Sunday, June 8, 2025

শিবতত্ত্বে সৃষ্টি, সংহার ও রক্ষা – শ্রীকণ্ঠ ও পুরাণসমূহের আলোক

শৈব দর্শনে শিব কেবল একজন উপাস্য দেবতা নন—তিনি নিজেই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পরম ব্রহ্ম। তিনিই এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূল কেন্দ্র। শ্রীকণ্ঠাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে একথাই প্রমাণ করেন এবং পুরাণসমূহও এই তত্ত্বকে পূর্ণ সমর্থন দেয়। এই প্রবন্ধে আমরা শৈব দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্ব, সংহারতত্ত্ব ও রক্ষাতত্ত্বের এক গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরব।

✦ শিব: কারণ ও কার্য উভয়ের আধার

◼ শ্রীকণ্ঠাচার্যের অভিমত

ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে (১.১.২) শ্রীকণ্ঠাচার্য বলেন:

"জগতকারণং শম্ভুরেভ"
(এই জগতের একমাত্র কারণ শম্ভু বা শিব।)

এই একটি বাক্যই শৈব দর্শনের মূলমন্ত্র—শিব কেবল কার্যকারণ নন, তিনিই উপাদান কারণ, নিমিত্ত কারণ এবং উপনির্মাতা। তিনি ছাড়া আর কেউ সৃষ্টির মালিক হতে পারে না।

◼ ব্যাখ্যা

শ্রীকণ্ঠ বলেন, শিব আত্মতত্ত্ব, বস্তুতত্ত্ব ও চেতনাতত্ত্ব—এই তিন ক্ষেত্রেই সর্বত্র বিস্তৃত। ত্রিমূর্তিতত্ত্বকে তিনি অব্যক্ত, ব্যক্ত এবং প্রব্যক্ত এই তিন অভিব্যক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চান।

✦ পুরাণসমূহে শিবের ত্র্যর্থরূপ

◼ লিঙ্গ পুরাণ (১.৬৯.৬৪)

“শিবাত্ প্রজাস্রষ্টা ব্রহ্মা, শিবাত্ পালনহরি:।
শিবাত্ সংহারকারী রুদ্রঃ, শিব: সর্বং প্রপঞ্চতে॥”

বাংলা অনুবাদ:
“শিব হতেই সৃষ্টি করেন ব্রহ্মা, শিব হতেই পালন করেন হরি, শিব হতেই সংহার করেন রুদ্র। শিবই সর্বভৌতিক জগতের মূল।”

এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, তিন দেবতা আসলে তিনটি কার্যরূপ মাত্র, মূলতত্ত্ব হলেন এক ও অদ্বিতীয় শিব।

◼ শিবপুরাণ: সর্বেশ্বরতত্ত্ব

শিবপুরাণে বলা হয়েছে:

"ন ত্বদ্ব্যতিতমস্ত্যন্যৎ, জগতঃ কারণং পরম্।"
(তোমার বাইরে এই জগতের আর কোনো কারণ নেই।)

এখানে শিবকে তত্ত্বগত “সর্বেশ্বর” হিসেবে দেখানো হয়েছে—তিনিই অনাদি ও অনন্ত, চৈতন্য ও স্থিতির উৎস।

AI created 


✦ ঈশ্বর গীতায় শিবতত্ত্বের আত্মপ্রকাশ

ঈশ্বর গীতা, যা কূর্ম পুরাণের অন্তর্গত, তাতে শিব নিজেই নিজের সর্বজ্ঞ ও সর্বব্যাপক রূপ তুলে ধরেন:

“অহং বিশ্বস্য কারণং, সৃষ্টিস্থিতিলয়ক্রিয়াঃ।
মম দ্বারা প্রসরন্তি, না অন্যঃ কারণমুচ্যতে॥”

অনুবাদ:
"আমি বিশ্বজগতের কারণ। সৃষ্টি, রক্ষা ও সংহার—এই কর্মসমূহ আমার দ্বারাই ঘটে; অন্য কোন কারণ নেই।"

এই শ্লোকটির ভাষ্য অনুসারে, শিবের ইচ্ছা বা ‘সঙ্কল্প’ থেকেই সৃষ্টি হয়, এবং তাঁর ‘নিশ্চয়’ থেকেই সংহার সংঘটিত হয়।

✦ শিবসূত্র: অভ্যন্তরীণ সৃষ্টি ও লয়ের ব্যাখ্যা

শিবসূত্রে (১.১):

“চিত্তং মন্ত্রঃ”
(“চৈতন্যই মন্ত্র।”)

শিবসূত্র (৩.১):

“জ্ঞানং বন্ধঃ।”
(“জ্ঞানই বন্ধন, যদি তা মুক্তিচেতনায় অভিজ্ঞ না হয়।”)

এখানে ‘সৃষ্টি’ বলা হয়েছে চেতনার অঙ্কুরোদ্গম, ‘সংহার’ বলা হয়েছে চেতনার নির্লিপ্ত অবস্থা, এবং ‘স্থিতি’ হচ্ছে ধারাবাহিক সত্তার অভিজ্ঞান।

✦ উপনিষদীয় আলোকে: গণপতি অথর্বশীর 

গণপতি অথর্বশীর উপনিষদে বলা হয়েছে:

“ত্বং ভূমিরাপোऽনলোনিলোনাভঃ।
ত্বং চত্বারী বাক্ পদানি॥”

অনুবাদ:
“তুমি ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—তুমি বাণীর চার রূপ।”

এখানে শিবরূপ গনেশকে বলা হয়েছে উপাদান ও উপনির্মাতা—এবং ভাষা বা শব্দতত্ত্বের উৎস।

✦ শৈব ত্র্যর্থতত্ত্ব বনাম ত্রিমূর্তি দর্শন

প্রচলিত ত্রিমূর্তি:

  • ব্রহ্মা – সৃষ্টি

  • বিষ্ণু – রক্ষা

  • রুদ্র – সংহার

শৈব বিকল্প:

এই তিন রূপই আসলে একক পরমতত্ত্ব শিব–এর তিনটি গুণপ্রকাশ (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ)। তাই তিনজন আলাদা ঈশ্বর নন, বরং এক শিব তিনভাবে প্রকাশমান।

লিঙ্গপুরাণে বলা হয়:
“ত্রিধা ভবতি শম্ভু:—ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও ঈশ্বর।”

✦ সৃষ্টি, রক্ষা ও সংহার: দার্শনিক ব্যাখ্যা

সৃষ্টি:

শিবের “ইচ্ছা শক্তি” (ইচ্ছে), “জ্ঞান শক্তি” (জ্ঞাতা) ও “ক্রিয়া শক্তি” (কর্তা)—এই ত্রিশক্তি থেকেই জগতের উৎপত্তি।

রক্ষা:

রক্ষাকর্ম হচ্ছে সেই সৃষ্টির নিয়ম রক্ষা করা। এই ধারাবাহিকতার জন্য শিব স্বয়ং নিজেকে ‘ধর্ম’ বলে ঘোষণা দেন ঈশ্বর গীতায়।

সংহার:

সংহার মানে ধ্বংস নয়, বরং মূলত্বে প্রত্যাবর্তন। সব সৃষ্টি যখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠে তখন তা তার উৎসে মিলিয়ে যায়—এই ধারণাই হল সংহারতত্ত্ব।

✦ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ: আত্মসৃষ্টি ও আত্মসংহার

মানব চেতনায় এই তিনটি কর্ম প্রতিফলিত হয়:

  • সৃষ্টি – জ্ঞান ও ধারণার উদ্ভব

  • রক্ষা – চর্চা ও অভ্যাস

  • সংহার – অহংকার ও ভ্রান্ত ধারণার বিলয়

এই প্রসঙ্গে শিবরূপ হলেন আত্মজ্ঞান, সত্ত্ব ও নির্গুণতত্ত্বের পূর্ণ প্রতীক

✦ উপসংহার

শিব কেবল সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবতা নন—তিনিই সৃষ্টি, তিনিই ধ্বংস, তিনিই ধ্রুবতা।
তিনি কোনো নির্দিষ্ট কালের বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঈশ্বর নন—তিনি হলেন সর্বজনীন চেতনা
শিবতত্ত্বের এই সৃষ্টি-স্থিতি-লয় চক্র শুধু পৌরাণিক আখ্যান নয়, বরং সমগ্র জীবনচক্র, জ্ঞানচক্র ও চৈতন্যচক্রের চিত্র

রেফারেন্স তালিকা:

  1. ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য – শ্রীকণ্ঠাচার্য (১.১.২, ২.১.১৪)

  2. লিঙ্গপুরাণ – অধ্যায় ১, ৬৯, ৭৫

  3. শিবপুরাণ – বিদ্যেশ্বর সংহিতা

  4. গণপতি অথর্বশীর্ষ উপনিষদ – শ্লোক ৫, ৮

  5. শিবসূত্র – সূত্র ১.১, ৩.১, ৩.৫

  6. ঈশ্বরগীতা – অধ্যায় ১, শ্লোক ১০-১৫

  7. স্কন্ধপুরাণ – কৈলাসখণ্ড, শিবগীতা অংশ

  8. দর্শন ও চৈতন্যতত্ত্ব – স্বামী চিন্ময়ানন্দের পাঠ্যভাষ্য

  9. Modern Physics & Advaita Comparison – Dr. Kapil Kapoor

Saturday, June 7, 2025

শৈবত্বের লক্ষণ ও শিবভক্ত চিনিবার উপায় — আগম ও পুরাণের আলোকে অষ্টবর্ণ ভিত্তিক বিশ্লেষণ

পরমেশ্বর ভগবান, আদিদেব, সকল দেবতা ও জাতির একমাত্র আরাধ্য—সাম্ব সদাশিব। যাঁর চরণাশ্রিত হয়েছেন, তিনি মাহেশ্বর; এবং যিনি মাহেশ্বর, তাঁকে চেনার একমাত্র পন্থা হলো "অষ্টবর্ণ"। এই আটটি মূল লক্ষণ একজন প্রকৃত শৈব ভক্তকে চিহ্নিত করে।

১. অষ্টবর্ণের শ্লোক ও ব্যাখ্যা

মূল শ্লোক:

অষ্টবর্ণং প্রপঞ্চয়েদ্যঃ শৈবঃ স্যাদধিগম্যতাম্।

গুরুলিঙ্গং চ জঙ্গমং ভস্ম মন্ত্রং রুদ্রাক্ষমেব চ।

পাদোদকং নির্মাল্যং চ—এতান্যষ্টবর্ণমুচ্যতে॥

অষ্টবর্ণং বিহীনস্য শৈবস্য নাস্তি কদাচন।

যঃ প্রপঞ্চয়েদষ্টবর্ণং স এব শৈব ইতি স্মৃতঃ॥

সূত্র: শৈব আগম, স্বচ্ছন্দ তন্ত্র, পূর্বখণ্ড ১.১


বাংলা অনুবাদ:

যিনি গুরুরূপ, লিঙ্গ, জঙ্গম, ভস্ম, মন্ত্র, রুদ্রাক্ষ, পাদোদক ও নির্মাল্য—এই আটটি গুণ দৈনন্দিন জীবনে মূর্ত করে তোলেন, তিনিই প্রকৃত শৈব; অন্যথায় শৈবতা অসম্পূর্ণ।


২. গুরু (Guru) — শিবের জীবন্ত প্রতিমূর্তি

শ্লোক ১:

শ্রীগুরুচরণপদ্মে সেবা কুরুতে সदा।

শিবায় তস্য নাস্তি ক্ষতির্নাম কদাচন॥

শ্লোক ২:

শ্রীগুরুরূপে শিবং বিজ্ঞায় সেবতে যত্নতঃ।

শৈবত্বং প্রপঞ্চয়েদ্যঃ সর্বকালেশ্বর ইতি স্মৃতঃ॥

শ্লোক ৩:

শ্রীগুরুচরণাম্ভোজে সেবা কুরুতে সदा যঃ।

তস্য শিবসমো ভাবঃ সর্বদা নির্মলঃ স্মৃতঃ॥

সূত্র: স্বচ্ছন্দ তন্ত্র, পূর্বখণ্ড ৮.১৬.১–৩


ব্যাখ্যা:

যিনি শ্রীগুরুর পদপদ্মে নিরন্তর সেবা করেন, তিনি কখনোই শিবের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন না। যে গুরুরূপে শিবকে উপলব্ধি করে সেবা করেন, তিনিই প্রকৃত শৈব, তাঁর হৃদয় নির্মল ও শিবসমান হয়ে ওঠে।


৩. লিঙ্গ (Liṅga) — শিবভক্তির বহিরপ্রকাশ

শ্লোক ১:

মূর্ধ্নি হৃদয়ে বাহৌ বা যঃ লিঙ্গং ধারয়ন্তি।

তেষাং কালঃ করোতি স্পর্ধামপি ভয়ঙ্করাম॥

সূত্র: গুরু গীতা, শ্লোক ১৬৪


শ্লোক ২:

যেষাং দেহে ন লিঙ্গস্পর্শঃ, তে শ্মশানসংস্থিতাঃ॥

ব্যাখ্যা:

যে ব্যক্তি শরীরে, হৃদয়ে বা মস্তকে শিবলিঙ্গ ধারণ করে, মৃত্যুও তার সামনে ভীত হয়। যাদের দেহে শিবলিঙ্গ নেই, তারা শ্মশানের মতো অপবিত্র বলে বিবেচিত।


৪. জঙ্গম (Jaṅgama) — শিবের সচল রূপ

শ্লোক:

যে জঙ্গমভাবনাভ্রষ্টাঃ কামনায় আসক্তাঃ।

ন তেষাং হৃদয়ে কদাচিদপি ত্রিপুরারী অবস্থিতঃ॥

সূত্র: রুদ্র যামল তন্ত্র, অধ্যায় ৮, শ্লোক ২২


ব্যাখ্যা:

যারা সাধুসঙ্গ বা জঙ্গম ভাবনা থেকে বিচ্যুত, তাদের হৃদয়ে কখনোই শিব বাস করেন না।





৫. ভস্ম (Bhasma) — শিবের চিহ্নস্বরূপ বিভূতি

শ্লোক ১:

যস্য দেহে ভস্মলেপনং নাস্তি, স যমদ্বারং প্রতি গচ্ছতি॥

শ্লোক ২:

ভস্মলেপনমিদং দেহমাশ্রিত্য, পশ্যতি কালঃ—ভয়াত্ত্রস্যতি॥

সূত্র: শিব মহাপুরাণ, রুদ্র সংহিতা, অধ্যায় ১৮

ব্যাখ্যা:

যে ব্যক্তি দেহে ভস্ম (ত্রিপুণ্ড্র) লেপন করেন না, মৃত্যু তার জন্য অবধারিত। আর যে এই ভস্ম ধারণ করে, তাকে মৃত্যু পর্যন্ত ভয় করে।


৬. মন্ত্র (Mantra) — পঞ্চাক্ষরী 'নমঃ শিবায়'

শ্লোক:

যস্য মুখে নাস্তি “নমঃ শিবায়” ইতি পঞ্চাক্ষরং।

তস্য মুখং শাপিতং শুষ্কমরুভূমিসমং স্মৃতং॥

সূত্র: গুরু গীতা, শ্লোক ৯৮


ব্যাখ্যা:

যে ব্যক্তির মুখে ‘নমঃ শিবায়’ ধ্বনিত হয় না, সেই মুখ অভিশপ্ত ও শুষ্ক মরুভূমির মতো নির্জীব।


৭. রুদ্রাক্ষ (Rudrākṣa) — ভক্তির অনিবার্য প্রতীক

শ্লোক ১:

যস্য সর্বাঙ্গে রুদ্রাক্ষঃ সন্নিবদ্ধঃ সदा।

ন তং হন্তি কো’পি, সম্পূর্ণং ত্রিলোক্যেষু চ॥

শ্লোক ২:

যঃ রুদ্রাক্ষবিদ্বেষী, স ত্রিলোকেষু ন রক্ষিতঃ॥

সূত্র: পদ্ম পুরাণ, উত্তর খণ্ড, শ্লোক ৫৪.৮৮


ব্যাখ্যা:

যিনি সর্বাঙ্গে রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন, তাঁকে ত্রিলোকে কেউই ক্ষতি করতে পারে না। আর যারা রুদ্রাক্ষ অবজ্ঞা করে, তারা রক্ষাহীন হয়ে পড়ে।


৮. পাদোদক ও নির্মাল্য (Pādodaka & Nirmālya)

শ্লোক (পাদোদক):

যে আচার্যচরণাম্বুজাৎ নির্গতামৃতং পিবন্তি।

ন তং অজ্ঞানরূপং তমঃ স্পৃশতি কদাচন॥

সূত্র: গুরু গীতা, শ্লোক ২৮৫


শ্লোক (নির্মাল্য):

যে নির্মাল্যাত্পরিত্যক্তাঃ, শুষ্কাঃ তে মরুভূমিসমা ইতি।

যে দূরস্থাত্ অপি নির্মাল্যং প্রণমন্তি, তু তে শিবত্বং লভন্তে॥

 সূত্র: কুলার্ণব তন্ত্র, অধ্যায় ১২


ব্যাখ্যা:

যিনি গুরুর চরণামৃত পান করেন, তাঁকে অজ্ঞান ছুঁতে পারে না। আর যে ব্যক্তি দূর থেকেও নির্মাল্যকে প্রণাম করে, সেও শিবত্ব লাভ করেন।



এই অষ্টবর্ণ—গুরুসেবা, লিঙ্গধারণ, জঙ্গমসঙ্গ, ভস্মলেপন, পঞ্চাক্ষরী মন্ত্রজপ, রুদ্রাক্ষধারণ, পাদোদক পান ও নির্মাল্য প্রণাম—শিবভক্তির মূল চিহ্ন। এগুলো যার জীবনে দৃঢ়ভাবে বিরাজমান, তিনিই প্রকৃত শৈব এবং তিনি অদ্বিতীয় শৈবত্বে প্রতিষ্ঠিত হন।


Friday, June 6, 2025

শিবই পরম ব্রহ্ম – শ্রীকণ্ঠাচার্যের দর্শনের আলোকে

 

ভূমিকা

হিন্দু দর্শনে “পরম ব্রহ্ম” ধারণাটি হলো সেই চূড়ান্ত বাস্তবতা, যেখান থেকে সব সৃষ্টি উৎপন্ন, যার মধ্যে সবকিছু অবস্থান করছে এবং যার মধ্যেই সবকিছু বিলীন হয়। বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ ব্রহ্মসূত্র এই ব্রহ্মতত্ত্বকে বিশ্লেষণ করে। শঙ্করাচার্য নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মরূপে তাঁর ব্যাখ্যা দেন। রামানুজাচার্য বিষ্ণুকে সগুণ পরম ব্রহ্মরূপে স্থাপন করেন।

কিন্তু অনেকেই জানেন না, দক্ষিণ ভারতের মহান শৈব দার্শনিক শ্রীকণ্ঠাচার্য এই ব্রহ্মসূত্রকেই ব্যাখ্যা করে শিবকে সর্বোচ্চ ব্রহ্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা দেখব – কিভাবে শ্রীকণ্ঠের দর্শনে শিব পরম ব্রহ্ম, এবং এই মত কিভাবে শাস্ত্রসম্মত।

শ্রীকণ্ঠাচার্যের শৈব-বিষিষ্টাদ্বৈত দর্শন

শ্রীকণ্ঠাচার্য "শৈব- বিষিষ্টাদ্বৈত" নামক একটি দার্শনিক অবস্থান প্রস্তাব করেন, যেখানে তিনি নিম্নোক্ত ধারণাগুলো স্পষ্ট করেন:

  • শিবই পরম ব্রহ্ম: ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে তিনি বলেন –

    “शिव एव परं ब्रह्म।”
    অর্থাৎ, শিবই পরম ব্রহ্ম।

  • জীব ও জগত শিবের গুণস্বরূপ: জীবাত্মা ও জড় প্রকৃতি, উভয়ই শিবের অধীন – তবে শিবের মত স্বয়ম্ভূ নয়।

  • সগুণ-নিগুণ সমন্বয়: শিবের এক দিকে নির্গুণ – কারণ তিনি অতীত, অনন্ত, রূপ-রহিত। কিন্তু তাঁর ইচ্ছাশক্তি, করুণাশক্তি, অনুগ্রহ ইত্যাদির কারণে তিনি সগুণ রূপেও প্রকাশিত।

এখানে, শিব কেবল “সৃষ্টিকর্তা” নন, বরং তিনিই সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান, পরম সত্তা

ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে শিব

ব্রহ্মসূত্রের প্রথম সূত্র –

“अथातो ब्रह्मजिज्ञासा।”
অর্থাৎ, “এবার ব্রহ্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা শুরু হোক।”

এখানে শ্রীকণ্ঠ বলেন –

"ब्रह्म शब्देन शिवपरमेश्वर उच्यते"
অর্থাৎ, “ব্রহ্ম শব্দে শিব পরমেশ্বরই বোঝানো হয়েছে।”

তিনি ব্রহ্মসূত্র ১.১.২-এ (জন্মাদ্যস্য যাতঃ) মন্তব্য করেন:

"यस्मात् शिवात् सर्वस्य उत्पत्तिरादिः"
"শিব হইতে সমস্ত জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়।"

এখানে ব্রহ্মতত্ত্বের তিনটি গুণ – সৃষ্টি, রক্ষণ, লয় – শিবের মধ্যে উপস্থিত, যা তাঁকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর ও ব্রহ্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে।




শাস্ত্রসমূহে শিবতত্ত্ব

১. ঈশ্বরগীতা (কূর্মপুরাণ)

"अहं ब्रह्म परमं, नान्यत् किञ्चित् अस्ति ततः।"
“আমি পরম ব্রহ্ম — এর বাইরে কিছুই নেই”

শিব নিজেই এই ঘোষণা দেন ঈশ্বরগীতায়। এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে শিবকে “পরম ব্রহ্ম” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

২. গণপতি অথর্বশীর্ষ উপনিষদ

"त्वं ब्रह्मा त्वं विष्णुस्त्वं रुद्रस्त्वं इन्द्रः..."
তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি রুদ্র, তুমি ইন্দ্র...

এখানে গণপতির রূপে মূলত রুদ্রতত্ত্বকেই ব্রহ্মরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে — যিনি সব দেবতার মধ্যমূলে বিরাজমান।

৩. লিঙ্গ পুরাণ

"शिवो निरगुणः शान्तः साक्षात् परब्रह्म परः।"
শিবই নিগুণ, শান্ত ও পরব্রহ্ম।

এটি পরিস্কারভাবে শিবকে সেই চূড়ান্ত, নির্গুণ পরম ব্রহ্ম বলে স্বীকৃতি দেয়।

৪. শিব পুরাণ

"शिवात् परं नास्ति किंचित्"
“শিবের ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই”

এটি শিবের সর্বোচ্চতা তুলে ধরে এবং তাঁকে চূড়ান্ত পরম সত্তা হিসেবে স্থাপন করে।

৫. স্কন্ধ পুরাণ – লিঙ্গোৎপত্তি খণ্ড

শিবলিঙ্গের উত্থানের কাহিনী যেখানে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু অনন্ত আলোর রূপ খুঁজে পান না, সেখানে বলা হয়:

"नास्ति तत् परं किंचिद् – यत् तद् लिङ्गं महेश्वरम्।"
এই লিঙ্গরূপই পরম — এর ঊর্ধ্বে কিছুই নেই।

এটি প্রমাণ করে, শিবলিঙ্গই সেই চূড়ান্ত রূপ – যা পরব্রহ্ম স্বরূপ।

দর্শনমূলক বিশ্লেষণ

শিব বনাম নির্গুণ ব্রহ্ম

শঙ্করাচার্যের ব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার, অনুভবের বাইরে — কিন্তু শ্রীকণ্ঠ বলেন, ব্রহ্ম যদি সম্পূর্ণ নির্গুণ হয়, তবে তিনি কিভাবে সৃষ্টি, সংহার বা করুণা করেন? তাই তিনি বলেন:

"ब्रह्म सत्-चित्-आनन्द स्वरूपं — तथा इच्छाशक्तियुतम् शिवम्।"

অর্থাৎ, পরম ব্রহ্ম শিব, যিনি সচ্চিদানন্দস্বরূপ ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন।

পরমেশ্বরের ব্যক্তিগততা

শ্রীকণ্ঠের দর্শনে শিব কেবল নিরপেক্ষ তত্ত্ব নয়, তিনি করুণাময়, উপাস্য, এবং মুক্তিদাতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি যোগ ও ভক্তিমূলক সাধনার সঙ্গে সমন্বিত

 শিব তত্ত্ব – আমাদের জীবনে

শিবকে কেবল “তাণ্ডবনৃত্যকারী দেবতা” হিসেবে দেখা নয়, বরং তাঁকে আমাদের নিজের অস্তিত্বের মূলে থাকা চেতনা হিসেবে উপলব্ধি করতে হবে। শিব মানে জ্ঞান, শিব মানে ত্যাগ, শিব মানে দয়া, আবার শিব মানে চিরন্তন শক্তি।

উপনিষদের সহিত সাযুজ্য

"एको रुद्रो न द्वितीयाय तस्थुः।" (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩.২)
“রুদ্র একাই আছেন — তাঁর দ্বিতীয় কেউ নেই।”

এই দৃষ্টিভঙ্গি শৈব অদ্বৈতবাদের মূলে। যেখানে শিবই জগত, জীব, কর্ম ও মুক্তির কেন্দ্রবিন্দু।

উপসংহার

শ্রীকণ্ঠাচার্যের দর্শন আমাদের একটি বিকল্প ও শক্তিশালী পথ দেখায় – যেখানে শিব পরম ব্রহ্ম, নিগুণ-সগুণের এককতায় অভিন্ন, এবং শাস্ত্রসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত।

এই দার্শনিক রূপরেখা শুধুমাত্র তাত্ত্বিক নয়, এটি উপাসক হৃদয়ে গভীর উপলব্ধির জন্ম দেয়। শিব শুধু দেবতা নন – তিনি চেতনার চূড়ান্ত স্তর, তিনি সেই পরম এক, যাঁর দ্বারা ও যাঁর মধ্যে সবকিছু।

শ্লোক স্মরণে রাখুন

"सच्चिदानन्द रूपाय, शिवाय ब्रह्मणे नमः।"
“সচ্চিদানন্দরূপ শিব, যিনি ব্রহ্ম — তাঁকেই প্রণাম।”


Sunday, December 8, 2024

সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা করে। আর সঠিক শাস্ত্রজ্ঞানের অভাবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিশোর ও যুবক বয়সীরা এই কথায় বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয় এবং ধর্মান্তরিত হয়। হ্যাঁ, বেদে প্রত্যক্ষভাবে সাকার রূপের উল্লেখ নেই ঠিকই। সাকার প্রতীকোপসনা মূলত পুরাণ ও তন্ত্র শাস্ত্র কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র সমূহেও অসংখ্য জায়গায় ঈশ্বরের সাকার উপাসনা এবং সাকার রূপের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে এবং সাকার উপাসনার বিরোধিতা, নিষেধাজ্ঞাও কোথাও দেওয়া নেই। বেদ ও প্রামাণ্য বৈদিক শাস্ত্র থেকে রেফারেন্স সহ সাকার উপাসনা এবং প্রতিমা পূজার উল্লেখ দিয়ে বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার নিরোধই এই পোস্টের উদ্দেশ্য।


১.ছান্দোগ্য উপনিষদ ( ৭/১/৪০)
নামৈবৈতৎ, নামোপাসস্ব, ব্রহ্মেতি ব্রহ্মবুদ্ধ্যা, যথা প্রতিমায়াং বিষ্ণুবুদ্ধ্যা উপাস্তে তদ্বৎ।।

শাঙ্কর ভাষ্যঃ নামরূপে প্রসিদ্ধ ঋগ্বেদ, যজুর্ব্বেদ প্রভৃতি, এ সমস্ত নামই, প্রতিমাকে যেরূপ বিষ্ণুজ্ঞানে উপাসনা করে, তদ্রূপ উক্ত নামকেও ব্রহ্মরূপে অর্থাৎ ব্রহ্মবুদ্ধিতে উপাসনা কর।

২. বৃহদারণ্যক উপনিষদ ( ১/১/১)
কাল-লোক-দেবতাত্বাধ্যারোপণঞ্চ প্রজাপতিত্বকরণং
পশোঃ। এবংরূপো হি প্রজাপতিঃ; বিষ্ণুত্বাদিকরণমিব প্রতিমাদৌ। সূর্য্যশ্চক্ষুঃ, শিরসোহনস্তরত্বাৎ সূৰ্য্যাধিদৈবতত্বাচ্চ; বাতঃ প্রাণঃ

শাঙ্কর ভাষ্যঃ প্রজাপতিও কালাদির সমষ্টিস্বরূপ; সেইজন্য প্রতিমা প্রভৃতিতে যেরূপ বিষ্ণুত্বাদি সম্পাদন করা হয়, তদ্রূপ কাল, লোক ও দেবভাব সমারোপণ দ্বারা যজ্ঞীয় পশুরও প্রাজাপত্যত্ব অর্থাৎ প্রজাপতিদৈবতভাব সম্পাদন করা হইয়া থাকে।

৩.  বৃহদারণ্যক উপনিষদ ( ১/৩/১)
ভেদেন হি ব্রহ্মণো নামাদিবস্তু-প্রতিপন্নস্থ্য নামাদৌ বিধীয়তে ব্রহ্মদৃষ্টিঃ-প্রতিমাদাবিব বিষ্ণুদৃষ্টিঃ। আলম্বনতেন হি নামাদি-প্রতিপত্তিঃ, প্রতিমাদিবদেব, ন তু নামাস্তেব ব্রহ্মেতি।

শাঙ্কর ভাষ্যঃ যাহারা নামপ্রভৃতিকে ব্রহ্ম হইতে পৃথক্ বস্তু বলিয়া অবগত আছেন, তাহাদের সম্বন্ধেই নাম প্রভৃতিতে ব্রহ্মদৃষ্টির বিধান করা হইয়া থাকে-অর্থাৎ প্রতিমাপ্রভৃতিতে যেরূপ ব্রহ্মদৃষ্টির বিধান করা হইয়া থাকে, ইহাও ঠিক তদ্রূপই। আর নামপ্রভৃতিতে যে ব্রহ্মদৃষ্টি, তাহাও ঠিক প্রতিমাপ্রভৃতি আলম্বনে ব্রহ্মদৃষ্টির ন্যায় আলম্বনরূপেই (চিন্তার বিষয়রূপেই) বিহিত হইয়া থাকে।

৪. ব্রহ্মসূত্র ( ১/১/২০)
স্যাৎ পরমেশ্বরস্য অপি ইচ্ছাবশাৎ মায়াময়ং রূপং সাধকানু গ্রহাথম।
শাঙ্কর ভাষ্যঃ সাধককে অনুগ্রহ করিবার জন্য পরমেশ্বরেরও ইচ্ছাবশতঃ মায়াময়রূপ হয় সম্ভব।

৫.ব্রহ্মসূত্র ( ১/৩/৩৩)
অস্তি হি ঐশ্বর্য্যযোগাৎ দেব- তানাং জ্যোতিরাজ্যাত্মভিশ্চ অবস্থাতুং, যথেষ্টং চ তং তং বিগ্রহং গ্রহীতুং সামর্থ্যম্ ।

শাঙ্কর ভাষ্যঃ ঐশ্বর্য্যের যোগবশতঃ (-নানাপ্রকার শরীর ধারণ করিবার সামর্থ্যরূপ বিভূতিযুক্ত হন বলিয়া) দেবগণের জ্যোতির্মগুলাদিরূপে অবস্থান করিবার এবং ইচ্ছানুযায়ী তত্তৎ শরীর গ্রহণ করিবার সামর্থ্য আছে।

৬. ঈশোপনিষদ ( ১৫ নং মন্ত্র)

হিরন্ময়েন পাত্রেন সত্যস্যাপিহিতং মুখম্ তৎ ত্বং পুষন্নপাবৃনু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।
- হিরন্ময় পাত্র দ্বারা সত্যের ( পুরুষোত্তম বস্তুর) মুখ আচ্ছাদিত রয়েছে ( যোগমায়া সমাবৃত)। হে পোষণকারী দেবতা, সত্যধর্ম আমার দৃষ্টির জন্য, উপলব্ধির জন্য তাহা অপসারণ করো।

৭. বিষ্ণু সংহিতা ( পঞ্চষষ্টিতম অধ্যায়)

অথাতঃ সুন্নাত: সুপ্রক্ষালিতপাণিপাদঃ স্বাচান্তো
দেবতার্চ্চায়াৎ স্থলে  বা ভগবন্তমনাদিনিধনং বাসুদেব- মভ্যর্জয়েৎ। ১। অশ্বিনোঃ প্রাণন্তেীত ইতি জীবা- দানং দত্ত্বা যুঞ্জতে মনঃ ইত্যম্বুবাকেনাবাহনং রুহা জানুভ্যাং পাণিভ্যাং শিরসা চ নমস্কারং কুষ্যাৎ। ২। আপোহিষ্ঠেতি তিস্বভিরাং নিবেদয়েৎ। ৩।

অর্থাৎ, অনন্তর উত্তমরূপে স্নান, তদন্তে উত্তমরূপে হস্ত- পদ প্রক্ষালন ও তৎপরে উত্তমরূপে আচমন করিয়া, দেবপ্রতিমাতে কিংবা স্থলে (অর্থাৎ ঘটা- দিতে) জন্ম-মৃত্যুরহিত ভগবান্ বাসুদেবের পুজা করিবে। "আশ্বনোঃ প্রাণাস্তোত” এই মন্ত্র দ্বারা জীব দান করিয়া-"যুঞ্জতে মনঃ' এই অনুবাক দ্বারা আহবান করবে। " আপোহিষ্ঠাঃ " ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা অর্ঘ্য প্রদান করবে।
এখানে দ্রষ্টব্য যে এই " যুঞ্জতে মনঃ " মন্ত্রটি শুক্ল যজুর্বেদে পাওয়া যায়, যার প্রয়োগ করে সংহিতা'য় সাকার উপাসনা করার নির্দেশ দিচ্ছে। যথাঃ
যুঞ্জতে মন উত যুঞ্জতে ধিয়ো বিপ্রা বিপ্রস্য বৃহতো বিপশ্চিতঃ। বি হোত্রা দধে বয়নাবিদেক ইন্মহী দেবস্য সবিতুঃ পরিষ্টুতিঃ ॥ 8 ॥ -( শুক্ল যজুর্বেদ)
আবার ঋগ্বেদেও এই মন্ত্রটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
৮১ সূক্ত
[দেবতা: সবিতা। ঋষি: অত্রির অপত্য শ্যাবাশ্ব। ছন্দ: জগতী)

যুঞ্জতে মন উত যুঞ্জতে ধিয়ো বিপ্রা বিপ্রস্য বৃহতো বিপশ্চিতঃ। বি হোত্রা দধে বয়নাবিদেক ইন্মহী দেবস্য সবিতুঃ পরিষ্টুতিঃ। ১॥

আবার, " আপোহিষ্ঠাঃ " এই মন্ত্রটিও শুক্র যজুর্বেদে পাওয়া যায়, যার প্রয়োগ করে সংহিতা'য় বিষ্ণুমূর্তির পূজার নির্দেশ আছে।! যথাঃ
আপো হি ষ্ঠা ময়োভুবস্তা ন উর্জে দধাতন। মহে রণায় চক্ষসে ॥ ১৪॥

৮. বিষ্ণু সংহিতা -২
তম্বোপ্যর ন্যাসেৎ স্বর্ণপাত্রে দেবং সুরেশ্বরম্। সুবর্ণনিষ্কষটুকেন নিৰ্ম্মিতং বজ্রবারিণম্। ১৭ যজেৎ পুরুষসূক্তেন বাসবং বিশ্বরূপিণম্।.
- তদুপরি স্বর্ণপাত্র রাখিয়া তাহাতে ছয় নিষ্ক পরিমিত সুবর্ণ দ্বারা নিৰ্ম্মিত বজ্রহস্ত দেবরাজ-প্রতিমা স্থাপন করিয়া বিশ্বরূপী ইন্দ্রদেবকে পুরুষসূক্ত মন্ত্র দ্বারা  পূজা করবে। 
এখানেও ঋগ্বেদোক্ত পুরুষ সূক্ত দ্বারা ইন্দ্রের সাকার মূর্তির পূজার বিধান দেওয়া হচ্ছে। 

৯. শাতাতপঃ সংহিতা
নিষ্কহপম্রা তু কর্তব্যো দেবঃ শ্রীবৎসলাঞ্ছনঃ
পট্টবস্ত্রেণ সংবেষ্ট্য পূজয়েৎ তং বিধানত
- নিষ্কপরিমিত সুবর্ণ দ্বারা শ্রীবৎস লাঞ্ছন শ্রীকৃষ্ণের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে পট্টবস্ত্র দ্বারা ঐ মূর্তি বেষ্টিত করে উক্ত দেবের যথাবিধি পূজা করবে।
এছাড়াও গৃহ্যসূত্রাদিতে সাকার উপাসনার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। 

১০. শুক্ল যজুর্বেদ -( ১৬শ অধ্যায়)
নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ। বাহুভ্যামুত তে নমঃ।
 - হে রুদ্রদেব, আপনার ক্রোধের উদ্দেশ্যে আমি নমস্কার করি। আপনার বাণের উদ্দেশ্যে এবং আপনার বাহুযুগলের উদ্দেশ্যে আমি নমস্কার করি।
নমস্তে নীলগ্রীবায় সহস্রাক্ষায় মীঢুষে ( ৮ নং মন্ত্র)
 - তিনি নীলবর্ণের কণ্ঠবিশিষ্ট। সহস্র অক্ষিযুক্ত  তাঁকে আমি প্রণাম জানাই।
হস্তে বভূব তে ধনুঃ ( ১১ নং মন্ত্র) 
 - তিনি হস্তে ধনু ধারণ করেছেন। 




এভাবেই বেদে পরোক্ষভাবে দেবতার সাকার রূপের অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। 
অনেকের দাবি বাল্মিকী রামায়ণে সাকার উপাসনা বা প্রতিমাপূজার উল্লেখ নেই।  কিন্তু মূল বাল্মিকী রামায়ণেও পরোক্ষভাবে সাকার উপাসনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

স তত্র ব্রহ্মণঃ স্থানমগ্নেঃ স্থানং তথৈব চ ৷
বিষ্ণোঃ স্থানং মহেন্দ্রস্য স্থানং চৈব বিবস্বতঃ ॥১৭
 সোমস্থানং ভগস্থানং স্থানং কৌবেরমেব চ।
 ধাতুর্বিধাতুঃ স্থানে চ বায়োঃ স্থানং তথৈব চ ॥১৮
 নাগরাজস্য চ স্থানমনন্তস্য মহাত্মনঃ ॥
স্থানং তথৈব গায়ত্রা বসূনাং স্থানমেব চ ॥১৯
 স্থানং চ পাশহস্তস্য বরুণস্য মহাত্মনঃ ॥
কার্তিকেয়স্য চ স্থানং ধর্মস্থানং চ পশ্যতি ॥২০ ॥

গোবিন্দ রাজ স্বামীর ভাষ্য অনুসারে এর অনুবাদ:-

শ্রীরামচন্দ্র সীতা দেবী ও লক্ষ্মণের সাথে অগস্ত্য মুনির আশ্রমে প্রবেশ করে অনেক দেবপূজাগৃহাদি দর্শন করলেন। চতুর্মুখ ব্রহ্মার মন্দির বা পূজা স্থান, অগ্নি, বিষ্ণু, ইন্দ্র, চন্দ্র, ভগ, কুবের, ধাতা ও বিধাতা, বায়ু, নাগরাজ অনন্তশেষ, শষ, গায়ত্রী, বসু ও পাশহস্ত বরুণ দেবের বিগ্রহ সেবিত মন্দির, কার্তিকেয় ও ধর্মরক্ষক যমের মন্দির দর্শন করলেন।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, মূল শ্লোকে পাশহস্ত বরুণের উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এখানে বরুণ অর্থে বেদের নিরাকার শক্তি নন। হাতে পাশ ধারণ করে আছেন এমন সাকার প্রতিমূর্তি বরুণদেবের উল্লেখ পাই। 
এভাবেই বেদ, উপনিষদ, উনবিংশ সংহিতা, বাল্মিকী রামায়ণ সহ অন্যান্য বৈদিক শাস্ত্রে প্রতিমা পূজার মাধ্যমে সাকার উপাসনার উল্লেখ পাওয়া যায়।

Saturday, November 23, 2024

ব্রাহ্মণের নয়গুন সমন্বিত যজ্ঞোপবীত


 আমরা সকলেই ব্রাহ্মণের গলায় একটা নয় প্যাচ যুক্ত পৈতা বা যজ্ঞোপবীত দেখতে পাই, যা প্রমাণ করে যে সে একজন ব্রাহ্মণ। আর এই পৈতা বা যজ্ঞোপবীত এক বিপ্র বালক এমনি এমনি পায় না; তাকে এটা দেয়ার জন্য উপনয়ন সংস্কার প্রচলিত আছে, এই উপনয়ন সংস্কারের মাধ্যমেই এক বিপ্রবালক সয়ংসম্পূর্ণ দ্বিজ এবং বিপ্র হয়ে উঠে। 

কিন্তু আমরা অনেক ব্রাহ্মণ এবং অনেকেই এই যজ্ঞোপবীতের নয়টি গুন কি কি তা জানি না! এই যজ্ঞোপবীতের নয়টি গুন সম্পর্কে শ্রীমদ্ভগবতগীতা বলছে.....

শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ।

জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম॥

~ [শ্রীমদ্ভগবতগীতা - ১৮/৪২]

অর্থ: শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষান্তি, আর্য, জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং আস্তিক্য এই সব হলো ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত (পূর্বজন্মের স্বীকৃতি প্রাপ্ত) কর্ম।

আমরা গীতার এই শ্লোক দ্বারা এইটা বুঝতে পারি যে এইসব (শম,দম,তপ ইত্যাদি) হলো ব্রাহ্মণের যজ্ঞোপবীতের এক একটি গুন সমন্বিত কর্ম, ব্রাহ্মণের এক একটি পৈতার প্যাচে এই এক একটি গুন আছে; কিন্তু আমরা এই গুলো জানলেও উপরে দেয়া গুন গুলোর চলিত ভাষায় অর্থ জানি না, আজকে আমরা সেটিই জানবো.......

ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞোপবীতের প্রথম গুনটি হলো~

শম:- শম অর্থ হলো অন্তর ইন্দ্রিয়ের বা মনের সংযম। আমাদের মধ্যে সবার মধ্যেই যে মন আছে তা নিয়ন্ত্রণে রাখাই হলো শম, আর ব্রাহ্মণ সবসময় তার মন নিয়ন্ত্রণে রাখে, তাই তার প্রথম গুন শম।

[এই পৈতার প্রথম গন্ডির দেবতা হলো পরমাত্মা বা ॐ]

ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞোপবীতের দ্বিতীয় গুনটি হলো~

 দম:- দম অর্থ হলো বহিঃ ইন্দ্রিয়ের সংযম, আমাদের শরীরে যে একাদশ ইন্দ্রিয় এবং প্রধান পাচ ইন্দ্রিয় (নাক, কান, চোখ, ত্বক এবং জিহ্বা) আছে তা নিয়ন্ত্রণে রাখাই হলো দম, ব্রাহ্মণ সবসময় চেষ্টা করে এই বহিঃ ইন্দ্রিয় সংযমে রাখার, তাই তার দ্বিতীয় গুন দম।

[এই পৈতার দ্বিতীয় গণ্ডীর দেবতা হলো অগ্নিদেব]

ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞোপবীতের তৃতীয় গুনটি হলো~

তপ:- তপ অর্থ হলো তপস্যা করা, কিন্তু কলিযুগে তপস্যা না থাকায় এখানে তপস্যা শব্দের অর্থ ঈশ্বরের চিন্তা করা; আর ব্রাহ্মণ সবসময় ঈশ্বরের চিন্তা বা ঈশ্বরের কর্ম করে, তাই তার তৃতীয় গুন হচ্ছে তপ।

[এই পৈতার তৃতীয় গণ্ডীর দেবতা হলেন অনন্তনাগ]

ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞোপবীতের চতুর্থ গুনটি হলো~

শৌচ:- শৌচ অর্থ হলো পবিত্রতা, ব্রাহ্মণ সবসময় পবিত্র; তাই ব্রাহ্মণের আরেক গুন হলো শৌচ।

[এই পৈতার চতুর্থ গণ্ডীর দেবতা হলেন চন্দ্রঁদেব]

ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞোপবীতের পঞ্চম গুনটি হলো~

ক্ষান্তি:- ক্ষান্তি অর্থ হলো ক্ষমা করা, ব্রাহ্মন সবসময় ক্ষমাশীল এবং সে সবসময় অন্যকে ক্ষমা করতে শিখে ছোটো হতে, তাই তার পৈতার আরেক গুন হলো ক্ষান্তি!

[এই পৈতার পঞ্চম গণ্ডীর দেবতা হলেন পিতৃপুরুষগন]

ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞপবীতের ষষ্ঠ গুনটি হলো~

আর্য:- আর্য শব্দের অর্থ হলো সরলতা, ব্রাহ্মণ সবসময় শুভচিন্তক, তাই ব্রাহ্মণ সরল প্রকৃতির; এইজন্য‌ই ব্রাহ্মণের আরেকটি গুন হলো আর্য বা সরলতা!

[এই পৈতার ষষ্ঠ গণ্ডীর দেবতা হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা]




ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞপবীতের সপ্তম গুনটি হলো~

জ্ঞান:- এখানে জ্ঞান শব্দের অর্থ শাস্ত্রজ্ঞান বোঝানো হয়েছে, ব্রাহ্মণ সবসময় শাস্ত্র অধ্যায়ন এবং অধ্যাপনা করান, তাই তার আরেক গুন হলো জ্ঞান।

[এই পৈতার সপ্তম গণ্ডীর দেবতা হলেন বায়ুদেব]

ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞপবীতের অষ্টম গুনটি হলো~

বিজ্ঞান:- এখানে বিজ্ঞান শব্দের অর্থ হলো আত্ম জ্ঞান; ব্রাহ্মণ সবসময় নিজের আত্মাকে জানেন এবং তাকেই পরমাত্মার অংশ‌ বলে মানেন, তাই তার আরেক গুন বিজ্ঞান।

[এই পৈতার অষ্টম গণ্ডীর দেবতা হলেন সূর্যদেব]

ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞোপবীতের একদম শেষের গুনটি হলো~

আস্তিক্য:- এখানে আস্তিক্য শব্দের অর্থ হলো বিশ্বাস রাখা; ব্রাহ্মণ সবসময় তার গুরু, বেদ এবং অন্যান্য শাস্ত্রে বিশ্বাসী, তাই তার আরেক গুন হলো আস্তিক্য।

[এই পৈতার শেষের গণ্ডীর দেবতা হলেন সবাই অর্থাৎ সমস্ত দেবদেবী]

এই হলো ব্রাহ্মণের পৈতা বা যজ্ঞোপবীতের নয়টি গুন এবং তার অর্থ, আজকের আলোচনা এতোটুকুই; আবার আগামী পোষ্টে নতুন কোনো টপিক নিয়ে দেখা হবে!

{অতিরিক্ত যুক্ত:- পৈতায় থাকা নয়টি গুনের দেবতা} 

নমস্কার, নমঃ শিবায় 

শিবার্পনমস্তু

Friday, November 1, 2024

বেদাদি শাস্ত্রে পশুবলির প্রমাণ

 

এষ ছাগঃ পুরো অশ্বেন বাজিনা পুষ্ণে ভাগো নীয়তে বিশ্বদেব্যঃ।


অভিপ্রিয়ং যত্ পুরোলোশমর্বতা ত্বষ্টেদেনং সোশ্রবসায় জিন্বতি।।     – ঋগবেদ ১/১৬২/৩


অর্থাৎ, সকল দেবতার উপযুক্ত ছাগ পূষারই ভাগে পড়ে, একে দ্রুতগতি অশ্বের সাথে সম্মুখে আনা হচ্ছে। অতএব ত্বষ্টা দেবতাগণের সুভোজনের নিমিত্ত অশ্বের সাথে ঐ অজ হতে সুখাদ্য পুরোডাশ প্রস্তত করুন।


যদশ্বস্য ক্রবিষো মক্ষিকাশ যদ্বা স্বরৌ স্বধিতৌ রিপ্তমস্তি।


যদ্ হস্তয়ৌঃ শামিতুর্যন্নখেষু সর্বা তা তে অপি দেবেষ্বস্তু।।    – ঋগবেদ ১/১৬২/৯


অর্থাৎ, অশ্বের অপক্ক মাংসের যে অংশ মক্ষিকা ভক্ষণ করে, ছেদনকালে বা পরিস্কার করবার সময় ছেদন ও পরিস্কার সাধন অস্ত্রে যা লিপ্ত হয় , ছেদকের হস্তদ্বয়ে এবং নখে যা লিপ্ত থাকে, সে সমস্তই দেবগণের নিকট যাক।


যদুবধ্যমুদরস্যাপবাতি য আমস্য ক্রবিষো গন্ধো অস্তি।


সুকৃতা তচ্ছমিতারঃ কৃণ্বন্তুত মেধং শৃ্তপাকং পচন্তু।।     – ঋগবেদ ১/১৬২/১০


অর্থাৎ, উদরের অজীর্ণ তৃণ বের হয়ে যায়, অপক্ক মাংসের যে লেশমাত্র থাকে, ছেদনকর্তা তা নির্দোষ করুন এবং পবিত্র মাংস দেবতাগণের উপযোগী করে পাক করুন।


যত্তে গাত্রাদগ্নিনা পচ্যমানাদভি শূলং নিহতস্যাবধাবতি।


মা তদ্ ভুম্যামা শ্রিষন্মা তৃণেষু দেবেভ্যস্তদুশদ্ভ্যো রাতমস্তু।।    – ঋগবেদ ১/১৬২/১১


অর্থাৎ, হে অশ্ব, অগ্নিতে পাক করবার সময়, তোমার গাত্র হতে যে রস বের হয় এবং যে অংশ শূলে আবদ্ধ থাকে তা যেন ভূমিতে পড়ে না থাকে এবং তৃণের সাথে মিশ্রিত না হয়। দেবতারা লালায়িত হয়েছেন, সমস্তই তাদের প্রদান করা হউক।


যে বাজিনং পরিপশ্যন্তি পক্বং যে ইমাহুঃ  সুরভির্নির্হরেতি।


যে চার্বতো মাংসভিক্ষামুপাসত উতো নেষামভিগুর্তির্ন ইন্বতু।।   – ঋগবেদ  ১/১৬২/১২


অর্থাৎ, যারা চারিদিক হতে অশ্বের পাক দর্শন করে, যারা বলে এর গন্ধ মনোহর হয়েছে, এখন নামাও এবং যারা মাংস ভিক্ষার জন্য অপেক্ষা করে, তাদের সংকল্প আমাদের সংকল্প হোক।


এভাবে ঘোড়াকে কেটে, রান্না করেও বলা হত ঘোড়া মরে নি, সে স্বর্গে দেবতাদের কাছে গিয়েছেঃ


ন বা উ এতন্ ম্রিয়সে ন রিষ্যসি দেবাং ইদেষি পথিভিঃ সুগেভিঃ    – ঋগবেদ    ১/১৬২/২১


অর্থাৎ, হে অশ্ব! তুমি মরছ না অথবা লোকে তোমার হিংসা করছে না, তুমি উত্তম পথে দেবতাগণের নিকট যাচ্ছ।


সব কিছু সমাপ্ত করে ঘোড়ার কাছে অর্থাৎ অশ্বমেধ থেকে ধন, পুত্র এবং শারীরিক বলের কামনা করা হতঃ


সুগব্যং তো বাজী স্বশ্ব্যং পুংসঃ পুত্রান্ উত বিশ্বাপুষং রয়িম্।


অনাগাস্ত্বং ত অদিতিঃ কৃণোতু ক্ষত্রং তো অশ্বা বনতাং হবিষ্মান্।।    – ঋগবেদ ১/১৬২/২২








অর্থাৎ, এ অশ্ব, আমাদের গো ও অশ্ববিশিষ্ট জগৎপোষক ধন প্রদান করুক, আমাদের পুরুষ অপত্য দান করুক। তেজস্বী অশ্ব আমাদের পাপ হতে বিরত করুক। হবির্ভূত অশ্ব আমাদের শারীরিক বল প্রদান করুক


অথ সংবৎসরে পূর্ণে তস্মিন্ প্রাপ্তে তুরংগমে।


সরয়্বাশ্চোত্তরে তীরে রাজ্ঞো যজ্ঞোহভ্যবর্তন।। ১


ঋষ্যশৃংগং পুরস্কৃত্য কর্ম চক্রুর্দ্বিজর্ষভাঃ।


অশ্বমেধে মহাযজ্ঞে রাজ্ঞোস্তস্য সুমহাত্মনঃ।। ২


নিযুক্তাস্তত্র পশাবস্তত্তদুদি্দশ্য দৈবতম্।


উরগা পক্ষিণশ্চৈব যথাশাস্ত্রং প্রচোদিতাঃ।।৩০


শামিত্রে তু হযস্তত্র তথা জলচরাশ্চ যে।


ঋষিভিঃ সর্বমেবৈতন্নিযুক্তং শাস্ত্রতস্তদা।। ৩১


পশুনাং ত্রিশতং তত্র যুপেষু নিয়তং তদা।


অশ্বরত্নোত্তমং তত্র রাজ্ঞো দশরথস্য চ।। ৩২


কৌসল্যা তং হয়ং তত্র পরিচর্য সমন্ততঃ।


কৃপাণৌর্বিশশাসৈনং ত্রিভিঃ পরময়া মুদা।। ৩৩


পত্রত্ত্রিণা তথা সার্ধং সুস্থিতেন চ চেতসা।


অবসদ্ রজনীমেকাং কৌসল্যা ধর্মকাম্যয়া।। ৩৪


হোতাধ্বর্যুস্তথোদ্গাতা হয়েন সমযোজয়ন্।


মহিষ্যা পরিবৃত্ত্যাথ বাবাতামপরাং তথা।। ৩৫


পতত্ত্রিণস্তস্য বপামুদ্ধৃত্য নিয়তেন্দ্রিয়ঃ।


ঋত্বিক্পরমসম্পন্নঃ শ্রপয়ামাস শাস্ত্রতঃ।। ৩৬


ধুমগন্ধং বপায়াস্তু জিঘ্রতি স্ম নরাধিপ।


যথাকালং যথান্যায়ং নির্ণুদন্ পাপমাত্মনঃ।। ৩৭


হয়স্য যানি চাংগানি তানি সর্বাণি ব্রাহ্মণাঃ।


অগ্নৌ প্রাপ্স্যন্তি বিধিবত্ সমস্তাঃ ষোড়শর্ত্বিজঃ।। ৩৮ 


(বালকাণ্ড, সর্গ ১৪)


তারপরে এক বছর সম্পন্ন হলে ঘোড়া ফিরে এল এবং সরযূ নদীর উত্তর তীরে রাজার যজ্ঞ আরম্ভ হল। (১) মহাত্মা রাজা (দশরথ)র  অশ্বমেধ নামক মহাযজ্ঞে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণগণ ঋষ্যশৃঙ্গ কে নিজেদের প্রধান বানিয়ে যজ্ঞকর্ম করতে লাগলেন। (২) … পশু, পক্ষী এবং সাপ, যাদের রাখার অনুমতি শাস্ত্র দেয় তাদের অধিষ্ঠাতা দেবতাদের নামে সেখানে রাখা হল। (৩০) ঋষিরা যজ্ঞে বধ করার জন্য ঘোড়া এবং জলচর প্রাণীদের যূপের সাথে বাধলেন। (৩১) সেই যজ্ঞে তিনশত পশু যূপের সাথে বাঁধা হয়েছিল।রাজা দশরথের সেই শ্রেষ্ঠ ঘোড়াকেও ( যে পৃথিবীর সর্বত্র ঘুরে এসেছিল) বাঁধা হয়েছিল। কৌশল্যা খুশিমনে অশ্বের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে  তলোয়ারের তিন কোপে তাকে হত্যা করেছিলেন। (৩৩) কৌশল্যা ঐ মৃত ঘোড়ার পাশে সাবধানচিত্ত হয়ে ধর্মের কামনা করে এক রাত অবস্থান করেছিলেন। (৩৪) তারপর হোতা, অধ্বর্যু এবং উদগাতা মহিষী (যে রানির রাজার সাথে রাজ্যাভিষেক হয়েছিল), পরিবৃত্তি (রাজার শূদ্র জাতীয় পত্নী) এবং বাবাতা (রাজার বৈশ্য জাতীয় পত্নী) এই তিন শ্রেণীর রানিদের ঘোড়ার সাথে যুক্ত করেছিলেন। (৩৫) জিতেন্দ্রিয় এবং শ্রৌতকর্মে কুশল ঋত্বিক (পুরোহিত) ঐ ঘোড়ার চর্বি বের করেছিল এবং শাস্ত্রানুসারে তা রান্না করেছিল। (৩৬) রাজা দশরথ সেই হবনকৃত চর্বির গন্ধ উপযুক্ত সময়ে বিধান অনুসারে শুঁকেছিলেন, যার ফলে তার পাপ দূর হয়ে গিয়েছিল। (৩৭) ষোল জন ঋত্বিক ব্রাহ্মণেরা মিলে ওই ঘোড়ার যত অঙ্গ ছিল, সব গুলোকে অগ্নিতে হবন করেছিলেন।


যজস্ব বাজিমেধেন বিধিবত্ দক্ষিণাবতা।। ১৫


অশ্বমেধো হি রাজেন্দ্র পাবনঃ সর্বপাপ্মনাম্।


তেনেষ্ট্বা ত্বং বিপাপ্মা বৈ ভবিতা নাত্র সংশয়ঃ।। ১৬  (অশ্বমেধিকপর্ব, অধ্যায় ৭১)


অর্থাৎ, ব্যাস বলেছেন, “ হে যুধিষ্ঠির, বিধি পূর্বক দক্ষিণা দিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান কর। রাজেন্দ্র, অশ্বমেধ যজ্ঞ সমস্ত পাপ নাশ করে যজমানকে পবিত্র করে। এর অনুষ্ঠান করে তুমি পাপমুক্ত হবে, এতে সংশয় নেই।“


ততো নিযুক্তাঃ পশবো যথাশাস্ত্রং মনীষিভিঃ।


তং তং দেবং সমুদ্দিশ্য পক্ষিণঃ পশবশ্ব যে।।


ঋষভাঃ শাস্ত্রপঠিতাস্তথা জলচরাশ্চ যে।


সর্বাস্তানভ্যযুংজংস্তে তত্রাগ্নিচযকর্মণি।।


যুপেষু নিয়তা চাসীত্ পশুনাং ত্রিশতী তথা।


অশ্বরত্নোত্তরা যজ্ঞে কৌন্তেয়স্য মহাত্মনঃ।।   (অশ্বমেধিকপর্ব  ৮৮/৩৩-৩৫)


অর্থাৎ, এরপর মনিষী ঋত্বিকেরা শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে পশুদের নিযুক্ত করলেন। ভিন্নভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশ্যে পশু, পাখি এবং শাস্ত্রকথিত বৃষভ এবং জলচর জন্তু-  এদের অগ্নিস্থাপন কার্যে যাজকেরা ব্যবহার করলেন। কুন্তীনন্দন মহাত্মা যুধিষ্ঠির এই যজ্ঞে যে সব যূপ দাঁড় করানো হয়েছিল, তাতে তিনশত পশু বাঁধা হয়েছিল। এসবের মধ্যে প্রধান সেই অশ্বরত্ন ছিল।


(মহাভারত, খণ্ড ৬, গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর, হিন্দি অনুবাদ সহিত, পৃষ্ঠা ৬২৯০)


শ্রপয়িত্বা পশুনন্যান্ বিধিবদ্ দ্বিজসত্তমাঃ।


তং তুরংগং যথাশাস্ত্রমালভন্ত দ্বিজাতয়ঃ।। ১


ততঃ সংশ্রপ্য তুরংগং বিধিবদ্ যাজকাস্তদা।


উপসংবেশয়ন্ রাজংস্ততস্তাং দ্রুপদাত্মজাম্।। ২


উদ্ধৃত্য তু বপাং তস্য যথাশাস্ত্রং দ্বিজাতয়ঃ।। ৩


শ্রপয়ামাসুরব্যগ্রা বিধিবদ্ ভরতর্ষভ।


তং বপাধুমগন্ধং তু ধর্মরাজঃ সহানুজৈঃ।। ৪


উপাজিঘ্রদ্ যথাশাস্ত্রং সর্বপাপাহং তদা।


শিষ্টান্যংগানি যান্যাসংস্তস্যাশ্বস্য নরাধিপ।। ৫


তান্যগ্নৌ জুহুবুর্ধীরাঃ সমস্তাঃ ষোড়শর্ত্বিজঃ।। ৬     ( অশ্বমেধিক পর্ব ৮৯ )


অর্থাৎ, সেই শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা অন্যান্য পশুদের বিধিপূর্বক রান্না করে ওই অশ্বকেও শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে বধ করলেন। (১) রাজন, তারপর যাজকেরা বিধিপূর্বক অশ্বকে রান্না করে তার কাছে দ্রৌপদীকে শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে বসালেন। (২)  হে ভরতশ্রেষ্ঠ, তারপর ব্রাহ্মণেরা শান্তচিত্ত হয়ে সেই অশ্বের চর্বি বের করে তাকে বিধিপূর্বক রন্ধন করা শুরু করলেন। (৩) ভাইদের সাথে যুধিষ্ঠির শাস্ত্রোক্ত আজ্ঞা অনুসারে সমস্ত পাপনাশক সেই চর্বির ধোয়ার গন্ধ শুঁকেছিলেন। (৪) নরেশ্বর, ওই অশ্বের যে শেষ অঙ্গ ছিল তা দিয়ে শান্ত স্বভাবের সমস্ত ষোল জন ঋত্বিকেরা অগ্নিতে হোম করেছিলেন। (৫) (মহাভারত, ষষ্ঠ খণ্ড, গীতাপ্রেস, গোরখপুর, হিন্দি অনুবাদ সহিত, পৃষ্ঠা ৬২৯০-৬১৯১)


৩৯। যজ্ঞার্থং পশবঃ সৃষ্টাঃ স্বয়মেব স্বয়ম্ভুবা।


যজ্ঞস্য ভূত্যৈ সর্বস্য তস্মাদ্‌যজ্ঞে বধোহবধঃ ॥


ব্রহ্মা নিজেই যজ্ঞের জন্য পশুগণকে সৃষ্টি করেছেন। যজ্ঞ সকলের উন্নতির কারণ ; সুতরাং, যজ্ঞে পশুবধ বধ নয়।


৪০। ওষধ্যঃ পশবো বৃক্ষাস্তির্যঞ্চঃ পক্ষিণস্তথা।


যজ্ঞার্থং নিধনং প্রাপ্তাঃ প্রাপ্নুবন্ত্ত্যচ্ছ্রিতীঃ পুনঃ ॥


ওষধি (যে গাছ ফল পাকলে মরে যায়), পশুগণ, বৃক্ষসমূহ, কচ্ছপাদি তির্যগ্‌জাতি ও পক্ষিগণ যজ্ঞের জন্য নিহত হলে পুনরায় উচ্চ জন্ম লাভ করে।


৪১। মধুপর্কে চ যজ্ঞে চ পিতৃদৈবতকর্মণি।


অত্রৈব পশবো হিংস্যা নান্যত্রেত্যব্রবীন্মনুঃ ॥


মধুপর্কে২, যজ্ঞে, পিতৃকার্যে ও দৈবকার্যেই শুধু পশুহত্যা বিহিত, অন্য স্থলে নয়—এই কথা মনু বলেছেন।


৪২। এবর্থেষু পশুন্‌ হিংসন্‌ বেদতত্ত্বার্থবিদ্‌ দ্বিজঃ।


আত্মানঞ্চ পশুঞ্চৈব গময়ত্যুত্তমাং গতিম্ ॥


এই সকল উপলক্ষ্যে পশুহত্যা করে বেদতত্ত্বজ্ঞ দ্বিজ নিজেকে ও (ঐ) পশুকে সদগতি লাভ করান।


৪৩। গৃহে গুরাবরণ্যে বা নিবসন্নাত্মবান্‌ দ্বিজঃ।


নাবেদবিহিতাং হিংসামাপদ্যপি সমাচরেৎ ॥


গৃহে, গুরুগৃহে বা বনে বাস করে প্রশস্তাত্মা দ্বিজ বেদনিষিদ্ধ হিংসা বিপদ্‌কালেও করবেন না।


৪৪। যা বেদবিহিতা হিংসা নিয়তাস্মিংশ্চরাচরে।


অহিংসামেব তাং বিদ্যাদ্বেদাদ্ধর্মো হি নির্বভৌ॥


এই চরাচর জগতে যে হিংসা বেদবিহিত, তাকে অহিংসা বলেই জানবে ; কারণ, বেদ থেকে ধর্ম প্রকাশিত হয়েছিল।


মনুস্মৃতি ৫ অধ্যায় 


মনুস্মৃতির একটি শ্লোকের মধ্যেও বলা নেই যে বেদে পশুবলি নিষিদ্ধ বরং বলা হয়েছে বেদ নির্দেশিত পশুবলি অহিংসা

Thursday, October 17, 2024

"শ্রী শ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয় ব্রত", দুই চিকিৎসক দেবতার ইতিবৃত্ত

অশ্বিনী কুমারদ্বয়।সনাতন দেব পরম্পরার  মহত্তপূর্ণ দুইজন দেবতা।সনাতনের সবচেয়ে প্রাচীন শাস্ত্রে যে তেত্রিশ জন বা কোটী দেবতার উল্লেখ রয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম এই দুই দেব।পবিত্র বেদের সংহিতা ভাগ থেকে বেদের ব্রাহ্মণভাগ,সুপ্রাচীন বৃহদ্দেবতা থেকে পুরান মহাপুরাণ উপপুরাণ, লোককথা সব জায়গায় রয়েছে এই দুইজন দেবের মাহাত্ম্য। 


অশ্বিনী কুমারদের পরিচয় দিতে গিয়ে পৃথিবীর প্রথম লিখিত সাহিত্য গ্রন্থ পবিত্র  ঋগ্বেদ জানাচ্ছে...

"ত্বষ্টা দুহিত্রে বহতু কৃণোতীতীদং বিশ্বংভূবংসমেতি।

যমস্য মাতা পর্যহ্যমানা মহো জায়া বিবস্বতে ননাস।।

অপাগৃহন্নমৃতাং মত্যের্ভ্যুঃ কৃত্বী সর্বন্নামদদুবিবস্বতে।

উতাশ্বিনাবভরদ্যওদাসীদজহাদু দ্বা মিথুনাসকন্যঃ।।[ঋগ্বেদ ১০/১৭/১-২]


ভাবার্থ-ত্বষ্টা দেব বিশ্বকর্মা নিজ কন্যা সুরণ্য সংজ্ঞা কে বিবস্বান সূর্যের সাথে বিবাহ দিলে যম দেবের জন্ম হয়।পরবর্তীতে সঙ্ঘা অদর্শন হইলে, তার মতো এক দিব্য নারীর সৃষ্টি করা হয় যাহা হতে অশ্বিনীকুমারদ্বয় দেবগণ জন্মগ্রহণ করেন।।


বৈদিক সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ বৃহদ্দেবতা। মহর্ষি শৌনক রচিত এই গ্রন্থের রচনা আনুমানিক ১৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ।অর্থাৎ আজকে থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে।  সুপ্রাচীন এই বৈদিক শাস্ত্রের মত প্রায়ই ঋগ্বেদের মতো একই। বৃহদ্দেবতাকার জানাচ্ছেন, 


"সরণ্যশ্চ বিবস্বস্তং বিদিত্বা হয়রূপিণম্। মৈথুনায়োপচক্রাম তাঞ্চ তত্রারূরোহ সঃ ॥ 

ততস্তয়োত্ত্ব বেগেন শুক্রং তদপতত্ত্ববি। 

উপাজিমুচ্চ সা তথা তদুক্ৰং গর্ভকামায়া ৷৷ আঘাতমাত্রাচ্ছক্রান্তু কুমারৌ সংবভূবতুঃ। 

নাসত্যশ্চৈব দশ্চ যৌ খ্যাতাবশ্বিনাবিতি ৷।

[বৃহদ্দেবতাঃ৭.১-৬]


অন্যদিকে মৎস,কূর্ম,বরাহ,বায়ু,স্কন্ধ, ভাগবত, মহাভারত ও রামায়ণ একই সুরে বলছে,


ততঃ স ভগবান্ গত্বা ভুলোকমমরাধিপঃ।

কাময়ামাস কামাৰ্ত্তো মুখ এব দিবাকরঃ।

অশ্বরূপেণ মহতা তেজসা চ সমাবৃতঃ।

সংজ্ঞা চ মনসা ক্ষোভম গমদ্ভয়বিহ্বলা ৷৷

নাসাপুটাভ্যামুৎসৃষ্টং পরো’য়মিতি শঙ্কয়া ।

তদ্ৰেতসম্ভৃতো জাতাবশ্বিনাবিতি নিশ্চিতম্ ৷৷

দত্রৌ দ্রুতত্বাৎ সঞ্জাতৌ নাসত্যৌনাসিকাগ্রতঃ।

[ মৎস্য পু. ১১.৩৪-৩৬]


এই যে এতোগুলো শাস্ত্রে তাঁদের পরিচয় দিচ্ছে। এই পরিচয়ের সারসংক্ষেপ হলো, সূর্যদেব ও সঙ্ঘার অশ্ব রুপকালে এই দুই দেবতার জন্ম হয়।পার্থক্য শুধু সংঙ্ঘা দেবীকে কোথাও সূরণ্য ডাকা হয়েছে। 

 

আমাদের সমাজে শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ অশ্বিনী কুমার দ্বয় দেবতাকে -" আশ্বিন কুমারী" বলে জানেন। যা নিতান্তই ভুল।শুধু অন্যরা কেন পুরোহিত পণ্ডিত সমাজের অধিকাংশ লোক ও আমরা এই দুই দেবতার আসল নামই জানিনা। এই দুই দেবতার একজন হলেন  - নাসত্য, অন্যজনের নাম দস্র।

" দসৌ স্ত্রতত্বাৎ সঞ্জাতৌ নাসতৌ নাসিকাগ্রতঃ।।

[মৎস পুরান -১১/৩৬][বায়ু পুরান-৮৪/২৩-২৪]



তবে খুবই আশ্চর্যের কথা এঁরা দুজন দেবতার সন্তান হয়েও তাঁরা সমাজে যজ্ঞের ভাগ পেতনা। পেতনা সোমরস। দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও ছিলোনা তাঁদের।  খোদ মহাভারতের মত গ্রন্থেই তাদের একবার শুদ্র দেবতা বলে ডাকা হয়েছে। পরবর্তী মহর্ষি চ্যাবনকেই দেখতে পাচ্ছি এই দুই দেবতাকে যজ্ঞের ভাগ ও সোমরস দিয়ে দেবত্বে প্রতিষ্ঠা করতে।

- অশ্বিনৌ তু স্মৃতৌ শূদ্রৌ তপস্যূগ্রে সমাস্থিতৌ। 

 [মহাভারত-১২.২০২.২৩]


অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে দেব বৈদ্য বা চিকিৎসক বলা হয়।

আমাদের ভারতবর্ষে প্রাচীন কাল থেকে মধ্যকাল পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ব্রাহ্মণরা বৈদ্য বা চিকিৎসা করত তাঁদের প্রচন্ডরকম সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতেন।সমাজে তাঁদের সম্মানের চোখে দেখা হতো না। স্মৃতিশাস্ত্রে এমন ভুঁড়ি ভুঁড়ি উদাহারন দেওয়া যায় যেখানে বৈদ্য ও চিকিৎসকদের নিচু করে দেখানো হয়েছে সামাজিক ভাবে।আমরা এই সামাজিক অবহেলারই পূর্ব প্রতিরূপ খুঁজে পাই অশ্বিনীকুমার এবং চ্যবন ঋষির ঘঠনায়। যেখানে সোমযজ্ঞে ইন্দ্রের সমান মর্যাদা দেওয়া হচ্ছেনা এই দুই দেবকে।পরবর্তীতে তাঁরা পূর্ন দেবতার মর্যাদা হয়তো পেয়েছেন। বেদের ব্রাহ্মণ ভাগেও আমরা এই দুই দেবকে  চিকিৎসক হিসেবে দেখতে পাই.

-অশ্বিনৌ বৈ দেবানাং ভিষজৌ।।

[ঐতেরেয় ব্রাম্মণ-১ম খন্ড -১/১/১৮]


শুধু তাই নয়,পাঠক জেনে অবাক হবেন পৃথিবীর অনেক বড় বড় সভ্যতা যখন শুধুমাত্র লতাপাতা কিংবা তাবিজ-কবজ দিয়ে চিকিৎসা করাতো, তখন ভারতবর্ষের আর্যরা কৃত্রিম হাত পা লাগানোর চর্চ্চা করছে। অবাস্তব নয়, স্বয়ং ঋগ্বেদেই আমরা  অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে সর্বপ্রথম কৃত্রিম পা সংযোজন কারী অর্থোপেডিক্স সার্জারী চিকিৎসক হিসেবে দেখতে পাচ্ছি, যা বিশেষজ্ঞ মহলে বহুল আলোচিত।


ঋগ্বেদের সময়ে খেল নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর কুলপুরোহিত ছিলেন অগস্ত্য। খেলের স্ত্রীর নাম ছিল বিশপলা। কোনো সময় এক যুদ্ধকালে বিশপলার একটি পা কাটা যায়। তিনি নিজেই যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন কিনা, সেটা বোঝা যায় না। বিষ্পলার পায়ের জন্য অগস্ত্য ঋষি অশ্বিনীকুমারদের স্তুতি করেন। তারপর দেখা যায় অশ্বিনীকুমারেরা রাতের কালে এসে বিশ্বলার পা-টাকে লোহার পায়ে সংযুক্ত করে দিলেন।

-" সদ্যো জঙ্গামায়সীং বিশাপলায়ে।ধনেহিতৈ সর্তবে প্রতৈধতম্।।

[ঋগ্বেদ -১/১১৬/৫-২৪]


মহাভারত কালীন সময়েও, দুই দেবতার চেহারা  হিরন্ময় সূর্যের মতো উজ্জ্বল এব অল্পবয়সী তরুণের মতো ভীষণ সুন্দর বলে লোকে জানতো।তাই অশ্বিনীকুমারদের সৌন্দর্য্যের ব্যাপারটা ইতিহাস পুরাণেও বিখ্যাত হয়ে আছে। মহাভারতে দুই অশ্বিনীকুমারের তেজে পান্ডুর পত্নী মাদ্রীর গর্ভে নকুল-সহদেবের জন্ম হয়। এই যমজ ভাইয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল-তাঁরা অসাধারণ সুন্দর   দেখতে -রূপেণাপ্রতিমৌ ভুবি। তাঁদের জন্মের সময় আকাশবাণী হল- অসামান্য রূপ, উৎসাহ এবং শৌর্য্যাদিগুণযুক্ত এই দুটি বালক যথাসময়ে আপন রূপ এবং তেজে দুই অশ্বিনীকুমারকেও ছাড়িয়ে যাবে- রূপসত্ত্বগুণোপেতাবেতাবত্যশ্বিনাবিতি। ভাসতস্তেজসাত্যর্থং রূপদ্রবিণসম্পদা ।। 

[ মহভারত- ১.১১৮.১৭-১৯;  মৎস্য পৃ. ৪৬.১০; ৫০.৫০]


এখনো ভারতবর্ষের মায়ের এই দুই দেবতার মতো সুন্দর সন্তান কামনায় পুজো করেন। আর কামনা করেন যাতে এই দেবতাদের দ্বারাই তাঁর সন্তানেরা সব রোগ থেকে মুক্ত থাকে।


এছাড়া যদুবংশ ধ্বংস হবার কিছুদিন আগে ইন্দ্র প্রভৃতি বিশিষ্ট দেবতারা দ্বারকায় এসে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন এবং কৃষ্ণকে তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠলোকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। এই সময় অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে অশ্বিনীকুমাররাও কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। 

[ভাগবত পু. ১১.৬.২]


অন্যদিকে, রাবনের সাথে দেবতাদের যুদ্ধ,বৃষপর্বা নামের দৈত্যের যুদ্ধের দিন ও আমরা এই দুই দেবতার প্রবল পরাক্রম দেখতে পাচ্ছি।  বৈদ্য  বা চিকিৎসক হলেই যে তিনি দূর্বল হবেন বা যুদ্ধ করতে পারেন না এমন ধারণা মিথ্যা করে দিয়ে এই অশ্বিনীকুমার রা সেদিন তাঁদের পরাক্রম দিয়ে সম্পূর্ণ দেব সমাজকেই অবাক করেছিলো।


কথিত আছে, সূর্য ও সঙ্ঘা শিবতেজ  সম্পন্ন সবচেয়ে সুন্দর রুপের পুত্র লাভার্থে দেবী ভগবতীর কাছে গেলে ভগবতী তাঁদের  দুইমুষ্টি তন্ডুল বা চাউল দিয়ে বলেন,আশ্বিন নবরাত্রি শেষে আশ্বিনের শেষদিনে তাঁরা যেনো এই চাউল রান্না করে কার্ত্তিকের প্রথমদিনে তাঁ ভক্ষন করে।তবেই তাঁদের মনের আশা পূর্ণ হবে।


পরবর্তীতে দেবীর কথামত এই নিয়ম পালন করলে অশ্বরুপে অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের জন্ম হয়।এখোনো সনাতন সমাজের মায়েরা সন্তান লাভ বা সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত করেন।মা সন্তানের আশায় বা সন্তানের জন্য যেকোনো বর প্রার্থনা করলে শীঘ্রই তা পূরণ হয়।মায়েরা বলেন,

"আশ্বিনে রাধে কার্তিকে খায়,

যে বর মাঁগে, সে বর পায়"


অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ধ্যান... 


- ওঁ আশ্বিনেয়ৌ মহাভাগৌ বন্ধ্যা-পুত্রবর প্রদৌ। দ্বিভুজৌ পদ্মনয়নৌ শরদিন্দু সমগ্রতৌ। সূর্য্যপুত্রৌ স্বৰ্গবৈদ্যৈ প্রমেয়ৈ কমলাননৌ । ধায়ত্তৌ নাসিকা জাতৌ রোগ-শোক নিবারকৌ।।


সজলান্ন নিবেদন মন্ত্রঃ 

"ওঁ এতানি ধাতবঃ পাত্রস্থ সজল সোপকরণ সিদ্ধান্নাণি অশ্বিনী কুমারাভ্যাং নমঃ ।।


প্রণাম - ওঁ জয়ো রবিনন্দনৈব কবস্থশ্চন্দ্র শেখর।নাসাবাভ্য মশ্বাভ্যাং স্বর্গ-বৈদ্যভাং নমোনমঃ ।। 


তথ্যসূত্রঃ

১.ঋগ্বেদ -রামকৃষ্ণ মিশন অনুবাদিত।পশ্চিমবঙ্গ।

২.ঐতৈরেয় ব্রাহ্মণ-রামকৃষ্ণমিশন অনুবাদিত।বেলুড়মঠ,পশ্চিমবঙ্গ।

৩.বৃহদ্দেবতা-অশোককুমার চট্টোপাধ্যায়। 

৪.মৎসপুরান-পঞ্চানন তর্করত্ন -নবভারত পাবলিশার্স। 

৫.বায়ু,কূর্ম,বরাহ, স্কন্দ পুরান-পঞ্চাননতর্করত্ন।

৬.মহাভারত -হরিসিদ্ধান্ত বাগীশ ভট্টাচার্য।

Friday, May 3, 2024

শিব রাম নাম করেন তাহলে শিব কি রামের থেকে ছোট?

 সম্প্রতি রামায়েতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচুর রামায়েতের দেখা পাওয়া যাচ্ছে যারা শ্রীরাম চন্দ্রকে উপরে তুলতে গিয়ে পরমেশ্বর শিবকে ছোট করছেন। 

চলুন দেখে নেই বাস্তবে কি বলছে বৈষ্ণবদের স্বাত্তিক পুরাণ?

হ্যাঁ উনি রাম নাম করেন। তবে এর একটি কারণ রয়েছে। নারদ পুরান কি বলছে দেখুন। 

ध्याये न किंचिद्गोविंदनमस्ये ह न किंचन ।।

किंतु नास्तिकजंतूनां प्रवृत्त्यर्थमिदं मया ।। ७९-२00 ।।


दर्शनीयं हरे चैतदन्यथा पापकारिणः ।।

तस्माल्लोकोपकारार्थमिदं सर्वं कृतं मया ।। ७९-२0१ ।।


Chapter 79, verse 200-201. “O Govinda, I do not meditate on anything. I do not bow to anybody. But in order to inspire the unbelieving animal beings, (Pasu) etc. this is shown to them. O Hari, otherwise, they will remain sinners. Hence, it was to render help to the world that all these activities have been performed by me."

মানে পশুদের ( আমাদের কথা বলা হচ্ছে) মাঝে যারা অবিশ্বাসী তাদেরকে দেখানোর জন্য আমি এই কাজ করে থাকি । নাহলে এরা পাপী থেকে যাবে। মানে শিব তা ইচ্ছা করেই করেন আমাদের জন্য। 

একই কথা আবার পদ্ম পুরান বলছেঃ 


शंकर उवाच-

ध्याये न किंचिद्गोविंद न नमस्येह किंचन २४७।

नोपास्ये कंचन हरे न जपिष्येह किंचन ।

किंतु नास्तिकजंतूनां प्रवृत्त्यर्थमिदं मया २४८।

दर्शनीयं हरे ते स्युरन्यथा पापकारिणः ।

तस्माल्लोकोपकारार्थमिदं सर्वं कृतं मया २४९।

ओमित्युक्त्वा हरिरथ तं नत्वा समतिष्ठत ।

अथ ते गौतमगृहं प्राप्ता देवगणर्षयः २५०।

सर्वे पूजामथो चक्रुर्देवदेवे पिनाकिने ।

देवो हनूमता सार्द्धं गायन्नास्ते रघूत्तम २५१।

पञ्चाक्षरीं महाविद्यां सर्व एव तदा जपन् ।

हनूमत्करमालंब्य देव्यभ्याशं गतो हरः २५२।

एकशय्यासमासीनौ तावुभौ देवदंपती ।

गायन्नास्ते स हनुमांस्तुंबुरुर्नारदस्तथा २५३।

नानाविधिविलासांश्च चकार परमेश्वरः ।

आहूय पार्वतीमीश इदं वाक्यमुवाच ह २५४।


Śaṅkara said: O Viṣṇu, I am not meditating upon anyone. I am not saluting anything. O Viṣṇu, I am not waiting upon anyone. I shall not mutter any prayer here; but O Viṣṇu, I have to exhibit (like) this for leading the unbelievers to activity. Otherwise they will be sinners. Therefore, to oblige the world, I have done all this.

Padma Purana,  Section 5 - Pātāla-Khaṇḍa, 247-254



Saturday, April 27, 2024

সমুদ্রপুত্র রাজা গৌড় গোবিন্দ ও শ্রীহট্ট

 সিলেটের  গৌড় গোবিন্দ এবং আজকের  শাহজালাল বিভিন্ন তথ্যপঞ্জী এবং পরবর্তিতে আবিষ্কৃত তাম্রফলক ও শিলালিপি থেকে সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কের জানা যায়। সিলেটের নামের অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। সেগুলা হলো- সিরিহট্ট, শিলহট বা শ্রীহট্ট। শ্রীঅর্থে- লাবন্য, তেজ, বীর্য ও জ্যোতি বোঝায়, অপর অর্থে লক্ষী। সিলেটের অন্যতম গৌরব মন্ডীত প্রাক্তন নাম শ্রীভুমি।ভারতের ভূস্বর্গ কাশ্মিরের সৌন্দর্যের কারনে এর রাজধানীর নাম রাখা হয়েছিলো শ্রীনগর। অনুরুপ ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের নগরী সিলেটশ্রীভুমিনামে পৃথিবীর কাছে পুর্বে পরিচিতি লাভ করেছিলো। শ্রীহট্ট তিনদিক থেকে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত। উত্তরে মেঘালয়, পূর্বে আসামের কাছার জেলা এবং দক্ষিনে ত্রিপুরা রাজ্য। শ্রীহট্টের নিম্নাঞ্চল অসমতল ভুমি এক সময় সাগরের অংশ ছিল।অনেক হাওর, বিল এবং নৌঘাটির অস্তিত্ব এ সাক্ষ্য বহন করে। হাওরের উৎপত্তি সায়র বা সাগরথেকে। সপ্তম শতাব্দীতে চীনা তীর্থ যাত্রি হিউয়েন সাং ভারতভ্রমনের সময় সাগর তীরে অবস্তিতএলাকাটিকে শিলিচট্টল বলে উল্লেখ করেছেন। এই শিলিচট্টলই শ্রীহট্ট।শ্রীহট্টের অধিকাংশই জলাভুমি। বিল,নদী, হাওর দ্বারা বেস্টিত। প্রাচীনশ্রীহট্ট প্রধান তিনটি খন্ডে বিভক্ত ছিল। তিনটি খন্ড রাজ্য হল- গৌড় লাউড়ও জয়ন্তিয়া। এ তিনটি রাজ্য ছাড়াও তরফ, ইটা, ও প্রতাপগর নামে ছোট ছোটরাজ্য ছিল যা পরবর্তীতে গৌড়রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়।

১)গৌড়ঃ বর্তমান সিলেট শহরসহ উত্তর সিলেট এবং পুর্ব ও দক্ষিণে অনেকদূর জায়গা নিয়ে গৌড় রাজ্য ছিল।

২) লাউড়ঃ গৌড়ের পশ্চিমে অর্থাৎ সিলেট জেলার পশ্চিমাংশ জুড়ে লাউড় রাজ্য ছিল। লাউড় রাজ্য ময়মনসিংহ ও হবিগঞ্জ জেলার কিছুঅংশ এবং সুনামগঞ্জ জেলার কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত।

৩) জয়ন্তীয়াঃ এই রাজ্য সিলেটের উত্তর-পুর্বাংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল।দক্ষিণে সুরমা নদী ও দক্ষিণ-পুর্বাংশের ত্রিপুরা রাজ্যের জয়ন্তীয়া রাজ্যের সীমারেখা অর্ন্তভুক্ত ছিল। সমগ্র পার্বত্য জয়ন্তীয়া জেলা এই রাজ্যের অর্ন্তগত।তরফ, ইটা এবং প্রতাপনগর রাজ্য পরবর্তীতে গৌড় রাজ্যের অংশ বলে বিবেচিত হয়েছিল।প্রাচীন সিলেট নগরির উত্তর এবং পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তের অনেক অংশ জুড়ে গৌড় রাজ্য বিস্তৃতছিল ।ঐতিহাসিক সুত্র মতে, সমুদ্রেরসন্তান ছিলেন রাজা গৌড় গোবিন্দ।

 

ত্রিপুরা রাজবংশীয় কোন এক রাজার শত রাণী ছিল । সমুদ্রদেব রাজার কোন এক রাণীর সঙ্গে রাজার মুর্তি রুপে মিলিত হন। এক পর্যায়ে রাণী গর্ভবতী হলে একথা মুনি দ্বারা জানাজানি হলে রাজা সেই রাণীকে নির্বাসিত করেন। রাণীর এইঅসহায় অবস্থা দেখে সমুদ্র তখন আবির্ভূত  হলেন। রাণীকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,তাঁর ইচ্ছায় সমুদ্রের জল সরে যতদূর চর পড়বে, নবজাত শিশু ততদুর পর্যন্ত রাজ্যঅধিকার করতে পারবে।উক্ত রাজ্যেরসকল বাসিন্দা বাণিজ্য দ্বারা অন্য দেশ থেকে প্রচুর ধনবান হবে এবং উক্তরাজ্যে ধনের অভাব কখনো হবে না (এজন্যই হয়তো সিলেটিরা সব লন্ডনী এবংটাকা-পয়সাওয়ালা) পরে সমুদ্র সরে যাওয়ায় ভরাট হওয়া স্থানটি গৌড়রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। একসময় রাণী সুন্দর এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। এই নির্বাসিতা রাণীর পুত্রই রাজা গোবিন্দ। গৌড় রাজ্য রাজা গৌড়গোবিন্দের শাসনাধীন ছিল। গোবিন্দ কোন নির্দিষ্ট রাজার নাম নয়। গৌড়রাজ্যের রাজারা গোবিন্দ উপাধিতে পরিচিত ছিলেন।

গৌড় গোবিন্দের চরিত্রঃ দেবতার ঔরসে জন্ম নেয়া গৌড় অত্যান্ত ধর্মভীরু এবং ন্যায় পরায়ণ শাষক ছিলেন। তিনি রাজ্যের সকল পুরুষদেরঅন্যরাজ্যে ব্যবসা এবং চাকরীর সুযোগকরে দিতেন নিজ রাজ্যের অর্থনৈতিকধারা সুদৃঢ় করার জন্য।  কথিত আছে একদা গৌড় তীর্থ ভ্রমনে গিয়ে বর্তমান বগুড়া জেলায় অবস্থিত পরশুরাম অবতারের অন্যতম জিয়ন কুয়ার সন্ধান স্বপ্নে দর্শন পান,যা ঈঁশা-খাঁ আক্রমণের ভয়ে গো-রক্ত ফেলে নষ্ট করে দিয়েছিলেন।সেখানে অবস্থানরত দুইজন সত্যদ্রষ্টা সাধুকে নিজ রাজ্যে এনে প্রধান উপদেষ্টাজন করে।এইসাধুরাই মুলত প্রাক্তন শ্রী হট্টের উন্নয়ন এবং গৌড়ের ধ্বংসের কারন। এরা প্রায়সই গৌড়কে ভুল পথে পরিচালিত করতেন।বেদ মন্ত্রদ্বারা পোষ্য একাধিক বাজ পাখি রাজ্যের সর্বত্র উড়েবেড়াতো প্রজাদের অবস্থা দর্শনের জন্য।এর মধ্যে একবার গৌড় রাজ্যে খড়াদেখা দেয়,উপদেষ্টা সাধুদের পরামর্শে গৌড় সারা রাজ্যে গো-হত্যা মৃত্যুতুল্য শমন জারী করে।এরই মধ্যেউক্ত সিলেটের বর্তমান যেটি জালালাবাদ পাহাড়,সেই পাহাড়ের এক অগ্যাত স্থানে এক যবন, পুত্রপ্রাপ্তির শোকরানা স্বরুপ গোপনে গরু জবাই করে।গৌড়ের বাজপাখি তা দেখে এক টুকরা গো মাংস মুখে নিয়ে গৌড়ের কাছে নিয়ে আসে।ক্রোধান্বিত গৌড় সৈনিক পাঠিয়ে উক্ত ব্যক্তিকে ধরে আনে এবং দেশদ্রোহী (যেহেতু রাজ্যের খড়া দুরীকরনে গো-হত্যা নিষিদ্ধ হয়েছিলো) আখ্যা দিয়ে তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়।কিন্তু উপদেষ্টা সাধুরা গৌড়কে জানায় উক্ত ব্যক্তিকে হত্যা না করে তার সদ্যজাত সন্তানকে হত্যা করলে সবচেয়ে ভাল হবে।অত:পর গৌড় তাইকরে উক্ত ব্যক্তিকে রাজ্য থেকে  বহিস্কার করে।উক্তব্যক্তি তখন বড়পীড় আব্দুলকাদের জিলানীর নিকট আশ্রয় নেয় এবং গৌড়ের রাজ্য সম্পুর্ন ইসলাম বিরোধী সে বিষয়ে বড়পীরকে অবহিত করে।বড়পীর তখন শাহজালাল কে তুরস্ক থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দ্যেশে গৌড়ের রাজ্যে প্রেরন করে এবং এখান থেকেই ইতিহাস বিকৃতি শুরু হয়।

 

যুদ্ধের কৌশল নির্ধারনে ভুলঃ শাহজালাল সুরমা পাড়ি দেবার আগেই সাধুরা ধ্যানবলে তা জানতে পেরে গৌড়কে অবহিত করে।গৌড় তখন সুরমার চারদিকে সৈন্যদের প্রেরন করে এক দুর্গ গড়ে তোলে। একই সাথে শাহজালালের জাহাজ ধ্বংস করতে বৈদিক গাণিতিক সুত্র ব্যবহার করে উপদেষ্টা সাধুরা প্রাসাদের মাথায় কয়েকটি বিশালাকার আয়না স্থাপনকরে যার মধ্যে সুর্যের আলোকেপ্রতিফলিত করে জাহাযে আগুন ধরিয়ে দেয়া যেত( অর্কিমিডিস এর সুত্রজানা আছে তো? পদার্থ বিজ্ঞ্যানে লেন্সের প্রতিফলনে এর ধারনা পাওয়া যাবে)

শাহজালালকে যুদ্ধে পরাস্থ করতে ক্রোধান্ধ সাধুরা ২য় মারাত্বক ভুল কৌশল অবলম্বন করেছিলো যা শাহজালালকে শুধু নয়,সমস্ত যুদ্ধের ইতিহাসে ন্যাক্কারজনক এবং গৌড়ের গৌরবকে অনেকটাই হীন করে দিয়েছিলো, তা হলো শত শত উলঙ্গ নারী,যারা সৈন্যদের প্রথম সারিতে ছিলো।কারন উপদেষ্টাধী জানতেন শাহজালাল বা তার কোন সাহাবীই উলঙ্গ শরীরের দিকে তাকাবে না।সেই সুযোগে তাদের হত্যা করা সহজ হবে।রাজা গৌড় রাজ্যের মানুষদের রক্ষায় সব কিছু নিরবে মেনে নেন এবং যুদ্ধেরজন্য প্রস্তুত নেন। প্রকৃত যুদ্ধ শাহজালাল ভারতের পূর্বাংশ দিয়ে সিলেটের দিকে যাত্রা শুরু করেন। পথে  চাশনী পীরসহ আরও বেশ কয়েকজন দরবেশ তার সফরসঙ্গী হন। দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া তাঁর আধ্যাত্নিক ক্ষমতার প্রমান পেয়ে এক জোড়া পায়রা উপহারদেন। পায়রা গুলির বংশধররা স্থানীয়ভাবে 'জালালি কবুতর' নামে পরিচিত ।

শ্রীভূমি (সিলেট)পর্যন্ত পৌঁছাতে শাহজালাল(রাঃ) এর শিষ্য সঙ্গীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮০ জন। উক্ত ৩৮০ জনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যোদ্ধারা হলেন শাহপরাণ,  খল্লা শাহ  কাশেম শাহ।কিন্তু সুরমা পাড়ি দেবার সময়প্রতিফলিত আলোকরশ্মি এসে একটিবহরের ২০ জন সাহাবীকেই মেরেফেলে। এতে প্রধান প্রধান কিছু আউলিয়া মারা যান।ক্রোধে শাহ পরানমামা  শাহজালালের কাছে গৌড়কে হত্যার অনুমতি চাইলে মামা বাধা দিয়ে বলেন এতে গৌড়ের কোন দোষ নেই।সে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নয়,রাজ্যের মানুষকে বাঁচানোর জন্য ভুলভাবে যুদ্ধ করছে।  শাহজালাল দ্রুত নৌবহর ঘুড়িয়ে সন্ধার পর যাত্রা করে ভোর রাতে সিলেটে প্রবেশ করেন। এইদিকে চারদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, সৈন্যদের চোখ ফাকি দিয়ে জেলের ভেক ধারন করে শাহজালাল জালালাবাদ পাহাড়ে গিয়ে অবস্থান নেন এবং ফযরের আযান দেন। এই সময় নামায শেষ করে কিছু সাহাবী তীক্ষ্ণ তীর শলাকা নিক্ষেপ করে প্রাসদের উপরে রাখা বিশালাকার আয়না গুলো ধ্বংস করে দেয়(মুসলিমরা দাবী করে আযানের শব্দে প্রাসাদ কেঁপে উঠেছিলো এবং আয়না ভেংগে গিয়েছিলো, কিন্তু তা সঠিক নয়।বিশালাকার আয়না বিশাল কোন বস্তু দূর থেকে নিক্ষেপ করে ভাংগা যায় না।কাঁচের কোন বস্তুকে সম্পুর্ণ ধ্বংস করতে হলে চিকন কিছু দিয়ে যত দূর থেকে নিক্ষেপ করবেন,ততোই দ্রুত এর মধ্যকার বন্ধন ভেংগে কাঁচ দ্রুত চুরমাচুর হয়ে যাবে, এটাই বিজ্ঞান বলে)এরপরেই শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।১ম যুদ্ধে উলজ্ঞ নারী দেখে  শাহজালাল সবাইকে চোখ বন্ধ করে যুদ্ধ করার আদেশ দেন এবং সবাই তা করে। শাহজালাল সৈনিকদের শেষ প্রান্তে ছিলেন। ১ম সারিতে থাকা অর্ধেক সৈন্যই যুদ্ধে মারা যায়। অত্যান্ত কৌশলে এবং চতুরতার সাথে তিনি মাত্র ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে এই যুদ্ধে জয়লাভ করলেও খল্লাশাহ, কাশেম শাহ সহ সুলতানশাহের মত অনেক সাহাবীদের হারাণ।ইতিমধ্যেই  শাহজালাল পায়রা মারফত খবর পাঠিয়ে আরো আওলাদ নিয়ে আসতে বড়পীরকে বিশেষ ভাবেঅনুরোধ করলে ঝাঁকেঝাঁকে পীর,মুর্শিদি আসতে থাকে।চারদিক থেকে সিলেটে মুসলীম আওলাদরা এসে যুদ্ধে যোগদান করেন।সেনাদের হত্যা,রশদ ভেংগে দেয়া,খাদ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা,চোরাগুপ্তা হামলা প্রভৃতি দুই দলই সমানে চালালো।এরমধ্যে রাজ্যে অবস্থানরত অন্যন্য যবন যুবকরাও মিলে গৌড়ের বিরুদ্ধে দূর্গের ভিতরই যুদ্ধ শুরু করে দেয়ায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। সৈনিকদের মধ্যে যারা ভিন্ন ধর্মের ছিলো এবং হিন্দু ছিলো তাদের মুসলিম সৈন্য দলরা হত্যা করা শুরু করলো।এমতাবস্থায় গৌড় সম্পুর্ণ দিশেহারা হয়ে যান।কারন দেশ রক্ষার যুদ্ধের বদলে ধর্ম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।তিনি দ্রুত বাজ পাখি মারফত পাশ্ববর্তী রাজ্যে সাহায্যের চিঠি পাঠালেও প্রত্যেকটি বাজকে তীর বিদ্ধ করে মারা হয়।এছাড়াও গৌড়ের নিজস্ব ১২জন দূতকে হত্যা করা হয়।রাজ্যে চরম অস্থিতিশীলতা তৈরী হয়।সমস্ত মুসলিম প্রজারা এবার যার যার অবস্থান থেকেই বিদ্রোহ শুরু করে দেয়।সেই যুদ্ধে শাহজালালের বাহিনী তীব্র থেকেও তীব্রতর হয়ে ওঠে।তারা ঐরাজ্যে অবস্থানরত মুসাফির,অন্যরাজ্যের দুত এবং ভিনদেশী ব্যবসায়ী ও পরিব্রাজক ছাড়া সকলকেই হত্যা শুরু করে।যুদ্ধের কৌশলেও এবার পরিবর্তন আনেন।এবার সরাসরি সৈনিকের বক্ষে তীর নিক্ষেপ নাকরে সৈনিকের বাহনে তীর নিক্ষপের বুহ্য সাজালেন।এতে খুব সহজেই অল্পসময়েই অনেক সৈন্য মরতে লাগলো।ক্রমেই  গৌড়ের শক্তি হ্রাস পাচ্ছিলো।গৌড়ের বিশ্বাসী ২০ দেহরক্ষীর মধ্যে কালা মিয়া নামের এক মুসলিম ছিলো।শেষ পর্যন্ত সেই জীবিত ছিলো।প্রভুভক্ত কালা মিয়া  গৌড়কে ছদ্মবেশ ধরিয়ে নিজের ভাই এবং গৌড়ের স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী বানিয়ে রাতে মহল থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরই শাহপরাণ মহল আক্রমন করেন এবং একজন মুসলিম ভৃত্য শাহপরাণকে কালামিয়ার ব্যাপারে বলে দেয়।ক্ষিপ্ত শাহপরাণ উক্ত ভৃত্যকে নিয়ে খুঁজতে বের হলেন।ঐদিকে কালা মিয়া  গৌড়কে নিরাপদে পেঁচাগড়ে পৌছে দিয়ে ফিরে আসার সময়  শাহ পরাণের হাতে ধরা পরেন।কালা মিয়া সালাম করার ভংগিতে ঐ ভৃত্যকে হত্যা করেন এই ভেবে যে যদি সে শাহ-পরাণকে পেঁচাগড়ের ঠিকানা বলে দেয় তাহলে  গৌড়কে আর বাঁচানো যাবে না। ভৃত্যকে খুন করতে দেখে  শাহপরাণ কালামিয়াকেও বর্শা দিয়ে হত্যা করেন।

গৌড়ের অনুপস্থিতি  শাহজালালের বিজয় নির্দেশ করে।সমগ্র সিলেটতিনি নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসেন।তবে যে পরিব্রাজক এই যুদ্ধের কাহানী ঐ স্থানে থেকে লিখেছেন,একই সময় আরো এক ব্যবসায়ী যুদ্ধের বিভিন্ন বার্তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তারমতে, গৌড়ের সরোবরে পরশুরামের জিয়ন কুয়াহতে আনা স্বর্ণের কৈ এবং মাগুর মাছ ছিলো। যা যুদ্ধের পর প্রথম শাহপরাণ দেখতে পান এবং মামা শাহজালালকে উপহার স্বরুপ প্রদান করেন। এছাড়াও তার ভাষ্যমতে কালামিয়াকে বর্তমান হবিগঞ্জজেলা বাজারে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।তার দেহ যখন কুমীরকে দিয়ে খাওয়ানোর জন্য সুরমা নদীতে নিয়ে ফেলা হয়,তখন  গৌড় গোবিন্দের ১মযুদ্ধে নিহত শাহজালালের প্রধান সেনাপতি  খল্লাশাহর ছিন্ন মস্তক উদ্ধার করে সিলেটে তার ১ম মাজার একটি জৈন মন্দির ভেংগে করা হয়।

শেষমেশ  গৌড় গোবিন্দের কি হয়েছিলো তা জানা যায় নি। শাহজালাল সিলেটে দীর্ঘ ৩০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। গৌড় গোবিন্দের মাথার বিনিময়ে গ্রাম ঘোষনা করা হয়েছিলো।তথাপি তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।সেই সময় শ্রীহট্ট ছেড়ে অনেক হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈনরা পালিয়ে যান।পরবর্তিতে ঘোষনা করা হয় গৌড় গোবিন্দকে হত্যা করা হয়েছে।কিন্তু তার কোন উপযুক্ত প্রমান নেই।ঐতিহাসিকদের মতে, গৌড় মানষিকভাবে প্রচন্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।পেঁচাগড় থেকে তিনি হয়তো তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ভারত বা অন্যকোন জায়গায় চলে গিয়েছিলেন।কারন যুদ্ধের এক বছর পর গৌড়ের ব্যবহৃত একটি হার এক ব্যক্তির নিকট পাওয়া যায়,সে দাবী করেছিলো উক্ত হারটি এক ব্যক্তি তার অশ্বালয় থেকে একটি তেজী ঘোড়ার বিনিময়ে নিয়েছিলেন।রাত্রী ছিলো বলে তিনি তাঁকে চিনতে না পারলেও সেই ব্যক্তির কথা বার্তা অন্যরকম ছিলো।সেই স্থান ত্যাগের আগে তিনি শ্রীহট্ট মুখী হয়ে ক্রদন করেছিলেন,এবং বলেছিলেন ‘আজ যদি আমার কোন বংশধর থাকতো,তা হলে আমার এই পরাজয়ের শোধ নিত। হে পিনাকনাথ,যদি মন দিয়ে তোমার সেবা দিয়ে থাকি,আমার পিতারচরের এই রাজ্য যেন যবন প্রসুত হয়ে সমুদ্রেচলে যায়,অথবা এমন কাউকে পাঠিয়ো,যে গোবিন্দ বংশীয় না হয়েও এইঅন্যায়ের শোধ তুলবে।’ উক্ত ব্যক্তির ভাষ্য সত্য না মিথ্যা তার কোন প্রমান নেই।কিন্তু অত্যান্ত দুখাতুর ভাবে একজন দেশপ্রেমিক আর্যের নিরবে পরাজয় ঘটলো।ইতিহাস আজ গৌরকে একজন অত্যাচারী রাজা হিসেবে জানে।কিন্তু বাস্তব সত্য, এই বাংলায় প্রত্যেক হিন্দু শাষকই তাঁদের রাজত্ব শেষ পর্যন্ত যবনদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন।১৩৮৪ খৃষ্টাব্দে সমুদ্র পুত্র আর্যসৈনিক রাজা গৌড়ের শ্রীহট্ট বিজয়ের পর শাহজালাল তাঁর শিষ্য অনুসারীদের বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন। হযরত শাহজালাল(রাঃ)৩২ বছর বয়সে শ্রীহট্ট আগামন করেন এবং ৩০ বছর বাস করার পর ৬২ বছর বয়সে মারা যান।১৩৮৫ সালে শ্রীহট্টের নাম পরিবর্তন করে "শিলাচট্টল" এবং পরে সিলেট রাখা হয়।খন্ডিত কাহিনী গুলো নিয়ে জোড়া বানালাম।লাইব্রেরিতে নিচের বইগুলো পেলে সব পেয়ে যাবেন।কিভাবে একজন ব্যক্তিকে পরাজিত করে অন্যায় ভাবে অপদস্ত করে জগতের চোখে তাকে ঘৃনিত করা হয়।

তথ্যসুত্রঃ

১) বাংলার ইসলামী আন্দোলন

২)ভক্তি ধর্ম আন্দোলন

৩)আজিমির চিস্তির জীবনকাহিনী

৪)World Sunni Saints in Bangla

৫) Hu An Sung Bangladesh Saint war

 

শিবতত্ত্বে সৃষ্টি, সংহার ও রক্ষা – শ্রীকণ্ঠ ও পুরাণসমূহের আলোক

শৈব দর্শনে শিব কেবল একজন উপাস্য দেবতা নন—তিনি নিজেই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পরম ব্রহ্ম । তিনিই এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূল কেন্দ্র...

Popular Posts