হিন্দুরা আগুনকে অগ্নিদেব, ভূমিকে মা বসুধা, বায়ুকে পবনদেব, গরুকে গো-মাতা, সর্পকে মা মনসাদেবী হিসাবে পূজা করে। ইংরেজীতে ঈশ্বর, ভগবান, এমনকি এ দেবতা কিংবা দেবী শব্দের শব্দের সমার্থক হলো God। এমনকি ইংরেজীদের কাছে ইসলামী আল্লাহ শব্দের ইংরেজী সমার্থকও God। এর ফলে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে আপাততঃ দৃষ্টিতে প্রকৃতির যে সকল উপদান গুলিকে হিন্দুরা দেবতা কিংবা দেবী হিসাবে চিন্তুন ও পূজন করেন এর সব ক’টিরই একটি একটি ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরী। আসলে কী তাই?
কুখ্যাত ডাঃ জাকির নায়কের পিস টিভির ইসলামী ওয়াজ মাহফিলে একটি ছেলে হিন্দুদের ঈশ্বর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছিল The Sun is God, Moon is God, Winter is God, etc etc. There are many many God of Hinduism. But Allah is one and only God of Muslim. পিস টিভির ঈশ্বর/আল্লাহ বিষয়ে বক্তব্যদানকারী এ বালকটির বক্তব্য ওর জন্য ঠিক। কিন্তু হিন্দু দর্শনের ভিত্তিতে বলতে গেলে বলতে হয় ছেলেটি পশ্চিমাদের মতো হিন্দু ধর্ম বিষয়ে এ বালকটিও অজ্ঞ। কেননা, হিন্দুরা প্রকৃতির সকল শক্তিকে ঈশ্বরের বিভূতি রুপে দেব কিংবা দেবী জ্ঞানে চিন্তন ও পূজন করে, ঈশ্বর নয়, এ ক্ষুদ্র জ্ঞানের জন্য হিন্দু দর্শন জানা জরুরী এটা হিন্দু বিদ্বেষী অনেকের অজানা থেকে যায়। হিন্দুরা প্রকৃতির শক্তিকে কেন দেব কিংবা দেবী রুপে পূজা করেন সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি হলো জন্মান্তর কর্মফলবাদ, এ অর্থ হলো কর্মানুসারে ফল ভোগের জন্য আত্মা পরবর্তী জীবনে দেহ লাভ করবে। একটি দিনের সমাপ্তি মানে রাত্রের শুরু, আবার রাত্রির শেষ মানে অন্য একটি নতুন দিনের শুরু। এটা হলো চক্র। এ চক্রের উপস্থিতি সপ্তাহ, মাস, বছর, ঋতুচক্র এভাবে ব্রম্ম্রান্ডের সর্বত্র দেখতে পাবে। আত্মারও জীবন চক্র হয়, এবং আত্মা ভবিষ্যতে কোন কোন দেহ ধারন করবে এটি নির্ভর করে তার বিদ্যামান জম্নের কর্মের ফলের উপর। যদি কেহ ভাল কর্ম করে তাহলে তার সুফল ভোগ করার জন্য একটি সুখী ও নিশ্চিত জীবন লাভ করবে। আবার যদি মন্দ কাজ করে, তাহলে মন্দ কাজের ধরনানুসারে যে কোন জড় কিংবা অন্য কোন জীব দেহ ধারন করতে পারেন। যারা মনুষ্যকুলে জন্ম নিয়ে পাপ ও পূর্ন্যরে উদ্ধে থাকে তাদের আর পূর্ণর জন্ম হয় না। এরা পরমাত্মার সাথে লীন হয়ে যায়। কোটি মানুষের মধ্যে দু একজনের ভাগ্যের অধিকারী হতে পারে।
সৃষ্টির যত প্রকারের প্রানী আছে তাদের সকলের আত্মার ভর এক। পার্থক্য শুধু আত্মার যে দেহটিতে অবস্থান বা ভর করে থাকে তার পার্থক্য। প্রানীর রুচি, জীবন ধারনের প্রনালী, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি প্রাপ্ত দেহের পার্থক্যের কারনের হয়ে থাকে। দেহের এ পার্থক্য শুধু একশ্রেণীর প্রানী থেকে অন্য শ্রেনীর প্রানী নয়, একই শ্রেনী ভুক্ত প্রানীর দেহেরও হয়, যেমন নর-নারী-কীব-বৃহন্নলা ইত্যাদি। আবার এক পুরুষ কিংবা অন্য পূরুষের দেহের গঠন, রক্তের গ্র“প, জিন ও গঠন শৈলীগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং দৃশ্যমান দেহ বাদ দিলে দেহাশ্রিত প্রানীরই আত্মার পার্থক্য নেই। পূর্বজম্নের ভাল কর্মফল ভোগ করার জন্য হয়ত মানুষ দেহ ধারণ করে প্রত্যেক্ষ কিংবা আজ ফেইস বুকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এবার আপনার প্রশ্ন থাকতে পারে আত্মার পূর্বজম্নের কর্মফল ভোগের জন্য আত্মা সাপ, গরু, হনুমান ইত্যাদি নিকৃষ্টতম দেহ ধারণ করার পরও হিন্দুরা কেন এদের পূজা করেন?
এর অতি সরল উত্তরে জানানো যায়, বায়ু, জল, ভূমি প্রকৃতির অংশ আর বৃক্ষাদি লতা গুল্ম, সাপ, গরু, হনুমান সহ সকল জড় ও জীব প্রকৃতির অংশ। এ সকল অবুদ্ধিমান প্রানীরা কর্মফল ভোগের জন্য নিকৃষ্টতম দেহে জন্ম গ্রহন করলেও শুধু প্রকৃতির অংশ হিসাবে এরা সব সময়ে আমাদের মত বুদ্ধিমান মানুষ গুলোর জীবনযাত্রাকে মশৃন করে রাখে। সনাতনীরা কৃতজ্ঞ থাকতে বিশ্বাস করে অর্থাৎ আমাদের ধর্মই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। সুতরাং এসকলে উপকারে আমরা এদের প্রতি কৃজ্ঞতা জানানোর জন্য এদেরকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞ্যাপন করি। তবে ঈশ্বর কিংবা ভগবান জ্ঞানে নয়। ঈশ্বর সব কিছুর উর্দ্ধে থেকে যিনি ব্রম্মান্ড রচনা ও নিয়মাতান্ত্রিক ভাবে চালিয়েছেন তিনি এটা আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের বেদী মূলে প্রোথিত, যা অন্যান্য ধর্ম প্রচারকরা সনাতনী শিক্ষা থেকে ধার করে নিয়ে একেশ্বরের ধারনা প্রচার করেছেন।
পরিশেষে বলছি, উপর থেকে তিরস্কারের মনোভার প্রদর্শন না করে একবার এর দর্শনের গভীরে প্রবেশ করুন, আশা করি জ্ঞান লাভ করবেন। কেননা বিদ্যাই পারে মনের অন্ধকার দূর করতে। মঙ্গল হউক।
ওম শান্তি শান্তি শান্তি !
ওম শান্তি শান্তি শান্তি !