দেহ কি আমাদের মুক্তি দেয়?
নমস্কার। একজন
সনাতনী হিসাবে আমারা সকলেই জানি যে সনাতন ধর্ম পঞ্চমতের সমন্বয়ে গঠিত। আদিগুরু তথা
জগৎগুরু আদি শংকর স্মার্ত ধারা প্রচলন করে আমাদের সকলকে এক করে দিয়ে গেছেন যাতে করে
আমরা বহিরাগত শক্তিদ্বারা আর বিভাজিত না হয়ে এক থাকি এবং সনাতনের বিজয় ধ্বজা চতুর্দিকে
ছড়িয়ে দেই। কিন্তু মধ্য যুগে কিছু ধর্ম বিকৃতিকারীদের কু-চিন্তা এবং কুট কৌশলের ফলে
আজ ধর্মে বিভাজন হয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে সনাতনীরা নিজেদের মধ্যেই মারামারিতে লিপ্ত। এমতাবস্থায়
সুজোগ নিচ্ছে পশ্চিমা ইসলামিক এবং খ্রীষ্টান শক্তি।
এরই ধারাবাহিকতায়
হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ এবং লাভজিহাদ নামক কুটকৌশল সনাতনীদের আরও দূর্বল করছে। কারন
একটাই, আব্রাহামিকদের একেশ্বরবাদ এবং আমাদের এক ব্রহ্ম তত্ত্ব সনাতনীদের কাছে পরিষ্কার
না। কারন অধিকাংশ সনাতনীর ধারণা কৃষ্ণ, বিষ্ণু, দূর্গা, শিব ইত্যাদি সবাই বিভিন্ন বেশে
উপরে কোন এক অজানা স্থানে বসে আছেন এবং তাঁদের সেই দেহ যদি পূজা করি তাহলে এরা আমাদের
অভিষ্ঠ লক্ষ পূরণে উনারা সহায়তা করবেন। বর্তমানে বিভিন্ন মতবাদীরা তাঁদের নিজ নিজ মন্দিরে
দেহ পূজা করে তাতেই মনোনিবেশ করছে এবং এতে সুজোগ পাচ্ছে বিধর্মীরা। যদিও বৈষ্ণবেরা
বিষ্ণু শিলা এবং শৈবরা লিঙ্গ পূজা করছেন তবুও যোগী বা সিদ্ধ পুরুষের লক্ষ্য থাকে নির্গুণ
তত্ত্বে অর্থ্যাৎ সর্ব স্থানে ব্রহ্মের উপলব্ধি করা। আর সেই নির্গুন তত্ত্বে পৌঁছাতে গেলে সঠিক নিয়ম বা প্রসেসের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। কিন্তু তথাকথিত মধ্যযুগীয় গৌড়ীয় ধারায় এই ভাব সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত।
তাইআজ
এই লেখায় আলোচনা করবো দেহ কি আমাদের মুক্তি দেয় নাকি দেহ একটি ভ্রম মাত্র?
·
ব্রহ্ম
কি দেহধারী?
আসুন শুরু করা
যাক।
আমাদের প্রাণের
শাস্ত্র এবং স্মৃতি শাস্ত্রের একমাত্র বৈদিক মুখপাত্র যোগেশ্বর কৃষ্ণের দ্বারা প্রণীত
শ্রীমদ্ভাগবত গীতাতেই রয়েছে এর সকল উত্তর।
শ্লোক সহ আলোচনা
করছি।
বিভেদকারীদের
দাবীঃ
গীতা ৯/১১
अवजानन्ति मां मूढा मानुषीं
तनुमाश्रितम् |
परं
भावमजानन्तो मम भूतमहेश्वरम् || 11|
অবজানন্তি মাং মুঢা মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্।| ১১।।
অনুবাদঃ প্রাণিসমূহের উপর
সর্বপ্রকারে এঁব্ধ্যপূর্ণ আমার পরম ভাব
বোধে অসমর্থ হওয়ায় অজ্ঞব্যক্তিগণ, মনুষ্যমূত্তিধারী সামান্ত জীব বলিয়া আমাকে
অবজ্ঞা করিয়া থাকে ॥১১
কিন্তু এবার ১০/৩ দেখুন। যোগেশ্বর ভগবান কৃষ্ণ কি বলছেন দেখুন।
यो मामजमनादिं च वेत्ति लोकमहेश्वरम् |
असम्मूढ: स मर्त्येषु सर्वपापै: प्रमुच्यते || 3|
যো মামজমনাদিঞ্চ বেত্তি লোকমহেশ্বরম্।
অসংমুঢ়ঃ স মর্ত্যেযু সর্ববপাঁপৈঃ
প্রমুচ্যতে ॥ ৩
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি মোহ-পরবশ না হইয়! আমাকে
অনাদি,
জন্ম-রহিত [এবং] সকল লোকেরই পরমেশ্বর এই
বলিয়া বুঝিয়া থাকে, মর্ত্ত্যগণের
মধ্যে সে বাক্তি সকল পাপ হইতে মুক্তিলাভ
করিয়। থাকে ॥৩
আমরা জানি ব্রহ্ম হলেন জন্ম-মৃত্যু আবদ্ধ থেকে মুক্ত। উনি মায়া
দ্বারা আবদ্ধ নন বরং মায়ার প্রকাশ উনি স্বয়ং নিজেই। তাহলে যে বা যারা যোগেশ্বর ভগবান
কৃষ্ণকে ব্রহ্মরূপে জড়-শরীর রুপে না ভেবে সাক্ষাৎ ব্রহ্মরূপে অনাদির কারন হিসাবে জানবে
সেই পাপ হতে মুক্ত। অথচ আমরা আজ যা দেখছি তা আসলেই কি শ্রীকৃষ্ণের বানী ??
চলুন দেখে নেই অন্য স্থানে গীতায় কি বলা আছে এই দেহ ভ্রম সম্পর্কে।
গীতা ২/১৮ বলছে,
अन्तवन्त इमे देहा नित्यस्योक्ता: शरीरिण:
|
अनाशिनोऽप्रमेयस्य तस्माद्युध्यस्व भारत || 18||
অন্তবস্ত ইমে দেহা নিত্যস্কোক্তাঃ শরীরিনাঃ |
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য তম্মাদৃযুধ্যস্ব ভারত ॥ ১৮
অনুবাদঃ হে ভারত, 'অবিনাশী অপ্রমেয় ও নিত্য শরীরীর এই
সফল
দেহই বিনাশশীলরূপে উক্ত হইয়াছে [যে কারণে আস্থার বিনাশ
হয় না]. এই
জন্য তুমি যুদ্ধ কর।
অর্থ্যাৎ শরীর অনিত্য। এর বিনাশ আছে। আর বিনাশী যেকোন কিছুই মায়া বা মিথ্যা। তাই এর পূজা করা ঠিক না।
একই অধ্যায়ের ২৮ এবং ৫৫ নং শ্লোক কি বলছে দেখে নেই।
अव्यक्तादीनि भूतानि व्यक्तमध्यानि भारत |
अव्यक्तनिधनान्येव तत्र का परिदेवना || 28||
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত ।
অব্যক্তনিধনানেব্য তত্র কা পরিদেবন। ॥ ২৮
অনুবাদঃ এই পৃথিবী প্রসৃতি ও তাহা হইতে
উৎপন্ন পুত্রমিত্র
প্রভৃতি ভূতসমূহের পূর্বাববস্থা
উপলব্ধ নহে; ইহাদের ভবিষ্যদবস্থাও অপরি- জ্ঞাত অর্থাৎ ইহাদের পূর্বাপর অবস্থা
প্রত্যক্ষগোচর হইবার নহে) কেবল ইহাদের
বর্তমান অবস্থাই "ব্যক্ত হইয়া থাকে, সুতরাং এই পূর্বাপরসত্তারহিত
ক্ষণিক বস্তর উৎপত্তি বা বিনাশে এই প্রকার
মোহনিবন্ধন প্রলাপ কি প্রকারে
[ সঙ্গত হইতে পারে ? ]॥ ২৮ :
प्रजहाति यदा कामान्सर्वान्पार्थ मनोगतान्
|
आत्मन्येवात्मना तुष्ट:
स्थितप्रज्ञस्तदोच्यते || 55||
প্রজহাতি যদা কামান্ সর্ববান্ পার্থ
মনোগতান্।
আত্মন্যেবাত্মন! তুটঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে ॥ ৫৫
অনুবাদঃ হেপার্থ! পরমাত্মস্বরূপ
নিজরূপে পরিতুষ্ট হইয়া যে সময় [যোগী] সকলপ্রকার মনোগত কাম (ইচ্ছাবিশেষ )
পরিত্যাগ করে, সেই সময়ই তাহাকে স্থিতধী-বলা যায়
॥ ৫৫
এছাড়াও গীতায় অনেক শ্লোকে (যেমন ৩/৩, ৪/৫, ৯/৪) দেহ ভ্রমে
ঈশ্বপর চিন্তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
তাই আসুন প্রভু যোগেশ্বর কৃষ্ণের পূজা আমরা বংশীধারি বা চক্রধারী
যে রূপেই করি না কেন তা যেন দেহ বা জড় শরীর বোধে না হয়। তা যেন হয় এক অব্যাক্ত পরমাত্মা
স্বরূপ।
ওম।