Saturday, June 7, 2025

শৈবত্বের লক্ষণ ও শিবভক্ত চিনিবার উপায় — আগম ও পুরাণের আলোকে অষ্টবর্ণ ভিত্তিক বিশ্লেষণ

পরমেশ্বর ভগবান, আদিদেব, সকল দেবতা ও জাতির একমাত্র আরাধ্য—সাম্ব সদাশিব। যাঁর চরণাশ্রিত হয়েছেন, তিনি মাহেশ্বর; এবং যিনি মাহেশ্বর, তাঁকে চেনার একমাত্র পন্থা হলো "অষ্টবর্ণ"। এই আটটি মূল লক্ষণ একজন প্রকৃত শৈব ভক্তকে চিহ্নিত করে।

১. অষ্টবর্ণের শ্লোক ও ব্যাখ্যা

মূল শ্লোক:

অষ্টবর্ণং প্রপঞ্চয়েদ্যঃ শৈবঃ স্যাদধিগম্যতাম্।

গুরুলিঙ্গং চ জঙ্গমং ভস্ম মন্ত্রং রুদ্রাক্ষমেব চ।

পাদোদকং নির্মাল্যং চ—এতান্যষ্টবর্ণমুচ্যতে॥

অষ্টবর্ণং বিহীনস্য শৈবস্য নাস্তি কদাচন।

যঃ প্রপঞ্চয়েদষ্টবর্ণং স এব শৈব ইতি স্মৃতঃ॥

সূত্র: শৈব আগম, স্বচ্ছন্দ তন্ত্র, পূর্বখণ্ড ১.১


বাংলা অনুবাদ:

যিনি গুরুরূপ, লিঙ্গ, জঙ্গম, ভস্ম, মন্ত্র, রুদ্রাক্ষ, পাদোদক ও নির্মাল্য—এই আটটি গুণ দৈনন্দিন জীবনে মূর্ত করে তোলেন, তিনিই প্রকৃত শৈব; অন্যথায় শৈবতা অসম্পূর্ণ।


২. গুরু (Guru) — শিবের জীবন্ত প্রতিমূর্তি

শ্লোক ১:

শ্রীগুরুচরণপদ্মে সেবা কুরুতে সदा।

শিবায় তস্য নাস্তি ক্ষতির্নাম কদাচন॥

শ্লোক ২:

শ্রীগুরুরূপে শিবং বিজ্ঞায় সেবতে যত্নতঃ।

শৈবত্বং প্রপঞ্চয়েদ্যঃ সর্বকালেশ্বর ইতি স্মৃতঃ॥

শ্লোক ৩:

শ্রীগুরুচরণাম্ভোজে সেবা কুরুতে সदा যঃ।

তস্য শিবসমো ভাবঃ সর্বদা নির্মলঃ স্মৃতঃ॥

সূত্র: স্বচ্ছন্দ তন্ত্র, পূর্বখণ্ড ৮.১৬.১–৩


ব্যাখ্যা:

যিনি শ্রীগুরুর পদপদ্মে নিরন্তর সেবা করেন, তিনি কখনোই শিবের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন না। যে গুরুরূপে শিবকে উপলব্ধি করে সেবা করেন, তিনিই প্রকৃত শৈব, তাঁর হৃদয় নির্মল ও শিবসমান হয়ে ওঠে।


৩. লিঙ্গ (Liṅga) — শিবভক্তির বহিরপ্রকাশ

শ্লোক ১:

মূর্ধ্নি হৃদয়ে বাহৌ বা যঃ লিঙ্গং ধারয়ন্তি।

তেষাং কালঃ করোতি স্পর্ধামপি ভয়ঙ্করাম॥

সূত্র: গুরু গীতা, শ্লোক ১৬৪


শ্লোক ২:

যেষাং দেহে ন লিঙ্গস্পর্শঃ, তে শ্মশানসংস্থিতাঃ॥

ব্যাখ্যা:

যে ব্যক্তি শরীরে, হৃদয়ে বা মস্তকে শিবলিঙ্গ ধারণ করে, মৃত্যুও তার সামনে ভীত হয়। যাদের দেহে শিবলিঙ্গ নেই, তারা শ্মশানের মতো অপবিত্র বলে বিবেচিত।


৪. জঙ্গম (Jaṅgama) — শিবের সচল রূপ

শ্লোক:

যে জঙ্গমভাবনাভ্রষ্টাঃ কামনায় আসক্তাঃ।

ন তেষাং হৃদয়ে কদাচিদপি ত্রিপুরারী অবস্থিতঃ॥

সূত্র: রুদ্র যামল তন্ত্র, অধ্যায় ৮, শ্লোক ২২


ব্যাখ্যা:

যারা সাধুসঙ্গ বা জঙ্গম ভাবনা থেকে বিচ্যুত, তাদের হৃদয়ে কখনোই শিব বাস করেন না।





৫. ভস্ম (Bhasma) — শিবের চিহ্নস্বরূপ বিভূতি

শ্লোক ১:

যস্য দেহে ভস্মলেপনং নাস্তি, স যমদ্বারং প্রতি গচ্ছতি॥

শ্লোক ২:

ভস্মলেপনমিদং দেহমাশ্রিত্য, পশ্যতি কালঃ—ভয়াত্ত্রস্যতি॥

সূত্র: শিব মহাপুরাণ, রুদ্র সংহিতা, অধ্যায় ১৮

ব্যাখ্যা:

যে ব্যক্তি দেহে ভস্ম (ত্রিপুণ্ড্র) লেপন করেন না, মৃত্যু তার জন্য অবধারিত। আর যে এই ভস্ম ধারণ করে, তাকে মৃত্যু পর্যন্ত ভয় করে।


৬. মন্ত্র (Mantra) — পঞ্চাক্ষরী 'নমঃ শিবায়'

শ্লোক:

যস্য মুখে নাস্তি “নমঃ শিবায়” ইতি পঞ্চাক্ষরং।

তস্য মুখং শাপিতং শুষ্কমরুভূমিসমং স্মৃতং॥

সূত্র: গুরু গীতা, শ্লোক ৯৮


ব্যাখ্যা:

যে ব্যক্তির মুখে ‘নমঃ শিবায়’ ধ্বনিত হয় না, সেই মুখ অভিশপ্ত ও শুষ্ক মরুভূমির মতো নির্জীব।


৭. রুদ্রাক্ষ (Rudrākṣa) — ভক্তির অনিবার্য প্রতীক

শ্লোক ১:

যস্য সর্বাঙ্গে রুদ্রাক্ষঃ সন্নিবদ্ধঃ সदा।

ন তং হন্তি কো’পি, সম্পূর্ণং ত্রিলোক্যেষু চ॥

শ্লোক ২:

যঃ রুদ্রাক্ষবিদ্বেষী, স ত্রিলোকেষু ন রক্ষিতঃ॥

সূত্র: পদ্ম পুরাণ, উত্তর খণ্ড, শ্লোক ৫৪.৮৮


ব্যাখ্যা:

যিনি সর্বাঙ্গে রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন, তাঁকে ত্রিলোকে কেউই ক্ষতি করতে পারে না। আর যারা রুদ্রাক্ষ অবজ্ঞা করে, তারা রক্ষাহীন হয়ে পড়ে।


৮. পাদোদক ও নির্মাল্য (Pādodaka & Nirmālya)

শ্লোক (পাদোদক):

যে আচার্যচরণাম্বুজাৎ নির্গতামৃতং পিবন্তি।

ন তং অজ্ঞানরূপং তমঃ স্পৃশতি কদাচন॥

সূত্র: গুরু গীতা, শ্লোক ২৮৫


শ্লোক (নির্মাল্য):

যে নির্মাল্যাত্পরিত্যক্তাঃ, শুষ্কাঃ তে মরুভূমিসমা ইতি।

যে দূরস্থাত্ অপি নির্মাল্যং প্রণমন্তি, তু তে শিবত্বং লভন্তে॥

 সূত্র: কুলার্ণব তন্ত্র, অধ্যায় ১২


ব্যাখ্যা:

যিনি গুরুর চরণামৃত পান করেন, তাঁকে অজ্ঞান ছুঁতে পারে না। আর যে ব্যক্তি দূর থেকেও নির্মাল্যকে প্রণাম করে, সেও শিবত্ব লাভ করেন।



এই অষ্টবর্ণ—গুরুসেবা, লিঙ্গধারণ, জঙ্গমসঙ্গ, ভস্মলেপন, পঞ্চাক্ষরী মন্ত্রজপ, রুদ্রাক্ষধারণ, পাদোদক পান ও নির্মাল্য প্রণাম—শিবভক্তির মূল চিহ্ন। এগুলো যার জীবনে দৃঢ়ভাবে বিরাজমান, তিনিই প্রকৃত শৈব এবং তিনি অদ্বিতীয় শৈবত্বে প্রতিষ্ঠিত হন।


শিবতত্ত্বে সৃষ্টি, সংহার ও রক্ষা – শ্রীকণ্ঠ ও পুরাণসমূহের আলোক

শৈব দর্শনে শিব কেবল একজন উপাস্য দেবতা নন—তিনি নিজেই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পরম ব্রহ্ম । তিনিই এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূল কেন্দ্র...

Popular Posts