Sunday, April 24, 2022

শ্রীকৃষ্ণের শিব উপাসনার তাৎপর্য ও শিক্ষা

“যদত্র পরমং গুহ্যং স বৈ দেব মহেশ্বরঃ”;



সমস্ত শাস্ত্রের মধ্যে অতি গোপনীয় তত্ত্ব হল শিবতত্ত্ব। অত্যন্ত গোপনীয় হওয়ায় শিবকে সবাই জানতে পারে না। যে অধিকারী ভক্তকে তিনি দয়া করেন, তিনিই তাঁকে বিন্দু পরিমাণ জানতে পারে।তিনি চিন্তার অতীত, বুদ্ধির অতীত, শাস্ত্রের অতীত। সাধনায় তুষ্ট হয়ে ভক্তের হৃদয়ে গভীরে তিনি দর্শন দেন; আবার কখনো মূর্তিমান হয়ে সাকার রূপ ধারণ করেন। কেউ তাঁকে সম্যকরূপে জানতে পারে না। পক্ষান্তরে তিনি ভূত,বর্তমান ভবিষ্যতের দ্রষ্টা, নিয়ন্তা এবং সাক্ষীপুরুষ।


বেদাঃ সাঙ্গোপনিষদঃ পুরাণাধ্যাত্মনিশ্চয়াঃ।

যদত্র পরমং গুহ্যং স বৈ দেব মহেশ্বরঃ।।

(মহাভারত: দ্রোণপর্ব, ১৭০.৮৯)


বেদ, ব্যাকারণাদি বেদাঙ্গশাস্ত্র, উপনিষদ পুরাণ ও সমস্ত অধ্যাত্মশাস্ত্রের মধ্যে যা অত্যন্ত গোপণীয় তাই মহাদেব মহেশ্বর।


পরমেশ্বর শিব সমস্ত কিছুর মধ্যে অতি গূঢ় ভাবে আছেন এবং সমস্ত শাস্ত্রে অতি গোপনীয় তত্ত্ব, তাই সকলে পরমেশ্বর শিবকে জানতে পারেন না।


দেবাসুরমুনীনাং তু যচ্চ গুহ্যং সনাতনম্।

গুহায়াং নিহিতং ব্রহ্ম দুর্ব্বিজ্ঞেয়ং মুনেরপি।।

(মহাভারত:অনুশাসনপর্ব, ১৫.২৯)


“যিনি দেবতা, অসুর ও মুনিগণের নিকটেও গুপ্ত রয়েছেন, যে সনাতন ব্রহ্ম সাধুগণের হৃদয়গুহায় নিহিত আছেন এবং যিনি মুনিগণেরও দুর্জ্ঞেয়।”


দুর্জ্ঞেয় শিবকে অবতার পুরুষেরা অবতার রূপে এসে তাঁর উপাসনা পদ্ধতি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। নিরাকার বাতাস যেমন চোখে দেখা যায় না। কিন্তু একটি বেলুনে সেই বাতাসকে ভরে নিলে সেই বাতাসের একটি সাময়িক রূপ পাওয়া যায়। আবার বেলুন ছিদ্র করে দিলে কোন রূপ নেই। তেমনিভাবে চিন্তার অতীত পরমেশ্বর ভগবান যখন অবতাররূপে আসেন, তিনি জীবের মাঝে জীবের মত করে থেকে তাদের লোকশিক্ষা দিয়ে যান। জগতের মানুষের কি কি করতে হবে তা আমরা অবতারদের কর্ম থেকেই শিক্ষা লাভ করতে পারি। যিনি শিবরূপী দুর্জ্ঞেয় পরমেশ্বর তিনিই যখন কৃষ্ণ নামে অবতাররূপে এসেছেন ; তিনি তখন লোকশিক্ষার জন্যে শিবরূপে নিজেরই উপাসনা করে জগতকে শিক্ষা দিয়েছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ , শিবভক্ত উপমন্যুর কাছে পাশুপত ব্রতের অনুষ্ঠান করেছিলেন। বিষয়টি শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানেই বর্ণিত আছে।ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শিব উপাসনার এ বিষয়টি মহাভারতের অনুশাসন পর্বের সাথে সাথে কূর্ম পুরাণের পূর্বভাগে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভস্ম মেখে, মুণ্ডিত মস্তকে বল্কল পড়ে রুদ্ররূপ শিবের নাম জপ করতে করতে তাঁর দর্শন পান। ভগবান শিব তাঁর শক্তি দেবী ভবানী সহ শ্রীকৃষ্ণের সামনে প্রকট হন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হাতজোড় করে কৃতাঞ্জলি মুদ্রায় গিরিশ ও গৌরীকে প্রণাম করে তাঁর স্তোত্র করেন।



নমোঽস্তু তে শাশ্বত সর্বযোনে

ব্রহ্মাধিপং ত্বামৃষয়ো বদন্তি ।

তপশ্চ সত্ত্বঞ্চ রজস্তমশ্চ

ত্বামেব সর্বং প্রবদন্তি সন্তঃ ।।

ত্বং ব্রহ্মা হরিরথ বিশ্বযোনিরগ্নিঃ

সংহর্ত্তা দিনকরমণ্ডলাধিবাসঃ ।

প্রাণস্ত্বং হুতবহবাসবাদিভেদ-

স্ত্বামেকং শরণমুপৈমি দেবমীশম্‌ ।।

সাংখ্যাস্ত্বাং ত্রিগুণমথাহুরেকরূপং

যোগাস্ত্বাং সততমুপাসতে হ্রদিস্থম্‌ ।

বেদাস্ত্বামভিদধতীহ রুদ্রমীড্যং

ত্বামেকং শরণমুপৈমি দেবমীশম্‌ ।।

ত্বৎপাদে কুসুমমথাপি পত্রমেকং

দত্বাসৌ ভবতি বিমুক্তবিশ্ববন্ধঃ ।

সর্বাঘং প্রণুদতি সিদ্ধ যোগিজুষ্টং

স্মৃত্বা তে পদযুগলং ভবৎপ্রসাদাৎ ।।

যস্যাশেষবিভাগহীনমমলং হ্রদ্যন্তরাবস্থিতং।

ত্তত্ত্বং জ্যোতিরনন্তমেকমচলং সত্যং পরংসর্বগম্‌ ।

স্থানং প্রাহুরনাদিমধ্যনিধনং যস্মাদিদং জায়তে।

নিত্যংত্বাহমুপৈমিসত্যবিভবং বিশ্বেশ্বরংতং শিবম্‌ ।।

ওঁ নমো নীলকণ্ঠায় ত্রিনেত্রায় চ রংহসে ।

মহাদেবায় তে নিত্যমীশানায় নমো নমঃ ।।

নমঃ পিনাকিনে তুভ্যং নমো মুণ্ডায় দণ্ডিনে ।

নমস্তে বহুহস্তায় দিগ্বস্ত্রায় কপর্দ্দিনে ।।

নমো ভৈরবনাদায় কালরূপায় দংষ্ট্রিনে ।

নাগযজ্ঞোপবীতায় নমস্তে বহ্নিরেতসে ।।

নমোঽস্তু তে গিরীশায় স্বাহাকারায় তে নমঃ ।

নমো মুক্তাট্টহাসায় ভীমায় চ নমো নমঃ ।।

নমস্তে কামনাশায় নমঃ কালপ্রথাথিনে ।

নমো ভৈরববেশায় হরায় চ নিষঙ্গিণে ।।

নমোঽস্তু তে ত্র্যম্বকায় নমস্তে কৃত্তিবাসসে ।

নমোঽম্বিকাধিপতয়ে পশূনাং পতয়ে নমঃ ।।

নমস্তে ব্যোমরূপায় ব্যোমাধিপতয়ে নমঃ ।

নরনারীশরীরায় সাংখ্যযোগপ্রবর্তিনে ।।

নমো ভৈরবনাথায় দেবানুগতলিঙ্গিনে ।

কুমারগুরুবে তুভ্যং দেবদেবায় তে নমঃ ।।

নমো যজ্ঞধিপতয়ে নমস্তে ব্রহ্মচারিণে ।

মৃগব্যাধায় মহতে ব্রহ্মাধিপতয়ে নমঃ ।।

নমো হংসায় বিশ্বায় মোহোনায় নমো নমঃ ।

যোগিনে যোগগম্যায় যোগমায়ায় তে নমঃ ।।

নমস্তে প্রাণপালায় ঘণ্টানাদপ্রিয়ায় চ ।

কপালিনে নমস্তুভ্যং জ্যোতিষাং পতয়ে নমঃ ।।

নমো নমো নমস্তুভ্যং ভূয় এব নমো নমঃ ।

মহ্যং সর্বাত্মনা কামান্‌ প্রপচ্ছ পরমেশ্বর ।।

(কূর্ম পুরাণ: পূর্বভাগ, ২৫.৬২-৭৮ )


“হে শ্বাশ্বত সর্বযানে ! আপনাকে প্রণাম করি। ঋষিগন আপনার সম্বন্ধে বলেন যে আপনিই ব্রহ্মারও অধিপতি এবং সাধুরা আপনাকেই সত্ত্ব, রজঃ তমঃ ও তপঃ বলে থাকেন।আপনিই ব্রহ্মা, আপনিই বিশ্বযোনি হরি, আপনিই অগ্নি, আপনিই সংহারকর্ত্তা এবং আপনিই সূর্যমণ্ডলের মধ্যে অবস্থান করেন । হে প্রভো! আপনিই প্রাণ, আপনিই অগ্নি ও ইন্দ্রাদিভেদে লোকপাল এবং আপনিই ঈশ। আমি ( শ্রীকৃষ্ণ ) একমাত্র আপনারই শরণগ্রহণ করছি । সাংখ্যেরা আপনাকে একরূপ এবং ত্রিগুণ বলে থাকেন । যোগিগন সতত আপনাকে হৃদয়ে ধ্যান করেন এবং বেদসমূহ আপনাকে পূজনীয় ‘রুদ্র’ বলে উল্লেখ করেছে। আমি একমাত্র আপনারই শরণাপন্ন হলাম। যে আপনার চরণে একটি পুস্প অথবা পত্র দেয়, সে-ই ভববন্ধন হতে বিমুক্ত হয় ; সিদ্ধ ও যোগীগণের সেবিত আপনার চরণযুগল স্মরণ করলে আপনার প্রসাদেই সমস্ত পাপ নিবারিত হয় । যিনি একমাত্র জ্যোতিঃ ; অশেষ বিভাগরহিত ; নির্মল হৃদয়ের অন্তরে অবস্থিত তত্ত্বপ্রকাশক , অচল, সত্য , সর্বোত্তোম ও সর্বগামী ; যিনি অনাদি – মধ্য – নিধন স্থানরূপ এবং সমস্ত জগত যাঁর থেকেই উৎপন্ন হয়েছে ; আমি সেই সত্যবিভব বিশ্বেশ্বর শিবকে প্রতিনিয়ত আশ্রয় করি । হে দেব! আপনি নীলকণ্ঠ , ত্রিনেত্র , রংহঃ , ঈশান ও মহাদেব – আপনাকে বারবার প্রনাম করছি । আপনি পিনাকী , মুণ্ডী, দণ্ডী, বহুভুজ , দিগ্বসন ও কর্প্পদী – আপনাকে নমস্কার । আপনি ভৈরবনাদ , কালরূপ , দংষ্ট্রী , নাগযজ্ঞোপবীতধারী ও বহ্নিরেতাঃ- আপনাকে নমস্কার । আপনি গিরিশ , স্বাহাকার , মুক্তাট্টহাস এবং ভীম – আপনাকে প্রণাম করি । আপনি কামনাশক , কালপ্রমাথী , ভৈরববেশ ও নিষঙ্গী হর ; আপনাকে নমস্কার । আপনি ত্রিলোচন , কৃত্তিবাসা , অম্বিকাপতি ও পশুপতি – আপনাকে নমস্কার করি । আপনি ব্যোমরূপ , ব্যোমাধিপতি , নরনারীদেহ এবং সাংখ্যযোগের প্রবর্তক – আপনাকে বারবার প্রণাম করি । আপনি ভৈরবনাথ , দেবানুগতলিঙ্গী, কুমারগুরু ও দেবদেব – আপনাকে নমস্কার করি । আপনি যজ্ঞাধিপতি , ব্রহ্মচারী , মহান মৃগব্যাধ ও ব্রহ্মাধিপতি – আপনাকে প্রণাম । আপনি হংস , বিশ্বমোহন , যোগী, যোগগম্য ও যোগময় – আপনাকে প্রনাম করি । আপনি প্রাণপাল , ঘণ্টানাদপ্রিয় , কপালী ও জ্যোতিস্পতি – আপনাকে প্রণাম । হে পরমেশ্বর ! আমি আপনাকে প্রনাম করছি ; আপনি সর্বপ্রযত্নে আমার মনের অভিষ্ট সিদ্ধ করুন।”


এইভাবে স্তব করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, পরমেশ্বর ভগবান শিব ও পরমেশ্বরী জগন্মাতা গৌরীর চরণে দণ্ডবৎ পতিত হয়ে তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন।


এবং হি ভক্ত্যা দেবেশমাতিষ্টুয় স মাধবঃ ।

পপাত পাদয়োর্বিপ্রা দেবদেব্যোঃ স দণ্ডবৎ ।।

(কূর্ম পুরাণ:পূর্বভাগ,২৫.৭৯ )


“হে বিপ্রগণ ! শোনো। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান দেবাদিদেবের স্তব করে পরমেশ্বর ভগবান শিব ও দেবী অম্বিকার চরণে দণ্ডবৎ হলেন ।


শ্রীকৃষ্ণকে উমা সহ মহেশ্বর সশরীরে দর্শন দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে তিনিই যে সকল জীবের কামনাপূর্ণকারী শিবের অভেদমূর্তি পুরুষোত্তম নারায়ণ। এ নারায়ণরূপে তিনিই সকল

জীবের প্রার্থনা সিদ্ধি করেন। যাঁর কৃপা ব্যতিরেকে সমস্ত কিছুই বিনষ্ট হয়ে যায়।


ত্বং হি সা পরমা মুর্মিমর্ম নারায়ণাহ্বা।

ন বিনা ত্বাং জগৎ সর্বং বিদ্যতে পুরুষোত্তম্।।

বেত্থ নারায়ণানন্তমাত্মানং পরমেশ্বরম্।

মহাদেবং মহাযোগং স্বেন যোগেন কেশব॥

(কূর্ম পুরাণ:পূর্বভাগ,২৫.৮২-৮৩ )


মহাভারতের অনুশাসন পর্বে শ্রীকৃষ্ণের শিব উপাসনার অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ তাৎপর্যমণ্ডিত এ বিষয়টি আরও সুবিস্তৃতভাবে রয়েছে। মহর্ষি উপমন্যুর নির্দেশনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখে মহাদেব এবং মহাদেবী উমা-মহেশ্বর আবির্ভূত হয়। শত্রুহন্তা শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন দিয়ে ভগবান শিব তাঁকে যেকোন দুর্লভ আটটি বর প্রার্থনা করতে বলেন। ভগবান শিব শ্রীকৃষ্ণকে নিজের পরম ভক্তরূপে উল্লেখ করে, তাঁর মঙ্গল বিধানের জন্য বর প্রার্থনা করতে বলেন। ভগবান শিব সাধুশ্রেষ্ঠ, যদুবংশশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণকে অতি দুর্লভ যেকোন দুর্লভ বর কামনা করতে বললেন। অনন্ত তেজরাশির মধ্যে ভগবান শিবের দর্শন এবং বরদানের প্রতিশ্রুতিবাক্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তিনি প্রীত হৃদয়ে উমা-মহেশ্বরকে ভূতলে মস্তক নিপতিত করে প্রণাম করে বর প্রার্থনা করলেন। মহাদেব শ্রীকৃষ্ণের আটটি বর প্রার্থনা শুনে “তাই হোক” বলে পূর্ণ করলেন। তখন শিবপত্নী উমাদেবী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর মঙ্গল সম্পাদনের জন্য স্বেচ্ছায় মহাদেবের মত তেজসম্পন্ন গুণসম্পন্ন ‘শাম্ব’ নামে একটি পুত্রের আশীর্বাদ করলেন।


ধর্মে দৃঢ়ত্বং যুধি শক্রঘাতং

যশস্তথাগ্র‍্যং পরমং বলঞ্চ।

যােগপ্রিযন্বং তব সন্নিকর্ষং

বৃণে সুতানাঞ্চ শতং শতানি॥

এবমস্ত্বিতি তদ্বাক্যং ময়ােক্তঃ প্রাহ শঙ্করঃ।

ততো মাং জগতো মাতা ধারিণী সর্বপাবনী।।

উবাচোমা প্রণিহিতা সর্বাণী তপসাং নিধিঃ।

দত্তো ভগবতা পুত্রঃ শাম্বাে নাম তবানঘ॥

(মহাভারত: অনুশাসন পর্ব,১৪.২-৪)


“ধৰ্মানুষ্ঠানে দৃঢ়তা, যুদ্ধে শত্রুসংহার, উত্তম যশ, উৎকৃষ্ট বল, যােগানুষ্ঠানে প্রীতি, আপনার সান্নিধ্য এবং দশসহস্র পুত্র আমি প্রার্থনা করি।আমার বর প্রার্থনায় মহাদেব বলিলেন—”তাই হোক”। এরপরে জগন্মাতা, জগদ্ধাত্রী, সর্বপাবনী, তপস্যানিধি ও মহাদেবের পত্নী উমাদেবী আমার মঙ্গলসম্পাদনে স্বেচ্ছায় আমাকে বললেন—হে নিস্পাপ কৃষ্ণ। ভগবান মহাদেব ‘শাম্ব’ নামে একটি পুত্র তােমাকে দান করিবেন।”


আমরা সনাতন শাস্ত্রের গুহ্য আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে না বুঝে বর্তমানে নিজস্ব সংকীর্ণতা, নিজস্ব চিন্তা এবং নিজস্ব মানসিকতা নিয়ে শাস্ত্রকে পাঠ করতে গিয়ে বারেবারেই নিজেদের অজ্ঞাতসারে নিজেরাই প্রতারিত হচ্ছি। আমরা যদি কূর্ম পুরাণের উক্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শিব উপাসনার এ ঘটনাটি ভাল করে পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখতে পাবো- অচিন্ত্য পরমেশ্বরই অবতাররূপে জগতে এসে আবার তিনিই শিবের উপাসনা করছেন। উপাসনায় তুষ্ট হয়ে পরমেশ্বর শিবও তাঁদের অভেদত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। অর্থাৎ যিনিই শিব, তিনিই কৃষ্ণ। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর শিবের কাছে তাঁর তুল্য পুত্র কামনা করেন।এ সকল বিষয়ই লোকশিক্ষার্থে এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের লীলা। তিনি এক ও অদ্বিতীয় হয়েও অনন্ত হয়ে, অনন্ত মূর্তিতে প্রকাশিত হয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে লীলা করেন। এ লীলা যোগ্য অধিকারী বিহীন কেউ উপলব্ধি করতে পারে না, তখন তারা প্রতারিত হয়। পরমেশ্বরকে বহু মনে করে। অচিন্ত্য পরমেশ্বরের কোন সুনির্দিষ্ট মূর্তি নেই। সর্বত্রই তিনি প্রকাশিত। তাঁর কোন পরিবার পরিজন নেই; কারো প্রতি রাজ বিদ্বেষ নেই; কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। জগতের সকল জীবই যেমন তাঁর সন্তান, তেমনি তাঁর কোন সন্তানসন্ততি নেই।কিন্তু আমরা উপাসনার স্বার্থে আমাদের পরিবার পরিজনের আদলে সৃষ্টিকর্তারও পরিবার পরিজন কল্পনা করে অসীম ঈশ্বরকে সসীম সীমায় এনে সাধন জগতে অগ্রসর হই।


বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন আপাত পরস্পরবিরুদ্ধ কাহিনী এবং সিদ্ধান্ত দেখে আমরা বর্তমানে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। শাস্ত্রের সঠিক পাঠ, চর্চা এবং ধারণা না থাকায় এ ঘটনাগুলো ঘটছে। শিবপুরাণে শিবের মাহাত্ম্য, দেবীপুরাণে দেবীর মাহাত্ম্য, বিষ্ণুপুরাণে বিষ্ণুর মাহাত্ম্য, সূর্যপুরাণে সূর্যের মাহাত্ম্য এবং গণেশপুরাণে গণেশের মাহাত্ম্য সহ বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। যে পুরাণ যে দেবতার নামে, সে পুরাণে সেই দেবতারই মাহাত্ম্যমণ্ডিত করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে মনে করে সনাতন ধর্ম বহুঈশ্বরবাদী। বিষয়টি হাস্যকর এবং অশাস্ত্রীয় হলেও অজ্ঞানতার কারণে সমাজে মতবাদটি প্রচলিত। যে পুরাণ নিয়ে এ বিভ্রান্তি, একটু ভাল করে সেই পুরাণগুলোর মধ্যে যদি আমরা দৃষ্টি দেই, তবে সেই পুরাণগুলোর মধ্যে আমরা একটি শাশ্বত সাধারণ বিষয় অনেকেই লক্ষ্য করে দেখি না। খুব ভালো করে যদি আমরা পুরাণগুলোকে পাঠ করি, তবে লক্ষ্য করে দেখতে পাবো প্রত্যেক পুরাণের মধ্যে যে দেবাতার নামে এবং যাঁর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে সেই দেবতাকেই পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম রূপে স্তোত্র করা হয়েছে। অর্থাৎ আমি যেই রূপে উপাসনা করি না কেন, পরমেশ্বরের আদতে এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর দ্বিতীয় নেই। তাই মুনিদের, ঋষিদের, পবিত্র হৃদয় সাধু-সন্তদের উপাসিত যেকোনো একটি রূপকে ইষ্ট নির্দিষ্ট করে যদি আমরা সাধন পথে অগ্রসর হই তবে আমরা মুক্তির পথে যেতে পারবো। এ সাধারণ বিষয়টি আমরা বুঝতে ভুল করি বারবার। বেদের মধ্যে, অষ্টাদশ পুরাণ এবং অষ্টাদশ উপপুরাণ মধ্যে, স্মৃতিশাস্ত্র মধ্যে -একথাই বোঝানো হয়েছে বিভিন্ন কাহিনী এবং দৃষ্টান্তের মাধ্যমে।

সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা ক...

Popular Posts