া দেবপুঙ্গবৈঃ।
সর্বলিঙ্গময়ো লোকঃ সর্বং লিঙ্গে প্রতিষ্ঠিতম্ ।।
তস্মাত্সম্পূজয়েল্লিঙ্গং যইচ্ছেৎ সিদ্ধিমাত্মনঃ।
সর্বে লিঙ্গার্চনাদেব দেবাদৈত্যাশ্চদানবাঃ।।
যক্ষা বিদ্যাধরাঃ সিদ্ধা রাক্ষসাঃ পিশিতাশনাঃ।
পিতরো মুনয়শ্চাপি পিশাচাঃ কিন্নরাদয়ঃ।।
অর্চয়িত্বালিঙ্গমূর্তিং সংসিদ্ধানাত্র সংশয়ঃ।
তস্মাল্লিঙ্গং যজেন্নিত্যং যেনকেনাপিবা সুরাঃ।। (লিঙ্গপুরাণ-১/৭৩/৬-৯)
অর্থাৎ : যে নিজের অভিষ্ট সিদ্ধি করতে চায়, সে লিঙ্গ পূজা করবে। কারণ সমস্ত জগৎ লিঙ্গাধীন এবং লিঙ্গে সমগ্র জগৎ অধিষ্ঠিত। দেব, দৈত্য, দানব, যক্ষ, বিদ্যাধর, সিদ্ধ, রাক্ষস, পিতৃপুরুষগণ, মুনি, কিন্নর সকলেই লিঙ্গমূর্তি মহাদেবকে পূজো করে সিদ্ধ হবে। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
ওই পুরাণের তৃতীয় অধ্যায়ের একেবারে প্রথমেই এই লিঙ্গের বর্ণনা আছে এইভাবে-
জ্ঞানীগণ নির্গুণ ব্রহ্মকেই লিঙ্গ বলে। মহাদেব সেই নির্গুণ ব্রহ্ম, তার থেকেই অব্যক্ত আবির্ভূত হয়েছে। শ্রেষ্ঠ লিঙ্গ প্রধান ও প্রকৃতি নামে প্রসিদ্ধ। রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শব্দ বর্জিত পরমেশ্বর শিবই অলিঙ্গ(চিহ্নহীন)। আবার তিনি নিজেই পঞ্চভূত(জল-তরলের প্রতীক, বায়ু-বায়বীয় পদার্থের প্রতীক, পৃথিবী-কঠিন পদার্থের প্রতীক,অগ্নি-শক্তির প্রতীক, আকাশ- অন্তরীক্ষ, শূন্য ও স্থানের প্রতীক ), পঞ্চতন্মাত্র(রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ) সকল গুণ ভূষিত লিঙ্গ রূপ উৎপন্ন হয়েছেন। এবং তার থেকেই সৃষ্টির কারণ শিবস্বরূপ প্রধান দেবত্রয়(সৃষ্টিকর্তা-ব্রহ্মা, পালনকর্তা-বিষ্ণু ও সংহারকর্তা-শিব) আবির্ভূত হয়েছেন।”
এবার দেখা যাক বেদ কি বলে-
সর্বপ্রথম কিছুই ছিল না, একেবারে কিছুই না। একমাত্র পরমেশ্বর ছিলেন আত্মারূপে, চিহ্ন বর্জিত। তার মধ্যে ইচ্ছার(সংস্কৃতে কাম/কামনা) সৃষ্টি এবং তা হতে সকল কিছুর সৃষ্টি।“
(ঋগ্বেদ মণ্ডল-১০, সুক্ত-১২৯ - নাসদীয় সুক্তম্)
অর্থাৎ প্রথমে সবকিছু একস্থানে ঘনীভূত ছিল যা হতে সব উৎপন্ন হয়েছে। এবং এই জিনিসটিকেই ঈশ্বরের প্রথম চিহ্ন ধরা হয় যাকে লিঙ্গ বলে, যা স্বয়ং ‘স্রষ্টা ও সৃষ্টি’।
(যোগশিখা উপনিষদ)
বেদের একই সুক্তে বলা হয়েছে, "এবার সেই কারণ সলিল নির্মিত পিণ্ড উপরে ও নিচে উঠতে লাগলো। আর মধ্যেও তার বিস্তার হতে থাকে। এই স্তম্ভকেই বলে লিঙ্গ।"
কেবল সেখানেই নয়, লিঙ্গপুরাণের লিঙ্গোদ্ভব অধ্যায়েও তাই বলা হয়েছে।
লিঙ্গের আকৃতি দেখলে আসা করি শুধু একটা উপবৃত্তাকার-স্থম্ভ দেখবে না! তার সঙ্গে নিচে বেদী আকৃতির একটি অংশ ও দেখবে। এটি আবার কি? মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগবে। তাহলে সেই উত্তরের সমাধান নিশ্চয়ই আছে। আর এর উত্তর সর্বদা লিঙ্গের পাশে বিদ্যমান থাকে।
সমগ্র শিবলিঙ্গের আকৃতির তিন ভাগ আছে। যদি শিবলিঙ্গ দেখে থাকো তাহলে নিশ্চয়ই দেখবে তার পাশে ত্রিশূল বসানো। তার তিনটি শূল তিন গুণের প্রতীক, যথা-
১। সত্ত্ব,
২। রজ,
৩। তম
এই তিন গুণ সৃষ্টির তিন কারণকে (সৃষ্টিকর্তা- ব্রহ্মা, পালনকর্তা- বিষ্ণু ও সংহারকর্তা- শিব) বুঝায়। আর এই তিন প্রধান দেবতা নিচ থেকে সম্পূর্ণ লিঙ্গটা সৃষ্টি করে এই ভাবে-
১। সবার নিচের অংশ বা ভুমি ভাগ-
এই ভাগ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার অংশ। এটি আমাদের বুঝায় সব কিছুর মুলেই সৃষ্টিকর্তা বিদ্যমান। আর সবকিছুর সাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন শান্তিময় স্থান এটি। অর্থাৎ ঈশ্বরের ছত্রতলেই জগতের সব শান্তি।
২। পীঠ বা মধ্য ভাগ-
এটা সেই অংশ যাতে পালনকর্তা বিষ্ণু অবস্থান করে। এই অংশ বুঝায় বিষ্ণু নিজে আমাদের ধারণ করেছেন তার মধ্যে এবং সুরক্ষা দিচ্ছেন। এইটি রজগুণকে বুঝায় যা সত্ত্ব আর তমের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। আবার এই অংশ বিষ্ণুর বৈশিষ্ট্যকেও বোঝায়। বিষ্ণু মোক্ষ দানে সহায়তা করে, যা শিব লিঙ্গে ঢালা জলের মধ্যে প্রকাশ পায়। জল যা জীবনের প্রতীক তা জগতে ঈশ্বরের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতিতে এসে আবার বিলীন হয়ে যায়।
এই দুই ভাগকে মিলে আবার প্রকৃতি ভাগও বলে, যা পুরুষ বা পরমাত্মাকে ধারণ করে। জগতমাতা দুর্গা এই প্রকৃতি। বিশেষ উল্লেখ্য এই যে শিব বেদে রুদ্র বলে বর্ণিত যে সর্বদা শান্ত থাকে শম্ভু রূপে যা শক্তি অর্থাৎ দেবী দুর্গার কারণে। লিঙ্গের এই অংশ তাই তিনি বিরাজ করেন। আর শিবের যে বিগ্রহগুলো থাকে তার বেশিরভাগই রুদ্র মূর্তি যা সংহারের ইঙ্গিত করে। তাই যুদ্ধ ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই শিবকে লিঙ্গে পূজা করা হয়।
৩। সর্বোপরি রুদ্র ভাগ-
এই অংশ মূল লিঙ্গকে বলে। একে পূজা ভাগও বলে। এতে পুরুষ(বেদে বর্ণিত পরমাত্মা, বা ঈশ্বর) বা শিব অবস্থান করে। যা সর্বশক্তির উৎস ও কেন্দ্র। লিঙ্গপুরাণের পূর্বভাগের অধ্যায়-১৭ তে এর বর্ণনা দেওয়া আছে এইভাবে যে শিব নিজে এই ভাগে ধ্যান অবস্থায় আছেন। যা হতে তিনি প্রথম আবির্ভূত হয়েছেন। অথর্ববেদের দশম কাণ্ডে তো সুস্পষ্ট ভাবে স্তম্ভের মধ্যে পরমেশ্বরের আরাধনার কথা লেখা আছে।
এই লিঙ্গ যে শুধু সৃষ্টি স্থিতি আর লয় বা পুরুষ ও প্রকৃতির কিম্বা পরমেশ্বরের কথা বলে তাই না। এটি আমাদের আত্মাকে ও জ্ঞানকে জাগ্রত করে। কিভাবে?
এভাবে- ইরা, পিঙ্গলা আর সুষুম্নাযদি কেউ যোগশাস্ত্র(অনেকে যাকে ইয়োগা বলে চিনো সেই বিষয়টা) পড়ে থাকো তাহলে এই তিনটা শব্দ নিশ্চয়ই শুনে থাকবে। ইরা আর পিঙ্গলাকে নদী বলে যা প্রাণীর দেহে প্রবাহিত হয়। মূলত এগুলো দেহের স্নায়ু তন্ত্রের দুইভাগকে বুঝায়, যা দুটি সাপ দিয়ে দেখানো হয়। আর সুষুম্না হলো মেরুদণ্ডে অবস্থিত মধ্য সুষুম্না। যোগশাস্ত্র মতে, এই সুষুম্নার মধ্যে সাতটি চক্র আছে, যা আমাদের জীবনের সঞ্চালক শক্তি। এগুলো যদি সম্পূর্ণ রূপে সক্রিয় হয় তাহলে মানুষ আধাত্মিক ও আত্মিক ভাবে জাগ্রত হবে, শান্তি এবং আনন্দ অনুভব করবে, বুদ্ধি বৃদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক ভাবে সংযোগ বৃদ্ধিসহ আরও অনেক লাভ পাবে। আর শিবলিঙ্গ এর সম্পূর্ণ জাগ্রত প্রতীক। কিভাবে?
মূল লিঙ্গের ভেতরে সক্রিয় সাতটি চক্র বিদ্যমান এবং শিবলিঙ্গে সাপ দেখবে যা কুণ্ডলিনী চক্রের মতো সাড়ে তিন প্যাঁচ দিয়ে উপরে উঠে। এবং এই শক্তি আমাদের মন স্থির করতে সাহায্য করে, তাই এটি আমাদের আধ্যাত্মিক ভাবে জাগ্রত এবং মানসিক ভাবে শান্ত করে। বিশ্বাস হচ্ছে না?
এটার প্রমান আমি দিবো না, তুমি নিজেই একটা নিস্তব্ধ শিব মন্দিরের গর্ভগৃহের(মন্দিরের সেই ঘর যাতে দেবতা থাকে) সামনে যাও, কোন কিছু করতে হবে না, না তাকে নমস্কার করতে হবে, না পূজা করতে হবে, শুধু চুপ করে একবার শান্ত হয়ে লিঙ্গটির দিকে দেখ আর চোখ বন্ধ করে আশেপাশের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করো। নিজেই বুঝতে পারবে এর তাৎপর্য।শেষ একটা উদাহরণ দিতে গেলে দেখা যায় ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়, কারণ জগতপালক শ্রীবিষ্ণু নিজেই একবার মানবকূল রক্ষা করতে একটা স্থম্ভ হতে আবির্ভূত হয়েছিলেন দেব নৃসিংহ রূপে। যা বিষ্ণু আর শিবকে দুইজন হয়েও এক করে দেয়।
(নৃসিংহ পুরাণ)
সাকার হয়েও নিরাকার এই শিবলিঙ্গ আবার নিরাকার হয়েও সাকার।কারণ-
শিব সাকার কিন্তু লিঙ্গের মধ্যে তার আকার নেই, কিন্তু পরমেশ্বর নিরাকার কিন্তু লিঙ্গে তিনি লিঙ্গ আকৃতিতে অবস্থিত। এবং এই জন্যই সকল প্রকার আরাধনাই এই শিবলিঙ্গে সম্ভব, যা একই সঙ্গে সাকার ও নিরাকার এবং সমগ্র জগতের প্রাণ কেন্দ্র।আবার এর আশেপাশে থাকা সবকিছুই জ্ঞানের প্রতীক। ত্রিশূল যেমন আমাদের সৃষ্টির তিন কারণ যা এক পরমেশ্বর বুঝায়, তেমনি তার প্রক্রিয়াও বুঝায়। যা তার তিন শূল থেকে ঝুলতে থাকা ডমরু হিসাবে থাকে। এইভাবে- তিন ঈশ্বর এক হয় যখন তখন এক মহাজাগতিক কম্পন বা নাদ সৃষ্টি করে যা হতে সবকিছুর সৃষ্টি। এর গায়ে আঁকা হয় মঙ্গল-তিলক যা ত্রিপুণ্ড্র নামে পরিচিত তা ঈশ্বরের সৃষ্টির তিন লোক(স্বর্গ মর্ত আর পাতাল) বুঝায়।
১৯০০ সালে প্যারিসে ধর্মীয় আলোচনায় রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, "শিবলিঙ্গ ধারণাটি এসেছে অথর্ববেদ সংহিতা গ্রন্থে যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ নামে একপ্রকার বলিদান স্তম্ভের স্তোত্র থেকে, কারণ এখানেই প্রথম শিবলিঙ্গ পূজার কথা জানা যায়। এই স্তোত্রে আদি ও অন্তহীন এক স্তম্ভ বা স্কম্ভ-এর বর্ণনা পাওয়া যায়। এই স্তম্ভটি চিরন্তন ব্রহ্মের স্থলে স্থাপিত। যজ্ঞের আগুন, ধোঁয়া, ছাই, সোম লতা এবং যজ্ঞকাষ্ঠবাহী ষাঁড়ের ধারণাটির থেকে শিবের উজ্জ্বল দেহ, তাঁর জটাজাল, নীলকণ্ঠ ও বাহন বৃষের একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাই মনে করা হয়, উক্ত যূপস্তম্ভই কালক্রমে শিবলিঙ্গের রূপ ধারণ করেছে। লিঙ্গপুরাণ গ্রন্থে এই স্তোত্রটিই উপাখ্যানের আকারে বিবৃত হয়েছে। এই উপাখ্যানেই কীর্তিত হয়েছে সেই মহাস্তম্ভ ও মহাদেব রূপে শিবের মাহাত্ম্য"।

জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ গুস্তাভ ওপার্ট শালগ্রাম শিলা ও শিবলিঙ্গের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রে এগুলিকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে সৃষ্ট প্রতীক বলে উল্লেখ করলে তারই প্রতিক্রিয়ায় স্বামী বিবেকানন্দ এই কথাগুলো বলেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, শালগ্রাম শিলাকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গ বলাটা এক কাল্পনিক আবিষ্কার মাত্র। তিনি আরও বলেছিলেন, শিবলিঙ্গের সঙ্গে পুরুষাঙ্গের তুলনা বৌদ্ধধর্মের পতনের পর বিদেশ হতে আগত ভারতের অন্ধকার যুগে কিছু অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি ও শাসকের মস্তিস্কপ্রসূত উদ্ভট বানোয়াট গল্প।

শ্রী স্বামী শিবানন্দও শিবলিঙ্গকে যৌনাঙ্গের প্রতীক বলে স্বীকার করেননি। ঔপন্যাসিক ক্রিস্টোফার ইসারউড লিঙ্গকে যৌন প্রতীক মানতে চাননি। ১৮৪০ সালে এইচ. এইচ. উইলসনও এই একই কথা বলেছিলেন। ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়ায় "Lingam/Lingham" ভুক্তিতেও শিবলিঙ্গকে যৌন প্রতীক বলা হয়নি। যদিও অধ্যাপক ডনিগার পরবর্তীকালে তাঁর দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি বইতে নিজের বক্তব্য পরিষ্কার করে লিখেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো কোনো ধর্মশাস্ত্রে শিবলিঙ্গকে ঈশ্বরের বিমূর্ত প্রতীক বা দিব্য আলোকস্তম্ভ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এইসব বইতে লিঙ্গের কোনো যৌন অনুষঙ্গমূলক অর্থ নেই। তাই শিবলিঙ্গ কোনক্রমেই স্ত্রী-পুরুষের মিলিত অঙ্গ বা পুরুষাঙ্গ নয়।
প্রকৃতপক্ষে শিবলিঙ্গে এমন এক নিগূঢ় ও অনির্বচনীয় শক্তি আছে, যা সহজেই ভক্তবৃন্দের ভেতর মহাদেবের প্রতি ভক্তি আরও বেশি নিবিষ্ট করে। বিশেষভাবে লক্ষ্য করলে এই ভক্তি ভাব অনুধাবন করা যায়। আর এজন্যই, শিবলিঙ্গের এমন সুন্দর তাৎপর্য একমাত্র বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী ও ধর্মচারী ভক্তবৃন্দরাই বুঝতে পারে।





শিবলিঙ্গ সম্পর্কে কিছু উল্টাপাল্টা কথার বিশ্লেষণ-

শিবলিঙ্গ কোন যৌন ইন্দ্রিয়ের পূজা নয়, কেন নয় তাই জানুন—
প্রথমেই দেখা যাক লিঙ্গ শব্দের প্রকৃত অর্থ কি। সংস্কৃত लिङ्गं,(লিঙ্গ); শব্দের অর্থ হলো "প্রতীক" বা চিহ্ন। কিন্তু লিঙ্গ অর্থে অনেকেই সাধারণত পুরুষের জননেন্দ্রিয় বুঝে থাকে; কিন্তু এটি একটি মারাত্মক ভুল ধারণা। লিঙ্গ শব্দের অর্থ যদি জননেন্দ্রিয়-ই হয়, তাহলে বাংলা ব্যাকরণে আমরা যে লিঙ্গ নামক অধ্যায় পড়েছিলাম সেটার কি হবে...?!
আমরা সবাই জানি; লিঙ্গ চার প্রকারের যথা-পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, উভয়লিঙ্গ, ক্লীবলিঙ্গ।
এই চার প্রকার লিঙ্গের কথা আমাদের সবারই মনে আছে। হ্যা, এখান থেকেই আমাদের বোঝা উচিত; ভাষাগত যে তথ্যের দ্বারা কোন মানুষকে ও প্রাণীকে পুরুষ বা স্ত্রী প্রজাতি হিসেবে, কিংবা কোন প্রাণহীন জিনিসকে বস্তুগত বিষয় হিসেবে সনাক্ত করা যায় তাই লিঙ্গ।।

কিন্তু এই বিষয়ে আপনার যদি এখনো সন্দেহ থেকে থাকে তবে MP3 George’s বাংলা বইতে লিঙ্গ নামক অধ্যায় খুলে দেখুন, কারণ এখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে 'লিঙ্গ শব্দের অর্থ চিহ্ন'

এবার অন্য যুক্তিতে আসুন, ছোটবেলায় আমরা সবাইতো বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ পরিবর্তন শিখেছি..... যেমন ধরুন--- বাবা(পুং লিঙ্গ)-মা(স্ত্রী লিঙ্গ); বর(পুং লিঙ্গ)-কনে(স্ত্রী লিঙ্গ); স্বামী(পুং লিঙ্গ)-স্ত্রী(স্ত্রী লিঙ্গ); সিংহ(পুং লিঙ্গ)-সিংহী(স্ত্রী লিঙ্গ) ইত্যাদি। আপনিই বলুন এভাবে শিখেছেন কিনা....?? এবার নিজেকে জিজ্ঞাস করুন, লিঙ্গ মানে কি...?? চিহ্ন না Penis....?? লিঙ্গের অর্থ Penis; এই ধরনের কথা যে বলে থাকে, সে একটা মূর্খ এবং তার মায়ের একটা Penis আছে। কারণ, বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী 'মা' স্ত্রীলিঙ্গ। আর তাই, লিঙ্গ অর্থ Penis বলা ব্যাক্তির 'মা' একটা হিজড়া। এই যুক্তিতে একইভাবে কনেরও Penis আছে, বোনেরও Penis আছে, এমনকি স্ত্রীরও Penis আছে এবং সিংহীরও Penis আছে।
এবার আরও একটি যুক্তিতে আসুন; লিঙ্গ শব্দের অর্থ Penis হলে বাংলা ব্যাকরণে লিঙ্গ পরিবর্তন বিষয়টি থাকত না। কারণ লিঙ্গ মানে যদি Penis-ই হয়, তবে লিঙ্গ পরিবর্তন হতো কিভাবে....? এটা কি প্র‍্যাক্টিক্যালি পরিবর্তন করা সম্ভব??? হিজরাদের কথা বাদ দেন, কারণ হিজরারা আদৌ ইচ্ছাকৃতভাবে থিওরেটিকালি বা প্র‍্যাক্টিক্যালি লিঙ্গ পরিবর্তন করে না। সব হিজরারাই হচ্ছে হরমোনাল ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পন্ন মানুষ। এরা লিঙ্গ পরিবর্তন করে না, এরা আসলে হরমোন ইমব্যালান্স দুর্ঘটনার শিকার।কিন্তু লিঙ্গ পরিবর্তন যদি করতেই হয়, তবে প্র‍্যাক্টিক্যালি একটা ছেলের লিঙ্গ কেটে অন্য কোন মেয়ের মধ্যে লাগানো ছাড়া সম্ভব না। একইভাবে সিংহের Penis অপারেশন করে কাটার পর সিংহীর মধ্যে না লাগানো পর্যন্ত লিঙ্গ পরিবর্তন সম্ভব না !! মূর্খদের দাঁতভাঙা জবাব দিন।।

আশা করি, এতক্ষণে আপনারা বুঝতে পেরেছেন, লিঙ্গ মানে Penis নয়, এর আভিধানিক অর্থ হলো চিহ্ন। সংস্কৃতে পেনিসের সঠিক প্রতিশব্দ হল শিশ্ন।


অন্যান্য কিছু নিয়ে আলোচনা-


শিব সম্পর্কে আরো অনেক উল্টা পাল্টা কথা শোনা যায় যেমন শিব মদ গাজায় আসক্ত--
কিন্তু, আসলেই কি তাই... আমার এই লেখাটী পড়তে পারেন ( https://avijitprataproy.blogspot.com/2017/09/blog-post_13.html ) 
সর্বক্ষণের জন্য মহাদেবের কাছে আছে দুজন অনুচর, তাদের নাম নন্দী এবং ভৃঙ্গী। নন্দী শব্দের উৎপত্তি নন্দ ধাতু থেকে, যার মানে আনন্দ। ভৃঙ্গী এসেছে ভৃ-ধাতু থেকে, যার মানে ভরণ, পোষণ ও ধারণ করা। আর এটা তো স্বাভাবিক; যেখানে মঙ্গল যাবে সেখানে তার প্রিয় অনুচর আনন্দ, ভরণ-পোষণ ও ধারণ চলে যাবে। নন্দীর আগমনের সাথে আসে প্রেরণা; অর্থ্যাৎ মানুষের মধ্যে বেড়ে ওঠে সহ্য, ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের মত গুণগুলো।
অপরপক্ষে ভৃঙ্গী হল কারক। সমাজ সংসারে চলতে হলে মানুষের মধ্যে এইসব গুণ থাকা একান্ত প্রয়োজন; কারণ এসব না থাকলে তার কপালে সাফল্য জুটবে না। 
বিভিন্ন নাটক বা ছবিতে দেখা যায় নন্দী এবং ভৃঙ্গী শিবের কাছে বসে সিদ্ধি ও গাঁজা টানছে। আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, যিনি মঙ্গলের প্রতীক; তার দুই অনুচর কিনা সিদ্ধি ও গাঁজা খাচ্ছে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ?? 
আসলে এটাতেও আমাদের বোঝার ভুল আছে। এখানে সিদ্ধি ও গাঁজা হল কর্মে কৃতার্থ হওয়ার পরমান্দ তথা আত্মপ্রসাদের প্রতীক, যা কখনোই পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া কোনো মাদক দ্রব্য নয়। নন্দী যিনি আনন্দদায়ীর কারক ও ভৃঙ্গী যিনি ভরণ-পোষণের কারক; এই দুই বিহিত ব্যাবহার ও অনুশীলনের ভিতর দিয়েই জেগে ওঠে কার্যসিদ্ধির সৌন্দর্য্য। আর প্রকৃত শিবভাব সম্পন্ন ব্যাক্তিত্বই হল কার্যসিদ্ধির উৎস। তাই, প্রকৃত শিবভাব বিশিষ্ট ব্যাক্তি কর্মে কৃতার্থ হওয়ার পরমান্দ তথা আত্মপ্রসাদকে সেবন করে আনন্দ লাভ করে।


শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা হয় কেনো ?

সমুদ্র মন্থনের সময় হলাহল নামক মারাত্মক বিষ উত্থিত হয়েছিল, যেটার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জীবের জীবন বিপন্ন করার ক্ষমতা ছিল অত্যধিক। ভগবান শিব সকল দেবতাদের অনুরোধে এই মারাত্মক বিষ থেকে সবাইকে রক্ষা করার ঐশ্বরিক দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব সম্পন্নের জন্যই তিনি সমস্ত বিষ পান করেন এবং তার কন্ঠে সংরক্ষণ করে রেখে দেন; আর এজন্যই মহাদেবের কণ্ঠদেশ নীলবর্ণ।
হলাহল বিষের বিষাক্ততা মাত্রা ছিল প্রচণ্ড রকমের বেশি, যদিও এটি ভগবান শিবের উপর কোন প্রভাব ফেলে নাই। কিন্তু হলাহল বিষের তাপমাত্রা ছিল অসম্ভব বেশি। এই তাপমাত্রার প্রভাব প্রশমিত করার জন্য দেবতারা মহাদেবের জন্য গঙ্গা অভিষেক করেন, আর এই গঙ্গা অভিষেকের মাধ্যমে দেবতারা শিবকে প্রসন্ন করেছিলেন। ভগবান শিবের সেই গঙ্গা অভিষেকে শুধুমাত্র সাপ এগিয়ে এসেছিল এই ঐশ্বরিক কারণ সমর্থনের জন্য। তারা নিজেরাও বিষের কিছু অংশ পান করে ও তাদের বিষদাঁতে কিছু বিষ গ্রহণ করে। এজন্য সেদিন থেকেই কিছু সাপ বেশি বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
সমুদ্র মন্থনের সময় যে গঙ্গা অভিষেক করা হয়েছিল, শিবের উপাসকদের দ্বারা শিবলিঙ্গে জল বা দুধ ঢালার কারণ হচ্ছে শিবের প্রতি ভক্তদের ভক্তি ও ভালোবাসা প্রতিভাস (প্রকাশ) করার জন্য।
শিবের পূজায় শিবলিঙ্গে এরকম জল বা দুধ ঢালা খুবই গুরুত্বপূর্ণ; অভিষেক ছাড়া শিবের পূজা অসম্পূর্ণ। অভিষেকের সময় এই জল বা দুধ ঢালা খুবই পবিত্র। কারণ অভিষেকের দ্বারাই শিবের প্রতি ভক্তদের গভীর অনুরক্তি প্রকাশিত হয়, আর এর মাধ্যমেই ভক্তিপরায়ণতা ফুটে উঠে।
এখানে অনেকে বলে থাকে,
শিবলিঙ্গে দুধ ঢেলে দুধ অপচয় করা হচ্ছে, কিন্তু এটা মোটেও সঠিক কথা নয়। কারণ এই দুধের বেশ খানিকটা অংশ চরণামৃত বানানোর জন্য ব্যবহার করা হয় এবং যা পূজা শেষে ভক্তদের মাঝে প্রসাদরূপে বিতরণ করা হয়। তাই দুধ ঢালা কোনক্রমেই অপচয় নয়, বরং এটা নিষ্কলুষ ভক্তিরই বহিঃপ্রকাশ।
দুঃখের বিষয় এই যে, শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা নিয়ে অনেকেরই এখনো চুলকানি আছে। শিবলিঙ্গে দুধ ঢালার কথা শুনলেই যেন তারা কান্না শুরু করে দেয়। তাদের ভাবখানাটা এমন; যেন ৩৬৪ দিন শিবলিঙ্গে অনেক অনেক পরিমাণে দুধ ঢেলে দুনিয়ার সব দুধ উজার করে দেয়া হচ্ছে।
এখানে চুলকানি রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা মড়াকান্না জুড়বে যে, শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা হচ্ছে কিন্তু অভুক্ত শিশুরা দুধ পাচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন ও ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, আসলে চুলকানি রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা সবসময় সবকিছু একটু বাড়িয়েই বলে। তাই তাদের উদ্ভট কথায় আমাদের ঘাবড়ানো উচিত নয়।
এই পৃথিবীতে আমরা সবাই নিতান্তই তুচ্ছ, আমাদের নিজের কোন কিছুই নেই। আমাদের শরীর, শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার বাতাস, গাছপালা, মাটি ইত্যাদি সবকিছুই ভগবানের দান। তাই শিবলঙ্গে দুধ ঢালা নিয়ে কৈফিয়ত তলব করা আমাদের মানায় না।
শিবতত্ত্বঃ
জ্ঞানের রাজ্য পার হয়েই জানা যায় শিবকে। জ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী পূজার পরই আসে শিবরাত্রি। এরও একটি গভীর তাৎপর্য আছে। দেবী সরস্বতী হংসরূঢ়া। হংসটি কিন্তু সাধারণ হংস নয়। মানুষের কূটস্থে যে দ্বিদলপদ্ম আছে, এতে “হং” এবং “সঃ” দুইটি বীজ। এই দুইটি বীজে দৃষ্টি স্থির রাখতে পারলেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞানক্ষেত্র খুলে যায়। আবার জ্ঞানক্ষেত্রে চতুর্বেদ রাগিনী সরস্বতী উপবিষ্ট। তাই ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধিকে সুসংযত করে কুটস্থে রাখতে পারলে সরস্বতীর কৃপা লাভ সম্ভব। জ্ঞানক্ষেত্র পার হলে পৌঁছা যায় ব্যোমক্ষেত্রে আমাদের কূটস্থের পর দহরাকাশ, চিদাকাশ, পরাকাশ, মহাকাশ ও আত্মাকাশ। এই পঞ্চ আকাশেই ব্যোমক্ষেত্র বা শিবক্ষেত্র। এ জন্যই শিবের অপর নাম পঞ্চানন। মানুষ সাধন ক্রিয়া দ্বারা এই ব্যোমক্ষেত্রে পৌছালে শিব শীঘ্র তুষ্ট হন। এ জন্য শিবের আর এক নাম আশুতোষ।


এছাড়াও শিব আরও যে যে রূপে মূর্ত হন তা নিম্নরূপ :


০১। চন্দ্রনাথদেবেরই আর এক নাম শিব। শিব অর্থ মঙ্গল বা শুভ। পুনর্জন্ম নিরোধ করে অর্থাৎ মোক্ষ দান করে তিনি জীবের মঙ্গলই করেন। তিনি আবার পঞ্চানন নামেও খ্যাত। পঞ্চ আনন (মুখ) যাঁর তিনিই পঞ্চানন। পঞ্চমুখ দেবতাই শিব।


০২। ‘ওঁ’-তত্ত্বের ত্রিদেবতা- ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। পঞ্চানন শিবই এই মহেশ্বর। মহেশ্বরী শক্তির অধিকারী তিনি। মহাপ্রলয়ের নটরাজ তিনি। তিনি ঈশান নামেও খ্যাত। ঈশান-ই বিষাণে অর্থাৎ শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে তিনি মহাপ্রলয় ঘোষণা করবেন।
 


০৩। মহাশক্তির দেবতা মহেশ্বর। সকল দেবতা ঐক্যশক্তি দিয়ে যা করতে পারেননা, মহেশ্বর একাকী তা সম্পন্ন করতে সমর্থ। দেবতার মাঝে বিচিত্র অদ্ভূতকর্মা দেবতা তিনি।

 
০৪। মৃত্যুকে জয় করেছেন বলে তিনি মৃত্যুঞ্জয়। তাইতো তিনি অকাতরে সমুদ্র মন্থনের হলাহল অর্থাৎ বিষ কণ্ঠে ধারণ করেছেন। বিষের ক্রিয়ায় তার কণ্ঠদেশ হয়েছে নীল। সে কারণে তার নাম নীলকণ্ঠ। 


০৫। বাঘের চামড়াকে বলে কৃত্তি। কৃত্তি পরিধান করে নাম ধরেছেন কৃত্তিবাস।


০৬। বিচিত্রকর্মা মহেশ্বর। অর্থাৎ তার সকল কর্মই অদ্ভূত ও বৈচিত্র্যময়। গঙ্গার ধারা ধারণকালে ত্রিশূল হাতে তিনি হিমালয়ের পাদদেশে থমকে দাঁড়িয়েছেন এবং মস্তকের জটাজুটকে উত্থিত করে দিয়েছেন ব্যোমে অর্থাৎ আকাশের দিকে এবং নাম ধরেছেন ব্যোম্‌কেশ। তার সেই উত্থিত জটাজুটের মাধ্যমে গঙ্গার ধারা পৃথিবীতে নেমে আসে। তবেই না মর্ত্যের মানুষ গঙ্গার পূত-পবিত্র সলিলে অবগাহন করে নিষ্পাপ হচ্ছে এবং মরণের পরে স্বর্গবাসী হচ্ছে।


০৭। ‘ধূর’ শব্দের অর্থ জটাভার বা ত্রিলোকের চিন্তাভার। মহাদেব চন্দ্রনাথই শিরে জটাভার ধারণ করেন অথবা ত্রিলোকের চিন্তাভার ধারণ ও বহন করেন। এসকল ভার বহন ও ধারণের কারণে তারই নাম ধূর্জটি।
 


০৮। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-‘কোন গুণ নাই তার কপালে আগুন’। এখানে ‘গুণ নাই’-এর অর্থ সত্ত্বঃ, রজ ও তম গুণের অতীত। মহাদেব ত্রিগুণাতীত। তিনটি নেত্র বা লোচন তার। একারণে দেব ত্রিলোচনও বলা হয় তাকে। তার ললাটের তৃতীয় নয়ন দিয়ে সর্বদাই ধক্‌ ধক্‌ করে আগুন জ্বলতে থাকে। ‘কপালে আগুন’ বলতে অন্নপূর্ণা দেবী ইঙ্গিতে মহাদেবের ললাট নেত্রের কথাই বলেছেন। আগুন আলোর প্রতীক। অন্ধকার দূর করতে আলোরই প্রয়োজন। তার ত্রিনেত্রের অগ্নি জ্ঞানরূপে আলো জ্বালানোর প্রতীক। অর্থাৎ মানুষকে জ্ঞান-চর্চা করতে হবে।
 


০৯। ত্রিগুণাতীত বলে শিব সর্বদাই নির্বিকার নির্বিকল্প। তাই শবরূপে তিনি শ্রীকালী মাতার চরণতলে শায়িত। শবরূপে শিব মানুষকেও বিকার রহিত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ শবেরইতো কোন বিকার নেই। তার ত্রিশূলও ত্রিগুণের প্রতীক। তিনি নিজে ত্রিগুণাতীত হয়ে মানুষকেও তার হস্তধৃত ত্রিশূল দেখিয়ে ত্রিগুণাতীত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
 


১০। শিব ‘হর’ এবং ‘শম্ভু’ নামেও খ্যাত। তিনি জীবের চিত্তকে, তাদের পাপকে হরণ করেন এবং কালপূর্ণ হলে জীবের জীবনকেও হরণ করেন। এসকল হরণ করার কারণে তার নাম ‘হর’। আবার তিনিই জীবের যম-ভয় অর্থাৎ শঙ্কা হরণ করে তাদের কল্যাণ সাধন করেন। তার নাম গ্রহণ করলেই আর কোন শঙ্কাই থাকে না। এ কারণে শংকর তার নাম। আবার ‘শম্‌’ শব্দের অর্থও কল্যাণ। যেহেতু তিনি কল্যাণ দান করেন, সেহেতু ‘শম্ভু’ নামেও তিনি বিশ্বখ্যাত।
 


১১। ত্রিপুর নামক অসুরের অত্যাচারে ত্রিপুরাবাসী অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালবাসী দেবতা, মানব এবং যক্ষকুল অতীষ্ট হয়ে উঠেছিলেন তখন শিব শরাসন থেকে শর নিক্ষেপ করে ত্রিপুরাসুরকে নিধন করেন। আর এই ত্রিপুরাসুরকে নাশ করে নাম ধরেছেন দেব ত্রিপুরারি।
 


১২। শিব অল্পেই বা শীঘ্রই সন্তুষ্ট হন। এ কারণে তাঁর এক নাম আশুতোষ।
 


১৩। শিব দেব, মানব, অসুর, রাক্ষস, গান্ধর্ব, কিন্নর সকল কতৃক বন্দিত। তিনি হলেন সকল দেবতাদের আদি তাই তাঁর নাম মহাদেব।
 


১৪। শিব সকল জীবের প্রভু, তাই তিনি ঈশান।
 


১৫। শিবের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী কেউ নেই, তাই তিনি স্বয়ম্ভু।


১৬। প্রতিকল্পে আপন লীলা মহিমায় তিনি ব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংস সাধন করেন এবং কাল উনার অধীন, তাই তিনি মহাকাল।



সত্যই জগতের প্রতিটি বস্তুকণায় শিবের অস্তিত্ব বর্তমান। “যত্র জীব-তত্র শিব”-পরমপুরূষ শ্রীরামকৃষ্ণ কঠোর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে এ সত্যই উপলব্ধি করেছেন। সুতরাং আমাদের সকলের উচিৎ জীব সেবার মাধ্যমে শিব সেবায় ব্রতী

 


সমুদ্রপুত্র রাজা গৌড় গোবিন্দ ও শ্রীহট্ট

  সিলেটের   ‎ গৌড় গোবিন্দ এবং আজকের   ‎ শাহজালাল বিভিন্ন তথ্যপঞ্জী এবং পরবর্তিতে আবিষ্কৃত তাম্রফলক ও শিলালিপি থেকে সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস স...

Popular Posts