অশ্বিনী কুমারদ্বয়।সনাতন দেব পরম্পরার মহত্তপূর্ণ দুইজন দেবতা।সনাতনের সবচেয়ে প্রাচীন শাস্ত্রে যে তেত্রিশ জন বা কোটী দেবতার উল্লেখ রয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম এই দুই দেব।পবিত্র বেদের সংহিতা ভাগ থেকে বেদের ব্রাহ্মণভাগ,সুপ্রাচীন বৃহদ্দেবতা থেকে পুরান মহাপুরাণ উপপুরাণ, লোককথা সব জায়গায় রয়েছে এই দুইজন দেবের মাহাত্ম্য।
অশ্বিনী কুমারদের পরিচয় দিতে গিয়ে পৃথিবীর প্রথম লিখিত সাহিত্য গ্রন্থ পবিত্র ঋগ্বেদ জানাচ্ছে...
"ত্বষ্টা দুহিত্রে বহতু কৃণোতীতীদং বিশ্বংভূবংসমেতি।
যমস্য মাতা পর্যহ্যমানা মহো জায়া বিবস্বতে ননাস।।
অপাগৃহন্নমৃতাং মত্যের্ভ্যুঃ কৃত্বী সর্বন্নামদদুবিবস্বতে।
উতাশ্বিনাবভরদ্যওদাসীদজহাদু দ্বা মিথুনাসকন্যঃ।।[ঋগ্বেদ ১০/১৭/১-২]
ভাবার্থ-ত্বষ্টা দেব বিশ্বকর্মা নিজ কন্যা সুরণ্য সংজ্ঞা কে বিবস্বান সূর্যের সাথে বিবাহ দিলে যম দেবের জন্ম হয়।পরবর্তীতে সঙ্ঘা অদর্শন হইলে, তার মতো এক দিব্য নারীর সৃষ্টি করা হয় যাহা হতে অশ্বিনীকুমারদ্বয় দেবগণ জন্মগ্রহণ করেন।।
বৈদিক সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ বৃহদ্দেবতা। মহর্ষি শৌনক রচিত এই গ্রন্থের রচনা আনুমানিক ১৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ।অর্থাৎ আজকে থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। সুপ্রাচীন এই বৈদিক শাস্ত্রের মত প্রায়ই ঋগ্বেদের মতো একই। বৃহদ্দেবতাকার জানাচ্ছেন,
"সরণ্যশ্চ বিবস্বস্তং বিদিত্বা হয়রূপিণম্। মৈথুনায়োপচক্রাম তাঞ্চ তত্রারূরোহ সঃ ॥
ততস্তয়োত্ত্ব বেগেন শুক্রং তদপতত্ত্ববি।
উপাজিমুচ্চ সা তথা তদুক্ৰং গর্ভকামায়া ৷৷ আঘাতমাত্রাচ্ছক্রান্তু কুমারৌ সংবভূবতুঃ।
নাসত্যশ্চৈব দশ্চ যৌ খ্যাতাবশ্বিনাবিতি ৷।
[বৃহদ্দেবতাঃ৭.১-৬]
অন্যদিকে মৎস,কূর্ম,বরাহ,বায়ু,স্কন্ধ, ভাগবত, মহাভারত ও রামায়ণ একই সুরে বলছে,
ততঃ স ভগবান্ গত্বা ভুলোকমমরাধিপঃ।
কাময়ামাস কামাৰ্ত্তো মুখ এব দিবাকরঃ।
অশ্বরূপেণ মহতা তেজসা চ সমাবৃতঃ।
সংজ্ঞা চ মনসা ক্ষোভম গমদ্ভয়বিহ্বলা ৷৷
নাসাপুটাভ্যামুৎসৃষ্টং পরো’য়মিতি শঙ্কয়া ।
তদ্ৰেতসম্ভৃতো জাতাবশ্বিনাবিতি নিশ্চিতম্ ৷৷
দত্রৌ দ্রুতত্বাৎ সঞ্জাতৌ নাসত্যৌনাসিকাগ্রতঃ।
[ মৎস্য পু. ১১.৩৪-৩৬]
এই যে এতোগুলো শাস্ত্রে তাঁদের পরিচয় দিচ্ছে। এই পরিচয়ের সারসংক্ষেপ হলো, সূর্যদেব ও সঙ্ঘার অশ্ব রুপকালে এই দুই দেবতার জন্ম হয়।পার্থক্য শুধু সংঙ্ঘা দেবীকে কোথাও সূরণ্য ডাকা হয়েছে।
আমাদের সমাজে শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ অশ্বিনী কুমার দ্বয় দেবতাকে -" আশ্বিন কুমারী" বলে জানেন। যা নিতান্তই ভুল।শুধু অন্যরা কেন পুরোহিত পণ্ডিত সমাজের অধিকাংশ লোক ও আমরা এই দুই দেবতার আসল নামই জানিনা। এই দুই দেবতার একজন হলেন - নাসত্য, অন্যজনের নাম দস্র।
" দসৌ স্ত্রতত্বাৎ সঞ্জাতৌ নাসতৌ নাসিকাগ্রতঃ।।
[মৎস পুরান -১১/৩৬][বায়ু পুরান-৮৪/২৩-২৪]
তবে খুবই আশ্চর্যের কথা এঁরা দুজন দেবতার সন্তান হয়েও তাঁরা সমাজে যজ্ঞের ভাগ পেতনা। পেতনা সোমরস। দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও ছিলোনা তাঁদের। খোদ মহাভারতের মত গ্রন্থেই তাদের একবার শুদ্র দেবতা বলে ডাকা হয়েছে। পরবর্তী মহর্ষি চ্যাবনকেই দেখতে পাচ্ছি এই দুই দেবতাকে যজ্ঞের ভাগ ও সোমরস দিয়ে দেবত্বে প্রতিষ্ঠা করতে।
- অশ্বিনৌ তু স্মৃতৌ শূদ্রৌ তপস্যূগ্রে সমাস্থিতৌ।
[মহাভারত-১২.২০২.২৩]
অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে দেব বৈদ্য বা চিকিৎসক বলা হয়।
আমাদের ভারতবর্ষে প্রাচীন কাল থেকে মধ্যকাল পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ব্রাহ্মণরা বৈদ্য বা চিকিৎসা করত তাঁদের প্রচন্ডরকম সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতেন।সমাজে তাঁদের সম্মানের চোখে দেখা হতো না। স্মৃতিশাস্ত্রে এমন ভুঁড়ি ভুঁড়ি উদাহারন দেওয়া যায় যেখানে বৈদ্য ও চিকিৎসকদের নিচু করে দেখানো হয়েছে সামাজিক ভাবে।আমরা এই সামাজিক অবহেলারই পূর্ব প্রতিরূপ খুঁজে পাই অশ্বিনীকুমার এবং চ্যবন ঋষির ঘঠনায়। যেখানে সোমযজ্ঞে ইন্দ্রের সমান মর্যাদা দেওয়া হচ্ছেনা এই দুই দেবকে।পরবর্তীতে তাঁরা পূর্ন দেবতার মর্যাদা হয়তো পেয়েছেন। বেদের ব্রাহ্মণ ভাগেও আমরা এই দুই দেবকে চিকিৎসক হিসেবে দেখতে পাই.
-অশ্বিনৌ বৈ দেবানাং ভিষজৌ।।
[ঐতেরেয় ব্রাম্মণ-১ম খন্ড -১/১/১৮]
শুধু তাই নয়,পাঠক জেনে অবাক হবেন পৃথিবীর অনেক বড় বড় সভ্যতা যখন শুধুমাত্র লতাপাতা কিংবা তাবিজ-কবজ দিয়ে চিকিৎসা করাতো, তখন ভারতবর্ষের আর্যরা কৃত্রিম হাত পা লাগানোর চর্চ্চা করছে। অবাস্তব নয়, স্বয়ং ঋগ্বেদেই আমরা অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে সর্বপ্রথম কৃত্রিম পা সংযোজন কারী অর্থোপেডিক্স সার্জারী চিকিৎসক হিসেবে দেখতে পাচ্ছি, যা বিশেষজ্ঞ মহলে বহুল আলোচিত।
ঋগ্বেদের সময়ে খেল নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর কুলপুরোহিত ছিলেন অগস্ত্য। খেলের স্ত্রীর নাম ছিল বিশপলা। কোনো সময় এক যুদ্ধকালে বিশপলার একটি পা কাটা যায়। তিনি নিজেই যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন কিনা, সেটা বোঝা যায় না। বিষ্পলার পায়ের জন্য অগস্ত্য ঋষি অশ্বিনীকুমারদের স্তুতি করেন। তারপর দেখা যায় অশ্বিনীকুমারেরা রাতের কালে এসে বিশ্বলার পা-টাকে লোহার পায়ে সংযুক্ত করে দিলেন।
-" সদ্যো জঙ্গামায়সীং বিশাপলায়ে।ধনেহিতৈ সর্তবে প্রতৈধতম্।।
[ঋগ্বেদ -১/১১৬/৫-২৪]
মহাভারত কালীন সময়েও, দুই দেবতার চেহারা হিরন্ময় সূর্যের মতো উজ্জ্বল এব অল্পবয়সী তরুণের মতো ভীষণ সুন্দর বলে লোকে জানতো।তাই অশ্বিনীকুমারদের সৌন্দর্য্যের ব্যাপারটা ইতিহাস পুরাণেও বিখ্যাত হয়ে আছে। মহাভারতে দুই অশ্বিনীকুমারের তেজে পান্ডুর পত্নী মাদ্রীর গর্ভে নকুল-সহদেবের জন্ম হয়। এই যমজ ভাইয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল-তাঁরা অসাধারণ সুন্দর দেখতে -রূপেণাপ্রতিমৌ ভুবি। তাঁদের জন্মের সময় আকাশবাণী হল- অসামান্য রূপ, উৎসাহ এবং শৌর্য্যাদিগুণযুক্ত এই দুটি বালক যথাসময়ে আপন রূপ এবং তেজে দুই অশ্বিনীকুমারকেও ছাড়িয়ে যাবে- রূপসত্ত্বগুণোপেতাবেতাবত্যশ্বিনাবিতি। ভাসতস্তেজসাত্যর্থং রূপদ্রবিণসম্পদা ।।
[ মহভারত- ১.১১৮.১৭-১৯; মৎস্য পৃ. ৪৬.১০; ৫০.৫০]
এখনো ভারতবর্ষের মায়ের এই দুই দেবতার মতো সুন্দর সন্তান কামনায় পুজো করেন। আর কামনা করেন যাতে এই দেবতাদের দ্বারাই তাঁর সন্তানেরা সব রোগ থেকে মুক্ত থাকে।
এছাড়া যদুবংশ ধ্বংস হবার কিছুদিন আগে ইন্দ্র প্রভৃতি বিশিষ্ট দেবতারা দ্বারকায় এসে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন এবং কৃষ্ণকে তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠলোকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। এই সময় অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে অশ্বিনীকুমাররাও কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
[ভাগবত পু. ১১.৬.২]
অন্যদিকে, রাবনের সাথে দেবতাদের যুদ্ধ,বৃষপর্বা নামের দৈত্যের যুদ্ধের দিন ও আমরা এই দুই দেবতার প্রবল পরাক্রম দেখতে পাচ্ছি। বৈদ্য বা চিকিৎসক হলেই যে তিনি দূর্বল হবেন বা যুদ্ধ করতে পারেন না এমন ধারণা মিথ্যা করে দিয়ে এই অশ্বিনীকুমার রা সেদিন তাঁদের পরাক্রম দিয়ে সম্পূর্ণ দেব সমাজকেই অবাক করেছিলো।
কথিত আছে, সূর্য ও সঙ্ঘা শিবতেজ সম্পন্ন সবচেয়ে সুন্দর রুপের পুত্র লাভার্থে দেবী ভগবতীর কাছে গেলে ভগবতী তাঁদের দুইমুষ্টি তন্ডুল বা চাউল দিয়ে বলেন,আশ্বিন নবরাত্রি শেষে আশ্বিনের শেষদিনে তাঁরা যেনো এই চাউল রান্না করে কার্ত্তিকের প্রথমদিনে তাঁ ভক্ষন করে।তবেই তাঁদের মনের আশা পূর্ণ হবে।
পরবর্তীতে দেবীর কথামত এই নিয়ম পালন করলে অশ্বরুপে অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের জন্ম হয়।এখোনো সনাতন সমাজের মায়েরা সন্তান লাভ বা সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত করেন।মা সন্তানের আশায় বা সন্তানের জন্য যেকোনো বর প্রার্থনা করলে শীঘ্রই তা পূরণ হয়।মায়েরা বলেন,
"আশ্বিনে রাধে কার্তিকে খায়,
যে বর মাঁগে, সে বর পায়"
অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ধ্যান...
- ওঁ আশ্বিনেয়ৌ মহাভাগৌ বন্ধ্যা-পুত্রবর প্রদৌ। দ্বিভুজৌ পদ্মনয়নৌ শরদিন্দু সমগ্রতৌ। সূর্য্যপুত্রৌ স্বৰ্গবৈদ্যৈ প্রমেয়ৈ কমলাননৌ । ধায়ত্তৌ নাসিকা জাতৌ রোগ-শোক নিবারকৌ।।
সজলান্ন নিবেদন মন্ত্রঃ
"ওঁ এতানি ধাতবঃ পাত্রস্থ সজল সোপকরণ সিদ্ধান্নাণি অশ্বিনী কুমারাভ্যাং নমঃ ।।
প্রণাম - ওঁ জয়ো রবিনন্দনৈব কবস্থশ্চন্দ্র শেখর।নাসাবাভ্য মশ্বাভ্যাং স্বর্গ-বৈদ্যভাং নমোনমঃ ।।
তথ্যসূত্রঃ
১.ঋগ্বেদ -রামকৃষ্ণ মিশন অনুবাদিত।পশ্চিমবঙ্গ।
২.ঐতৈরেয় ব্রাহ্মণ-রামকৃষ্ণমিশন অনুবাদিত।বেলুড়মঠ,পশ্চিমবঙ্গ।
৩.বৃহদ্দেবতা-অশোককুমার চট্টোপাধ্যায়।
৪.মৎসপুরান-পঞ্চানন তর্করত্ন -নবভারত পাবলিশার্স।
৫.বায়ু,কূর্ম,বরাহ, স্কন্দ পুরান-পঞ্চাননতর্করত্ন।
৬.মহাভারত -হরিসিদ্ধান্ত বাগীশ ভট্টাচার্য।