Saturday, July 4, 2020

আমেরিকা কার কাছ থেকে কিভাবে স্বাধীনতা অর্জন করে?

কলোম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের (১৪৯২) পর, একদল ইংরেজ উত্তর আমেরিকায় নতুন ভূখন্ডে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। এর পিছনে অনেক কারণ ছিল, যেমন, নতুন ভূখন্ডে বিপুল পরিমাণে সম্ভাব্য কাঁচামাল ও খনিজের আকর্ষন, পছন্দসই পরিবেশ এবং আভ্যন্তরীন সামাজিক অস্থিরতা। এই ভূখন্ডে ইউরোপীয় পরিযায়ীরা তেরোটি কলোনি তৈরি করে, যদিও বেশিরভাগেরাই জাতিতে ইংরেজ ছিল কিন্তু ইউরোপের অন্যান্য প্রান্ত থেকেও বহু মানুষ এসে সেখানে বসতি স্থাপন করে। ইংল্যান্ডের সরকার এই কলোনির গুলোর শাসনব্যবসস্থা পরিচালনার জন্য একজন করে গভর্নর নিযুক্ত করে। একটি নির্দিষ্ট কলোনির মুরুব্বিদের নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠিত হত, এরা শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য গভর্নরকে সাহায্য করত। এইভাবে একটি আধা স্বয়ংনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা তৈরি হয়, যদিও কলোনির পাশ করা আইন বাতিলের পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ছিল ব্রিটিশ সংসদের।
যে কারণগুলি আমেরিকান জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় সেগুলি বিভিন্ন প্রকার, যেমন, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়। মনস্তাত্বিকভাবে কলোনিতে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে একরকম একত্বতাবোধ তৈরি হয়। যদিও তাঁরা বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে এসেছিল, মাতৃভূমি থেকে অনেক দূরে বাস করা, একসাথে বিরূপ প্রকৃতির বিরূদ্ধে লড়াই, একই গীর্জায় একসাথে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, ইত্যাদির ফলে যে সামাজিক একত্ববোধ তৈরি হয় তার ফলেই জন্ম নেয় আমেরিকান জাতীয়তাবাদের। বেশিরভাগ কলোনিতে বসবাসকারী মানুষ জাতে ইংরেজ হলেও এরা বাপটিস্ট ক্রিশ্চান গোত্রের পিউরিট্যান বা কোয়েকার ছিলেন, এদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ইংল্যান্ডের প্রোটেস্ট্যান্ট ক্রিশ্চানদের থেকে আলাদা ছিল। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা অভিজাত ব্রিটিশ শ্রেণীর মধ্যে পড়তেন না, তাই তাদের মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্যের অহংবোধ ছিল না। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন পেশার মানুষ ছিলেন, কোনো সামাজিক উচ্চ নিচ বিভাজন ছিল না, তাই এই স্বাধীনচেতা মানুষগুলির একত্ববোধ তাঁদের শহুরে ইংরেজ অভিজাতদের বিরুদ্ধে বিরূপ করে তোলে।
এর পর আসে বৌদ্ধিক নবজাগরন। আমেরিকান মানুষেরা খুব গর্বের সাথে তাঁদের নেটিভ ইংরেজি ব্যবহার করত, শহুরে শুদ্ধ ব্যাকরণের ধার ধারত না। তাঁরা জানত, অভিজাতরা এদের নিচু নজরে দেখেন। এই নেভিট ইংরেজিতে তাঁরা লিখতেন, কথা বলতেন। সমসাময়িক দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী থম্যাস জেফারসন গ্রীক দর্শন ও প্রাচীন গ্রীক-রোমান ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হন, তাঁর লেখনী আমেরিকান মানুষদের এক ভিন্ন সংস্কৃতি প্রদান করে। লেখক থমাস পাইনের লেখা The rights of Man শুধু আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বজুড়ে অত্যাচারী ঔপনিবেশিক শক্তির চেহারাটা নগ্ন করে দেয়।
এবার রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের দিকে মনোনিবেশে করব। রাজনৈতিক অসোন্তোষের জন্ম নেয় যাকে ইতিহাসে আমরা বলি the seven years war, তার পরে।কানাডা থেকে ফরাসী আক্রমনের ভয় ছিল, তাই আমেরিকাবাসী ইংরেজরা মাথা নত করে নিজের মাতৃভূমির সরকারের দ্বারাই নিপীড়িত হচ্ছিল চুপচাপ। এই যুদ্ধ শেষ হতেই সে ভয়টা কেটে যায়। সাথে সাথে ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের মাত্রাটাও যেন বেড়ে ওঠে কয়েকগুন।
ব্রিটিশ সরকার ঠিক করে, এই আমেরিকান উপনিবেশগুলোকে তাঁদের কাঁচামালের উৎস ও ইংল্যান্ডের কলকারখানায় তৈরি পণ্যের বাজার, এই দুইভাবেই ব্যবহার করবে। শুরু হয়ে গেল অর্থনৈতিক শোষন। একগুচ্ছ নেভিগেশন আইন পাশ হল। আমেরিকানদের পায়ে বেড়ি পড়ল।

১. আমেরিকানদের চিনি, কাপড়, পশম, মদ ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য ইংল্যান্ডের থেকেই কিনতে হবে। স্বস্তায় পেলেও অন্য জায়গা থেকে কেনা যাবে না, অন্যথায় প্রচুর কর দিতে হবে।

২. আমেরিকানরা কোনো কারখানা খুলতে পারবে না। ফলতঃ স্বনির্ভর হওয়ার রাস্তা বন্ধ।

৩. তাঁদের উৎপাদিত কাঁচামাল যেমন, তামাক, চামড়া, খনিজ ইত্যাদি বেশি দাম পেলেও অন্য জায়গায় বেচতে পারবে না। ব্রিটিশ সরকারকেই বেচতে হবে।

এইভাবে অর্থনৈতিক নিপীড়নের যাঁতাকলে পেশাই হতে থাকে আমেরিকান স্বাধীন চেতনা ও মূল্যবোধ।
তৃতীয় জর্জ ও তার টরি মন্ত্রীসভা এই আর্থিক শোষনে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। তারা ঠিক করে the seven years war এর আর্থিক ক্ষতি আমেরিকান মানুষদের অর্থনৈতিক শোষনের মধ্য দিয়েই মেটাবে। ফলে পাশ হয়, writs of assistance act, যাতে-

১. আমেরিকানদের ঘরে ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ সার্চ করতে পারবে।

২. ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি ছাড়া আমেরিকানরা গুদামের পণ্য মজুদ করতে পারবে না।

এর পর গ্ৰেনভিল্যে মন্ত্রক আরো দুটি দমন পীড়ন মূলক আইন পাশের সিধান্ত নেয়, যা stamp act এবং sugar act নামে পরিচিত। প্রথমটিতে কোনো সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য বা সংবাদপত্রে পাবলিকেশনের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে কর দিতে হবে। এতে সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েন আইনজীবি ও সংবাদমাধ্যমের সাথে যুক্ত মানুষ। পরের আইনটিতে আমেরিকানদের কম দামে ফরাসী কলোনি গুলোর থেকে চিনি আমদানির ওপড় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের থেকে অধিক মূল্যে চিনি আমদানির ফলে চিনি ও মদের দাম বেড়ে যায়। সাধারন মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে।
এই আমেরিকান আইনজীবীদের মধ্যে একাংশ একটি মৌলিক প্রশ্ন তোলেন। কিভাবে ব্রিটিশ সংসদ, যেখানে আমেরিকানদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই তারা আমেরিকানদের উপড় কর চাপান? জেমস্ ওয়েটিসের একটি ব্যক্তব্য, যা প্রায় একটি স্লোগানে রূপান্তরিত হয়, "No taxation without representation."
ক্রমশ Technicality থেকে একটি বৃহৎ সাংবিধানিক প্রশ্নের জন্ম নেয়। ইংল্যান্ডের রাজার চার্টারে কাউন্সিল নিয়ন্ত্রিত গভর্নর কতৃক শাসনের কথা লেখা ছিল। এমন কোথাও লেখা ছিল না যে ব্রিটিশ সংসদ স্বেচ্ছাচারিতা চালাতে পারবে। বিশেষত যেখানে আমেরিকানদের প্রতিনিধিত্ব নেই।এছাড়াও ব্রিটিশ সংসদ কমন ল এবং ন্যাচারাল ল দ্বারা চালিত হত। ন্যাচারাল ল অনুযায়ী কর প্রতিনিধিত্ব ছাড়া চাপানো যায় না। অথচ এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণরুপে লঙ্ঘন করে ব্রিটিশ সরকার। হিসেব বলছে, এই স্ট্যাম্প আইনের ফলে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ইউরো দন্ড দিতে হয় আমেরিকান জনগনকে। আমেরিকানরা বলেন স্বেচ্ছাকৃতভাবেই তাঁরা কর দেবেন, দমনপীড়নের মাধ্যমে নয়।
রকিংঘ্যাম মন্ত্রীসভা বিদ্রোহের আঁচ পেয়ে একটি Declaratory act পাশ করায়, তার মাধ্যমে স্ট্যাম্প আইন কিছু সময়ের জন্য তুলে নেওয়া হয়। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টাউনশেন্ড সুগার আইনে ব্যাপক কাটছাঁট করেন। আমদানিকৃত প্রতি কিলোগ্রাম চিনিতে মাত্র তিন পেনি করে কর আদায়ের সিধান্ত নেওয়া হয়, যা আমেরিকান কলোনিগুলোর শাসনব্যাবস্থাতেই খরচ হবে। কিন্তু আমেরিকানদের যে মৌলিক প্রশ্ন, যার সঙ্গে তাঁদের আত্মসম্মান জড়িয়ে ছিল, অর্থাৎ প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আদায় কিভাবে সম্ভব? তা কিন্তু রয়েই যায়। লর্ড অ্যাকশন পরবর্তীতে দাবি করেছিলেন,এই চার পেনি করের জন্য আমেরিকায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন হয়। অর্থাৎ অর্থের চেয়েও আত্মসম্মানের লড়াই ছিল অনেক বেশি।
এমতবস্থায় কিছু আমেরিকান জাতীয়তাবাদী একটি কান্ড করে বসেন। এদের মধ্যে Benjamin, Franklin George Washington মত ব্যক্তিত্বরাও ছিলেন। বোস্টন বন্দরের Dartmouth জাহাজের ডেকের ওপড় রাখা চা ভর্তি পেটি তারা সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রতীকি প্রতিবাদ জানান, যা ইতিহাসের পাতায় Boston tea party নামে পরিচিত। এই ঘটনায় ব্রিটিশ সরকারের আঁতে ঘা লাগে। অবিলম্বে বোস্টন বন্দর বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়, ম্যাসাচুসেটস্ উপনিবেশের সায়ত্বশাসন বাতিল করা হয় ও চারটি শাস্তিমূলক অর্ডিন্যান্স তাঁদের ওপড় চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকানরা এই চারটি অর্ডিন্যান্সকে অবৈধ ঘোষনা করে ও মানতে অস্বীকার করে।


এরপর জর্জিয়া বাদে বাকি বারেটি উপনিবেশের মেম্বাররা একত্রে ফিলাডেলফিয়াতে সমাবেশ করেন। তাঁরা রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে সুবিচারের আবেদন জানান, রাজা তাঁদের দাবি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেন। এরপর লেনিংটনে ইংরেজ নাবিকেরা আমেরিকানদের ওপড় গুলি চালায়, পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। অবশেষে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফিলাডেলফিয়া কংগ্রেসের পর বিখ্যাত Declaration of independence পাশ হয়। আমেরিকানরা স্বাধীনতার শপথ নেন। থমাস পাইনে তাঁর বিখ্যাত common sense শীর্ষক প্রবন্ধে এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে অকুন্ঠ সমর্থন জানান। শুরু হয় আমেরিকার স্বাধীনতার লড়াই। এই যুদ্ধে ইংল্যান্ডের চিরশত্রু ফরাসী সরকার নৌ ও পদাতিক সৈন্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পূর্ণ সমর্থন জানায়। অবশেষে ১৭৮৩ সালে treaty of Versailles এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সংগ্রামের পর স্বাধীনতার সূর্য ওঠে আমেরিকার দিগন্তে। অত্যাচারী, দাম্ভিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন হয় চিরতরে।

সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা ক...

Popular Posts