প্রতি সোমবারে ফেসবুকে ৫টি পর্ব আকারে আমি পরমেশ্বর ভগবান শিবের বিভিন্ন দিক, গুন আর রুপ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। যদিও প্রভু রুপ, রস ,গন্ধ, স্থান, কাল সবকিছুর অতীত। তারই মিলিত রুপ এখানে সন্নিবেশ করলাম। প্রভুকে উনার ভক্তের সাথে পরিচয় করে দেবার একটি অতি ক্ষুদ্র প্রয়াস।
শুভ সোমবার। পরমেশ্বর শিবের আর এক নাম সোম। এই কারনে শৈবদের কাছে এই দিন বিশেষ শিব পূজার দিন। বঙ্গদেশে শিবের এতো পূজা পার্বন হয় না। হলেও তা খুব অবহেলা সহকারে এবং অনেকটা "পাগল ব্যাটার পূজা করো নাহলে পাগলামি করে সব নষ্ট করে দিবে।" যা একটি মহাপাপ ও আসুরিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। আশার কথা হল ,তরুন সমাজে আজকাল শিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ ধর্ম চর্চা ও বৈদিক শিক্ষার প্রসার ঘটছে আস্তে আস্তে। যা খুবই আশার কথা। কিন্তু শিব কে? উনি কেন বৈদিক? বেদের
একাদশ রুদ্র আর উনি কি সমান? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর এখনও অনেক যুবক খুঁজে যাচ্ছেন। আর এই অজ্ঞ্যানতার সুযোগ নিচ্ছে তথাকথিত নিরাকারবাদী কিছু অতি পন্ডিত আর নাহয় বিভেদ সৃষ্টিকারী অনেক সম্প্রদায়। এর ফলে অনেক তরুন-তরুনী দিশাহীন হয়ে পড়ছেন। অনেকদিন ধরে ভাবছি এই বিষয়ে কিছু লিখবো। পরমেশ্বর শিব জ্ঞ্যানের বিশাল সাগর। শ্রী পুস্পদন্ত মহিন্ম স্তোত্রে বলেছেন।
অসিত-গিরি-সমং স্যাত্ কজ্জলং সিন্ধু-পাত্রে
সুর-তরুবর-শাখা লেখনী পত্রমুর্বী ।
লিখতি য়দি গৃহীত্বা শারদা সর্বকালং
তদপি তব গুণানামীশ পারং ন য়াতি ॥
পৃথিবী যদি কাগজ হয়,
সাগর যদি কালি হয় ,
আর মাতা সরস্বতী যদি নিরন্তর লিখেও যান তবুও তোমার গুন আর জ্ঞ্যানের পরিধি শেষ হবে না।
আজ থেকে প্রতি সোমবার আমি কয়েক পর্বে শিব জ্ঞ্যানের বিভিন্ন দিক আলোচনা করবো। পড়ার অনুরধ রইলো।
শিব জ্ঞান
ওঁ নমঃ শিবায়
সনাতন ধর্মের মধ্যে পঞ্চ মতের পূজা অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। সারা পৃথিবীতে শাক্ত, শৈব, গাণপত্য, সৌর ও বৈষ্ণব সম্প্রদায় বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর মধ্যে শৈবদের সংখ্যা অধিক। যদিও বঙ্গদেশে (পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে) গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাই এইসব অঞ্চলে শৈবদের উপস্থিতি এতটা দেখা যায় না। যদিও সনাতন ধর্মের মহাপুরুষদের মধ্যে বঙ্গদেশে প্রণবমঠ, লোকনাথ ভক্তসম্প্রদায়, ভোলানন্দগিরি সম্প্রদায় প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষভাবে শৈব শাখার সঙ্গে যুক্ত। শৈবদের সংখ্যা অত্যাধিক হওয়ার কারণ হচ্ছে শক্তি তথা মাতা পার্বতী এবং শ্রীগণেশ বা গণপতি কোন না কোনভাবে পরমেশ্বর মহাদেবের সাথে সংযুক্ত। পুরাণমতে ত্রিভুবনে সবথেকে বেশি ভক্তসংখ্যা পরমেশ্বর শিবের কারণ গান্ধর্ব, পিশাচ, রাক্ষস, সর্প, মানব, দেব এরা সকলেই সর্বক্ষণ শিবনাম করেন এবং বিপদে সর্বদা শিবের শরণাপন্ন হয়। শিবশংকর মঙ্গলকারী বলে সবাই তাঁর উপাসনা করে থাকেন। পরমেশ্বর শিব যদিও কল্যাণকারীরূপে ত্রিভুবনে বিরাজমান কিন্তু সৃষ্টির নিমিত্তে তিনিই সংহার কর্তা। শিবই একমাত্র ভগবান যিনি বাহির থেকে তমঃগুণী এবং ভেতর থেকে সত্ত্বগুণী। ভগবান ব্রহ্মা যিনি তিন লোকের জন্মদাতা তিনি ভেতর এবং বাহির দুই অবস্থাতেই রজঃগুণী
ভগবান পরমব্রহ্ম শিব তিনগুণের অধিকারী। এর রহস্য হল সত্ত্ব মানে আনন্দ অর্থাৎ শিব সচ্চিদানন্দ কারণ শিব সর্বদা আনন্দে লীন থাকেন। দুঃখের রূপ তমঃ তাই শিব সতীর দু;খে সংসার ত্যাগী হয়েছিলেন, শিব রজঃগুণী কারণ স্থান, কাল, পাত্রভেদে উনি রজঃগুণী হন এবং সৃষ্টির কর্ম সচল রাখেন। তমঃগুণী বিষ্ণু বিশ্বের পালনকর্তা কারণ পৃথিবীতে এই সৃষ্টি আদতে সুখের মনে হলেও(সত্ত্বগুণ) কিন্তু তা বাস্তবিকর্থে তা দুঃখের আধার। তাই ভগবান বিষ্ণুর বাহ্যিকরূপ অত্যন্ত চাকচিক্যপূর্ণ এবং সুখী মনে হলেও একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় শ্রীবিষ্ণুর গায়ের রং শ্যামবর্ণ যা তমঃগুণের প্রকাশক। ভগবান শিব বাহ্যিকরূপে তমঃগুণী হলেও বাস্তবিকর্থে উনি সত্ত্বগুণী কারণ উনি সংসার ধ্বংসের মাধ্যমে সবকিছু পুনরায় পরমাত্মাতে লীন করেন এবং পরমাত্মা সর্বদা সুখের রূপ।তাছাড়া উনি ভেতর থেকে সত্ত্বগুণী বলেই আশুতোষ এবং সহজেই সন্তুষ্ট হন এবং এটাই সত্ত্বগুণের প্রভাব। ভগবান ব্রহ্মা সর্বদা সংসারে সৃষ্টি করে থাকেন। তাই তিনি রজঃগুণী এবং শাস্ত্রে কর্ম বা ক্রিয়াকে রজঃগুণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই ভগবান ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু এই দুই জনের উপাসনা স্ব্য়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায় যদি কেউ শিবের উপাসনা করে থাকেন। এ জন্যই ত্রিনাথের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই কারণ শিব থেকেই সম্পূর্ণ জগতের সৃষ্টি, শিবের মধ্যেই সম্পূর্ণ জগৎ অবস্থিত এবং সম্পূর্ণ জগৎ শিবেতেই লয়প্রাপ্ত(লীন) হয়। পরমেশ্বর শিবকে আদতে মানব যেভাবে কল্পনা করে থাকে তিনি তাঁর থেকেও বিশাল এবং বর্ণনাতীত এজন্যই তাঁর নাম স্বয়ম্ভু বা শিবশম্ভু।
শিল্পীর চোখে প্রভু পরমেশ্বর |
শিবপুরাণে ভগবান শিবের নির্গুণ স্বরূপকে সদাশিব, সগুণ রূপকে মহেশ্বর, বিশ্বের সৃষ্টিকর্তাকে ব্রহ্মা, পালনকারী স্বরূপকে বিষ্ণু এবং সংহারকারী রূপকে রুদ্র বলা হয়েছে। রুদ্রের আরেকটি অর্থ হল যে সম্পূর্ণ দুঃখ হতে মুক্তিদান করেন। বাস্তবে জন্ম, পালন ও মৃত্যু তিন-ই শিবের অধীন। সদাশিবের শরীরে অনেক চিহ্ন রয়েছে যা অনেক অর্থ বহন করে।
নির্বস্ত্র শরীর এবং ভস্মধারীঃ
এইরূপ অত্যন্ত বিখ্যাত কারণ ভস্ম হলো জীবদেহের আকারের সর্বশেষ রূপ এবং তা প্রভু শরীরে মাখেন। মানব বা পশু প্রত্যেকের আকার ভস্মতেই লীন হয়। এই ভস্মই শিব দেহে ধারণ করেন অর্থাৎ সমস্ত প্রকৃতি উনার থেকেই সৃষ্টি উনাতেই লীন হবে। এটাই নির্বস্ত্রধারী ভস্মধারীর অর্থ তাছাড়াও ভস্ম ত্যাগের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
জটাঃ
মহাদেব অখণ্ড এবং আদিযোগী। যদি জটাকে ভালভাবে প্রতক্ষ্য করা যায় তা তিন অংশে বিভক্ত। এই তিন অংশ মানুষের তিন অবস্থাকে নির্দেশ করে যা যোগের মাধ্যমে প্রতিটি জীব বৃদ্ধি করতে পারে এবং কমাতে পারে। জটার এই তিন তিন অংশের রহস্য হল মানবের শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যত্মিক প্রতিফলন।উপরের জটার শক্ত করে বাঁধা কেশ মানবের শারীরিক যোগের প্রতিফলন মধ্যমে অংশ মানসিক যোগ এবং সর্বশেষ খোলা চুলের অংশ আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক। মানুষের শারীরিক শক্তি সবসময় বদ্ধ অবস্থায় থাকার দরকার তা প্রদর্শনের জন্য নয়। মধ্যভাগের মানসিক শক্তি পেশী শক্তি থেকে প্রবলতর হওয়া উচিত। শিবের জটার মধ্যভাগ উপরিভাগের তুলনায় মোটা এবং এর অর্থ পেশী শক্তি থেকে মানসিক শক্তি যত বেশি হবে মানুষ তত বেশি উন্নতি লাভ করতে পারবে। এবার আসি আধ্যাত্মিক শক্তি সর্বদা বহমান হওয়া দরকার। শারীরিক ও মানসিক যোগের সমন্ব্য়ে তৈরী হয় একটি সুন্দর আধ্যাত্মিক যোগ।
গঙ্গাঃ
গঙ্গা সনাতন ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র নদী হিসেবে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এটা মান হয় যে শুধুমাত্র গঙ্গায় স্নান করে জীবের শারীরিক ও মানসিক শুদ্ধতা নেমে আসে। এই গঙ্গাই শিবের জটা থেকে বহমান। স্ত্রী হওয়ার কারণে তাকে মাতা গঙ্গা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। এটা দিয়ে বুঝানো হয় যে শুধুমাত্র গঙ্গা যে শুদ্ধতা আসে তা শিবের ধ্যান পূজা এবং সেবাতেই হয়। পরমেশ্বর শিবের জটায় গঙ্গা দেবীকে স্থান প্রদান করে তাকে সর্বদা পবিত্র করেন। পরমেশ্বর শিব এতটাই দয়ালু যে নিজ জটায় স্থান দিয়ে জীবকে মুক্তিলাভ করতে সচেষ্ট হন।
চন্দ্রমাঃ
চন্দ্রমা হচ্ছেন পরমেশ্বরের অলঙ্কার। যা উনার শরীরের অংশ নয়। এর দ্বারা বুঝায় ‘উগাম এবং নিগাম’ অর্থাৎ সংসারের কিছুই স্থায়ী নয় । যা আসে তা কিছু সময়ের জন্যই স্থায়ী হয়। যেমন চন্দ্রমা অমবস্যা থেকে পূর্ণিমা থেকে অমবস্যায় আসা যাওয়া করতে থাকেন। আবার একইভাবে তা জীবাত্মার অবস্থাকে নির্দেশ করে। শ্রীশিবগীতা মতে আত্মা অবিনশ্বর তার কোন ধ্বংস নেই। তেমনি প্রভু এটাই নির্দেশ করছেন যে পূর্ণ থেকে অপরিপূর্ণ আবার অপরিপূর্ণ থেকে পরিপূর্ণ অবস্থায় জীবের আত্মার পরিবর্তন হয়।
ত্রিনেত্রঃ
শিবকে ত্রিনেত্র অথবা ত্রয়ম্বকম্ হিসেবেও উল্লেখ করা যায়। প্রভুর দক্ষিণ নেত্রে সূর্য, বাম নেত্রে চন্দ্রমা এবং মধ্যের তৃতীয় নয়ন জ্ঞানাগ্নির প্রতীক। এসব প্রভুর মধ্যেই সমাহিত। এই তৃতীয় নয়নের মানে হল অন্ধকার দূর করতে জ্ঞানের আলো মানুষকে প্রজ্জ্বলন করা উচিত অর্থাৎ জ্ঞানই শক্তি জ্ঞানই মুক্তি। জ্ঞান দ্বারাই পরমেশ্বরের স্বরূপ জানা সম্ভব। সূর্যের প্রকাশ এবং চন্দ্রের শীতলতা সমভাবে ভারসাম্য করতে পারলে মানুষ তার জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটাতে পারবে।
ধ্যানস্থ নয়নঃ
শিবের নয়ন যদি আপনারা ভালভাবে প্রতক্ষ্য করেন তবে দেখবেন ধ্যানমুদ্রায় অবস্থিত। অর্থাৎ সৃষ্টির নির্মাণ হচ্ছে। যোনীদের(মনুষ্য,খেচর,নাগ প্রভৃতি) জন্ম অনবরৎ ক্রিয়াশীল। এই ধ্যানমুদ্রাই যোগীর সত্যিকারের পরিচয়। যদি নয়ন পুরোপুরি ভাবে বন্ধ থাকে তাঁর মানে তিনি নুতন কোন অন্তরীক্ষ সৃষ্টি করছেন। নেত্র উন্মোচিত থাকে তার অর্থ অন্তরীক্ষ সৃষ্টি সম্পন্ন। অর্ধনিমজ্জিত নয়নে প্রভু প্রত্যক্ষ্ হন তথা তিনি সৃষ্টিনির্মাণে নিয়োজিত।
কুণ্ডলঃ
শিবের দক্ষিণ কর্ণে যে কুণ্ডল পরিলিক্ষিত হয় তার নাম নিরঞ্জন। নিরঞ্জন কথার অর্থ যা চর্ম চক্ষু দ্বারা দর্শন করা সম্ভব নয় শুধু উপলব্ধির দ্বারাই বোঝা সম্ভব। শিবের বাম কর্ণে যে কুণ্ডল পরিলক্ষিত হয় তার নাম অলকশায়া। এর অর্থ হল যা কোন চিহ্ন দ্বারা প্রকাশিত নয়। নিরঞ্জনেতেই সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য বিদ্যমান। একটু ভালো করলে দেখলে যাবে যে বাম কর্ণের অলকশায়া স্ত্রী কুণ্ডলের মত আর দক্ষিণ কর্ণের কুণ্ডল পুরুষের কুণ্ডলের মতো এর অর্থ হচ্ছে শিব শক্তি তথা প্রকৃতি পুরুষের মিলন যা সম্পূর্ণ সৃষ্টির আধার।
সর্পঃ
সর্প মানব জাতির নিকট সর্বদা আশ্চর্যজনক প্রাণী। কিন্তু বাস্তবে সর্প শিবের সমান যোগী। যোগীর যেমন কোন গৃহ নেই বস্ত্র নেই তেমনই সর্পের গৃহ, বস্ত্র, থাকে না। সে তার শরীরের খোলসও ত্যাগ করতে থাকে। বেশির ভাগ সময় সর্প খোলা আকাশের নিচে থাকে এবং গুপ্ত যায়গায় থাকে। এর জন্যই শিবের মতো সহযোগীর প্রতীক এই সর্প। একটু খেয়াল করলে বুঝা যায় এই বাসুকী নাগ তিন স্তরে মহাদেবের গলায় বেষ্টিত থাকে যা ভূত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ- এর প্রতীক। অর্থাৎ একজন যোগী ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সর্বদা থাকেন। এর ফণা সর্বদা দক্ষিণমুখে বিরাজমান অর্থাৎ সর্বদা শিব সতর্ক অবস্থায় থাকেন।
রুদ্রাক্ষের মালাঃ
রুদ্র মানে হচ্ছে স্বয়ম্ভু এবং অক্ষ কথার অর্থ চক্ষু তথা নয়ন। শিবের গলায় ১০৮টি রুদ্রাক্ষ থাকে। এই ১০৮টি রুদ্রাক্ষ ১০৮টি তত্ত্বের প্রতীক। যার মাধ্যমে সৃষ্টির নির্মাণ হয়েছে।
বরমুদ্রাঃ
বরমুদ্রার মাধ্যমে শিব অজ্ঞানকে জ্ঞানে রুপান্তর করেন। জ্ঞানের পথ হলো, প্রভুর পথ। জ্ঞানের দর্শন হলো, প্রভুর দর্শন। যা কিছুই প্রভুর কাছে প্রার্থনা করা হয় তা প্রভু প্রদান করেন।
নির্গুন পরম ঈশ্বর প্রভু শিব স্বয়ম্ভু |
ত্রিশূলের তিনটি শূল থাকে এর সর্ব বামে শক্তি মধ্যভাগে ইচ্ছা তথা ক্রিয়া এবং সর্ব ডানে জ্ঞান বিদ্যমান। শক্তি ইচ্ছার মাধ্যমেই মানুষ কর্ম করে এবং কর্ম থেকেই জ্ঞানের উন্মেষ হয়। জ্ঞান প্রাপ্তি হওয়ার সাথে সাথে আনন্দ লাভ হয় যা আমাদের পরমেশ্বর ভোলানাথের কাছে নিয়ে যায়।
ডমরুঃ
শিব সমস্ত মানব্জাতির কল্যাণের জন্য নাদ তথা শব্দের সৃষ্টি করে থাকেন। এই শব্দই হচ্ছে ‘ওঁ’। এই ‘ওঁ’ থেকেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করে থাকেন। তাই উনাকে ওঁকারেশ্বর নামে ডাকা হয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই নাদ বা শব্দ শ্রবণ করা সম্ভব নয়। এই নাদের সূক্ষস্বরূপ হচ্ছে ডমরু। এই ডমরুর আকৃতি হচ্ছে চোঙাকৃতির। যা দুই দিক থেকে আলাদা আলাদা শব্দ উৎপন্ন করা সত্ত্বেও তা একত্রিত ভাবে একই ওঁ কার নাদ তৈরী করে অর্থাৎ এক এ এসে লীন হয়।
ব্যাঘ্রচর্মঃ
বাঘের চর্ম উন্মত্ত অহঙ্কার , কামনা, হিংসা, দ্বেষ, ক্রোধ ইত্যাদির প্রতীক। শিব এর উপর উপবিষ্ট থাকেন। অর্থাৎ তিনি সকল কিছুর উর্ধ্বে স্থিত।
লিংগ্/লিঙ্গমঃ
মহাদেব সর্বপ্রথম নিরাকার এবং সাকারের প্রতিরূপ হিসেবে শিব্লিঙ্গম এর মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এই শিব্লিংগ্ এর আকৃতি থেকে বুঝা যায় যে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। নিচের অংশের নাম চৌরাস, মধ্যভাগের নাম অষ্টোহোনী এবং উপরিভাগের নাম গোরাকার।শিবলিংগ্ এর উপরের গোরাকার অংশ শিবলিংগ্ এর উচ্চতার এক তৃতীয়াংশ। নিচের চৌরাস অংশটি শ্রীব্রহ্মা, মধ্যভাগ শ্রীবিষ্ণু এবং পূজনীয় উপরের অংশ পরমেশ্বর মহাদেব স্বয়ং। এই শিবলিঙ্গম এর মাধ্যমে শিবের সৃষ্টি, পালন এবং সংহাররূপ একত্রে পূজিত হন। লিঙ্গম শব্দটি দুইটি শব্দের মিশ্রণে তৈরী। লিংগ্ এর অর্থ শিব এবং ইংগ্ শব্দের অর্থ আত্মা। অর্থাৎ আত্মা এবং পরমাত্মা এই দুইয়ের মিশ্রণে তৈরী এই শিবলিঙ্গম। লিঙ্গম এর পরিভাষা তিনটি শিবলিঙ্গম এর মধ্যে স্পষ্ট ভাবে বুঝা যায়।
• ইষ্টলিংগ্ এর মধ্যে পরমেশ্বর শিবে তার সুন্দররূপে পরিলক্ষিত হন এবং সকলকে দান ও বরদান করে থাকেন।
• ভাবলিংগ্ এর মধ্যে শিব নিরওঁঙ্কার। এই লিংগ্ অন্তরাত্মার মাধ্যমেই উপলব্ধ হয়। এর জন্য ইহা স্থান ও সময়ের অধীনে থাকেন না।
• প্রাণলিংগ্ পর্বতলিংগ্ নামেও পরিচিত। ইহা ঈশ্বরের সত্ত্বরূপের বাহক। যার উপস্থিতি কেবল কঠোর তপস্যা এবং স্থির মনের দ্বারাই উপলব্ধি করা যায়।
পুরাণের মাধ্যমে যে লিংগ্ এর সাথে মিলনের কথা বলা হয়ে থাকে তা আত্মা ছয়টি রাস্তার মধ্য দিয়ে এবং ইষ্টলিংগ্, ভাবলিংগ্ এবং প্রাণলিংগ্ এর আধারেই সম্পন্ন হয়। এই ছয় রাস্তাকে একত্রে স্বঃতশ্যালা অথবা শূণ্যসম্প্রদায় নামে পরিচিত।
আমরা জানি পবিত্র ঋকবেদ মতে ৩৩ কোটি (রকমের) দেবতা আছেন। এর মাঝে ১১ জন হলেন রুদ্র। যাঁদের একসাথে একাদশ রুদ্র বলে সম্বোধন করা হয়। এদের প্রত্যেকের নিজ নিজ আঁকার বা রূপ রয়েছে। জায়গা স্বল্পতার কারনে তাঁদের ছবিগুলো প্রকাশ করতে পারছি না বলে দুঃখিত। তবে আমার নোট সেকশনে আমি অচিরেই এদের সম্পর্কে বিস্তারিত লিখা ছবি সহ প্রকাশ করবো।
একাদশ রুদ্রের প্রণাম
• শম্ভু
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশান দেবদানবরাক্ষস্বাঃ
যস্মাৎ প্রজৎনিরে দেবাস্তম শম্ভুম প্রণমাহম্।।
• পীনাকি
ক্ষমারথসমারুরুম ব্রহ্মসুত্র সমনবিতম।
চতুর্বেদৈশ্চসচিতম পিনাকী নমোহম ভজে।।
• গিরীশ
কৈলাসশিখরপ্রতৈন্মনিমমন্ডপম
গিরীশ গিরিজা প্রাণবল্লভোস্তুসুদামুদে।।
• স্থানু
বামাঙ্গকৃতসম্ভেশগিরি কন্যাসুখাবহম্।
স্থানুমনমামি শিরষা সর্বদেব নমস্কৃতম।।
• ভার্গভ
চন্দ্রাবতংসু জটিলস্ত্রীনেত্র ভস্মপাণ্ডরহ।
হৃদয়স্থ সদাভুয়াৎভর্গ ভয়বিনাশিনাহা।।
• সদশিব
ব্রহ্মাভুত্বাসৃজনলোকাম্ বিষ্ণুরভুত্বাথপয়ালয়ন।
রুদ্রভুত্বাহরননন্তে গতির্মেস্তুসদাশিবহম।।
• শিব
গায়াত্রীপ্রতিপাদ্যায়ম্প্য
কল্যাণগুণধাম্নেস্তু শিবায়বিহিতানতিহি।।
• হর
আশিবিষাহারকৃতে দেবৌঘপ্রনতান্ধয়ে।
পিনাকঙ্কিতহস্তায় হরায়স্তুনমস্কৃতিহি।।
• শর্ভ
ত্রিস্নুনাঞ্চপুরামহন্তা কৃতানন্তমতভঞ্জনঃ।
খড়গপাণিস্তিক্ষ্ণদ্রৌষ্টাহ্
• কপালী
তক্ষাঘৌসাকারা কোপযুক্তামবুখাম্ভুজাহাঃ।
শূলপাণিসুখায়াস্তু কপালীমেযহর্নিশম।।
• ভব
যোগীন্দনতপাদাব্জম্ দ্বন্দ্বদিতমজনাস্রয়ম।
বেদান্তক্তসঞ্চারম ভবনুতমশরণম ভজে।।
তব তত্ত্বম ন জানামি কিত্রীশোষী মহেশ্বরঃ
ইয়াদ্রিষোশী মহাদেব তাদ্রিশায়া নমঃ নমঃ।।
মহামৃত্যুঞ্জয় কথা
পবিত্র বেদের(ঋক)মতে পরমেশ্বর মহাদেবের ৮ টি মুর্তি আছে। পুরান মতে এই আদি শক্তি গুলো পৃথিবীর ৮ প্রকারের উপাদানের মিশ্রন।
১.সর্ব- পৃথিবী বা মাটি। ইনার পূজা ভূমি লিঙ্গতে করতে হয়। মন্দিরঃ তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরম।
২. ভবঃ – জলের সাথে উনার সম্পর্ক রয়েছে। জল লিঙ্গতে উনার উপাসনা করতে হয়।মন্দিরঃ জম্বুকেশ্বর তিরুভানিকাবাল, তামিলনাড়ু।
৩. রুদ্র- আগুন হল রুদ্রের উপস্থাপক। উনার উপাসনা তেজ লিঙ্গের মাধ্যমে করতে হয়। মন্দিরঃ তামিলনাড়ুর তিরুভান্নামালাই।
৪. উগ্র- বায়ুর সাথে উনার তুলনা করা হয়। বায়ু লঙ্গতে উনার পূজা হয়। মন্দিরঃ অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রী কালহাষ্টিশ্বর।
৫. ভীমা – অন্তরীক্ষের সাথে উনি যুক্ত আছেন সর্বদা। অক্ষ লিঙ্গে উনার পূজা হয়। মন্দিরঃ তামিলনাড়ুর চিদাম্বরমে ভীমার মন্দির রয়েছে।
৬.পশুপতি- মানব সহ সকল পশু-পাখী তথা জীবন শক্তি সম্পন্ন জীবের সাথে উনার তুলনা হয়। উনার পূজা ইয়াজম্না বা ইয়াজমানা লিঙ্গতে হয়। মন্দিরঃ নেপালের কাঠমন্ডুতে উনার মন্দির রয়েছে।
৭. মহাদেব- উনার সাথে শ্রী চন্দ্রের সাথে তুলনা হয়। চন্দ্র লিঙ্গে উনার পূজা হয়। মন্দিরঃ পশ্চিম বঙ্গের চন্দ্রনাথে যা ছটগাভ থেকে ৩৪ মাইল দূরে অবস্থিত।
৮. ঈশান –সুর্যের অধিপতি বা সুর্য শক্তির আঁধার হিসাবে উনাকে কল্পনা করা হয়। উনার উপাসনা সুর্য লিঙ্গে করা হয় যার মন্দির উড়িষ্যাতে কর্নাটকের সুর্য মন্দিরে বিদ্যমান।
এরা সবাই একসাথে ভগবান মৃত্যুঞ্জয় নামে জানা যায়। ভগবান মৃত্যুঞ্জয়ের সাকার রুপের ৮টি হাত। উপরের ৪ হাতে অমৃত কলস দ্বারা অমৃতধারা বর্ষন করছেন। মধ্যের বামহস্তে মৃগমুদ্রা এবং ডানহস্তে রুদ্রাক্ষ। সর্বনিম্নে অপরিপুর্ন কলস ধরে আছেন। মাথায় সোম চন্দ্রমা, সর্ব অঙ্গে সর্পহার, পদ্মাসনে প্রস্ফুটিত কমলের উপর স্থিত, ধ্যানস্ত অবসস্থায় পঞ্চভুতের অধীশ্বর সর্বদা প্রকৃতি ও সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষায় সদা ব্যাস্ত।
আমার এই ৫ পর্বের লেখায় কেউ যদি কোন সংযজন বা বিয়োজন করতে চান তাহলে কোন সংকোচ না করে আমাকে জানালে খুশী হবো। এই লেখার মাধ্যমে যদি আপনার পরমেশ্বর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞ্যান লাভ হয় তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।সবাই ভালো থাকুন। জগতের সকল প্রানী শান্তি লাভ করুন, সকলের কল্যান হোক।
ওম শান্তি শান্তি শান্তি
হর হর মহাদেব!
পবিত্র বেদের(ঋক)মতে পরমেশ্বর মহাদেবের ৮ টি মুর্তি আছে। পুরান মতে এই আদি শক্তি গুলো পৃথিবীর ৮ প্রকারের উপাদানের মিশ্রন।
১.সর্ব- পৃথিবী বা মাটি। ইনার পূজা ভূমি লিঙ্গতে করতে হয়। মন্দিরঃ তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরম।
২. ভবঃ – জলের সাথে উনার সম্পর্ক রয়েছে। জল লিঙ্গতে উনার উপাসনা করতে হয়।মন্দিরঃ জম্বুকেশ্বর তিরুভানিকাবাল, তামিলনাড়ু।
৩. রুদ্র- আগুন হল রুদ্রের উপস্থাপক। উনার উপাসনা তেজ লিঙ্গের মাধ্যমে করতে হয়। মন্দিরঃ তামিলনাড়ুর তিরুভান্নামালাই।
৪. উগ্র- বায়ুর সাথে উনার তুলনা করা হয়। বায়ু লঙ্গতে উনার পূজা হয়। মন্দিরঃ অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রী কালহাষ্টিশ্বর।
৫. ভীমা – অন্তরীক্ষের সাথে উনি যুক্ত আছেন সর্বদা। অক্ষ লিঙ্গে উনার পূজা হয়। মন্দিরঃ তামিলনাড়ুর চিদাম্বরমে ভীমার মন্দির রয়েছে।
৬.পশুপতি- মানব সহ সকল পশু-পাখী তথা জীবন শক্তি সম্পন্ন জীবের সাথে উনার তুলনা হয়। উনার পূজা ইয়াজম্না বা ইয়াজমানা লিঙ্গতে হয়। মন্দিরঃ নেপালের কাঠমন্ডুতে উনার মন্দির রয়েছে।
৭. মহাদেব- উনার সাথে শ্রী চন্দ্রের সাথে তুলনা হয়। চন্দ্র লিঙ্গে উনার পূজা হয়। মন্দিরঃ পশ্চিম বঙ্গের চন্দ্রনাথে যা ছটগাভ থেকে ৩৪ মাইল দূরে অবস্থিত।
৮. ঈশান –সুর্যের অধিপতি বা সুর্য শক্তির আঁধার হিসাবে উনাকে কল্পনা করা হয়। উনার উপাসনা সুর্য লিঙ্গে করা হয় যার মন্দির উড়িষ্যাতে কর্নাটকের সুর্য মন্দিরে বিদ্যমান।
এরা সবাই একসাথে ভগবান মৃত্যুঞ্জয় নামে জানা যায়। ভগবান মৃত্যুঞ্জয়ের সাকার রুপের ৮টি হাত। উপরের ৪ হাতে অমৃত কলস দ্বারা অমৃতধারা বর্ষন করছেন। মধ্যের বামহস্তে মৃগমুদ্রা এবং ডানহস্তে রুদ্রাক্ষ। সর্বনিম্নে অপরিপুর্ন কলস ধরে আছেন। মাথায় সোম চন্দ্রমা, সর্ব অঙ্গে সর্পহার, পদ্মাসনে প্রস্ফুটিত কমলের উপর স্থিত, ধ্যানস্ত অবসস্থায় পঞ্চভুতের অধীশ্বর সর্বদা প্রকৃতি ও সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষায় সদা ব্যাস্ত।
আমার এই ৫ পর্বের লেখায় কেউ যদি কোন সংযজন বা বিয়োজন করতে চান তাহলে কোন সংকোচ না করে আমাকে জানালে খুশী হবো। এই লেখার মাধ্যমে যদি আপনার পরমেশ্বর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞ্যান লাভ হয় তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।সবাই ভালো থাকুন। জগতের সকল প্রানী শান্তি লাভ করুন, সকলের কল্যান হোক।
ওম শান্তি শান্তি শান্তি
হর হর মহাদেব!