ভগবান শিব সচ্চিদানন্দঘন লীলাময় পরম প্রভু। তিনি সত্য, সনাতন, অনাদি ও অনন্ত ব্রম্মহের স্বরূপ। তিনি সর্বশক্তিমান, শাশ্বত , নিরঞ্জন। সাকারে তিনি মহাদেব, লীলাময় প্রভু শিব, বিষ্ণু, ব্রম্মা ইত্যাদি নামে জানা গেলেও তিনি আদতে নিরাকার। এরজন্য উনার কোন মুর্তি পূজা হয় না। লিঙ্গম বা লিঙ্গ পূজা করা হয়। কিছু বিকৃত মস্তিষ্ক উনার এই পূজা কে পুরুষের লিঙ্গের সাথে তুলনা করে ধর্মকে হেয় বা নীচু দেখানর চেষ্টা করে। কিন্তু আদতে অজ্ঞ্যান ও মুর্খতার দরুন তাঁরা এর গুঢ তত্ত্ব অনুধাবন করতে ব্যার্থ হয়। সংস্কৃত লিঙ্গাম শব্দ থেকে লিঙ্গ শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ হল চিহ্ন। অর্থ্যাত পরম পুরুষ নিরাকার পরম ব্রহ্মের একটি চিহ্নকে আমরা উপাসনা করি। যা অনেকটাই নিরাকার ঈশ্বর উপাসনার মতন। পবিত্র বেদের মাঝে যে রুদ্রকে আমরা দেখি তা আসলে নিরাকার সেই পরম তত্ত্বের রূপ। এরজন্যই শৈবদের মাঝে অতিমার্গ ও মন্ত্রমার্গ শৈবরা পরম তত্ত্বের বৈদিক রুদ্রকে উপাসনা করেন। বলাবাহুল্য আমি নিজেও অতিমার্গ শৈবইসম অনুসরন করি। তাই যে বৈদিক রুদ্র ও পরম তত্ত্ব রূপ শিব এর মাঝে অভেদ করেন তিনি অল্প বিদ্যায় পারদর্শি এই কথা বোঝাই যায়। পরম নয়ন্তা,পরম প্রভু, পরম শক্তিমান। তিনি চির সুন্দর , চির নিরুপম। রহস্যময় মনরম তাঁর অপ্রাকৃত লীলা। তিনিই একমাত্র পরম সত্য ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর। শান্তম শিবম অদ্বৈতম। তাই শিব তত্ত্বই একমাত্র পরম তত্ত্ব। কিন্তু কিছু অজ্ঞ লোক এই বিষয়ে একেবারেই না জেনে বিজ্ঞ সাজতে গিয়ে অযথাই অপকথা বলে বেড়াচ্ছেন।
বাংলাদেশী হিন্দুদের কাছে শিব বা মহাদেব হলেন তম গুন সম্পন্ন এক শ্মশানবাসী। যিনি মদ গাঁজা আর ভুত প্রেত নিয়ে পরে থাকেন। তাঁকে এই দেশের মানুষরা এতো মুল্য দেয় না বর্তমানে। কারন ইনি নাকি মুক্তি দিতে পারেন না। অবশ্য এইসব অবান্তর কথা এই অঞ্চলে বেশীদিন হয় নাই। আগে এই অঞ্চলের মানুষদের প্রধান উপাস্য ছিলেন মা কালী। যিনি দক্ষিণা কালী হিসাবে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। চৈতন্য মহাপ্রভু আসার পর এই অঞ্চলে গৌড়ীয় মতবাদ বিস্তৃতি লাভ করে। এইখানে শাক্তবাদ এর কল্যানে মানুষ শিব সম্পর্কে এতটা জ্ঞ্যানি ছিলেন না। কিন্তু শিব এর পূজা ঠিকই করতেন। পূজা বলতে শিব লিঙ্গে একটু দুধ ঢেলে একটা কলা মাথায় দিয়ে বোম বোম বা ভলে বাবা ঠান্ডা হউ এই ধরনের আচরণ যা এখনও চলে আসছে। ব্যাপারটা অনেকটা যেন শিবকে ঠাণ্ডা রাখ নাহলে উনি পাগলামি করে সব নষ্ট করে দিবেন। কিন্তু আসলে কি তাই? এরজন্য আমার কিছু বক্তব্য শাস্ত্রের আলোকে ব্যাখ্যা করবো।যেহেতু এইদেশের সবাই পুরান তথা সংহিতায় বিশ্বাসী তাই আমি এর আলোকেই সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করবো। যারা বেদ বা উপনিষদ এর রেফারেন্স চান তাঁরা আমাকে ইনবক্স করতে পারেন।
ভগবান শিব সাক্ষ্যাৎ সত্য সনাতন পরমেশ্বর। তিনি কালের উর্ধে বিরাজিত মহাকালেশ্বর। কাল বা সময় উনার অধীন। তাই সর্বযুগে সবার আরাধ্য ভগবান শিব। কিন্তু ঐ যে, অসাধু ও মুর্খ্যরা অপকথা বলে আর মানতে চায় না। তাই শাস্ত্র থেকে কিছু কথা বলবো।
অজ্ঞরা বলে থাকে যে , কলি কালে নাকি এক কৃষ্ণ নামে মুক্তি বাকীরা নাকি মুক্তি দিতে পারেন না। এরজন্যই যারা শিব উপাসনা করেন এদেরকে এরা হেয় বা হীন চোখে দেখে। কথাটা একটু যদি ঘুরিয়ে বলি তাহলে বলা যায় শাস্ত্রে শিব নামে মুক্তি নেই এই কথা নেই। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় এরা শিব, দুর্গা, কালী ভক্তদের ইনিয়ে বিনিয়ে বা সরাসরি বলতে শুরু করে কলি যুগে নাকি এক কৃষ্ণ নাম ছাড়া মুক্তি নেই। এসব ক্ষেত্রে এরা কয়েকটি শ্লোক আওড়ায়। যথা-
হরিনাম্ হরিনাম্ হরিনামব্য কেবলম্
কলৌও নাস্তব্য নাস্তব্য নাস্তব্য গতিরন্যথা
সারমর্ম হল ‘হরি( এদের ভাষায় কৃষ্ণ) নাম ছাড়া কলি যুগে মুক্তি নাই।‘
আর একটি শ্লোক হল ভাগবত গীতার
সর্ব ধর্ম পরিত্যাজ্যং মামেকং শরনং ব্রজ
মানে সব ধর্ম ত্যাগ করে আমার স্মরণ নাও।
একটু বিশ্লেষনে যাই এবার। প্রথমে আসি হরি নাম নিয়ে। অবশ্যই, হরি মানে বিষ্ণু নামে মুক্তি আছে। কারন উনি পরম পুরুষের একটি পালন রূপ। উনার নাম নিয়ে ভক্ত প্রহ্লাদ বা ধ্রুব মুক্তি পেয়েছিলেন। এর হাজার প্রমান আছে। মহাবিষ্ণুর শ্রী চরনে আমার হাজার হাজার প্রনাম। কিন্তু অজ্ঞ্যানীরা এইখানে কৃষ্ণকে কোথায় পেলেন? যদি কেউ বলেন কৃষ্ণ উনার অবতার তাহলে উনার সাথে কৃষ্ণকে জড়ালে দোষ কথায়? আমি বলবো নৃসিংহ, রাম, পরশুরাম, বরাহ উনাদের সাথেও জড়ান না কেন? বা কেনই উনাদের নিয়ে আপনারা কোন পুরান আবিস্কার করেন না?জানি করবেন না কারন এতে আপনাদের রমরমা ব্যাবসা নষ্ট হবে আর সত্য উন্মচিত হবে।
এবার আসি ভাগবত গীতার শ্লোকে।গীতা নিয়ে আমার অনেক কিছু বলার আছে। আসলে মুর্খ ও অল্প শিক্ষিত লোকজন বলে ভাগবত গীতা নাকি বেদসার সংক্ষেপ। শুনে হাসি পায় এরকম মুর্খ কথা শুনলে। আমাদের ধর্মে মোট ২০০ ধরনের গীতা আছে এর মাঝে ৪২টি গীতা অন্যতম।গীতা বলতে ৯৮% মানুষ ঐ ভাগবত গীতাকেই বোঝেন। বাস্তবে এর বাইরেও আরও অনেক কিছু যে আছে তা এই মুর্খ্য কুয়োর ব্যাঙেরা জানেন না। হিন্দু ধর্ম বলতে এরা শুধু বোঝে গৌড়ীয় তিলক দেয়া, মালা জপা আর একাদশী রেখে মনের সুখে লাফানো। হিন্দু ধর্মের খুব নগন্য ও তুচ্ছ একটি বিষয়কে আঁকড়ে ধরে এরা মনে করেন বিশ্ব জগতের সমস্ত জ্ঞ্যান আমার মাথায় গিজ গিজ করছে। আসলে যে ভগবত গীতা আপনারা দেখেন তা হিন্দু ধর্মের ইতিহাস নামে খ্যাত মহাভারতের খুব ছোট একটি অংশ মাত্র।শুধু এক মহাভারত থেকে প্রায় ২০+ গীতা বের হয়েছে।
এবার আসি সেই ভগবত গীতা প্রসঙ্গে। ভগবত গীতাতে কৃষ্ণ আমি বলতে নিজেকে যে বোঝান নি তা অনুগীতার উৎপত্তিই আমাদের বলে দেয়। মহাভারতের ১৪ তম অধ্যায়ের অশ্বমেধ পর্বে অর্জুন যখন কৃষ্ণকে বলেন “হে কৃষ্ণ আমি ভগবত গীতার সৃতিভ্রষ্ট হইয়াছি আমাকে আবার আপনার বিশ্ব রূপ দর্শন দিন।‘ কৃষ্ণ তখন উত্তরে বলেন “ হে পার্থ, আমি যোগী শ্রেষ্ঠ। যোগ দ্বারা আবিষ্ট হইয়া আমি পরম পুরুষের বানী আমি মানব জাতিকে দিয়েছি। সেই পরম যোগ আমার পক্ষে এই জন্মে আর ধারন করা সম্ভব নহে। তাই এর সারমর্ম আমি তোমাকে বলিতেছি, শ্রবন করো।“এতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে আমি বলতে উনি কোন আমিকে নির্দেশ করেছিলেন। কিন্তু বোকারা এই আমি বলতে কৃষ্ণকে ধরে নিয়েছেন। কৃষ্ণ বোধ হয় ওপরে গিয়ে নিজেই নিজের মাথা চাপড়াচ্ছেন।যাইহোক যদি আমি ভগবত গীতাকে কৃষ্ণের বানী সত্যি ধরেও নেই তারপরও বলবো সেই পরম সত্ত্বা আর কেউ নন শিব নিজে। কেন বলছি??!! অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই? একটু পেছনে যাই। ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণের জন্মের আগে উনি ত্রেতা যুগে যে শরীর ধারন করেছিলেন তাঁর নামটা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রাম। উনিও কৃষ্ণের মতনই ভীষণ শিব ভক্ত ছিলেন। রাম যখন সীতা হরনের পর বিলাপ করতে থাকেন তখন মহামুনি অগস্ত্য রামকে শিব আরাধনার জন্য বলেন। আর সেই পরমাত্তার স্বরূপের জ্ঞ্যান ও বর রামকে প্রার্থনা করতে বলেন। এরি পরিপ্রেক্ষিতে রাম শিব আরাধনা করেন আর পরম পুরুষ শিবের দর্শন লাভ করেন। প্রভু শিব শ্রী রামকে পরম জ্ঞ্যান ও মানব আত্মার প্রকৃত স্বরূপের কথা ব্যাক্ত করেন যা উনারি পরবর্তী জন্ম শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন। বিশ্বাস হয় না?! শিব গীতার সাথে ভাগবত গীতার শ্লোকগুলো একটু মিলিয়ে দেখতে পারেন। বরং শিব গীতায় মানব ভ্রুনের অনেক বিস্তারিত বর্ণণা পাবেন যা আধুনিক বিজ্ঞ্যান বলে।
কলি যুগে শিব মানেই মুক্তি। শুধু কলিযুগে কেন, সর্ব যুগে, সর্ব সময়ে শিব নামে অথবা শিব ভক্তিতেই মুক্তি হয়। শাস্ত্র থেকে এই বিষয়ে অসংখ্য উদ্বৃতি দেয়া যায়। তবে এতে লেখার আকার বড় হবে অন্য কিছুই না। তবে অল্প কিছু দিলাম। বুঝতে পারলেই হল। যারা খুঁতখুঁতে মনের মানুষ তাঁদের বিচার বিশ্লেষণ করতে অনুরোধ করবো। আর যারা বিনীত ও অহংমুক্ত হয়ে জিজ্ঞ্যাসু, তাদেরকে মনোযোগ দিয়ে অনুধাবন করতে প্রার্থনা করবো।
আমি বলে রাখি শুদ্ধ বৈষ্ণব, শাক্ত , শৈব সকলেই মহান। প্রত্যেকেই মুক্তি লাভ করবেন যদি নিজ নিজ স্থান থেকে প্রভুকে স্মরণ মনন করেন।উত্তম ভক্তের লক্ষন বিষয়ে বৃহন্নারদীয় পুরানে বলা হয়েছে,
শিবপ্রিয়াঃ শিবসক্তাঃ শিবপাদার্চ্চনে রতাঃ।
ত্রিপুন্ড্রধারিণো যে চ তে বৈ ভাগবতত্তমাঃ।
ব্যাহরন্তিচ নামনি হরেঃ শম্ভোর্মহাত্ন্নঃ।
রুদ্রাক্ষালংকৃতা যে চ তে বৈ ভাগবতোত্তমাঃ।।
যে যজন্তি মহাদেবং ক্রতুর্ভিবহুদক্ষিনৈঃ।
হরিং বা পরয়া ভক্ত্যা তে বৈ ভাগবতত্তমাঃ।
বিদিতানি চ শাস্ত্রানিপরার্থং প্রবদন্তি যে।
সর্ব্বত্র গুনভাজো যে তে বৈ ভাগবতোত্তমাঃ।।
- শিবে প্রীতি, শিবে ভক্তি, শিবের অর্চ্চনায় রত, ত্রিপুন্ড্রধারী। বিষ্ণুনাম ও শিবনাম কীর্তন, রুদ্রাক্ষ ধারন যারা এসব করে এরাই ভাগবতত্তম।বহুদক্ষিণা দানে দৃঢ়ভক্তির সাথে মহাদেবের অথবা বিষ্ণুর যজ্ঞ্যানুষ্ঠান করেন এবং পরমার্থ বষোয়ে বিদিত শাস্ত্রের উপদেশ যারা প্রদান করেন এবং যারাগুনধর, তাঁরাই উত্তম ভাগবত।
বিনা শম্ভু সেবাং সংসার তরনং ন হি।। - সৌরপুরান
- ভগবান শিবকে আশ্রয় করেই মুক্তি হয়। শিবসেবা ব্যাতিত সংসার পার হওয়া যায় না।
নার্চ্চ্যন্তীহ যে রুদ্রং শিবং ত্রিদশবন্দিতম
তেষাং দানং তপো যজ্ঞ্য বৃথা জীবিতমেব চ।।
--কুর্ম্ম পুরান
যারা ইহলোক ত্রিদশ বন্দিত মহাদেবের আরাধনা না করে তাঁদের দান, তপস্যা, যজ্ঞ্য ও জীবন সমস্তই বৃথা।
বায়বীয় সংহিতায় মাতা পার্বতি (দুর্গা) প্রভু শিবকে জিজ্ঞ্যাসা করেন – হে ভগবান! কলিযুগে আপনার ভক্তগন কিভাবে মুক্ত হবেন? তখন পরমেশ্বর বলেন
আশ্রিত্য পরমাং বিদ্যাং হ্রিদ্যাং পঞ্চাক্ষরীয়ং মম।
ভক্ত্যা চ ভাবিতাত্মানো মুচ্যন্তে কলিজা নরাঃ।।
-প্রিতমে! কলিকালের মানুষ আমার প্রতি ভক্তি ভাবিত হয়ে আমার পঞ্চাক্ষরি বিদ্যা অবলম্বন করলেই মুক্তি লাভ করবে।
ময়ৈবমস্কৃদ্দেবি প্রতিজ্ঞ্যাতং ধরাতলে।
পতিতোহপি বিমুচ্যেত মদ্ভক্তো বিদ্যায়ানয়া।
-হে দেবী! আমি বার বার ধরাতলে প্রতিজ্ঞ্যা করেছি যে , আমার ভক্ত পতিত হলেও শুধু আমার পঞ্চাক্ষরী নামের প্রভাবে মুক্তি পেয়ে থাকে।
সুতরাং পরমেশ্বর শিবের পঞ্চাক্ষরী মহামন্ত্র (ওম নমঃ শিবায়ঃ) জপ করলে মানুষ অনায়াসে মুক্তি পায়।
শ্রী ব্রম্মা বলেছেন
‘তন্নাম জাপিন দেব ন ভবন্তি ভবাশ্রয়াঃ।।‘
-বামন পুরান।
হে শিব তোমার নাম যারা জপ করেন তাঁদের আর পুনউৎপত্তি হয় না।
ওঙ্কারং রুথমারুহ্য বিষ্ণুং কৃত্তা তু সারথিম।
ব্রম্মলক পদান্বেষী রুদ্রারাধন তৎপরঃ।।
-অমৃতনাদ উপনিষদ
-ব্রম্মলক তথা ব্রম্মজ্ঞ্যান পথের যারা সন্ধানী, তাঁরা ওমকার রূপ রথকে বাহন করে তার ওপর চেপে বসবেন। বিষ্ণুকে করবেন সেই রথের সারথি। আর রুদ্রের আরাধনায় নিমগ্ন হবেন।
পরমেশ্বর সদা শিব বলেছেন-
জগত প্রলয়ে প্রাপ্তে নষ্টে চ কমলোদ্ভবে।
মদ্ভক্তা নৈব নশ্যন্তি স্বেচ্ছা বিগ্রহ ধারিনঃ।
যোগিনাং কর্ম্মিনাঞ্চৈব তাপসানাং যতাত্মানাম।
অহমেব গতিস্তেষাং নান্যদস্তিতী নিশ্চয়ঃ।।- সৌর পুরান
-জগতের প্রলয় হলে , এমনকি ব্রম্মার প্রলয়হলেও আমার ভক্ত বিনষ্ট হয় না, কেননা তারা আমার কৃপাধারী। যোগী, কর্মী এবং সংযত চিত্ত তপসশী-সকলেরই গতি আমি। অন্য গতি নাই এটা নিশ্চিত।
শিব ভক্তগন অনায়াসে মুক্তিলাভ করেন। তাঁদের সুবিধা এটাই যে, তারা পরমেশ্বর সদা শিবের কৃপায় ব্রম্মলক, বিষ্ণুলোক , গলক ইত্যাদি ধামে ইচ্ছামত বিচরন করতে পারেন।
পরম পুরুষ , নিরাকার নির্গুন শিব শঙ্কর সম্পর্কে কিছু তথ্য
-------------------------- -------------------------- -------------------------- ----
কথিত আছে, পরম পুরুষ একটি বেলপাতাতেই তুষ্ট। কিন্তু অতি প্রাচীন কাল থেকেই শিবলিঙ্গের উপাসনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বেলপাতা কয়েকটি বিশেষ বস্তু অর্ঘ্য দিয়ে এসেছে। বিশ্বাস এই যে, এই বস্তুগুলি শিবলিঙ্গে প্রদান করলে বিশেষ বিশেষ মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
কী সেইগুলি দেখা যাক—
• বেল পাতার পেছনের অংশে মা লক্ষ্মীর বাস। বেল পাতা ৩ গুন ও ত্রিদেব এর প্রতীক। তাই বিল্ব পত্র পরমপুরুষের অনেক প্রিয়। এতে সার্বিক মঙ্গল হয় ও দাতা প্রভুর প্রিয় পাত্র হন।
• শিবলিঙ্গে ধুতুরা নিবেদন করলে জীবনে সমৃদ্ধি আসে, জীবন অনেক সহজ হয় বলে জানায় বিবিধ পুরাণ।
• শিবলিঙ্গে দুধ-গঙ্গাজল প্রদানের সময়ে তা লিঙ্গগাত্রে ঘষে দেওয়ার বিধি অতি প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত। বিশ্বাস এই, এর ফলে জীবন সুখের হয়।
• বিবাহিত জীবন সুখপ্রদ করতে শিবলিঙ্গে জাফরান প্রাদন বিধেয়। এর দ্বারা বিবাহে বাধাও দূর হয়।
• শনির সাড়ে সাতি দশা কাটাতে শিবলিঙ্গে তিল প্রদানের রীতিও বহু প্রাচীন।
• ১১টি বিল্বপত্র দ্বারা নির্মিত মালা শিবলিঙ্গে প্রদান করলে অশুভ প্রভাব জীবন থেকে দূর হঠে বলে বিশ্বাস রয়েছে।
• শিবলিঙ্গে দুর্বাঘাস প্রদান করলে নীরোগ জীবন লাভ হয় বলে বিশ্বাস।
• শিবলিঙ্গে দুগ্ধ প্রদানের জন্য তাম্রপাত্রই প্রশস্ত।
• আর্থিক সমৃদ্ধিকে অব্যাহত রাখতে শিবলিঙ্গে চাল প্রদান করাও প্রাচীন রীতি।
আরও ব্যাপার হল মহাদেব এর গনেশ -কার্তিক ছাড়াও ৪ পুত্র আছে। এই পুত্রেরা কেউই কিন্তু পার্বতীর সন্তান নন। শিবের বিভিন্ন লীলার সময়ে তাঁদের জন্ম হয়েছিল। কার্তিক-গণেশ ছাড়াও বাকি চার পুত্রের সন্ধান রইল এখানে।
• অয়প্প— অসুরদের হাত থেকে অমৃতকে বাঁচানোর জন্য বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করেন। সেই সময়ে শিব শক্তি তাঁর সঙ্গে যোগে মিলিত হন এবং এই মিলনের ফলেই অয়প্পর জন্ম হয়। দক্ষিণ ভারেত অয়প্পকে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা বলেই মনে করা হয়। তাঁকে হরি ও হরের সম্মিলিত রূপ বলে মনে করা হয়।
• অন্ধক— দানবরাজ হিরণ্যাক্ষ পুত্রহীন ছিলেন। তিনি পুত্রলাভের আশায় মহাদেবের তপস্যা করেন। শিব তাঁকে এক পুত্রসন্তান প্রদান করেন। জন্মান্ধ সেই পুত্রের নাম ছিল অন্ধক।
• ভৌম— শিবের অংশ ভূমিতে পড়েই ভৌমের জন্ম হয়েছিল। শিব তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। ভূমিদেবীই ভৌমকে পালন করেন। পরে শিব ভৌমের কথা জানতে পারেন এবং তাঁকে পুত্র হিসেবে স্বীকার করে নেন।
• খুজ— একবার গভীর ধ্যানে মগ্ন অবস্থায় শিবের দেহ থেকে তীব্র জ্যোতি বিকীর্ণ হতে থাকে। সেই জ্যোতি ভূমিতে প্রবিষ্ট হলে খুজের জন্ম হয়। তাঁকে লৌহের দেবতা বলে মনে করা হয়।
আশ্চর্য সুন্দর কৈলাস পর্বত।
কৈলাস পর্বতকে দেবাদিদেব মহাদেবের আবাস বলে বর্ণনা করেছে হিন্দু পুরাণ। ২২০০০ ফিট উচ্চতাবিশিষ্ট এই পর্বত তার চেহারার দিক থেকেও স্বাতন্ত্রপূর্ণ। তার উপরে এই পর্বতের সন্নিহিত মানস সরোবরের অবস্থান একে অন্য মহিমা দান করেছে। সবমিলিয়ে কৈলাস এক দুর্লভ তীর্থ। কিন্তু কৈলাসের রহস্যময়তাও কিছু কম নয়। কৈলাস সংক্রান্ত আলোচনায় বার বার উঠে এসেছে এমন কিছু রহস্য, যার সমাধান সম্ভব হয়নি কোনও কালেই।
দেখা যাক কৈলাস-রহস্যের কয়েকটিকে।
• পশ্চিম তিব্বতের এই পর্বত কেবল হিন্দুদের কাছেই নয়, জৈন, বৌদ্ধ, তিব্বতের প্রাচীন ‘বন’ ধর্ম— সব ক’টিই কৈলাসকে পবিত্র বলে মনে করে।
• এক সময়ে রাশিযান বিশেষজ্ঞরা কৈলাস কে একটি বিশালাকৃতি পিরামিড বলে বর্ণনে করেছিলেন। তাঁরা এই পর্বতকে মানুষের তৈরি বলেও জানান। কোনও গোপন কাল্টের উপাসনাস্থল হিসেবে তাঁরা কৈলাসকে ব্যক্ত করেন। খুঁটিয়ে দেখলে কৈলাসের পিরামিডাকৃতি বোঝা যায়।
• ইউরোপের অকাল্টবাদীরা কৈলাসকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাঁদের মতে, এখানে অতিপ্রাকৃত শক্তির অবস্থান। অনেকের মতে আবার এই স্থান যাবতীয় অতিপ্রাকৃতের কেন্দ্র।
• পুরাণ অনুযায়ী কৈলাস পর্বতের চারটি পাশ স্ফটিক, চুনি, সোনা এবং লাপিস লাজুলি দ্বারা গঠিত। এই তথ্য সত্য নয়। কিন্তু, দিনের বিভিন্ন সময়ে আলোর পড়ে এই সব পাথর বা ধাতুর বিভ্রম কৈলাস অবশ্যই তৈরি করে।
• কৈলাস অঞ্চলে অবস্থিত হ্রদগুলির আকৃতি রহস্যময়। মানস সরোবর পূর্ণ গোলাকার এক জলাশয়। রাক্ষস তালের আকৃতি অর্ধচন্দ্রাকার। এরা নাকি সূর্য ও চন্দ্রের শক্তিকে প্রকাশ করে।
• তিব্বতী তান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুযায়ী কৈলাস তাঁদের দেবতা ডেমচমংয়ের আবাস। হিন্দুদের মতে এখানে বাস করেন শিব। জৈন-ধারণায় কৈলাসের বাসিন্দা তাঁদের প্রথম তীর্থঙ্কর। এই তিন ধর্ম অনুসারে কৈলাসে আরোহণ নিষিদ্ধ।
• কেবল এটুকুই জানা যায়, ১১ শতকের তিব্বতী মহাযোগী মিলারেপাই একমাত্র কৈলাসে আরোহণ করেছিলেন।
বাংলাদেশী হিন্দুদের কাছে শিব বা মহাদেব হলেন তম গুন সম্পন্ন এক শ্মশানবাসী। যিনি মদ গাঁজা আর ভুত প্রেত নিয়ে পরে থাকেন। তাঁকে এই দেশের মানুষরা এতো মুল্য দেয় না বর্তমানে। কারন ইনি নাকি মুক্তি দিতে পারেন না। অবশ্য এইসব অবান্তর কথা এই অঞ্চলে বেশীদিন হয় নাই। আগে এই অঞ্চলের মানুষদের প্রধান উপাস্য ছিলেন মা কালী। যিনি দক্ষিণা কালী হিসাবে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। চৈতন্য মহাপ্রভু আসার পর এই অঞ্চলে গৌড়ীয় মতবাদ বিস্তৃতি লাভ করে। এইখানে শাক্তবাদ এর কল্যানে মানুষ শিব সম্পর্কে এতটা জ্ঞ্যানি ছিলেন না। কিন্তু শিব এর পূজা ঠিকই করতেন। পূজা বলতে শিব লিঙ্গে একটু দুধ ঢেলে একটা কলা মাথায় দিয়ে বোম বোম বা ভলে বাবা ঠান্ডা হউ এই ধরনের আচরণ যা এখনও চলে আসছে। ব্যাপারটা অনেকটা যেন শিবকে ঠাণ্ডা রাখ নাহলে উনি পাগলামি করে সব নষ্ট করে দিবেন। কিন্তু আসলে কি তাই? এরজন্য আমার কিছু বক্তব্য শাস্ত্রের আলোকে ব্যাখ্যা করবো।যেহেতু এইদেশের সবাই পুরান তথা সংহিতায় বিশ্বাসী তাই আমি এর আলোকেই সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করবো। যারা বেদ বা উপনিষদ এর রেফারেন্স চান তাঁরা আমাকে ইনবক্স করতে পারেন।
ভগবান শিব সাক্ষ্যাৎ সত্য সনাতন পরমেশ্বর। তিনি কালের উর্ধে বিরাজিত মহাকালেশ্বর। কাল বা সময় উনার অধীন। তাই সর্বযুগে সবার আরাধ্য ভগবান শিব। কিন্তু ঐ যে, অসাধু ও মুর্খ্যরা অপকথা বলে আর মানতে চায় না। তাই শাস্ত্র থেকে কিছু কথা বলবো।
অজ্ঞরা বলে থাকে যে , কলি কালে নাকি এক কৃষ্ণ নামে মুক্তি বাকীরা নাকি মুক্তি দিতে পারেন না। এরজন্যই যারা শিব উপাসনা করেন এদেরকে এরা হেয় বা হীন চোখে দেখে। কথাটা একটু যদি ঘুরিয়ে বলি তাহলে বলা যায় শাস্ত্রে শিব নামে মুক্তি নেই এই কথা নেই। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায় এরা শিব, দুর্গা, কালী ভক্তদের ইনিয়ে বিনিয়ে বা সরাসরি বলতে শুরু করে কলি যুগে নাকি এক কৃষ্ণ নাম ছাড়া মুক্তি নেই। এসব ক্ষেত্রে এরা কয়েকটি শ্লোক আওড়ায়। যথা-
হরিনাম্ হরিনাম্ হরিনামব্য কেবলম্
কলৌও নাস্তব্য নাস্তব্য নাস্তব্য গতিরন্যথা
সারমর্ম হল ‘হরি( এদের ভাষায় কৃষ্ণ) নাম ছাড়া কলি যুগে মুক্তি নাই।‘
আর একটি শ্লোক হল ভাগবত গীতার
সর্ব ধর্ম পরিত্যাজ্যং মামেকং শরনং ব্রজ
মানে সব ধর্ম ত্যাগ করে আমার স্মরণ নাও।
একটু বিশ্লেষনে যাই এবার। প্রথমে আসি হরি নাম নিয়ে। অবশ্যই, হরি মানে বিষ্ণু নামে মুক্তি আছে। কারন উনি পরম পুরুষের একটি পালন রূপ। উনার নাম নিয়ে ভক্ত প্রহ্লাদ বা ধ্রুব মুক্তি পেয়েছিলেন। এর হাজার প্রমান আছে। মহাবিষ্ণুর শ্রী চরনে আমার হাজার হাজার প্রনাম। কিন্তু অজ্ঞ্যানীরা এইখানে কৃষ্ণকে কোথায় পেলেন? যদি কেউ বলেন কৃষ্ণ উনার অবতার তাহলে উনার সাথে কৃষ্ণকে জড়ালে দোষ কথায়? আমি বলবো নৃসিংহ, রাম, পরশুরাম, বরাহ উনাদের সাথেও জড়ান না কেন? বা কেনই উনাদের নিয়ে আপনারা কোন পুরান আবিস্কার করেন না?জানি করবেন না কারন এতে আপনাদের রমরমা ব্যাবসা নষ্ট হবে আর সত্য উন্মচিত হবে।
এবার আসি ভাগবত গীতার শ্লোকে।গীতা নিয়ে আমার অনেক কিছু বলার আছে। আসলে মুর্খ ও অল্প শিক্ষিত লোকজন বলে ভাগবত গীতা নাকি বেদসার সংক্ষেপ। শুনে হাসি পায় এরকম মুর্খ কথা শুনলে। আমাদের ধর্মে মোট ২০০ ধরনের গীতা আছে এর মাঝে ৪২টি গীতা অন্যতম।গীতা বলতে ৯৮% মানুষ ঐ ভাগবত গীতাকেই বোঝেন। বাস্তবে এর বাইরেও আরও অনেক কিছু যে আছে তা এই মুর্খ্য কুয়োর ব্যাঙেরা জানেন না। হিন্দু ধর্ম বলতে এরা শুধু বোঝে গৌড়ীয় তিলক দেয়া, মালা জপা আর একাদশী রেখে মনের সুখে লাফানো। হিন্দু ধর্মের খুব নগন্য ও তুচ্ছ একটি বিষয়কে আঁকড়ে ধরে এরা মনে করেন বিশ্ব জগতের সমস্ত জ্ঞ্যান আমার মাথায় গিজ গিজ করছে। আসলে যে ভগবত গীতা আপনারা দেখেন তা হিন্দু ধর্মের ইতিহাস নামে খ্যাত মহাভারতের খুব ছোট একটি অংশ মাত্র।শুধু এক মহাভারত থেকে প্রায় ২০+ গীতা বের হয়েছে।
রাম কৃষ্ণ উভয়েই শিব আরাধনা করতেন |
এবার আসি সেই ভগবত গীতা প্রসঙ্গে। ভগবত গীতাতে কৃষ্ণ আমি বলতে নিজেকে যে বোঝান নি তা অনুগীতার উৎপত্তিই আমাদের বলে দেয়। মহাভারতের ১৪ তম অধ্যায়ের অশ্বমেধ পর্বে অর্জুন যখন কৃষ্ণকে বলেন “হে কৃষ্ণ আমি ভগবত গীতার সৃতিভ্রষ্ট হইয়াছি আমাকে আবার আপনার বিশ্ব রূপ দর্শন দিন।‘ কৃষ্ণ তখন উত্তরে বলেন “ হে পার্থ, আমি যোগী শ্রেষ্ঠ। যোগ দ্বারা আবিষ্ট হইয়া আমি পরম পুরুষের বানী আমি মানব জাতিকে দিয়েছি। সেই পরম যোগ আমার পক্ষে এই জন্মে আর ধারন করা সম্ভব নহে। তাই এর সারমর্ম আমি তোমাকে বলিতেছি, শ্রবন করো।“এতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে আমি বলতে উনি কোন আমিকে নির্দেশ করেছিলেন। কিন্তু বোকারা এই আমি বলতে কৃষ্ণকে ধরে নিয়েছেন। কৃষ্ণ বোধ হয় ওপরে গিয়ে নিজেই নিজের মাথা চাপড়াচ্ছেন।যাইহোক যদি আমি ভগবত গীতাকে কৃষ্ণের বানী সত্যি ধরেও নেই তারপরও বলবো সেই পরম সত্ত্বা আর কেউ নন শিব নিজে। কেন বলছি??!! অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই? একটু পেছনে যাই। ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণের জন্মের আগে উনি ত্রেতা যুগে যে শরীর ধারন করেছিলেন তাঁর নামটা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রাম। উনিও কৃষ্ণের মতনই ভীষণ শিব ভক্ত ছিলেন। রাম যখন সীতা হরনের পর বিলাপ করতে থাকেন তখন মহামুনি অগস্ত্য রামকে শিব আরাধনার জন্য বলেন। আর সেই পরমাত্তার স্বরূপের জ্ঞ্যান ও বর রামকে প্রার্থনা করতে বলেন। এরি পরিপ্রেক্ষিতে রাম শিব আরাধনা করেন আর পরম পুরুষ শিবের দর্শন লাভ করেন। প্রভু শিব শ্রী রামকে পরম জ্ঞ্যান ও মানব আত্মার প্রকৃত স্বরূপের কথা ব্যাক্ত করেন যা উনারি পরবর্তী জন্ম শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন। বিশ্বাস হয় না?! শিব গীতার সাথে ভাগবত গীতার শ্লোকগুলো একটু মিলিয়ে দেখতে পারেন। বরং শিব গীতায় মানব ভ্রুনের অনেক বিস্তারিত বর্ণণা পাবেন যা আধুনিক বিজ্ঞ্যান বলে।
কলি যুগে শিব মানেই মুক্তি। শুধু কলিযুগে কেন, সর্ব যুগে, সর্ব সময়ে শিব নামে অথবা শিব ভক্তিতেই মুক্তি হয়। শাস্ত্র থেকে এই বিষয়ে অসংখ্য উদ্বৃতি দেয়া যায়। তবে এতে লেখার আকার বড় হবে অন্য কিছুই না। তবে অল্প কিছু দিলাম। বুঝতে পারলেই হল। যারা খুঁতখুঁতে মনের মানুষ তাঁদের বিচার বিশ্লেষণ করতে অনুরোধ করবো। আর যারা বিনীত ও অহংমুক্ত হয়ে জিজ্ঞ্যাসু, তাদেরকে মনোযোগ দিয়ে অনুধাবন করতে প্রার্থনা করবো।
আমি বলে রাখি শুদ্ধ বৈষ্ণব, শাক্ত , শৈব সকলেই মহান। প্রত্যেকেই মুক্তি লাভ করবেন যদি নিজ নিজ স্থান থেকে প্রভুকে স্মরণ মনন করেন।উত্তম ভক্তের লক্ষন বিষয়ে বৃহন্নারদীয় পুরানে বলা হয়েছে,
শিবপ্রিয়াঃ শিবসক্তাঃ শিবপাদার্চ্চনে রতাঃ।
ত্রিপুন্ড্রধারিণো যে চ তে বৈ ভাগবতত্তমাঃ।
ব্যাহরন্তিচ নামনি হরেঃ শম্ভোর্মহাত্ন্নঃ।
রুদ্রাক্ষালংকৃতা যে চ তে বৈ ভাগবতোত্তমাঃ।।
যে যজন্তি মহাদেবং ক্রতুর্ভিবহুদক্ষিনৈঃ।
হরিং বা পরয়া ভক্ত্যা তে বৈ ভাগবতত্তমাঃ।
বিদিতানি চ শাস্ত্রানিপরার্থং প্রবদন্তি যে।
সর্ব্বত্র গুনভাজো যে তে বৈ ভাগবতোত্তমাঃ।।
- শিবে প্রীতি, শিবে ভক্তি, শিবের অর্চ্চনায় রত, ত্রিপুন্ড্রধারী। বিষ্ণুনাম ও শিবনাম কীর্তন, রুদ্রাক্ষ ধারন যারা এসব করে এরাই ভাগবতত্তম।বহুদক্ষিণা দানে দৃঢ়ভক্তির সাথে মহাদেবের অথবা বিষ্ণুর যজ্ঞ্যানুষ্ঠান করেন এবং পরমার্থ বষোয়ে বিদিত শাস্ত্রের উপদেশ যারা প্রদান করেন এবং যারাগুনধর, তাঁরাই উত্তম ভাগবত।
বিনা শম্ভু সেবাং সংসার তরনং ন হি।। - সৌরপুরান
- ভগবান শিবকে আশ্রয় করেই মুক্তি হয়। শিবসেবা ব্যাতিত সংসার পার হওয়া যায় না।
নার্চ্চ্যন্তীহ যে রুদ্রং শিবং ত্রিদশবন্দিতম
তেষাং দানং তপো যজ্ঞ্য বৃথা জীবিতমেব চ।।
--কুর্ম্ম পুরান
যারা ইহলোক ত্রিদশ বন্দিত মহাদেবের আরাধনা না করে তাঁদের দান, তপস্যা, যজ্ঞ্য ও জীবন সমস্তই বৃথা।
বায়বীয় সংহিতায় মাতা পার্বতি (দুর্গা) প্রভু শিবকে জিজ্ঞ্যাসা করেন – হে ভগবান! কলিযুগে আপনার ভক্তগন কিভাবে মুক্ত হবেন? তখন পরমেশ্বর বলেন
আশ্রিত্য পরমাং বিদ্যাং হ্রিদ্যাং পঞ্চাক্ষরীয়ং মম।
ভক্ত্যা চ ভাবিতাত্মানো মুচ্যন্তে কলিজা নরাঃ।।
-প্রিতমে! কলিকালের মানুষ আমার প্রতি ভক্তি ভাবিত হয়ে আমার পঞ্চাক্ষরি বিদ্যা অবলম্বন করলেই মুক্তি লাভ করবে।
ময়ৈবমস্কৃদ্দেবি প্রতিজ্ঞ্যাতং ধরাতলে।
পতিতোহপি বিমুচ্যেত মদ্ভক্তো বিদ্যায়ানয়া।
-হে দেবী! আমি বার বার ধরাতলে প্রতিজ্ঞ্যা করেছি যে , আমার ভক্ত পতিত হলেও শুধু আমার পঞ্চাক্ষরী নামের প্রভাবে মুক্তি পেয়ে থাকে।
সুতরাং পরমেশ্বর শিবের পঞ্চাক্ষরী মহামন্ত্র (ওম নমঃ শিবায়ঃ) জপ করলে মানুষ অনায়াসে মুক্তি পায়।
শ্রী ব্রম্মা বলেছেন
‘তন্নাম জাপিন দেব ন ভবন্তি ভবাশ্রয়াঃ।।‘
-বামন পুরান।
হে শিব তোমার নাম যারা জপ করেন তাঁদের আর পুনউৎপত্তি হয় না।
ওঙ্কারং রুথমারুহ্য বিষ্ণুং কৃত্তা তু সারথিম।
ব্রম্মলক পদান্বেষী রুদ্রারাধন তৎপরঃ।।
-অমৃতনাদ উপনিষদ
-ব্রম্মলক তথা ব্রম্মজ্ঞ্যান পথের যারা সন্ধানী, তাঁরা ওমকার রূপ রথকে বাহন করে তার ওপর চেপে বসবেন। বিষ্ণুকে করবেন সেই রথের সারথি। আর রুদ্রের আরাধনায় নিমগ্ন হবেন।
পরমেশ্বর সদা শিব বলেছেন-
জগত প্রলয়ে প্রাপ্তে নষ্টে চ কমলোদ্ভবে।
মদ্ভক্তা নৈব নশ্যন্তি স্বেচ্ছা বিগ্রহ ধারিনঃ।
যোগিনাং কর্ম্মিনাঞ্চৈব তাপসানাং যতাত্মানাম।
অহমেব গতিস্তেষাং নান্যদস্তিতী নিশ্চয়ঃ।।- সৌর পুরান
-জগতের প্রলয় হলে , এমনকি ব্রম্মার প্রলয়হলেও আমার ভক্ত বিনষ্ট হয় না, কেননা তারা আমার কৃপাধারী। যোগী, কর্মী এবং সংযত চিত্ত তপসশী-সকলেরই গতি আমি। অন্য গতি নাই এটা নিশ্চিত।
শিব ভক্তগন অনায়াসে মুক্তিলাভ করেন। তাঁদের সুবিধা এটাই যে, তারা পরমেশ্বর সদা শিবের কৃপায় ব্রম্মলক, বিষ্ণুলোক , গলক ইত্যাদি ধামে ইচ্ছামত বিচরন করতে পারেন।
শ্রী বিষ্ণুর সুদর্শন লাভ থেকে শুরু করে রামের মুক্তিদাতা হিসাবে প্রভু শঙ্কর সব সময় প্রকট হয়েছিলেন। |
পরম পুরুষ , নিরাকার নির্গুন শিব শঙ্কর সম্পর্কে কিছু তথ্য
--------------------------
কথিত আছে, পরম পুরুষ একটি বেলপাতাতেই তুষ্ট। কিন্তু অতি প্রাচীন কাল থেকেই শিবলিঙ্গের উপাসনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বেলপাতা কয়েকটি বিশেষ বস্তু অর্ঘ্য দিয়ে এসেছে। বিশ্বাস এই যে, এই বস্তুগুলি শিবলিঙ্গে প্রদান করলে বিশেষ বিশেষ মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
কী সেইগুলি দেখা যাক—
• বেল পাতার পেছনের অংশে মা লক্ষ্মীর বাস। বেল পাতা ৩ গুন ও ত্রিদেব এর প্রতীক। তাই বিল্ব পত্র পরমপুরুষের অনেক প্রিয়। এতে সার্বিক মঙ্গল হয় ও দাতা প্রভুর প্রিয় পাত্র হন।
• শিবলিঙ্গে ধুতুরা নিবেদন করলে জীবনে সমৃদ্ধি আসে, জীবন অনেক সহজ হয় বলে জানায় বিবিধ পুরাণ।
• শিবলিঙ্গে দুধ-গঙ্গাজল প্রদানের সময়ে তা লিঙ্গগাত্রে ঘষে দেওয়ার বিধি অতি প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত। বিশ্বাস এই, এর ফলে জীবন সুখের হয়।
• বিবাহিত জীবন সুখপ্রদ করতে শিবলিঙ্গে জাফরান প্রাদন বিধেয়। এর দ্বারা বিবাহে বাধাও দূর হয়।
• শনির সাড়ে সাতি দশা কাটাতে শিবলিঙ্গে তিল প্রদানের রীতিও বহু প্রাচীন।
• ১১টি বিল্বপত্র দ্বারা নির্মিত মালা শিবলিঙ্গে প্রদান করলে অশুভ প্রভাব জীবন থেকে দূর হঠে বলে বিশ্বাস রয়েছে।
• শিবলিঙ্গে দুর্বাঘাস প্রদান করলে নীরোগ জীবন লাভ হয় বলে বিশ্বাস।
• শিবলিঙ্গে দুগ্ধ প্রদানের জন্য তাম্রপাত্রই প্রশস্ত।
• আর্থিক সমৃদ্ধিকে অব্যাহত রাখতে শিবলিঙ্গে চাল প্রদান করাও প্রাচীন রীতি।
আরও ব্যাপার হল মহাদেব এর গনেশ -কার্তিক ছাড়াও ৪ পুত্র আছে। এই পুত্রেরা কেউই কিন্তু পার্বতীর সন্তান নন। শিবের বিভিন্ন লীলার সময়ে তাঁদের জন্ম হয়েছিল। কার্তিক-গণেশ ছাড়াও বাকি চার পুত্রের সন্ধান রইল এখানে।
• অয়প্প— অসুরদের হাত থেকে অমৃতকে বাঁচানোর জন্য বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করেন। সেই সময়ে শিব শক্তি তাঁর সঙ্গে যোগে মিলিত হন এবং এই মিলনের ফলেই অয়প্পর জন্ম হয়। দক্ষিণ ভারেত অয়প্পকে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা বলেই মনে করা হয়। তাঁকে হরি ও হরের সম্মিলিত রূপ বলে মনে করা হয়।
• অন্ধক— দানবরাজ হিরণ্যাক্ষ পুত্রহীন ছিলেন। তিনি পুত্রলাভের আশায় মহাদেবের তপস্যা করেন। শিব তাঁকে এক পুত্রসন্তান প্রদান করেন। জন্মান্ধ সেই পুত্রের নাম ছিল অন্ধক।
• ভৌম— শিবের অংশ ভূমিতে পড়েই ভৌমের জন্ম হয়েছিল। শিব তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। ভূমিদেবীই ভৌমকে পালন করেন। পরে শিব ভৌমের কথা জানতে পারেন এবং তাঁকে পুত্র হিসেবে স্বীকার করে নেন।
• খুজ— একবার গভীর ধ্যানে মগ্ন অবস্থায় শিবের দেহ থেকে তীব্র জ্যোতি বিকীর্ণ হতে থাকে। সেই জ্যোতি ভূমিতে প্রবিষ্ট হলে খুজের জন্ম হয়। তাঁকে লৌহের দেবতা বলে মনে করা হয়।
আশ্চর্য সুন্দর কৈলাস পর্বত।
কৈলাস পর্বতকে দেবাদিদেব মহাদেবের আবাস বলে বর্ণনা করেছে হিন্দু পুরাণ। ২২০০০ ফিট উচ্চতাবিশিষ্ট এই পর্বত তার চেহারার দিক থেকেও স্বাতন্ত্রপূর্ণ। তার উপরে এই পর্বতের সন্নিহিত মানস সরোবরের অবস্থান একে অন্য মহিমা দান করেছে। সবমিলিয়ে কৈলাস এক দুর্লভ তীর্থ। কিন্তু কৈলাসের রহস্যময়তাও কিছু কম নয়। কৈলাস সংক্রান্ত আলোচনায় বার বার উঠে এসেছে এমন কিছু রহস্য, যার সমাধান সম্ভব হয়নি কোনও কালেই।
দেখা যাক কৈলাস-রহস্যের কয়েকটিকে।
• পশ্চিম তিব্বতের এই পর্বত কেবল হিন্দুদের কাছেই নয়, জৈন, বৌদ্ধ, তিব্বতের প্রাচীন ‘বন’ ধর্ম— সব ক’টিই কৈলাসকে পবিত্র বলে মনে করে।
• এক সময়ে রাশিযান বিশেষজ্ঞরা কৈলাস কে একটি বিশালাকৃতি পিরামিড বলে বর্ণনে করেছিলেন। তাঁরা এই পর্বতকে মানুষের তৈরি বলেও জানান। কোনও গোপন কাল্টের উপাসনাস্থল হিসেবে তাঁরা কৈলাসকে ব্যক্ত করেন। খুঁটিয়ে দেখলে কৈলাসের পিরামিডাকৃতি বোঝা যায়।
• ইউরোপের অকাল্টবাদীরা কৈলাসকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাঁদের মতে, এখানে অতিপ্রাকৃত শক্তির অবস্থান। অনেকের মতে আবার এই স্থান যাবতীয় অতিপ্রাকৃতের কেন্দ্র।
• পুরাণ অনুযায়ী কৈলাস পর্বতের চারটি পাশ স্ফটিক, চুনি, সোনা এবং লাপিস লাজুলি দ্বারা গঠিত। এই তথ্য সত্য নয়। কিন্তু, দিনের বিভিন্ন সময়ে আলোর পড়ে এই সব পাথর বা ধাতুর বিভ্রম কৈলাস অবশ্যই তৈরি করে।
• কৈলাস অঞ্চলে অবস্থিত হ্রদগুলির আকৃতি রহস্যময়। মানস সরোবর পূর্ণ গোলাকার এক জলাশয়। রাক্ষস তালের আকৃতি অর্ধচন্দ্রাকার। এরা নাকি সূর্য ও চন্দ্রের শক্তিকে প্রকাশ করে।
• তিব্বতী তান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুযায়ী কৈলাস তাঁদের দেবতা ডেমচমংয়ের আবাস। হিন্দুদের মতে এখানে বাস করেন শিব। জৈন-ধারণায় কৈলাসের বাসিন্দা তাঁদের প্রথম তীর্থঙ্কর। এই তিন ধর্ম অনুসারে কৈলাসে আরোহণ নিষিদ্ধ।
• কেবল এটুকুই জানা যায়, ১১ শতকের তিব্বতী মহাযোগী মিলারেপাই একমাত্র কৈলাসে আরোহণ করেছিলেন।