সরস্বতীর জন্ম কিভাবে হলো?
কে তার সৃষ্টিকর্তা?
সরস্বতী কী বিবাহিত নাকি অবিবাহিত?
বিবাহিত হলে তার স্বামী কে? বিষ্ণু নাকি ব্রহ্মা?
ব্রহ্মা তো সৃষ্টিকর্তা, উনি বিয়ে করবেন তার নিজের কন্যাকে?
আসুন আজকে আপনাদের দ্বন্দ্ব সমাধান করব।
অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী ||
— ঋগ্বেদ ২.৪১.১৬
মাতাশ্রেষ্ঠ, নদীশ্রেষ্ঠ, দেবীশ্রেষ্ঠ তুমি সরস্বতী।
প্রথমে একটা ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিৎ। পরমেশ্বরীর জন্ম হয় না৷ এই ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন নাই। এবার বলবেন, তাহলে সরস্বতী আসলো কোথা থেকে?
সরস্বতীর উৎপত্তি সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বলছে, বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মার উৎপত্তি কালে সরস্বতীও উৎপন্ন হয়েছে, তারই সাথে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, তার প্রকাশ কিভাবে হলো? এই প্রশ্নের উত্তরে অগ্নিপুরাণের একটা শ্লোক দেখা যাক,
অগ্নি বলছেন :
হে মহান (ঋষি বসিষ্ঠ), উক্ত সাত ঋষি প্রাণীকুল এবং রুদ্রগণের জন্মদেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একভাগে নর(ব্রহ্মা নিজে) হলেন অন্যভাগে নারী(দেবী সরস্বতী) হলেন। অনন্তর তারা সন্তান(স্বয়ম্ভু মনু)-এর জন্ম দিলেন।
— অগ্নিপুরাণম্, ১৭/১৬
আরও বিশ্লেষণ পাওয়া যায় মৎস্যপুরাণে -
গুণেভ্যঃ ক্ষোভমাণোভ্যস্ত্রয়ো দেবা বিজজ্ঞিরে।
একা মূর্তিস্ত্রয়ো ভাগা ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বরাঃ।।
— মৎস্যপুরাণম্, ৩/১৬
বঙ্গানুবাদ : এই তিনগুণের (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের) অস্থিতিশীলতার কারণে দেবতাদের সৃষ্টি হয়। এক মূর্তি (পরমেশ্বর) তিনভাগ হয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর হলো।
একই অধ্যায়ের কিছুদূর পরের শ্লোকে বলা হচ্ছে,
ব্রহ্মা যখন নিজে এই সৃষ্টির অংশ হিসেবে প্রবেশ করলেন, তিনি সাবিত্রীর তথা পরমেশ্বরীর কাছে নিজেকে সমর্পিত করলেন। সেই সময় তপস্যারত অবস্থায় তার দেহ দুইভাগে বিভক্ত হলো। অর্ধেকে ব্রহ্মা নিজে রইলেন অন্যভাগ নারী রূপ ধারণ করল। সেই নারী সাবিত্রী, শতরূপা, সরস্বতী, গায়ত্রী বা ব্রহ্মাণী নামে পরিচিত হলো। প্রথমে ব্রহ্মা সেই পরমেশ্বরীর রূপকে নিজের সৃষ্টি তথা কন্যা ভেবে বসেন।(*) পরে তিনি মোহিত হন তার রূপে৷ দেবী তখন তার উৎপত্তিস্থল অর্থাৎ ব্রহ্মার পরিক্রমা করছিল। ব্রহ্মা পরমেশ্বরীর অপূর্ব রূপ দখে তার দিকে সর্বদা তাকিয়ে থাকার জন্য চার দিকে চারটা মাথা উৎপন্ন করলেন। ব্রহ্মার এরূপ তাকিয়ে থাকার কারণে সৃষ্টি অবজ্ঞায় পরে গেল। তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায়,পাপের কারণে চতুর্মুখের উপরে আরও একটা মস্তক উৎপন্ন হলো। ব্রহ্মা তার মন থেকে উৎপন্ন পুত্রদের সৃষ্টির দায়িত্ব দিল। অতঃপর ব্রহ্মা তার অর্ধাঙ্গিনীকে বিবাহ করে পুনরায় সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় ফিরে এলো। ব্রহ্মা ও সরস্বতী প্রথম মনু স্বয়ম্ভুর জন্ম দিল।
— মৎস্যপুরাণম্, ৩/৩০-৪৭
(*) এটাই মূল দ্বন্দ্বের কেন্দ্র। এই চরণ ভুল পড়া বা বুঝানোর কারণেই যতো ভ্রান্তির সৃষ্টি।
তার পরের অধ্যায়ের একদম শুরুতে দেখা যায় বৈবস্বত মনু সেই একই প্রশ্ন করছেন যা সরস্বতীকে ব্রহ্মার মেয়ে ভাবার কারণে আমাদের মাথায় ঘুরে। ব্রহ্মা সরস্বতীকে বিয়ে করে নিষ্কলঙ্ক কিভাবে রইলেন?
মৎস্য অবতারে ভগবান বলছেন :
প্রথমতঃ রজঃগুণাত্মিকা সরস্বতী এবং দেবতারা মানবশরীরের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে না। তাই তাদের কোনোকিছুর প্রভাব সম্ভব নয়৷ ইহা মানুষের মতো করে চিন্তা করা ঠিক না। দ্বিতীয়তঃ ব্রহ্মা আর সরস্বতী একজনই, প্রকাশ যেমন সূর্য থেকে আলাদা করা সম্ভব না তেমনই তাদের সম্পর্কটাও।
— মৎস্যপুরাণম্, ৪/১-১০
দ্বিধা দূর এখানেই হবে যখন এটা উপলব্ধি হবে, তারা একই মায়ের সন্তান নয় বা তারা একজনের সন্তান অন্যজন নয়। গোত্র ইত্যাদি তখনই থাকবে যখন রক্তমাংসের দেহ থাকবে, যখন ডিএনএ থাকবে।
এখন যেই দেবতারা আছে; তারা আগেও ছিল, পরমেশ্বরের মধ্যে। প্রয়োজন অনুসারে তারা রূপ নিয়েছে। রূপ দানে মূল দায়িত্বে ব্রহ্মা। তাকে সৃষ্টিকর্তা অপেক্ষা রচয়িতা বা শিল্পি বলাটাই শ্রেয় বলে আমি মনে করি। কারণ?
সবকিছুই তো সেই পরমেশ্বরের অংশ, সেই পরমেশ্বর যিনি অনাদি-অনন্ত। তারই মধ্যে রূপ দেওয়া হচ্ছে। মূল কথা দেবতাদের জন্ম হয় না, হয় উৎপত্তি।
অর্ধাঙ্গিনী শব্দটা দেবতাদের জন্য বিশেষ প্রযোজ্য। সরস্বতী ব্রহ্মারই অংশ, অর্থাৎ অর্ধাঙ্গিনী। সরস্বতীও ব্রহ্মা ছাড়া অপূর্ণ। পূর্ণরূপ ব্রহ্মা সৃষ্টির জন্য নিজেকে দ্বিখণ্ডিত করে নিজের অংশকে প্রকাশ করেছেন দেবী সরস্বতী রূপে। সৃষ্টির জন্য এটা আবশ্যক ছিল।
সত্যি বলতে, স্বামী-স্ত্রীর যেই স্বর্গীয় সম্পর্কের কথা তা এখান থেকেই আসে। এটা বুঝার জিনিস না। রক্তমাংসের চক্ষু দিয়ে বিচার করা সম্ভব না।
সরস্বতী ব্রহ্মার কন্যা নয়, তার অর্ধাঙ্গিনী। উৎপত্তিতে তারা এক, প্রকাশ বিভাজনের মাধ্যমে।
হ্যাঁ, বৌদ্ধদের মধ্যে দেবী স্বরস্বতীর আরাধনার প্রচলন আছে।
হিন্দু শাস্ত্রে তিনি বিদ্যা দান করেন। সংস্কৃতি রক্ষা করেন। কিন্তু সেই দেবী বৌদ্ধ ধর্মের আঙ্গিকে গিয়ে কিছুটা পাল্টে যান৷ সেখানে তিনি ধর্মগ্রন্থ 'ত্রিপিটক'কে রক্ষা করেন।
সরস্বতী বৌদ্ধধম্মে ত্রিপিটক রক্ষাকারী দেবী হিসেবে পরিচিত। হয়তো সেই কারণেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলিতে তাঁর পূজার প্রচলন রয়েছে। পালিতে ‘সূরস্সতী’ নামে ডাকা হয়। মায়ানমারে ‘থুরাথান্ডি’ বা তিপিটকা মেডাও নামে পরিচিত। একইভাবে জাপান, থাইল্যান্ড ও চিনেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে।
এছাড়াও, বৌদ্ধদের বজ্রযান শাখায়, দেবী স্বরস্বতীর তান্ত্রিক রূপ, 'দশমহাবিদ্যা'র নবম স্থানে অবস্থিত 'মাতঙ্গী' পূজিত হত।