নমঃ শিবায়। সকলকে নমস্কার । বর্তমানে কৃৈষ্ণব আগ্রাসন বাংলায় সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। সকল কালী, শিব, দূর্গা, শনি ইত্যাদি মন্দির দখল করে সেখানে চলছে অশাস্ত্রীয় এবং বিকৃত হরে কৃষ্ণ নাম এবং আন্তর্জাতিক আমেরিকান একটি অবৈদিক সংঘটনের আস্ফালন।
এদের গুরু বা আচার্য্যরা এদের যে শিক্ষা দিয়েছে এরা এদেরই পথ অনুসরণ করছে। এদের বিভেদকামী আচরণ আর মতবাদের জন্য বাংলাদেশী সনাতন সমাজ আজ ভাগে ভাগে বিভক্ত। আদিগুরু যেভাবে সনাতন ধর্মের আমাদের সকল মত বা পথের সমন্বয় করে দিয়ে আমাদের শক্তিশালী একটি জাতিতে পরিণত করেছিলেন, সেই ব্যাক্তির মতকে এই অবৈদিক দল মায়াবাদ বলে গালি দেয়। এর প্রমাণে এরা পদ্মপুরাণ থেকে একটি শ্লোক মানুষকে দেখিয়ে বিভ্রান্ত করে। আজকে সেই হাস্যকর যুক্তির খন্ডনে এই লেখা। আসুন প্রথমে শ্লোকটি দেখে নেই।
পদ্মপুরাণে উত্তরখণ্ডে ৬২ অধ্যায়ে রুদ্র স্বয়ং দেবীকে বলেছেন--
"মায়াবাদমসচ্ছাস্ত্রং প্রচ্ছন্নং বৌদ্ধ মুচ্যতে।
ময়ৈব বিহিতং দেবী কলৌ ব্রাহ্মণ মূর্তিণা।।"
"হে দেবী , আমি কলি যুগে ব্রাহ্মণ মূর্তি ধারণ করে অসৎ শাস্ত্র মাধ্যমে মায়াবাদ রুপ প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ মত স্থাপন করি"।
ভগবদ্ বিমুখ ঘোর নাস্তিক আসুরিক ভাবাপন্ন মানুষের চেতনা থেকে ভগবান নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইলেন। তাই ভগবান তার প্রিয় জন মহাদেবের মাধ্যমে মায়াবাদ প্রচার করতে নির্দেশ দিলেন।
ভগবান শ্রী হরি মহাদেব কে বলেন-
"স্বাগমৈঃ কল্পিতৈস্ত্ব জনান্ মদ্বিমুখান্ কু্রু।
মাং চ গোপয় যেন স্যাৎ সৃষ্টিরেষোত্তরোত্তরা।।"
"তোমার কল্পিত মতবাদের দ্বারা মানুষদের আমার প্রতি বিমুখ করে তোল। আমাকে এমন ভাবে গোপন করো যাতে বহির্মুখ মানুষেরা তাদের সংসার প্রবৃত্তি কর্মে বিরক্তি না জন্মে। বরং তারা উত্তরোত্তর জড়-জাগতিক উন্নতিতে আগ্রহী হয়।" (পদ্মপুরাণ উত্তর খন্ড ৬২/৩১)
এইস্থলে দেখা যায়,বলা হচ্ছে---
(১) জ্ঞানিগণের পাতিত্যকারক যে সকল তামসশাস্ত্র,তারা শৈব,পাশুপত,বৈশেষিক,ন্যায়,সাংখ্য,চার্বাক,বৌদ্ধ ও জৈনশাস্ত্র।
(২)মায়াবাদটি অসৎশাস্ত্র ও প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধশাস্ত্র।
(৩)এটি ব্রাহ্মণরুপী রুদ্রকর্তৃক কলিতে কথিত।
(৪)এই বাদটিতে শ্রুতিবাক্যের অন্যথা করা হয়েছে,কর্মের ত্যাগ উপদিষ্ট হয়েছে,জীব ও ঈশ্বরের ঐক্য উক্ত হয়েছে,ব্রহ্মকে নির্গুণ বলা হয়েছে ইত্যাদি।
ভগবান শঙ্করের মত মায়াবাদ না--কিন্তু ব্রহ্মবাদ বা ঔপনিষদবাদ
এস্থলে ব্রাহ্মণরুপী রুদ্র মায়াবাদপ্রচারকর্তা বলে নির্দেশ থাকায় বৈষ্ণবগণ আচার্য শঙ্কর ও তাঁর মতবাদ বলে বুঝে থাকেন।কিন্তু শঙ্করসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিগণ বলেন--এতে আচার্য শঙ্করের ব্রহ্মবাদ লক্ষ্য করা হয় নাই।কারণ,শঙ্করের মতবাদটি মায়াবাদই না; ব্রহ্মবাদ।যেহেতু শঙ্কর নিজ বেদান্তসূত্রভাষ্যে ২/২/৯ সূত্রের ভাষ্যে নিজেই বলেছেন--
জ্ঞানশক্তিও সাংখ্য অনুমান করলে প্রতিবাদকার্য হতে তিনি নিবৃত্ত হলেন,আর তখন এক চেতনই অনেকস্বরুপ জগৎ প্রপঞ্চের উপাদান হল এরুপে ব্রহ্মবাদই স্বীকার করা হল।
এই যে শঙ্করমতকে মায়াবাদ বলা হয়,তা বিপক্ষগণের কথা।যেমন হিন্দু শব্দটা যবনগণ সিন্ধুবাসিগণকে নিন্দার ছলে বলত,কিন্তু কালে তারাই রাজা হওয়ায় যেমন আর্যগণ বাস্তবিকই সিন্ধুনদতীরবাসী বলে নিজেদেরকে হিন্দু বলতে লাগল।এস্থলেও যেন তদ্রুপ কতকটা হয়ে পড়েছে।বৈষ্ণবগণ প্রবল হয়ে শঙ্কর সম্প্রদায়কে যা বলে নিন্দা করতেন,শঙ্করসম্প্রদায়ের অজ্ঞব্যক্তিগণ তা নিন্দার সূচক না বুঝে নিজেকেই তাই বলে নির্দেশ করতে লাগল।পরে প্রসিদ্ধি অনুরোধে বিজ্ঞেও তাই বলতে লাগলেন।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শঙ্করমতকে মায়াবাদ বলাই যায় না।কারণ,যে মতে যাকে সর্বমূলতত্ত্ব বলে নির্দেশ করা হয়,তারই নামে সেই মতবাদের নামকরণ করা হয়।যেমন--শিব শক্তি বিষ্ণু প্রভৃতি যে যে মতে মূলতত্ত্ব বলা হয়,সেই সেই মতের নাম শৈব শাক্ত বৈষ্ণব প্রভৃতি।শঙ্করমতে জগৎ মিথ্যা(আবার এ মিথ্যা মানে অলীক বা অসৎ মনে করবেন না।) অর্থ্যাৎ মায়া,সত্য একমাত্র ব্রহ্ম।তাই সকলের মূলতত্ত্ব।এই ব্রহ্মে এই জগৎ কল্পিত বলে জগৎ মিথ্যা বলা হয়।সুতরাং মায়া মূলতত্ত্ব না, ব্রহ্মই মূলতত্ত্ব।এজন্য শঙ্করমতকে ব্রহ্মবাদই বলা সঙ্গত।অন্যত্র বহু স্থলে মীমাংসক ও ন্যায়াচার্যগণ এবং স্বমতের আচার্যগণ একে ঔপনিষদবাদ নামে আখ্যাত করেছে।এজন্য কুসুমাঞ্জলি,শাস্ত্রদীপিকা এবং মধুসূদনী প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
এবার আসুন দেখে নেই কেন শঙ্করমতকে মায়াবাদ বলে এরা
কৃৈষ্ণবগণ একে মায়াবাদ বলবার কারণ এই যে,এর সঙ্গে বৌদ্ধমতের কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য আছে।সে সাদৃশ্য এই যে,বৌদ্ধগণ জগৎকে অসতে অর্থ্যাৎ শূন্যে,মায়া বা অবিদ্যাকল্পিত বলিয়া থাকেন,সুতরাং বৌদ্ধমতেও জগৎ নাই।শঙ্করমতে জগৎ সতে অর্থাৎ ব্রহ্মে মায়াকল্পিত বলিয়া পরমার্থতঃই নাই।এখন জগতের না থাকা অংশে বা কল্পিতত্ব অংশে ঐক্যই একটু সাদৃশ্য বলতে হবে।বৈষ্ণবাদি বিপক্ষগণ এই সাদৃশ্য অংশকে লক্ষ্য করিয়া নিজমতে নিষ্ঠার বৃদ্ধি উদ্দেশ্যে পরমতের নিন্দা করে একে মায়াবাদ বলেছেন।বস্তুতঃ বৌদ্ধমতে জগৎকল্পনার অধিষ্ঠান অর্থ্যাৎ মূলতত্ত্ব অসৎ বা শূন্য এবং শঙ্করমতে সেই অধিষ্ঠান বা মূলতত্ত্ব সৎ ব্রহ্ম,আর তাতে এই দুই মতের যে অত্যন্ত বিরোধ তা কেউই অস্বীকার করতে পারেন না।অতএব মায়াবাদ শঙ্করের বাদ নহে।শঙ্কর যদি জগতের মূলতত্ত্ব বা অধিষ্ঠানকে মায়া বা শূন্য বলতেন তা হলে তাঁর মতবাদ মায়াবাদ হত।যেহেতু মূলত্ত্বানুসারেই মতবাদের নামকরণ হয়--এটাই রীতি।মায়া উভয় মতেই নিমিত্তকারণ বটে,কিন্তু তাই বলে তা যে অধিষ্ঠানরুপ উপাদান কারণ,তা শঙ্কর বলেন নাই।বৌদ্ধমতে উপাদানরূপ এই অধিষ্ঠান স্বীকার করা হয় না,তাঁদের মতে নিরধিষ্ঠান ভ্রম স্বীকার করা হয়।অতএব পদ্মপুরাণের এই নিন্দা প্রকৃতপক্ষে শঙ্করমতের নিন্দা না,পরন্তু অন্য কোন মতবাদের নিন্দা।পরবর্তী বিপক্ষগণ শঙ্করমতে এরুপ মায়াবাদত্ব আরোপ করিয়া নিন্দা করে থাকেন মাত্র।
তাদের যুক্তি অনুসারে তারাই বিপদে পড়ে চৈতন্যস্বরুপ আত্মার জ্ঞানরুপে পরিণাম স্বীকার করায়,রামানুজ জৈনমতের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছেন বলে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে।সর্বদর্শনসংগ্রহে মাধবাচার্য মধ্বের মুখে ভেদাভেদবাদী রামানুজকে জৈন পদাঙ্কনুসারী বলতে কুন্ঠিত হন নাই।রামানুজ যে পাঞ্চরাত্রমতাবলম্বী,সেই পাঞ্চরাত্র মত সম্বন্ধে বরাহ পুরাণে ৬৬ অধ্যায়ে আছে--
অলভা বেদমন্ত্রাণাং পাঞ্চরাত্রোদিতেন হি....শুদ্রাদীনান্ত ন শ্রোতপদবী মুপাযাস্যতি।।১২
তাহার পর অপরাপর পুরাণ মধ্যে আছে--
পাঞ্চরাত্রং ভাগবতং তন্ত্রং-----এবং বিধানি চান্যানি মোহনার্থানি তানি তু।।।
কুর্ম ১১ অধ্যায়,সুতসংহিতা ৪র্থ মুক্তিখণ্ড
এইরুপ পুরাণজাতীয় অপরাপর বহু গ্রন্থেই ভাগবত ও রামানুজমতের বহু নিন্দা আছে।যাহা হউক ইহা হইতে জানা যায়--
(১) বেদমন্ত্র লভ্য না হইলে পাঞ্চরাত্র আচারে ভগবান লাভ।
(২) পাঞ্চরাত্রমত ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের জন্য,শূদ্রের জন্য নহে।
(৩) পাঞ্চরাত্র ভাগবত ও বৈখানসতন্ত্র বেদভ্রষ্টের জন্য বিষ্ণু উপদেশ করিয়াছেন।
(৪) পাঞ্চরাত্রাদির বেদমূলকত্ব নাই ।
(৫)পাঞ্চরাত্রাদি শাস্ত্র মোহনার্থ রচিত।
(৬)ভাগবত ও সাত্ত্বত শাস্ত্র অভিন্ন।
(৭) কুণ্ড ও গোলকগণের জন্য অভিপ্রেত।কুণ্ড অর্থ--পতিসত্ত্বে জারজ পুত্র এবং গোলক অর্থ--পতি মরণান্তে জারজ পুত্র।।
এদিকে অদ্বৈতমতে জগৎকে বলা হয় মিথ্যা অর্থ্যাৎ অনির্বচনীয়।কেবলমাত্র জগতের ব্যবহারিক সত্যতাই এই মতে স্বীকৃত হইয়া থাকে।দ্বৈতবাদীও এই ব্যবহারিক সত্তার বাইরে যেতে পারেন না।আর,ব্যবহারিক সত্তাতো প্রাতিভাসিক সত্তারই সামগ্রিক উন্নতর সংস্করণমাত্র।
(The Collective elevation of an individual illusion)।
এই অবস্থায় বিজ্ঞানে বিজ্ঞেয় বিষয়ের প্রাতিভাসিক সত্তা দ্বৈতবাদীকেও নত মস্তকে স্বীকার করতে হবে।এই প্রাতিভাসিক সত্তার ক্ষেত্রে তা হলে দ্বৈতবাদী,অদ্বৈতবাদী,বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ প্রভৃতি সকলেই একমত।বিজ্ঞেয় বিষয়ের প্রাতিভাসিক সত্তার অতিরিক্ত পারমার্থিক সত্তার প্রশ্নে দ্বৈতবাদের সাথে অদ্বৈত ও বৌদ্ধমতের মতদ্বৈধ আছে সন্দেহ নাই।কিন্তু অন্ততঃ একটি ক্ষেত্রে (প্রাতিভাসিক সত্তার ব্যাখায়) তো সকল মতেরই অনুমোদন আছে দেখা গেল।অতএব বিজ্ঞানের আধারে জগৎ কল্পিত,এই সিদ্ধান্তের জন্য অদ্বৈতবেদান্তবাদ ও বিজ্ঞানবাদ যদি অভিন্ন হয়,তবে বিজ্ঞান জ্ঞেয় বিষয়ের প্রাতিভাসিক সত্তা আছে,এইরুপ সিদ্ধান্ত স্বীকার করার জন্য দ্বৈতবাদীকেও বিজ্ঞানবাদী বলতে আপত্তি কী?দ্বৈতবাদীর অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রকাশত্মযতি তদীয় 'বিবরণে' যে প্রত্যুত্তর দিয়েছেন,এটাই তাঁর(প্রকাশত্মযতির) নিগূঢ় রহস্য বলে মনে হয়।প্রকাশত্মযতির বক্তব্যের সাথে আমরা আরও একটু যোগ করে বলতে পারি-বহির্জগতের বস্তুসত্তা অস্বীকার করার জন্য যদি বিজ্ঞানবাদ ও অদ্বৈতবাদ এক হয়ে যায়,তবে পরিদৃশ্যমান বিশ্বের বাস্তব সত্তা স্বীকার করার জন্য চার্বাক দর্শন ও দ্বৈতদর্শন এক বা অভিন্ন হয়ে যায় না কেন?দ্বৈতবাদীরা কি নিজেদের চার্বাকপন্থী বলতে রাজি হবেন?
পুরাণে শঙ্করমতের নিন্দার উদ্দেশ্য
আর শঙ্করকে,চার্বাকমতপ্রবর্তক বৃহস্পতি অথবা বৌদ্ধমতপ্রবর্তক বুদ্ধের ন্যায় দৈত্যবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণকে মোহিত করবার জন্য রুদ্রাবতার বলতে পারা যায় না।কারণ,তাঁর প্রচারিত মত ব্যাসদেবেরই পুরাণমধ্যে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত।পুরাণাদিমধ্যে বৌদ্ধ বা চার্বাকমত থাকলেও তাতে অশ্রদ্ধা উৎপাদনের জন্য সেই পুরাণমধ্যেই বলা হয়েছে।কিন্তু শঙ্করমতের সম্বন্ধে সে চেষ্টা করা হয় নাই।যে পুরাণে শঙ্করমত উক্ত তাতে তার বিন্দুমাত্র নিন্দা নাই।যে পুরাণে অন্যমত বর্ণিত,তাতেই নিন্দা আছে।
ঋণঃ স্বামী চিদঘনানন্দ পুরী ও আশুতোষ শাস্ত্রী,কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ,
প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলার,এম-এ পিএইচডি,বিদ্যাবাচস্পতি