Friday, June 6, 2025

শিবই পরম ব্রহ্ম – শ্রীকণ্ঠাচার্যের দর্শনের আলোকে

 

ভূমিকা

হিন্দু দর্শনে “পরম ব্রহ্ম” ধারণাটি হলো সেই চূড়ান্ত বাস্তবতা, যেখান থেকে সব সৃষ্টি উৎপন্ন, যার মধ্যে সবকিছু অবস্থান করছে এবং যার মধ্যেই সবকিছু বিলীন হয়। বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ ব্রহ্মসূত্র এই ব্রহ্মতত্ত্বকে বিশ্লেষণ করে। শঙ্করাচার্য নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মরূপে তাঁর ব্যাখ্যা দেন। রামানুজাচার্য বিষ্ণুকে সগুণ পরম ব্রহ্মরূপে স্থাপন করেন।

কিন্তু অনেকেই জানেন না, দক্ষিণ ভারতের মহান শৈব দার্শনিক শ্রীকণ্ঠাচার্য এই ব্রহ্মসূত্রকেই ব্যাখ্যা করে শিবকে সর্বোচ্চ ব্রহ্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা দেখব – কিভাবে শ্রীকণ্ঠের দর্শনে শিব পরম ব্রহ্ম, এবং এই মত কিভাবে শাস্ত্রসম্মত।

শ্রীকণ্ঠাচার্যের শৈব-বিষিষ্টাদ্বৈত দর্শন

শ্রীকণ্ঠাচার্য "শৈব- বিষিষ্টাদ্বৈত" নামক একটি দার্শনিক অবস্থান প্রস্তাব করেন, যেখানে তিনি নিম্নোক্ত ধারণাগুলো স্পষ্ট করেন:

  • শিবই পরম ব্রহ্ম: ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে তিনি বলেন –

    “शिव एव परं ब्रह्म।”
    অর্থাৎ, শিবই পরম ব্রহ্ম।

  • জীব ও জগত শিবের গুণস্বরূপ: জীবাত্মা ও জড় প্রকৃতি, উভয়ই শিবের অধীন – তবে শিবের মত স্বয়ম্ভূ নয়।

  • সগুণ-নিগুণ সমন্বয়: শিবের এক দিকে নির্গুণ – কারণ তিনি অতীত, অনন্ত, রূপ-রহিত। কিন্তু তাঁর ইচ্ছাশক্তি, করুণাশক্তি, অনুগ্রহ ইত্যাদির কারণে তিনি সগুণ রূপেও প্রকাশিত।

এখানে, শিব কেবল “সৃষ্টিকর্তা” নন, বরং তিনিই সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান, পরম সত্তা

ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে শিব

ব্রহ্মসূত্রের প্রথম সূত্র –

“अथातो ब्रह्मजिज्ञासा।”
অর্থাৎ, “এবার ব্রহ্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা শুরু হোক।”

এখানে শ্রীকণ্ঠ বলেন –

"ब्रह्म शब्देन शिवपरमेश्वर उच्यते"
অর্থাৎ, “ব্রহ্ম শব্দে শিব পরমেশ্বরই বোঝানো হয়েছে।”

তিনি ব্রহ্মসূত্র ১.১.২-এ (জন্মাদ্যস্য যাতঃ) মন্তব্য করেন:

"यस्मात् शिवात् सर्वस्य उत्पत्तिरादिः"
"শিব হইতে সমস্ত জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়।"

এখানে ব্রহ্মতত্ত্বের তিনটি গুণ – সৃষ্টি, রক্ষণ, লয় – শিবের মধ্যে উপস্থিত, যা তাঁকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর ও ব্রহ্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে।




শাস্ত্রসমূহে শিবতত্ত্ব

১. ঈশ্বরগীতা (কূর্মপুরাণ)

"अहं ब्रह्म परमं, नान्यत् किञ्चित् अस्ति ततः।"
“আমি পরম ব্রহ্ম — এর বাইরে কিছুই নেই”

শিব নিজেই এই ঘোষণা দেন ঈশ্বরগীতায়। এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে শিবকে “পরম ব্রহ্ম” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

২. গণপতি অথর্বশীর্ষ উপনিষদ

"त्वं ब्रह्मा त्वं विष्णुस्त्वं रुद्रस्त्वं इन्द्रः..."
তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি রুদ্র, তুমি ইন্দ্র...

এখানে গণপতির রূপে মূলত রুদ্রতত্ত্বকেই ব্রহ্মরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে — যিনি সব দেবতার মধ্যমূলে বিরাজমান।

৩. লিঙ্গ পুরাণ

"शिवो निरगुणः शान्तः साक्षात् परब्रह्म परः।"
শিবই নিগুণ, শান্ত ও পরব্রহ্ম।

এটি পরিস্কারভাবে শিবকে সেই চূড়ান্ত, নির্গুণ পরম ব্রহ্ম বলে স্বীকৃতি দেয়।

৪. শিব পুরাণ

"शिवात् परं नास्ति किंचित्"
“শিবের ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই”

এটি শিবের সর্বোচ্চতা তুলে ধরে এবং তাঁকে চূড়ান্ত পরম সত্তা হিসেবে স্থাপন করে।

৫. স্কন্ধ পুরাণ – লিঙ্গোৎপত্তি খণ্ড

শিবলিঙ্গের উত্থানের কাহিনী যেখানে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু অনন্ত আলোর রূপ খুঁজে পান না, সেখানে বলা হয়:

"नास्ति तत् परं किंचिद् – यत् तद् लिङ्गं महेश्वरम्।"
এই লিঙ্গরূপই পরম — এর ঊর্ধ্বে কিছুই নেই।

এটি প্রমাণ করে, শিবলিঙ্গই সেই চূড়ান্ত রূপ – যা পরব্রহ্ম স্বরূপ।

দর্শনমূলক বিশ্লেষণ

শিব বনাম নির্গুণ ব্রহ্ম

শঙ্করাচার্যের ব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার, অনুভবের বাইরে — কিন্তু শ্রীকণ্ঠ বলেন, ব্রহ্ম যদি সম্পূর্ণ নির্গুণ হয়, তবে তিনি কিভাবে সৃষ্টি, সংহার বা করুণা করেন? তাই তিনি বলেন:

"ब्रह्म सत्-चित्-आनन्द स्वरूपं — तथा इच्छाशक्तियुतम् शिवम्।"

অর্থাৎ, পরম ব্রহ্ম শিব, যিনি সচ্চিদানন্দস্বরূপ ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন।

পরমেশ্বরের ব্যক্তিগততা

শ্রীকণ্ঠের দর্শনে শিব কেবল নিরপেক্ষ তত্ত্ব নয়, তিনি করুণাময়, উপাস্য, এবং মুক্তিদাতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি যোগ ও ভক্তিমূলক সাধনার সঙ্গে সমন্বিত

 শিব তত্ত্ব – আমাদের জীবনে

শিবকে কেবল “তাণ্ডবনৃত্যকারী দেবতা” হিসেবে দেখা নয়, বরং তাঁকে আমাদের নিজের অস্তিত্বের মূলে থাকা চেতনা হিসেবে উপলব্ধি করতে হবে। শিব মানে জ্ঞান, শিব মানে ত্যাগ, শিব মানে দয়া, আবার শিব মানে চিরন্তন শক্তি।

উপনিষদের সহিত সাযুজ্য

"एको रुद्रो न द्वितीयाय तस्थुः।" (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩.২)
“রুদ্র একাই আছেন — তাঁর দ্বিতীয় কেউ নেই।”

এই দৃষ্টিভঙ্গি শৈব অদ্বৈতবাদের মূলে। যেখানে শিবই জগত, জীব, কর্ম ও মুক্তির কেন্দ্রবিন্দু।

উপসংহার

শ্রীকণ্ঠাচার্যের দর্শন আমাদের একটি বিকল্প ও শক্তিশালী পথ দেখায় – যেখানে শিব পরম ব্রহ্ম, নিগুণ-সগুণের এককতায় অভিন্ন, এবং শাস্ত্রসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত।

এই দার্শনিক রূপরেখা শুধুমাত্র তাত্ত্বিক নয়, এটি উপাসক হৃদয়ে গভীর উপলব্ধির জন্ম দেয়। শিব শুধু দেবতা নন – তিনি চেতনার চূড়ান্ত স্তর, তিনি সেই পরম এক, যাঁর দ্বারা ও যাঁর মধ্যে সবকিছু।

শ্লোক স্মরণে রাখুন

"सच्चिदानन्द रूपाय, शिवाय ब्रह्मणे नमः।"
“সচ্চিদানন্দরূপ শিব, যিনি ব্রহ্ম — তাঁকেই প্রণাম।”


শিবতত্ত্বে সৃষ্টি, সংহার ও রক্ষা – শ্রীকণ্ঠ ও পুরাণসমূহের আলোক

শৈব দর্শনে শিব কেবল একজন উপাস্য দেবতা নন—তিনি নিজেই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পরম ব্রহ্ম । তিনিই এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূল কেন্দ্র...

Popular Posts