Saturday, December 2, 2023

অভিনবগুপ্ত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা


৭৬১ সালের আগে, ৭২৪ সালের পরে কোনো এক সময়ে আজকের উত্তরপ্রদেশের গঙ্গ-যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চল, যাকে পূর্বে মধ্যদেশ বা অন্তর্বেদী বলা হত, সেই অন্তর্বেদী থেকে কাশ্মীরের মহারাজ মুক্তাপীড় ললিতাদিত্য (৭২৪-৭৬০) নিয়ে আসেন সপরিবার এক শৈব ব্রাহ্মণকে। তিনি অত্রিগুপ্ত। গোত্র – অত্রি। এঁর উত্তরপুরুষই হলেন মহামাহেশ্বর আচার্য অভিনবগুপ্ত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাঁর শিষ্য প্রশিষ্যাদিক্রমে তাঁকে অভিনবগুপ্তপাদ বা অভিনবগুপ্তনাথও বলা হয়ে থাকে। অভিনবগুপ্ত তাঁর এই পূর্বপুরুষ সম্বন্ধে বলছেন (তন্ত্রালোক, ৩৭.৩৮) – 

নিঃশেষশাস্ত্রসদনং কিল মধ্যদেশ-

স্তস্মিন্নজায়ত গুণাভ্যধিকো দ্বিজন্মা ।

কোঽপ্যত্রিগুপ্ত ইতি নামনিরুক্তগোত্রঃ

শাস্ত্রাব্ধিচর্বণকলোদ্যদগস্ত্যগোত্রঃ ॥

মধ্যদেশ হল সমস্ত শাস্ত্রের (বিদ্যার) আলয়। সেখানে একজন অতিগুণবান কোনো এক বিপ্র জন্ম গ্রহণ করেছিলেন যাঁর নাম ছিল অত্রিগুপ্ত। তাঁর নামই তাঁর গোত্রকে বলে (অর্থাৎ তাঁর গোত্র অত্রি, বা তিনি অত্রিগোত্রীয় ব্রাহ্মণ)। (কিন্তু) শাস্ত্রের সাগরকে তিনি যেভাবে গিলে ফেলেছিলেন তাতে তিনি অগস্ত্যেরই গোত্রীয় বটে।

অভিনবগুপ্ত কত সংখ্যক উত্তরপুরুষ তা জানা যাচ্ছে না। অত্রিগুপ্তের পরেই নাম পাওয়া যাচ্ছে অভিবগুপ্তের ঠাকুরদা বরাহগুপ্তের। এঁর পুত্র নরসিংহগুপ্ত। কাশ্মীর লোকসমাজে এঁর নাম ছিল চুখুলক। ডাক নাম গোছের। নরসিংহগুপ্তের বিবাহ হয় বিমলাদেবীর সঙ্গে। এঁদের সন্তান অভিনবগুপ্ত।

এঁদের নামের সঙ্গে গুপ্তটি এখনকার অমুকচন্দ্র-অমুকনাথ-গোছের। বংশধারায় এমন নাম চলে এসেছে। প্রসঙ্গে বলে রাখি, অভিনবগুপ্তদের পারিবারিক মানুষদের নাম ছাড়াও সমসাময়িক এবং অভিনবপূর্ববর্তী অনেক নাম মেলে যাদের নামের শেষে গুপ্ত-শব্দটি রাখার চল ছিল। এরা একই পরিবারের বিভিন্ন শরিক বা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের একথা চিন্তনীয়। কেউ কেউ শিবসূত্রের রচয়িতা বসুগুপ্তকে অভিনবগুপ্তের একজন পূর্বপুরুষরূপে বলেছেন বটে, তবে এই বিষয়ে কোনো তথ্য প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তাই সেটি গুপ্ত-গুপ্ত-পরিবার গোছের কথা। যাক, এই প্রসঙ্গ নিয়ে আরও বিস্তার করার প্রয়োজন হলে শৈবধারার আলোচানায় করা যাবে।

প্রাচীন আচার্যদের মধ্যে এই আত্মচরিত কথনে বিরত, তাতে অভিনবগুপ্ত নিতান্ত একজন বিলক্ষণ ব্যক্তি। তাঁর মত এত ব্যক্তিগত তথ্যের উপস্থানে তৎপর কষ্টে শিষ্টে কেউ মেলে।








তিনি কাশ্মীরের বর্ণনা দিচ্ছেন, সেখানকার গাছ-নদী-খাদ্যের। তিনি অনেক রাজা ও স্বীয় শিষ্যদের কথা বলছেন। তিনি তাঁর গুরুদের। কার কাছ থেকে কী পেয়েছেন সেই কথাও বলছেন। ন তু এতেনৈব অলম্। এই যথেষ্ট নয়, তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় রচনাকাল উল্লেখ করে গেছেন। এতো! এতো! এতোটা তো দেখা যায় না। সেই বুদ্ধের বিষয়ে অনেক পর্যাপ্ত তথ্য আছে, তবে সেখানে পরমুখগত আত্মকথা আছে, এখানে সাক্ষাৎ আত্মকথা। আর তাও এতো।

এখানে সব থেকে মজার বিষয়। বিস্ময়ই বটে! বিখ্যাত রাজতরঙ্গিণীকার, এ নিতান্ত অতিশয় নয় তিনিই ভারতীয় তথ্যাবলম্বী রাজকীয় দেশজ ইতিহাসের জনক, পণ্ডিত কল্হণ একটি বারও অভিনবগুপ্তের উল্লেখ করেননি। বিষয়টি এমন একদমই হতে পারে না যে কল্হণ অভিনবগুপ্তকে চিনতেন না। চিনতেন না বলা ভুল হবে, কারণ অভিনবগুপ্তের অন্তর্ধানের অনেক পরে প্রায় ১০৯৫ সালে কল্হণের জন্ম। তিনি অভিনবগুপ্তের শিষ্য বিখ্যাত কবি ক্ষেমেন্দ্রের নৃপাবলি পড়েছেন। এবং সেটির সমালোচনাও করেছেন। আর ক্ষেমেন্দ্রের থেকেই আমরা জানছি অভিনবগুপ্ত তাঁর গুরু। তাঁর কৃপাতেই ক্ষেমেন্দ্র নাট্যাদি সাহিত্যশাস্ত্র এবং কবিত্ব লাভ করেছেন। তাই কল্হণের অভিনবগুপ্ত সংক্রান্ত অজ্ঞতার কোন বীজ থাকাই সম্ভব নয়। যেখানে অভিনবগুপ্ত তাঁর জীবদ্দশাতেই শিবাবতার, ভৈরবের অবতার বলে প্রখ্যাত। যিনি সিদ্ধান্ত, বাম, কুল, ত্রিক, প্রত্যভিজ্ঞা, ক্রম আদি অদ্বৈত শৈববাদের, শুধু তাই নয় কলার প্রভূত দিক, বিশেষত সঙ্গীতশাস্ত্র, সমগ্র ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র, অলঙ্কারশাস্ত্র, ধ্বনিসম্প্রদায়, রসসম্প্রদায়, অন্যদিকে ব্যাকরণ, তাঁকে অনেকে শেষনাগ পতঞ্জলির অবতার মনে করেছেন তাই তাঁর নাম অভিনবগুপ্তপাদ, গুপ্তপাদ-লুকানো পা অর্থাৎ সাপ অর্থাৎ নাগেশ্বর অনন্ত শেষ অর্থাৎ পতঞ্জলি তিনি অভিনব হয়ে এসেছেন তাই অভিনবগুপ্তপাদ, তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর তন্ত্রালোকে তিনি বেদ থেকে প্রসঙ্গ তুলে তার তান্ত্রিক ব্যাখ্যা করছেন, যে পূর্বপক্ষীরা এই ভৈরবসম্প্রদায়ের শৈবদের কৌলদের অবৈদিক বলে নাক ঊঁচু করছে তিনি সেই সব উড়িয়ে দিচ্ছেন কলমের খোঁচায়, এমন উদ্ভট পাণ্ডিত্য নিয়ে যিনি মূর্ধন্য আচার্য তাঁর সমাজে নিঃসন্দেহে এক প্রতিষ্ঠা এবং বহুজনবিদিততা ছিল।

আমার স্বকীয় একটি বিচার এই প্রসঙ্গে আছে। সেই গুলি কাশ্মীরের রাজপরিবার, কাশ্মীরীয় শৈব-শাক্ত তন্ত্রের পরম্পরা এই সবের সঙ্গে যুক্ত।

Thursday, May 25, 2023

মান্ধাতার আমল বলতে কী বোঝায়?

মান্ধাত্রী বা মান্ধাতা , হিন্দু পুরাণে, একজন ইক্ষ্বাকু রাজবংশের রাজা এবং যুবানাশ্বের পুত্র ছিলেন।[1] তিনি যাদব রাজা শশবিন্দুর কন্যা এবং চিত্ররথের নাতনী বিন্দুমতি চৈত্ররথিকে বিয়ে করেছিলেন। পুরাণ অনুসারে, তার তিন পুত্র ছিল, পুরুকুৎস, অম্বরীষা এবং মুচুকুন্দ। তিনি তার উদারতা এবং উদারতার জন্য সুপরিচিত।


ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের 134 নম্বর স্তোত্রটি তাঁর জন্য দায়ী।


মহাভারত অনুসারে, তিনি ছিলেন সূর্যবংশ রাজা যুবাংশ্বের পুত্র। 

আমরা পুরণো আমলের কোন জিনিসের উপমা দিতে ‘মান্ধাতার আমল’ কথাটা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু কে এই মান্ধাতা? কেনইবা তার আমল ইতিহাসে এত উল্লেখযোগ্য? হিন্দুধর্মের ‘বিষ্ণুপুরাণে’ মান্ধাতার কাহিনি পাওয়া যায়। মান্ধাতা ছিলেন সূর্য বংশের একজন রাজা যার জন্ম মাতৃগর্ভে না হয়ে পিতৃগর্ভে হয়েছিল। উল্লেখ্য, এ বংশেই মান্ধাতার বহুকাল পরে রামের জন্ম হয়েছিল। কৃত্তিবাসের রামায়ণে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আছে।






মান্ধাতার পিতার নাম ছিল যুবনাশ্ব। সূর্য বংশের এ রাজার কোন পুত্র সন্তান ছিল না। সন্তান লাভের আশায় সব চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে তিনি মুনিদের আশ্রমে যোগ সাধনা শুরু করেন। মুনিরা যুবনাশ্বের সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তার পুত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য এক যজ্ঞ আরম্ভ করেন। যজ্ঞ শেষ হতে রাত গভীর হয়ে গেল। এ সময় মুনিরা একটি কলসি ভর্তি পানিতে মন্ত্র পড়ে ঘুমাতে যান। এই কলসির পানি পান করলে যুবনাশ্বের স্ত্রীর গর্ভে পুত্র সন্তানের জন্ম হবে।কিন্তু যুবনাশ্ব রাতের বেলা পিপাসায় কাতর হয়ে নিজেই কলসির পানি পান করে ফেলেন। সকালে মুনিরা ঘুম থেকে জেগে পানি পানের ঘটনা শুনে ঘোষণা করলেন - পানি যেহেতু যুবনাশ্ব পান করেছে, সন্তান তার গর্ভেই জন্মাবে। গর্ভধারণের কষ্টের কথা ভেবে ভয় পেয়ে গেলেন যুবনাশ্ব। মুনিরা তাকে গর্ভধারণের কষ্ট থেকে রেহাই দিলেন। একশ বছর পর তার পেটের বাম পার্শ্ব ভেদ করে জন্ম নিলেন মান্ধাতা। কিন্তু পিতৃ-গর্ভে জন্মানো শিশুর জন্য দুধ যখন পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন দেবরাজ ইন্দ্র তার মুখে নিজের তর্জনী দিয়ে বলেছিলেন, 'মামধাস্ততি'-সংস্কৃত এই শব্দের মানে 'আমাকে পান করো।'মাম এবং ধাতা-এই শব্দবন্ধের মিলনই পরে ফোনলজিক্যাল সূত্রে মান্ধাতা নামে উচ্চারণ করা হতে থাকে। এখান থেকেই রাজা মান্ধাতার নামকরণ হয়েছিল।বড় হয়ে মান্ধাতা বাবার রাজ্যের রাজা হলেন। এবার তিনি পৃথিবী জয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সুমেরু পর্বতে রাক্ষসরাজ রাবণের সাথে তার তুমুল যুদ্ধ হলো। উভয়ের শক্তি সমান হওয়ায় কেউই পরাজিত হলেন না। হয়ে গেল তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব। এরপরে মান্ধাতা স্বর্গরাজ্য জয়ে বের হলে ইন্দ্র তাকে সারা পৃথিবী জয়ের পর স্বর্গরাজ্য জয় করার চেষ্টা করতে বলেন। কারণ মধুর পুত্র লবণাসুর তখনো তার অধীনতা মেনে নেয়নি। এবারে যুদ্ধ হলো লবণের সাথে। কিন্তু মান্ধাতা আর পারলেন না। নিহত হলেন তার হাতে।

কখন ছিল মান্ধাতার এ আমলটা? হিন্দুধর্ম মতে, মহাকাল (সময়কাল/যুগ) সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চার যুগে বিভক্ত। এদের মধ্যে সত্য যুগটা শ্রেষ্ঠ যুগ। সে যুগে কোন পাপ ছিলনা। মৃত্যু ছিল ইচ্ছাধীন। সে যুগের রাজা ছিলেন মান্ধাতা। তার আমলটা ছিল হয়তো এখন থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে। কারণ সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের সময়কাল ছিল যথাক্রমে ১৭,২৮,০০০ বছর, ১২,৯৬,০০০ বছর এবং ৮,৬৪,০০০ বছর। আর আমরা যে পাপের যুগে (কলি কাল) বাস করছি তার দৈর্ঘ্য ৪,৩২,০০০ বছর। বোঝা যাচ্ছে, মান্ধাতার আমলটা অনেক প্রাচীন। সুতরাং এজন্যই প্রাচীন বা পুরণো জিনিস বুঝাতে ‘মান্ধাতার আমল’ কথাটা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বাংলা ভাষায় অনেক আগের কোন সময় বোঝাতে বিভিন্ন রাজা বা নবাবদের আমল অনেকেই বলে থাকেন। তবে পৌরাণিক কাহিনী হলেও মান্ধাতার আমলের চেয়ে পুরনো কোন আমল বাংলা ভাষায় খুঁজে পাওয়া যাবে না।

Friday, March 24, 2023

শিব বলেন আমি ব্রহ্ম আবার বিষ্ণু বলেন আমি ব্রহ্ম তাহলে আসলে কে ব্রহ্ম?

 নমস্কার প্রিয় ব্লগ পাঠক/ পাঠিকাবৃন্দ। 

অনেক শৈব ভ্রাতা/ভগ্নিরা আজকাল প্রশ্ন করেন
" দাদা শিব বলেন আমি ব্রহ্ম আবার বিষ্ণু বলেন আমি ব্রহ্ম । তাহলে আসলে ব্রহ্ম কে?"

দ্বৈতবাদী কৃষ্ণ বা বিষ্ণু ভক্তদের আপনি যদি অদ্বৈত বুঝান এরা তা বুঝবে না। কারণ এঁদের মগজ ধোলাই খেয়ে গিয়ে অবুঝ হয়ে গেছে।  তাই এর উত্তর এঁদের দ্বৈতবাদের ভিত্তিতে দেয়াই সমীচীন


শিবের মায়ায় বিষ্ণু বলেন উনি আসলে ব্রহ্ম 

প্রথমে আসি অদ্বৈতভাবের অন্যতম গ্রন্থ  মহর্ষি সূতের সূত সংহিতার ১/৩/৪ এ। উত্তর ভারতে তা স্বতন্ত্র গ্রন্থ যদিও দক্ষিণের স্কন্ধ পুরাণে এই সূত সংহিতা পাওয়া যায়। 

তো আসুন সেখানে কি বলা আছে দেখি? 








এখানে বলা কি বলা হচ্ছে আসুন দেখে নেই। 

পুরা বিষ্ণুর্জগন্নাথঃ পুরাণঃ পুরুষোত্তমঃ।
মায়য়া মোহিতঃ সাক্ষাচ্ছিবস্য পরমাত্মনঃ।।

ভোগ এবং মোক্ষের জন্য কোন দেবতার পূজা করা উচিৎ? মানে এমন কোন দেবতা আছেন যিনি একাধারে ভোগ মোক্ষ আর ফলপ্রদ । তখন সূত মহারাজ উত্তরে বলছেন,

একবার ভগবান জগন্নাথ যিনি পুরাণ পুরুষোত্তম ( পুরাণ পুরুষদের মাঝে যিনি উত্তম) সাক্ষাৎ তিনি পর্জন্ত  পরমাত্মা শিবের মায়ার দ্বারা মোহিত হয়ে আমি জগত কর্তা , আমার মধ্যেই জগত আছে আমার দ্বারাই জগত স্থিতি হচ্ছে, আমার শক্তিরই সব বিলাস, আমার দ্বারা এই চরাচর সৃষ্টি ইত্যাদি করে গর্বে মত্ত হন এবং তিনি অন্যদের বলেন আমারই পূজা করো । শুধু জগন্নাথ দেব নন, অন্যান্য দেবতারাও মায়া মোহ দ্বারা মোহিত হয়ে যায় সেই সময় যখন এই দেবতারা মায়া দ্বারা মোহিত হয়ে যায় তখন নন্দিকেশ্বর ( শিবের প্রধান গণ) তিনি তাঁদের কাছে আসেন এবং তাঁদের শিবতত্ত্ব খুলে বলেন । 




একই কথা আবার শিব মহাপুরাণের শতরুদ্র সংহিতাও বলছে। কি ? 

১৫ থেকে ১৭ দেখুন। শ্রী ব্রহ্মাকে শ্রী নন্দীশ্বর বলছেন, 


" স্বয়ং শ্রী বিষ্ণুও যিনি কখনও কখনও রেগে যান তিনিও মায়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যান। " 

১৭ তেও শ্রী সূত মহর্ষি যা বলেছেন তাঁর মিল পাচ্ছেন কিনা দেখুন? 

এখন, যারা মায়া দ্বারা মোহিত হয়ে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের গুণকীর্তন করতঃ মহাদেব আর দেবী শক্তিকে ছোট বা নীচু দেখান, সমকক্ষ দেখাতে চান না এঁদের জন্য এই হল উত্তর। এখন আপনারা কি বলবেন? সূত মহর্ষি তামসিক? নাকি উনি মূর্খ? মহর্ষি মূর্খ  আর আপনারা এক একজন মহাজ্ঞানী? 

আমার মতে দুই এক আর সেই একই দুই। তাই বিভেদ কাম্য নয়। 

ইস্কন সহ দ্বৈতবাদীরা সনাতন সমাজের একতার পরিপন্থী। এঁদের বর্জন করুন। কারণ এরা শাস্ত্র নিন্দা এবং শাস্ত্র বাক্য বিকৃতি করে। 

Monday, February 6, 2023

ভন্ড শৈবদের জবাব ২

 #issgt_exposed

যারা বোঝার এরা বুঝে এদিকে আর যাবেন না। আর যারা চ্যালা এরা চ্যালাগিরি করুন আর কনফিউসড দল আরও কনফিউসড হন। 

স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্যঃ 





আমার এই বক্তব্যঃ 

 যতটুকু খণ্ডন-মণ্ডনের সাথে জড়িত সম্পূর্ণটাই আমরা ঘেটে দেখেছি। এবং এই অন্তঃসারশূণ্য বক্তব্যের শেষ কথা এটাই - 

১/ঠেকায় পড়লে ভাস্কর রায় এবং উৎপল দেব উভয়েই মান্য। অর্থাৎ খিচুড়ীবাদ তারা সমর্থন করে। 

২/ তাদের দাবী মতে ভাস্কর রায় এবং উৎপল দেব এর মতামত এক - অর্থাৎ উভয়ে ভিন্নবাদ সমর্থন করলেও দিনশেষে রোহিতের খিচুড়ীবাদ রক্ষার জন্য তারা এক। 

৩/ রোহিতের লাইভের বক্তব্যে প্রথমে শুরু হয়েছে - উভয় মত এক নয়। এরপর রোহিত আবার বক্তব্যের শেষে চেইঞ্জ করে বলছেন দুইটাই একই। এক মুখে এতকথা খিচুড়ী না খেলে বলা সম্ভব না। 

৪/ রোহিত বলতে চাইছেন স্পন্দ ও প্রত্যভিজ্ঞা এক না হলেও দুই মতবাদ মান্য- উভয়েই কাশ্মীরি শৈব পরম্পরা অন্তর্ভুক্ত। নতুন করে মান্যতার কী আছে ঠিক বুঝলাম না। মাথা ডানে হেলিয়ে কথা বলে একবার বামে হেলিয়ে। 

৫/শক্তির স্বরূপ জগত- বুঝলাম না। খায় না মাথায় দেয়? 

৬/ বীর শৈব দর্শন ও ভাস্কর রায় সেইম- বুঝলাম না। 

৭/স্বাতন্ত্র্য শক্তি শক্তি না দর্পণ - কি বলেন কিছুই বুঝি না। 

৮/ স্বাতন্ত্র্য শক্তি বিনা বিম্বে প্রতিবিম্ব সিদ্ধ করালে আভাসের কী আছে তাও বুঝিনি, অর্থাৎ আপনার কথায় উৎপল দেবই না স্বয়ং খণ্ডিত হয়ে যান কিনা এই টেনশনে পড়ে গেলাম। স্বাতন্ত্র্য শক্তি পরিণামে অথবা আভাসে জগত প্রতিষ্ঠিত করেন কিনা সেসব আলোচনায় লেশ মাত্র নেই।

৯/ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বীরশৈবকে কী বলা যায় কি বলা যায় না - ভগবানই জানে আপনি কী বলতে চান। আমার আর বুঝে কাজ নেই। 

১০/ মোদ্দা কথা হল ত্রিকের প্রচারের জন্য ভাস্কর রায় কেও ডাকা লাগে শ্রীকরকেও ডাকা লাগে শাক্ত শৈবের খিচুড়ী করা লাগে- সম্মানের তলে খিচুড়ী করে পাব্লিক খাওয়ান আর অদ্বৈতবেদান্তীকে ক্রিটিসাইজ করেন- এসব ছাগলামি ছেড়ে দেন।  

১১/ এইবার আপনাদের গুরু পরম্পরা নিয়ে কোথায় কি বললেন ? আপনার চ্যালা তো বড় বড় বুলি ছাড়ছিল। পরুম্পরা কি আপনার? গুরু কে? কবে কখন, কোথায় দীক্ষা হয়েছে আপনার? 

এই হল মাত্র কয়েক মিনিটের ভিডিওতে ভুল। পুরোটা দেখতে পারছি না কারণ কান থেকে রক্ত বের হচ্ছিল এর ভাট শুনে। আর আমাদের এত সময়ও নেই। 

এইবার , সকলকে জানাতে চাইছিঃ 

কাশ্মীর শৈব দর্শনের স্কলার যিনি কাশ্মীর শৈব দর্শনের বর্তমান অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত এবং প্রফেসর দেবব্রত সেন শর্মা,  ( যার বই থেকে রোহিত কপি পেষ্ট করেছিল), প্রফেসর নবজীবন রাস্তোগী মহাশয়ের সরাসরি শিষ্য , যিনি আবার ঈশ্বর আশ্রম ট্রাষ্ট ফেলোশিপ দ্বারা ভূষিত যা স্বামী লক্ষণ-Joo মহারাজ দ্বারা স্থাপিত । উনি সরাসরি বলেছেন এগুলো একটারও কোন কাশ্মীর শৈব দর্শনের ক ও জানে না। এমনকি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কাশ্মীরি শৈব দর্শনের স্কলার( যিনি শৈব দর্শন নিয়ে পিএইচডি করছেন) তিনিও বলেছেন

 " আমি যতটুকু এদের আর আপনার তর্ক দেখলাম তাতে মনে হল আপনার প্রতিপক্ষ  কাশ্মীর শৈব দর্শনের কিছুই জানে না। আপনি যে লাইভে যান নাই এইটা বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। কারণ মূর্খদের সাথে লাইভে যাবার দরকার নেই। আপনি ডকুমেন্ট আকারে যেভাবে চাইছেন সেভাবেই হোক সব। এতে আমাদের পড়তে আর বিতর্ক দেখতে সুবিধা। "

এইবার আপনারাই বোঝেন  এরা কেন ডকুমেন্ট ছেড়ে লাইভে যেতে চাচ্ছে। আমার কাছে কিছু সাম্ভব্য কারণ মনে হচ্ছেঃ 

১. ডকুমেন্টে যুক্তি কাটতে খুব সহজ কিন্তু লাইভে প্রতিপক্ষকে গালাগাল, ব্যাক্তিগত আক্রমণ কিংবা ভুল তথ্য উপাত্ত দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে হারানো যেতেও পারে।(বিশেষ করে যারা মৌখিক বিতর্ক কম করেছেন।)

২. ডকুমেন্টে যেমন তাড়াতাড়ি যুক্তি কাঁটা যায় তা লাইভে সম্ভব না। যা শৈব দর্শনের স্কলারই বলেছেন। 

এরা ভয় পাচ্ছে যে এদের ডকুমেন্টে লড়লে হাজার ভুল ধরা যাবে যা লাইভে সম্ভব নাও হতে পারে।




Sunday, January 29, 2023

ভন্ড শৈব খিচুড়িবাদীদের পাল্টা জবাব প্রদান

যারা ত্রিক দর্শন নিয়ে সামান্য পড়াশোনা করেছেন এরা জানেন যে পরিণামবাদ আর বিবর্তবাদ সৃষ্টির কারণ নয়  ঈশ্বরের স্বাতন্ত্র‍্যই সৃষ্টির কারণ । এটাই যদি কারণ হয় তাহলে কাশ্মীর শৈব দর্শনের ফন্ডিত ড়োহিঠ মহাশয় কি লিখলেন এনার তো দেখি গণেশে গলদ ! আর মূর্খকে বলতে চাই পরিণামবাদ আর আভাসবাদ সেইম নাকি? আগে বেসিক ঠিক করে আসেন। 

ফন্ডিত ফ্রবু কে বলবো ভাইজান আপনারা আগে ঠিক করেন যে আপনারা পরিণামবাদী নাকি স্বাতন্ত্র‍্য (স্বভাব) বাদী। স্বাতন্ত্র‍্যশক্তিবলে ঈশ্বর সমস্তই সৃষ্টি করেন- এ সৃষ্টি না আভাস না পরিণাম- শৈবাচার্য্যগণের আভাস আর আদি শঙ্কর এর ভ্রম এক বিষয়।- শুধু সৃষ্টির অস্তিত্ব স্বরূপ বিষয়ক মতভেদ আছে। জীব তদীয় আভাসরূপ অজ্ঞান জন্য মনে হয়, কিন্তু এ সৃষ্টি মূলত আভাস নয়। – কারণ আভাস হলে সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য প্রয়োগের সার্থকতা ব্যর্থ হয়। আপনি নিজ আচার্য্যকেই উত্তেজনাবশতঃ খন্ডন করে ফেলেছেন - ফ্রবু, আপনার অপরিমেয় বিজনেস পলিসির জ্ঞান- ভুগিচুগি বুঝিয়ে যজ্ঞিবাসুদেবের মত সদগুরু সাজার ধান্দা আমরাও বুঝি। সবাইকে বেক্কল মনে করবেন না। আর সাথে দিয়ে এটাও বলি আপনারা গোপীনাথ কবিরাজের স্নেহভাজন ছাত্র দেবব্রত সেনশর্মার বই ঘাটবেন না। কারণ ঐ স্তরের লেখা বুঝার মতন জ্ঞান আপনার উর্বর গোবর মস্তিস্কে ধরবে না। 

ভাস্কর রায় হলেন মূলত অদ্বৈতবাদের সমর্থক। উনি তো অদ্বৈতবাদীই। আচার্য্য ভাস্কর- সম্পূর্ণ প্রকারেই অদ্বৈতমতকে পোষণ তার স্বীয় লেখায় করে এসেছেন- এ সকল স্কলারদের মতামত। শক্তি উনার উপাস্য।

আর এখানে শাক্তপরম্পরায় শৈব পরম্পরার সমন্বয় করার ষড়যন্ত্র কেন করছেন? সমস্যা হল আপনি বিরিয়াণী খাওয়ার লোক নন, খিচুড়ী খেয়ে এখন সর্বত্র কৃশরান্নরূপ ব্রহ্ম দর্শন হচ্ছে। মোটা দাগে মোটা মাথায় যা বুঝেন আর কি! 

পদ্মবিভূষণ ডি.লিট সর্বতন্ত্রস্বতন্ত্র মহাচার্য মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজের তন্ত্রতত্ত্বে এ নিয়ে স্পষ্টত বিদ্যমান। শ্রী চণ্ডীর গুপ্তবোধীনি টীকা করেছেন যে ভাস্কর রায় সে শাক্ত। শৈব নন। তাহলে খিচুড়ীটা কে? আপনারা নাকি আমরা? আপনি কি ভাস্করকে মানবেন নাকি উৎপল কে? কাশ্মীরি শৈবাগম নাকি শাক্তাগম? কোনটা মানবেন? বোধহয় ভাস্কর ভট্ট এবং ভাস্কর রায় গুলিয়ে ফেলেছেন। আর ব্রহ্ম পরিণামবাদ আর বিবর্তবাদের ঠিক কী পার্থক্য যদি একটু বোঝাতেন!



  আচার্য ভাস্কর-রায়-প্রণীত ‘বরিবস্যারহসাম্'-গ্রন্থের 'প্রকাশ'-ব্যাখ্যায় ধর্মী ও ধর্ম, – শক্তিমান ও শক্তির অভিন্নতাপ্রতিপাদক বিচারশৈলীর কথা মনে পড়ে। 


‘কথমিব তস্মিন্‌জ্ঞাতে সর্বং বিজ্ঞাতমুচাতে'— এই প্রতিজ্ঞার ভাষ্যে ভাস্কর-রায় বলেছেন : “অত একৈক বিজ্ঞানেন সর্ববিজ্ঞানং শ্রুতাবুক্তং কথং সঙ্গচ্ছত ইতি সাশ্চর্যমাহ – কথমেতি। 


অথবা বিবর্তবাদং বেদান্তিসম্মতং পরিণামবাদী তান্ত্রিকে। দূষয়তি—কথমেবেতি।...অত্রেয়ং তান্ত্রিক প্রক্রিয়া—'ইচ্ছামি', 'জানামি' ইত্যাদাবুত্তম- পুরুষান্তভাসমানং স্ফুরণাদ্বীয় জ্ঞানমের প্রকাশাভিধং ব্রহ্ম। তচ্চ সর্বজ্ঞসর্বেশ্বরত্বসর্ব- কর্তৃত্বপূর্ণত্বব্যাপকত্বাদিশক্তিসংবলিতম্। 

তস্য চানন্দর পাংশ্চ এব স্ফুরণং পরাহস্তা বিমর্শ: পরা ললিতা-ভট্টারিক৷ ত্রিপুরসুন্দরীত৷দিপদৈর্ব্যবহ্রিয়তে।... 'বাচারগুণং বিকার:’ ( ছান্দোগ্য-উপনিষৎ ৬/১/৪ ) ইত্যাদিশ্রুতীনাং তত্রৈব দ্বারস্যাচ্চ। শক্তি- শক্তিমতোর পাদানো পাদেয়য়োরত্যশুমভেদং, ন পুনরোপনিষদাদিবদ্ভেদাভেদৌ অতএব 'সর্বং খৰিদৎ ব্ৰহ্ম' (ছাঃ উঃ ৩/১/৪/১) ইতি সামানাধিকরণামভেদে, ন তন্ত্রে তত্ত্ব ও সাধনা পুনবাধাপ্পাম্। অদ্বৈতশ্রুঃয়ঃ সর্বা অপ্যেতদভিপ্রায়িকা এবাৰিষুদ্ধাঃ। সর্বপ্রমাণ- মূর্ধনাহ্মাতা তদনুসরিতয়ৈশ্চাদ্বৈতে কথিতে তদ্বিরুদ্ধত্বেন ভাসমানঃ কার্যকারণয়ো- ভেদাংশ এব কম্পিত আস্তাং ন পুনঃ সর্বোঽপি প্রপঞ্চঃ।... ততষ্কশ্রুতেরপি পরিণামবাদ এর সংমতঃ সিধ্যত। ভগবতা ব্যাসেনাপি 'প্রকৃতিশ্চ প্রতিজ্ঞাদৃষ্টান্তানুপরোধাৎ' (ব্রহ্মসূত্র ১/৪/১৩) ইত্যাস্মিন্নাধিকরণে একবিজ্ঞানেন সর্ববিজ্ঞান প্রতিজ্ঞা মৃদ্ধটনখনকৃত্তনাদিদৃষ্টান্তম্ 'বহুস্যাং প্রজায়েয়' (তৈঃ উপঃ ২/৭ ) ইতাভিধ্যোপদেশা- দিকং চানুসন্ধানেন পরিণামবাদ এবাভিমতে...। ভাষ্যকারেরপি তন্ত্র বিবর্তবানুসারেণ ব্যাচক্ষাণৈরপি সৌন্দর্যলহর্যাম্ ‘অনাং ব্যোম্ ত্বম্' ইতি শ্লোকে 'জ্বয়ি পরিণতায়াম্ ইতি স্বাভিমতঃ পরিণামবাদ এব স্ফুটীকৃতঃ।'' 


এখানে দেখা যায়, আচার্য ভাস্কর-রায় দার্শনিক অপ্পয়দীক্ষিতের মতের অনুসারী হ'য়ে বিবর্তবাদের প্রসঙ্গে সৃষ্টিশ্রুতিকে পরিণামবাদের পক্ষে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পণ্ডিত কৃষ্ণস্বামী শাস্ত্রী 'বরিবস্যারহস্য’ গ্রন্থের মুখবন্ধে বলেছেন : "** respectively Dharma and Dharmin. The form Dharma is divided itself into male and female. The female form is the consort (Devi) of the Supreme Śiva (Dharmin). The male form viz Vishnu became the meterial (Upādāna ) cause of the universe এ'প্রসঙ্গে পণ্ডিত কৃষ্ণস্বামী শাস্ত্রী মন্তব্য ক'রে পুনরায় বলেছেন যে, ভাস্কর-বায় পরিপূর্ণভাবে অদ্বৈতমতেরই সমর্থক, কিন্তু অনেকে তাঁকে পরিণামবাদী তান্ত্রিক মতানুযায়ী ব'লে ব্যাখ্যা করেন: “Yet in the face of this direct testimony, it is strange to find that a view prevails that Bhaskararāya's attitude toward the Advaitavāda was no altogether sympathetic" এজন্য শাস্ত্রী মহাশয় অদ্বৈতবাদের পক্ষে তিনটি যুক্তির মধ্যে তৃতীয় যুক্তিতে বলেছেন, আচার্য শঙ্কর স্বয়ং ২/১/১৪ ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে প্রথমে পরিণামবাদ ও পরে বিবর্ত্তবাদের দিগদর্শন করেছেন। ঠিক তেমনইভাবে সংক্ষেপশারীরকার সর্বজ্ঞাত্মমুনির উদাহরণ দিয়ে তিনি পুনরায় বলেছেন: "Categorically declares that in the Vedānta system the Pariņāma-vāda is but the necessary stepping stone, which naturally leads to the central doctrine of Advaitavada." 


সৌন্দর্য্যলহরীর টীকায় শ্রীমান  লক্ষীধর আগম পঞ্চক যে স্বীকার করেছেন সেখানে শৈবাগমের কমিকাদি আটাশটি আগমের স্বীকৃতি কোথায়? আনন্দগিরি ও লক্ষ্মীধর কোথায় বলেছেন যে শিবশক্তির অভেদত্বই প্রকৃতপক্ষে অদ্বৈতবাদ? সৌন্দর্য্যলহরীর টীকার কোনস্থানে? 


শৈবাগমে বা বহুবিধ বঙ্গদেশীয় তন্ত্রে আভাসবাদ স্বীকৃত কিন্তু শ্রদ্ধেয় ভাষ্যকার রাঘব ভট্ট অনেক সময় বিবর্তবাদের আশ্রয় নিয়ে তন্ত্রের তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছেন। পন্ডিত আচার্য্য ভাস্কর রায়ও বরিবস্যা প্রকাশ গ্রন্থে বিবর্তবাদের আশ্রয় নিয়ে বহু তন্ত্র তত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তো ভাই আপনার সাথে তো উনাদের মতের বা কথাবার্তার তো কোন মিলই নাই। এরা তো সমন্বয়বাদী এরা বিবর্ত এবং পরিণাম উভয়ই স্বীকার করে এমন একটা বিষয়। ভাস্কর মহাশয় বিবর্তকে মূলাবিকৃত পরিণামবাদ বলতে চেয়েছেন। উনারা আসলে ব্রহ্মপরিণামবাদের মোড়কে বিবর্তবাদকেই প্রচার করেছেন। স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য। 


প্রসঙ্গত শৈব ভাস্কর ভট্ট এবং শাক্ত ভাস্কর রায় এক নন।


আপনাদের মনে রাখা উচিত যে শিবাদ্বৈতবাদ রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদেরই অনুরূপ। রামানুজাচার্য্য সালোক্য ও সামীপ্য আর শৈবরা সাযুজ্য মানে। এটাই পার্থক্য। এদের Terminology diffrent হতে পারে কিন্তু background ব্যাখ্যা  structure  পুরোপুরি একই। অর্থাৎ অদ্বৈতবাদের আড়ালে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদই চালাচ্ছেন। অদ্বৈতবেদান্তের বহু আগে থেকেই ত্রিক দর্শনের প্রচার প্রসার এর প্রমাণ কি ? দয়া করে বসুগুপ্ত শঙ্করের আগে তা বলবেন না। (হাসির ব্যাপার হল শঙ্করের পূর্বে কেউ অদ্বৈতবাদ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলেন নি। আদিগুরু অদ্বৈতবাদের প্রসারের পর বসুগুপ্ত নন-ডুয়ালিস্টিক এই শৈব দর্শনের ধারণার প্রচারণা শিব সূত্র দ্বারা ও স্পন্দকারিকা দিয়ে নিয়ে আসেন- অর্থাৎ কিনা টুকলির জন্য আদিগুরুকে মানতেই হয়। আদিগুরু ঐতিহাসিকভাবে বসুগুপ্তের পূর্বে এ ইতিহাস সিদ্ধ)

ভেদ, অভেদ এবং ভেদাভেদবিশিষ্ট আগমের প্রকাশক সদাশিব। তা আপনারা কোন সাইডের আগম মানছেন?  

শ্রীপতি পন্ডিত আরাধ্যের শ্রীকর ভাষ্য যে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী তা কি এই মর্কট মূর্খ জিন্সের প্যান্ট পড়া শৈবাচার্য্য জানে না? বেক্কল কি কাশ্মীর শৈব আর বীর শৈব এক করে গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছে?  



আপনাদের কাছে আমার কিছু সম্পূরক প্রশ্নঃ 

ISSGT এর মুল আচার্য্য পরম্পরা কি? 

আপনারা কী শাক্ত না শৈব পরম্পরা? 

ভাস্কররায়ের মূলাবিকৃতপরিণামবাদ ও উৎপলদেবের আভাসবাদ কী একই? পরম্পরাও কী একই?

ভেদ, অভেদ, ভেদাভেদ বিশিষ্ট আগমের স্বপ্রকাশ সদাশিব। তা আপনারা কোন সাইডের আগম মানছেন?

শ্রীপতি পন্ডিত আরাধ্যের শ্রীকর ভাষ্য যে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী আর কাশ্মীর শৈব দর্শন কি এক আপনার কাছে? 

মোদ্দা কথা হল আপনারা নিজেরাই খিচুড়ীবাদি আপনারা জোড়াতালি দিয়ে ভন্ডামি করছেন আর মানুষকে বোকা বানিয়ে ধান্দাবাজি শুরু করেছেন। নিজেরা আচার্য্য সেজে ব্যাবসা আর হিন্দু সমাজের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙ্গে নিজেদের প্রতিপত্তি বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আগের নিজের গোড়া ঠিক করেন এরপর আপনার সাথে নির্গুণ আর নির্বিকার নিয়ে আলোচনা করা যাবে। যার গোড়া ঠিক নাই তাঁর সাথে কিসের আলোচনা আর কিসের লাইভ? কারণ গোড়ার উচ্ছেদ হলেই সমস্ত কিছুর উচ্ছেদ হয়। 

নিজেদের আচার্য্যের কথা আপনারা কিছু বুঝেন নি আর ধার করা বক্তব্যে জোর করে শৈববাদের নামে জগার খিচুড়ী চালাচ্ছে আর আদিগুরুকে অযথাই আপনারা অপমান করছেন। যদিও এ সূর্য্যে থুতু ছিটানোর মত। আদি গুরু আকাশ সমেত সূর্য্য - আপনাদের শিব-শক্তি সঙ্গমাবস্থার সাক্ষাৎ অবতার। কোথায় কী বলবেন না বলবেন বুঝে বলবেন।


Friday, January 27, 2023

মুঘল হারেম কি এবং সেখানে কি কি হত?

 হারেম: যৌবনকালের যৌন জীবন এর নিষিদ্ধ উপাখ্যান

নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। তৎকালীন যুগে, সাধারণ মানুষের অনুপ্রবেশের নিষেধাজ্ঞা ছিল বলে হারেম বা হেরেম সব যুগেই মানুষের কাছে অতীব আগ্রহের জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে। হারেম বলতে যে ভাবনাটি কমবেশি সবার মধ্যে সর্বপ্রথম ভেসে ওঠে তা হল , সেখানে থাকা বিভিন্ন বয়সী রমণী এবং যে সম্রাটের অধীনে তারা আছেন তার সঙ্গে ঐ রমনীদের অবৈধ সম্পর্ক বা প্রণয়ের দুষ্টু মিষ্টি কাহিনী! ভাবনাটি অনেক অংশে সত্যি হলেও হারেম নিয়ে এর বাইরেও অনেক কাহিনী আছে বা ঘটনা আছে। যেগুলো আজকে এই লেখায় জানাতে চেষ্টা করব।

কেউ বলেন হারেম তুর্কি শব্দ, আবার কারো মতে, হারেম শব্দটি এসেছে আরবী ‘হারীম’ বা হারাম থেকে যার অর্থ নিষিদ্ধ বা অলঙ্ঘনীয় সীমারেখা; এটি হলো মহিলাদের জন্য নির্ধারিত স্থান যেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ। তুর্কি সাম্রাজ্যেই হারেমের উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় যা পরবর্তীতে মুঘল সম্রাটদের মাধ্যমে উপমহাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব স্থান লাভ করে। হারেমের তুর্কি প্রতিশব্দ সেরাগলিও, পারসিক প্রতিশব্দ জেনানা, এবং সংস্কৃত প্রতিশব্দ অন্ত:পুর।

মুঘল যুগের ইতিহাস চর্চায় সবচেয়ে জল্পনা এবং কৌতূহলের বিষয় হল মুঘল হারেম। রাজদরবারের মহিলা এবং তাঁদের সখি ও সহযোগিনীদের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট স্থান 'হারেম' নামে পরিচিত। হারেম শব্দের উৎপত্তি আরবি শব্দ 'হারাম' থেকে, যার অর্থ নিষিদ্ধ। মুঘল রমণীদের বসবাসের স্থানে বিশেষ কারন ছাড়া, যেমন: শিক্ষা ও চিকিৎসা, পরপুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। সুদীর্ঘ শাসনামলে (১৫২৬- ১৮৫৭) মুঘলরা শুধু সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভাগ্যই নিয়ন্ত্রণ করেনি, হিন্দুস্তানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক , শৈল্পিক সকল ক্ষেত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তারই মধ্যে মুঘল হারেম তেমনি এক সংযোজন। হারেম শুধু রাজা বাদশাহদের চিত্তবিনোদনেরই স্থান ছিল তা নয়, বরং তা ছিল রাজার কাছের মহিলাদের নিরাপদে রাখার জন্য একটি সুরক্ষিত স্থান।

মুঘল হারেমের ব্যাপারে খুবই অল্পসংখ্যক তথ্য পাওয়া যায়। কোন প্রত্যক্ষ বিবরণ নেই বললেই চলে। কারণ মুঘল সম্রাটরা তাদের হারেম কাহিনী সেভাবে বর্ণনা করে যাননি বা তাদের সভাকবি দের দিয়ে বর্ণনা করেননি। ফলে, যেটুকু পাওয়া যায় তার প্রধান উৎস তুজুক ই জাহাঙ্গীরি ও আবুল ফজলের কিছু বর্ণনা এবং ইউরোপীয় পর্যটকদের কাহিনি, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মনগড়া কথা লিখে গেছেন , অতিরঞ্জিত করেছেন এবং সেগুলিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেখান থেকে সত্য উদ্ধার করা সহজ নয় ।

তখনকার সময়ে রাজা বা সম্রাটের অনেক পত্নী আর উপপত্নী থাকবে এটাই স্বাভাবিক ছিল। নিজেদের দাস-দাসী আর পত্নীদের সম্রাট নিজের ইচ্ছেনুযায়ী ব্যবহার করবেন সেটাও অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল না। হারেমে তাই সর্বাধিক গুরুত্ব পেত আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা।

  • গ্রেট মুঘলদের বিবাহিত পত্নীগণ:

মুঘল সম্রাটদের বিবাহিত স্ত্রীও কম ছিল না। এ সত্ত্বেও তারা তাদের খেয়ালখুশি মতো হারেমে রমণীদের কে গ্রহণ করতেন।

সম্রাট বাবরের স্ত্রী ছিলেন ১১ জন। তাদের নাম ছিল ১. আয়েশাহ সুলতানা বেগম, ২. বিবি মুবারিকা ইউসুফজাই, ৩. দিলদার বেগম, ৪. গুলনার আগাচেহ, ৫. গুলরুখ বেগম, ৬. মাহাম বেগম (সম্রাট হুমায়ুনের মা), ৭, মাসুমাহ বেগম, ৮. নারগুল আগাচেহ , ৯. জয়নব সুলতানা বেগম, ১০. সালিহা সুলতান বেগম এবং ১১. সাদিয়া আফাক।
সম্রাট হুমায়ুনের স্ত্রীরা হচ্ছেন : ১. বেগা বেগম (হাজি বেগম), ২. শাহজাদী খানম, ৩. মাহ চুচাক, ৪. মিবেহজান, ৫. হামিদা বানু (সম্রাট আকবরের জননী), ৬. খানেশ আগা, ৭. মেওয়াজান, ৮. শাহনাম আগা, ৯. গুলবার্গ বার্লাস, ১০. সাদ বিবি, ১১. চাঁদ বিবি এবং ১২. গানওয়ার বিবি।

সম্রাট আকবরের স্ত্রীরা হচ্ছেন : ১. রুকাইয়া সুলতানা বেগম সাহিবা (বিয়ের বছর ১৫৫২), ২. আবদুল্লাহ খানের কন্যা, নাম অজানা, (১৫৫৭), ৩. রাজকুমারী সালমা সুলতান ( বৈরাম খানের বিধবা স্ত্রী) ১৫৬১, ৪. মরিয়ম-উজ-জামানি (যোধবাঈ), সম্রাট জাহাঙ্গীরের মাতা, ৫. রাজকুমারী শ্রীনাথি বাঈ (১৫৬২), ৬. বিবি দৌলত শাদ বেগম (১৫৬৩), ৭. রাজকুমারী খন্দেশ (১৫৬৪), ৮. ফাদম খানের কন্যা (নাম জানা যায়নি), ৯. কাশ্মিরি রাজকন্যা, সুলতান মুহাম্মদ নাসিরউদ্দিন হোসেন শাহের কন্যা (নাম জানা যায়নি) (১৫৬৯), ১০. রাজকুমারী সিন্ধ বেগম সাহিবা (১৫৭০), ১১. রাজকুমারী বাঈজিলাল কানওয়ারী সাহিবা (১৫৭০), ১২. রাজকুমারী বাঈজিলাল ভুনামতি কানওয়ারী সাহিবা (১৫৭০), ১৩. নহর দাসের কন্যা (নাম জানা যায়নি) ১৫৭২, ১৪. নাগৌরের রাজকুমারী, রাজা শ্রী জয়চাঁদের কন্যা (১৫৭৩), ১৫. রাজকুমারী কারিশমা বানু বেগম সাহিবা (১৫৭৫), ১৬. ডুঙ্গাপুরের রাজকুমারী, শ্রী আসকারান সাহিব বাহাদুরের কন্যা (১৫৭৭), ১৭. রাজকুমারী রুকমাবতী বাঈজিলাল সাহিবা (১৫৮১), ১৮. মেরতার রাজকুমারী, রাজা শ্রী কেশো দাস রাথোরের কন্যা (১৫৮১), ১৯. কাজী ইসার কন্যা (১৫৯৪), ২০. নাসির খানের কন্যা (১৫৯৭), ২১. কোচ বিহারের রাজকন্যা, লক্ষ্মী নারায়ণ ভুপ বাহাদুরের কন্যা (১৫৯৭), ২২. রাজকুমারী গোহার খানম , ২৩. তারা বেগম সাহিবা ২৪. তৌতি বেগম সাহিবা, ২৫. মেরতার হাসান খানের কন্যা, ২৬. নয়ানগরের রাজকুমারী, ২৭. রাজকুমারী মানভাওতি সাহিবা, ২৮. আবদার বেগম সাহিবা, ২৯. আচানক বেগম, ৩০. বিবি পুনগ্রেই, ৩১. বিবি আরাম ককস, ৩২. সেলিনা সুলতান বেগম, ৩৩. বিবি খেরিয়া বেগম, ৩৪. রাজিয়া সুলতান বেগম, ৩৫. বিবি মরিয়ম শাহজাদা, ৩৬. বিবি নৌন, ৩৭. শামস চকের কন্যা (১৫৯২)। ( এত??)🙄

সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী দের নাম : ১. ভগবান দাসের কন্যা মামাতো বোন মনবাঈ (বিয়ের বছর ১৫৮৫), ২. রাজকুমারী রতন বাঈ (১৫৮৬), ৩. রাজকুমারী যোধবাঈ (১৫৮৬) (যোধবাঈয়ের ছেলে সম্রাট শাহজাহান), ৪. মালিকা শিকর বেগম (১৫৮৬), ৫. শাহেব জামিল (১৫৮৬), ৬. বিকানার রাজা রাজসিংহের কন্যা (১৫৮৬), ৭. মালিকা-ই-জাহান বেগম (১৫৮৭), ৮. রাজা মলভাসির কন্যা (নাম জানা যায়নি) (১৫৮৮), ৯. জোরা বেগম (১৫৯০), ১০. রাজকুমারী করমাসি (১৫৯১), ১১. দোস্ত মোহাম্মদ খাজার কন্যা (১৫৯১), ১২. রাজকুমারী কানওয়াল রানী (১৫৯২), ১৩. নূরুন্নিসা বেগম (১৫৯৩), ১৪. জয়সলমির রাজা রাওয়াল ভিমের কন্যা (১৫৯৩), ১৫. কাশ্মিরের সৈয়দ মোবারক খানের কন্যা (১৫৯৩), ১৬. হুসেন চাকের মেয়ে, ১৭. রাজা ফারুকীর মেয়ে (১৫৯৩), ১৮. বেলুচিস্তানের আলাউদ্দিন খানের কন্যা, ১৯. বিবি খাস মহল (১৫৯৬), ২০, সাহিলা বানু (১৬০৮), ২১. কোকা কুমারী সাহিবা (১৬০৮), ২২. ঠাকুর মনচাঁদের কন্যা, ২৩.রামচন্দ্র বুন্দেলার কন্যা, ২৪. মধুকর দেও বুন্দেলার কন্যা, ২৫. মেহেরুন্নেসা (নূরজাহান) (১৬১১)।

শাহজাহানের স্ত্রীদের নাম- ১. আকবারাদি মহল, ২. কান্দাহারি মহল, ৩. মমতাজ মহল (সম্রাট আওরঙ্গজেবের মা), ৪. হাসিনা বেগম সাহেবা, ৫. মতি বেগম সাহেবা, ৬. ফতেপুরি মহল সাহেবা, ৭. সরহিন্দি বেগম সাহেবা, ৮. শ্রীমতি মানভবাতি বাঈজিলাল সাহেবা, ৯. লীলাবতী বাঈজিলাল সাহেবা।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের স্ত্রীদের নাম- ১. নবাব বাঈ বেগম (রাজপুরী জারাল রাজপুত কন্যা), ২. দিলরাস বানু বেগম (পারস্য), ৩. আওরঙ্গবাদী মহল, ৪. উদয়পুরি মহল, ৫. জৈনবাদী মহল, খ্রিস্টান দাসী এবং উপপত্নী। আওরঙ্গজেব সম্রাট হওয়ার পূর্বেই তার মৃত্যু হয়।

হারেমের উল্লেখ প্রায় সকল রাজপরিবারের ভেতরেই পাওয়া যায়। এটি সেই স্থান যেখানে বসবাসের জন্য কেবল মাহরামের( ইসলামি পরিভাষায় মাহরাম দ্বারা বুঝায়, যাদের বিবাহ করা হারাম) প্রবেশাধিকার আছে। হারেমে অবস্থান করতেন রাজা, সুলতান বা সম্রাটের স্ত্রীরা, উপপত্নীরা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র, অবিবাহিত কন্যা, মহিলা আত্মীয় এবং দাসীরা। এছাড়া হারেমে রাজা বা রাজপুত্রদের বিনোদনের জন্য থাকত শত শত, হাজার হাজার যুবতী মেয়ে এবং যুবতী নারী। হারেমে যে সবাই রাজ রক্তের থাকতেন, তা কিন্তু নয়, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্য নিয়ে আসা রমণীরাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকতেন।

অনেকেই বলে থাকেন যে, সম্রাটের হেরেমের সব মহিলাই তাঁর স্ত্রী, উপপত্নী, নর্তকী, বাইজি, গায়িকা ও বাঁদি। এই ভাবনা সঠিক নয়। এই ধরনের মহিলা অবশ্যই থাকতেন। তবে তারাই সব নয়। সম্রাটের মাতা, সৎমা, দুধমা, দাদি, নানী, খালা, চাচি, ফুফু, বোন, কন্যা, পুত্রবধূ ও নানা আত্মীয়-স্বজন সেখানে থাকতেন। এমনকি শিশু শাহজাদারাও হারেমে বড় হত। জাহাঙ্গীর প্রথম শাহজাদা হিসাবে হারেমে বড় হয়েছিলেন।

  • যেভাবে হারেমের জন্য নারী সংগ্রহ করা হতো:

যে সম্রাট বা রাজা বা সুলতান যত বেশি অভিজাত, ক্ষমতাশালী ও অর্থবিত্তের অধিকারী তার হারেমে নারীর সংখ্যাও তত বেশি থাকত। তখনকার রাজা বাদশাহদের আমলে যুদ্ধবিগ্রহ কম-বেশি লেগেই থাকত।

.আর যুদ্ধে পরাজিতদের স্ত্রী কন্যাকে দাস-দাসী হিসেবে হারেমে নিয়ে আসা হতো।

. কখনো বিয়ে কিংবা উপঢৌকন হিসেবে কাউকে আনা হতো।

৩.কাউকে দাসীরূপে ক্রয় করে আনা হতো। সেই দাসী কাল ক্রমে জায়গা পেত সম্রাটের হারেমে।

.এছাড়া সম্রাটের কোনো অনুচর তাকে জানাল যে, অমুক জায়গায় অমুকের একটা সুন্দর মেয়ে আছে। সম্রাট বলে দিতেন ঠিক আছে তাকে হারেমে নিয়ে আস। অনুচরেরা তাকে হারেমে নিয়ে আসত।

৫.কোনো কৃষক খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে খাজনাস্বরূপ তার পুত্র-কন্যাকে তুলে নেওয়া হতো। পুত্রকে দাস হিসেবে রাজার কাজে লাগানো হতো এবং কন্যাকে দাসী হিসেবে হারেমে প্রেরণ করা হতো। এভাবে নানা উপায়ে হারেমে নারী সংগ্রহ করা হতো।

  • হারেমের গঠন প্রণালী ও কাজকর্ম

হারেম সংস্কৃতির প্রথম দিকে প্রাসাদের অভ্যন্তরেই আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা থাকতো। যেটা হারেম নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে নারীদের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণের রীতি শুরু হয়। মুঘল আমলেই হারেম পূর্ণাঙ্গ রাজকীয় পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকাশ লাভ করে। শাহী পরিবারের নারীদের আবাসস্থলগুলো ‘মহল’ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও জেনানা, মহল-সারা, হারেম-সারা, হারেম-গাঁ, রানীবাস ইত্যাদি নামেও হেরেমকে আখ্যায়িত করা হতো। রাজপ্রাসাদের এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল মহল এলাকা। বাগান আর ফোয়ারার দিকে মুখ করে থাকা অগুনতি কামরায় হাজার দুয়েক নারীর বাস আর তাদের প্রত্যেকের জন্যই আলাদা মহল। এছাড়া আর তিনটি প্রাসাদে সম্রাটের উপপত্নীগণ বাস করতেন।

(মুঘল হারেমের অন্যতম প্রবেশ দ্বার)

একটি হারেম বা অন্তঃপুরে অনেক কক্ষের ব্যবস্থা থাকতো। আলাদা রন্ধনশালা, আলাদা প্রহরী, আলাদা গোসলখানাসহ কোনো কিছুর অভাব ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি কক্ষের মধ্যে থাকতো আরো একাধিক কক্ষ, এক কক্ষের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করা যেতো একাধিক কক্ষের প্রবেশমুখে। হারেমের চারদিক প্রহরী ও প্রাচীর বেষ্টিত থাকতো। এতোসব কক্ষ ও আয়োজনের মূল দরজা কিন্তু থাকতো কেবলমাত্র একটিই।মুঘল হারেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর ছিল। বহিরাগতের জন্য মুঘল হারেমে প্রবেশ করা রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিল।শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি যে, মোগল সম্রাটদের হারেমে থাকা নারীদের মধ্যে থেকে মাত্র 5% নারী জীবনের কোন না কোন সময়ে সম্রাটের সঙ্গ পেতেন। বাকিরা সারা জীবন একাকী কাটাতেন তাদের ডাক আসার প্রতীক্ষায়।

বিশাল এলাকা নিয়ে হারেম গঠিত হতো। হারেমের মধ্যে বিভিন্ন মহল বা প্রাসাদ থাকত। মহলগুলোর বিভিন্ন নাম ছিল। যেমন- জেনিসার (শনিবার) মহল, লেথেবার (রবিবার) মহল, মঙ্গল (মঙ্গলবার) মহল, বাঙালি মহল ইত্যাদি।

বাঙালি মহলে থাকত বিদেশি নারী ও বিদেশি উপপত্নী। রাজা বা সুলতান বা সম্রাট একেক দিন একেক মহলে যেতেন। রাজা বা সুলতান বা সম্রাট কোনদিন কোন মহলে যাবেন তা নির্ধারিত থাকত। রাজা অবশ্য ইচ্ছা করলে যেকোনো দিন যেকোনো মহলে যেতে পারতেন। সম্রাট হারেমের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময় কানিজ (নারী কর্মচারী)-দের দল তাঁকে অনুসরণ করত। হারেমে রাজা নর্তকীদের নাচ, গায়িকাদের গান উপভোগ করতেন, যাকে ভালো লাগত তাকে নিয়ে ইন্দ্রিয়সুখে মত্ত হতেন। এবং সেই উৎসব প্রায় ভোররাত পর্যন্ত চলতো।

সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতো হারেমের দরজা। ভেতরে জ্বেলে দেওয়া হতো আলো। খোজা প্রহরী ছিল নিরাপত্তার দায়িত্বে। তাদের বলা হতো "নাজির।" হারেমে থাকতো চিকিৎসক, ধাত্রীবিশারদ। হারেম সুন্দরীদের জন্য ছিল হাতি-ঘোড়ার ব‍্যবস্থা। আমোদ-প্রমোদের এলাহি বন্দোবস্ত ছিল। নাচগানের সঙ্গে ছুটতো রঙিন পানীয়ের ফোয়ারা। সম্রাট হারেমের যে কোনো নারীকে শয়নকক্ষে নিয়ে যেতে পারতেন। হারেমের ভেতরে বাইরে লাগানো হতো জীবন্তী, শ্বেতা মুস্কক ও বন্দক লতার গাছ। ওই লতা তুলে দেয়া হতো পেজাত ও অশ্বথ গাছের ডালে। এসব লতা ও গাছের জন্য নাকি বিষধর সাপ ভেতরে ঢুকতে পারতো না। আরো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পোষা হতো বিড়াল, ময়ূর, বেজি ও চিত্রল হরিণ। এসব প্রাণী সাপ দেখলে আক্রমণ করতো, তারপর খেয়েও ফেলতো।হারেমে ব্যবহারের জন্য আলাদা রকমের মুদ্রা ছিল যা বাইরে পাওয়া যেত না

হারেমের নারীদের কাজই ছিল রাজা বা রাজপুত্রদের মনোরঞ্জন করা। এ জন্য তারা নিজেরা রূপচর্চা করতেন, হারেমের অভ্যন্তরে ফুলের বাগান করতেন, নাচ-গান করতেন। নৃত্যে, সঙ্গীতে ও কাব্যচর্চায় হারেমের নারীদের জুরি মেলা ভার। কেউ রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে রাজপত্নী বা উপপত্নী হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। রাজা বা রাজপুত্র হারেমের কোনো সুন্দর কুমারীকে উপভোগ করলে রাজমাতা, ভগ্নি, স্ত্রীরা বিছানায় রক্তপাত হয়েছে কি না তা নিরীক্ষা করতেন। অবশ্য এটা সে যুগের রেওয়াজ ছিল। কোনো মেয়ের বিয়ে হলে প্রথম সহবাসে তার রক্তপাত হয়েছে কি না তা তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিরীক্ষা করতেন। উদ্দেশ্য সে সতী কুমারী কি না। না হলে তার কপালে নেমে আসত শাস্তির খাড়া। শক্তিশালী তাতার, তুর্কি এবং কাশ্মীরি মহিলাদের হারেমের গার্ডের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তারা স্থানীয় ভাষা বোঝে না, এটাও একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল।

  • হারেমের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থা

হারেমের অভ্যন্তরে ‘বেগানা’ (পর) পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল বলে হারেম-রমণীদের শল্যচিকিৎসার ভারও ছিল নারীদেরই ওপর। এদের বলা হতো, ‘জারাহ’। তবে রোগীদের অবস্থা যখন জারাহদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেত, তখন বাধ্য হয়েই পুরুষ হাকিমদের ডেকে পাঠাতে হতো বেগমখানায়। তাদের হারেমে নিয়ে যাওয়ার ঝক্কিও কম ছিল না। বেগমের জন্য নির্ধারিত খোজার কঠিন পাহারায় আপাদমস্তক কাশ্মীরি শালে মুড়ে অন্ধের মত তাকে ভেতরে নেয়া হতো। কেউ তার চেহারা দেখত না, তিনিও কাউকে দেখতে পেতেন না। ভেতরে প্রবেশের পরেও শাহী নিয়ম অনুযায়ী, বাতচিত করা যেত না সরাসরি বেগমের সাথে। বেগমের খাস বাঁদির মুখে তার বিবরণ শুনে সেই মত ইলাজ অর্থাৎ ওষুধের ব্যবস্থা করা হতো। হারেমের এক প্রান্তে, বিশেষ করে পেছন দিকে, থাকতো ধাত্রীবিদ্যা ও বিভিন্ন ব্যধিতে ব্যবহৃত ওষুধ-পথ্যের ভাঁড়ার। হারেমের নারীকুলের জন্য আলাদা চিকিৎসালয় স্থাপন করাটা গণ্য হতো অত্যাবশ্যক হিসেবে।

এমনও অনেক লেখা থেকে বর্ণনা পাওয়া যায় যে বিভিন্ন সাহেব চিকিৎসক এসে চিকিৎসার নামে, হারেমের ভিতরে নিষিদ্ধ আনন্দ লাভ করেছিলেন, হারেমে বন্দিনী অনেক অতৃপ্ত রমনীর কাছ থেকে।

  • হারেমের বিভিন্ন পদ ও তাদের কাজ:

১.রাজা বা সুলতানের মা ছিলেন হারেমের প্রধান। তাকে বলা হতো ভালিদা সুলতান (সুলতানের মা)। তিনি সমগ্র হারেমের ঘোষিত বা অঘোষিত প্রধান ছিলেন এবং হারেমের সমস্ত তদারিকির কাজ তার নামে হত।

২. হারেমের সর্বোচ্চ পদাধিকারী মহিলা কর্মচারী ছিলেন ‘মহলদার’। এরা সম্রাটের গুপ্তচর হিসেবেও কাজ । হেরেমে অবস্থানকারী মহিলাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তারা নিয়মিত সম্রাটকে অবহিত করতেন। মহলদারের হস্তক্ষেপের কারণে প্রায়ই রাজকুমারদের সাথে তার তিক্ততা সৃষ্টি হতো। মহলদারের তীক্ষ্ম নজরদারী রাজকুমারগণ পছন্দ করতেন না।

৩.তারপরে ছিল বা-খাদিম এফেন্দি। তিনি হলেন সুলতান বা রাজার প্রথম সন্তানের জননী। প্রথম সন্তানের সুযোগ ছিল পরবর্তী রাজা হওয়ার।

৪.এরপরে ছিলেন ইকবালার। তারা ছিলেন রাজার প্রথম সন্তানের পর অন্যান্য সন্তানের জননী। তারা রাজার পত্নী হিসেবে বিবেচিত হতেন।

৫. এরপরে ছিল গেদিকলি কাদমলার। এরা ছিল অভিজ্ঞ দাস-দাসী এবং তারা রাজাকে গোসল করিয়ে দিত।

৬.এরপরে ছিল অদাখলার। এরা ছিল কিশোরী দাসী যাদের সঙ্গে রাজা বা সুলতান রাত কাটাতেন এবং ভবিষ্যতে সন্তানের জননী হতেন।

৭.এরপরে ছিল গোজদে শ্রেণি। এরা ছিল সুন্দর যুবতী দাসী। এদের মধ্যে যে সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হতো, সে সুলতানের বিছানায় উঠে আসতে পারত।

৮.এরপরে সর্বশেষ শ্রেণি ছিল কারিয়ালার। এরা সাধারণ কাজকর্ম করত। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এবং বিভিন্ন যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হতে পারলে এরা গোজদে হওয়ার সুযোগ পেত। এর বাইরেও আরো বিভিন্ন রকমের কর্মচারী ছিল হারেমের জন্য, তবে তাদের উল্লেখ সেভাবে ইতিহাসের পাতায় সুপস্ট রূপে পাওয়া যায় না।

  • হারেমের পাহারাদার খোজা বাহিনী

হারেমের পাহারায় যারা নিযুক্ত থাকত তারা ছিল খোজা। তাদের খোজা ( নপুংসক) করে দেওয়া হতো যাতে তারা হারেমের ভিতর কোনো যৌন ক্রিয়ায় অংশ নিতে না পারে। রণাঙ্গনে পরাজিত সৈনিকদের খোজা করা হতো। দাস বা ক্রীতদাসদের পুত্রসন্তানদের শৈশবে খোজা বানানোর লক্ষ্যে তাদের অণ্ডকোষসহ শুক্রথলি কেটে ফেলে দেওয়া হতো।

মানুষের ক্ষেত্রেও এরূপ করা হতো শুধু খোজা বানাতে। খোজারা ছিল হারেমের প্রহরী ও কর্মচারী। তারা ছিল কামশূন্য। তাদের কোনো জৈবিক চাহিদা ছিল না, সংসার ছিল না। তাই তারা সম্রাটের খুব বিশ্বস্ত ছিল। তারা প্রভুর বিছানা তৈরি, বস্ত্রাদি ধৌত করা, চুল কাটা, পালকি টানা, মলমূত্র পরিষ্কার ইত্যাদি কাজকর্ম করত। তখন দেশে-বিদেশে খোজাদের বেশ চাহিদা ছিল। খোজারা রাজা বা রানীর ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করত। খোজাদের চাহিদা থাকায় দাস ব্যবসায়ীরা দাসদের, বিশেষ করে শিশু দাসদের খোজা করে বেশি দামে বিক্রি করত।

তৎকালীন সম্রাট ,রাজা, নবাব, সামন্ত প্রভু, অভিজাত সবারই মর্যাদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী হারেম ছিল। আর হারেমের পাহারা দেওয়ার জন্য খোজার দরকার ছিল। খোজারা হারেমের প্রহরী থাকায় রাজা নিশ্চিত হতে পারতেন যে, হারেমে জন্ম নেওয়া শিশুর পিতা তিনিই। হারেমের নারীদের কিন্তু খোজা করা হতো না। তাদের জৈবিক জ্বালা ঠিকই ছিল। রাজা বা রাজপুত্র কয়জনের কাছে যাবে? ফলে বহু নারী যৌনক্ষুধায় অভুক্ত থাকত। তাই তারা পরপুরুষের সঙ্গে কামলীলায় লিপ্ত হতে পারে এ আশঙ্কায় খোজাদের হারেমের পাহারাদার নিযুক্ত করা হতো। খোজারা নাজির নামেও অভিহিত ছিল। হারেমের অভ্যন্তরে প্রাসাদ বা মহলপ্রতি মহিলা রক্ষীও থাকত। তারা নাজিরের কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করত।প্রত্যেক রাজকুমারীর একজন করে নাজির থাকত যার ওপর তিনি গভীর আস্থা স্থাপন করতেন।

  • মুঘল হারেমের কার্যকলাপ ও অন্যান্য কাহিনী

ভারতে মুঘল বাদশাহদের হারেম ছিল। এক বিশাল হারেম তৈরি করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। তাঁর হারেমে ছিল প্রায় ৫ হাজার নারী। প্রত‍্যেকের জন্য ছিল কম বেশি আলাদা আলাদা কক্ষ। বেগমের জন্য ছিল মহিলা দারোগা। রূপ-গুণ অনুসারে তাঁর বেতন ছিল। এছাড়া ছিল কোষাধ্যক্ষ। বেগমের কোনো কিছু দরকার হলে কোষাধ্যক্ষের কাছে আবেদন করতে হতো। আর হারেমে ব‍্যবহারের জন্য ছিল আলাদা মুদ্রা, যা বাইরে চলতো না। উপপত্নীদের জন্য ছিল আলাদা মহল।

হারেমের বেগম, শাহজাদি ও রক্ষিতা---সবাই কমবেশি একই রকম সাজগোজ করতো। ঝলমলে পোষাক, হাতে আয়না বসানো আংটি, যে আংটিতে বার বার নিজের মুখ দেখতো হারেম সুন্দরী। বাবর-কন্যা গুলবদন, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, শাহজাহান-কন্যা জাহানারা ও রোশেনারা, দারাশিকোহর স্ত্রী নাদিরা বেগম, আওরঙ্গজেব-কন্যা জেবউন্নিসা ছিলেন মোগল হারেমের উল্লেখযোগ্য নারী

সম্রাট হারেমে প্রবেশ করলে তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য সঙ্গীত ও নাচের জলসা বসত। এরূপ জলসায় নারীরা তাঁকে উত্তেজক পানীয় গ্রহণে উৎসাহিত করত। হারেমের নারীদের মধ্যে একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা ছিল সম্রাট বা সুলতানের সঙ্গী হওয়ার। তবে বাইরে যাওয়ার সময় শুধু সম্রাটের প্রিয়তমা প্রত্নী সঙ্গী হতে পারতেন। সব পত্নীর ভাগ্যে সে সুযোগ হতো না। কারণ সম্রাটদের স্ত্রীও ছিল অনেক।

সম্রাট বা রাজপুত্রদের অগণিত পত্নী, উপপত্নী ও দাসী থাকা সত্ত্বেও হারেমের কোনো একজনকে হয়তো পিতা-পুত্র উভয়েরই ভালো লেগে যেত এবং তা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও দেখা দিত। যেমন আনারকলি নামে আকবরের এক দাসী ছিল। আনারকলির নাম ছিল কারও মতে শরফুন্নেসা, কারও মতে নাদিরা বেগম। আকবর তার নাম দিলেন আনারকলি। আনারকলি অর্থ ডালিম ফুল। তিনি ছিলেন নর্তকী, অপরূপা সুন্দরী। এ কারণে তার প্রতি আকবরের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় এবং তিনি হয়ে যান আকবরের উপপত্নী।

এক পর্যায়ে যুবরাজ সেলিম (জাহাঙ্গীর) ও আনারকলির মধ্যে অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আকবর এ সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। তিনি সেলিমকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করারও হুমকি দেন। কথিত আছে, আর এদিকে তিনি চার দেয়ালের মাঝে আনারকলিকে বন্দির আদেশ দেন এবং সেখানেই করুণভাবে তার মৃত্যু হয়। কারও মতে, সম্রাটের নির্দেশে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। এ ঘটনা ঘটে ১৫৯৯ সালের দিকে। পরে শাহজাদা সেলিম আনারকলির স্মৃতির উদ্দেশে লাহোরে এক সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন।

আকবরের হারেম সম্বন্ধে জনৈক লেখক ও ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন:

There were five thousand women in Akbar’s harem and these five thousand women were different from his 37 wives. A tavern was built near the Emperor’s Palace. There were so many prostitutes gathered there that it became difficult to even count them. If a courtier wanted to take a new girl home, she had to take permission from Akbar. Many times there was a quarrel among people to carry beautiful girls. Once Akbar himself called a few prostitutes and asked them who was the first to enjoy them.”

এছাড়াও মুঘল হারেমে জায়গা পেয়েছিল কাঞ্চনী নামনি একপ্রকার নৃত্য গীতে পটিয়সী মহিলাদের দল। যাদের রং হবে। এবং দেখতে হবে তারা অপরূপ রূপসী। কাঞ্চনী দলের আইন-কানুন ছিল বড্ড কড়া। কাঞ্চনী হওয়ার প্রথম শর্ত, গেরস্থ ঘরের মেয়ে হতে হবে। ভদ্র ঘরের, তবে সম্পন্ন নয় কেউই। সাধ করে কি আর কেউ কাঞ্চনী হয়! আর হ্যাঁ, এক বার কাঞ্চনী হলে তার আর সংসার পাতার উপায় নেই। কাঞ্চনীরা চিরকুমারী। একে ভদ্র পরিবারের, তায় চিরকুমারী, নাচিয়ে-গাইয়ে মহলে তাই খাতির ছিল কাঞ্চনীদের।নাই বা হলেন কাঞ্চনীরা বারবিলাসিনী। ভদ্রঘরের মেয়ে হলেও, দশ জন পুরুষের সামনে নেচেকুঁদে বেড়ায় তো! দরবারের নাচওয়ালিও বটে! হারেমের দরজা তাই তাঁদের জন্য বন্ধ।

সম্রাট শাহজাহান ভঙ্গ করেছিলেন সেই নিয়ম। শাহি হারেমের ইজ্জত ক্ষুণ্ণ করে কাঞ্চনীদের ঠাঁই দিয়েছিলেন বেগম-মহলে। এমনকী কাঞ্চনীদের হারেমের মেলাতেও প্রবেশের অধিকার দিয়েছিলেন তিনি। বিরক্ত হয়েছিল বেগমখানা, তৎকালীন সমাজ। সম্রাট শাহজাহান কেবল তাদের একবার দর্শন করেই মুক্তি দিতেন না। প্রায়ই তিনি সারারাত তাদের আটকে রাখতেন এবং রাজকর্মের শেষে তাদের নৃত্যগীত উপভোগ করতেন, তাদের সঙ্গে মসকরা করে সময় কাটাতেন।’

যে যাই বলুক, শাহজাহান পরোয়া করেননি। তবে সমস্ত সমালোচনার আঁতুড়ঘর যে তাঁর দরবার। সে কথা ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন বাদশা। শাহজাহান রসিক লোক। এক দিন হাসতে হাসতেই দরবারিদের শুনিয়ে দিলেন এক ফারসি বয়েৎ— “মিঠাই নেক্‌ হর দোকান কিস্‌ বাসাদ!” যে দোকান থেকেই কিনে আনো না কেন, মিঠাই মানেই মিষ্টি! অর্থাৎ তাই তার স্বাদ নিতে কোন দ্বিধা থাকা উচিত নয়।

  • মুঘল হারেম নিয়ে বিভিন্ন জনের বক্তব্য:

আবুল ফজল মোগল হারেমকে বলেছেন, "শাবিস্থান-ই-খাস।"

সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের পিতা ইতিমাদউদ্দৌলা জানাচ্ছেন, মোগল হারেমে কন্যা জন্মালে তাদেরও হারেমে রাখা হতো এবং যৌবনকালে সে হতো সম্রাটের ভোগ‍্যা। আর ছেলে হলে তাকে খোজা করা হতো, অথবা কারাগারে পাঠানো হতো বা হত্যা করা হতো।

ইওরোপীয় পর্যটক বার্ণিয়ে তাঁর "ট্র‍্যাভেলস্ ইন্ দ‍্য মুঘল এম্পায়ার" গ্রন্থে লিখছেন, প্রাসাদের মধ্যে ঘন ঘন মীনাবাজার বসানো হতো এবং সেখানে জোর করে ধরে আনা হিন্দু নারীদের বেচাকেনা করা হতো। সম্রাটের কাউকে মনে ধরে গেলে তার স্থান হতো হারেমে।

শাহজাহানের আমলে আসা ইংরেজ পর্যটক পিটার মাণ্ডি জানাচ্ছেন, শাহজাহানের আমলে দুর্ভিক্ষ হয় দাক্ষিণাত‍্য ও গুজরাটে। এই দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে দাক্ষিণাত্যের অধিকাংশ স্ত্রীদের বানানো হয়েছিল যৌনদাসী।

পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ে, তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, হারেমে থাকা কাঞ্চনবালা নাম্নী একপ্রকার নৃত্য গীতে পটিয়সী রমণীদের ‘দেহের গড়ন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমন নরম ও কোমল যে নৃত্যের প্রতিটি ভঙ্গিমা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে যেন লীলায়িত হয়ে ওঠে। তাল ও মাত্রাজ্ঞানও চমৎকার। কণ্ঠের মিষ্টতাও অতুলনীয়।’ মুঘল দরবার চিরকালই গান-বাজনার সমঝদার। এমন কলাপ্রেমীদের দরবারে কাঞ্চনীদের মতো শিল্পীদের কদর তো হবেই।

ইতালীয় চিকিৎসক মনুচ্চি তার স্মৃতিকথাতে মুঘল হারেমের ব্যাপারে অনেক কিছু বর্ণনা করেছেন। দারাশিকোর আমলে মুঘল হারেমে অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। সম্রাটের অনুগ্রহে কালো কাপড়ের আবরণও দরকার হত না মনুচ্চির হারেমে যাবার জন্য। তাই তাঁর কাছে হারেমের নারীদের শরীরের অতৃপ্তি আর তা থেকে অসুখের নাম করে ডাক্তারদের ডেকে এনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর এই খবর লুকোনো ছিল না। এ এগুলো তিনি কমবেশি তার স্মৃতিকথাতে সব বর্ণনা করেছেন।

এক নারীতে বেশি দিন মন টিকত না রাজপুরুষদের। রাজ মহিষীর সাথে রাত কাটাতে এসে রানির শৃঙ্গারে সাহায্য করতে ব্যস্ত কোনও পরিচারিকার দিকে নজর যাওয়ায় তাঁকে নিয়েই সেই রাত কাটানোর ঘটনাও দুর্লভ নয় সম্রাটদের ক্ষেত্রে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে রাজার অঙ্কশায়িনীর মর্যাদা, ক্ষমতা বেড়ে যেত পরের দিন থেকে।
অন্য কারও দিকে মন উঠে গেলে সেই রানি বা উপপত্নী পড়ে থাকতেন অবহেলায়। বিলাসিতার কোনও অভাব না থাকলেও কোনও পুরুষের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ছিল না। তাই লুকিয়ে চুরিয়ে পুরুষের সংসর্গের জন্য পাগল হয়ে উঠতেন তাঁরা। 
সেই আকুলতার ছবিই ধরা পড়েছে মনুচ্চির বইয়ে।

Sir Thomas Coryate writing that ,emperor Jahangir “keepeth a thousand women for his own body.”

হল্যান্ডের পর্যটক ফ্রান্সিসকো পেলসার্ট মন্তব্য করেছেন যে,

Jahangir was well-known for being the most lustful king in the history of Mughal kings, and his harem is often used as a reference to explain the workings of the Mughal Harem as an institution. At the age of just 25, he was legally married to 20 different women and had over 300 slave girls in his harem, which appeared to be ever-expanding throughout his rule.

মনুচ্চি ছাড়াও বার্নিয়ার, টমাস রো, জন মার্শাল, উইলিয়াম ফিঞ্চের মতো সেই সময় ভারতে আসা বিদেশীদের বর্ণনাতেও মুঘল হারেমের অন্তঃপুরের নানা চমকে দেওয়ার মতো নানান ঘটনা সামনে আসে।

  • মুঘল হারেমে ,এক ফরাসি প্রেমিকের কাহিনী:

বার্নার্ড সাহেব ডাক্তার। মুঘল দরবারের, এবং হারেমেরও। সুদূর ফ্রান্স থেকে হিন্দুস্তানে এসেছেন, জাহাঙ্গিরের রাজত্বের শেষ পর্বে। সাহেবের কপালও ভাল। এ দেশে পা রাখতে না রাখতেই মুঘল দরবারে হাকিমের চাকরি জুটে গেল তাঁর। কিছু দিনের মধ্যে বাদশার দিলও জয় করে ফেললেন। তাঁর ব্যবহার আন্তরিক।সবচেয়ে বড় কথা, কাজে অসাধারণ হাতযশ তাঁর। হিন্দুস্তানের হাকিমরা ইলাজ ভালই করেন, কাটাছেঁড়াও সামলান। তবে ইউরোপীয়দের মতো পটু নন। দরবারে তাই সাহেব চিকিৎসকদের ভারী কদর।

বার্নার্ডের অবশ্য আরও একটা গুণ ছিল। মানুষটা বিশ্বাসী। বেগমখানার চিকিৎসা তাঁর ওপর দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। বাদশা জাহাঙ্গীরের তাই বার্নার্ডকে ভারী পছন্দ। বেগম-মহলের ডাক্তার যিনি, তাঁর কি আর ঐশ্বর্যের অভাব হয়! বার্নার্ড সাহেবের আয় ছিল হিংসে করার মতো। যদিও তাঁর দৈনিক তন্‌খা মাত্র দশ ক্রাউন। রোগী যাঁর বেগম-মহল, সে আর তন্‌খার পরোয়া করবে কী! দরবার থেকে হারেম, সর্বত্র ভেট আর তোফার রেওয়াজ। প্রায়ই সাহেবের কাছে মুঘল হারেম থেকে তোফা আসে। দরবারের বাইরেও ডাক্তারের মস্ত পসার। শহরের রইস আদমি আর আমির-ওমরাহ মহলেও তাঁর খুব খাতির। কেউ বিমারে পড়লেই এত্তেলা আসে। আসে তোফা। মাঝে মাঝে এমনিতেও ভেট আসে তাঁর কাছে। বাদশার ঘনিষ্ঠ বলে সবাই তাঁকে খুশ রাখতে চায়। দস্তরখান থেকে শরাব পিনা, সবখানেই যিনি বাদশার সঙ্গী, তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে কে না চায়!

সব মিলিয়ে সুখেই ছিলেন ডাক্তার। কিন্তু ওই যে একটা কথা আছে, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়! বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করে প্রেমে পড়লেন বার্নার্ড সাহেব। আর তাও কিনা এক কাঞ্চনীর! সেই থেকে সাহেবের মুখ অন্ধকার। চোখে কালি। মন উচাটন। কাঞ্চনীরা মুঘল দরবারের নর্তকী। নাচিয়েরা সব কাঞ্চনবর্ণা, তাই কাঞ্চনী। শুধু কাঞ্চনবর্ণ হলেই হবে না, হতে হবে অপরূপ রূপসি। তা হলেই মিলবে কাঞ্চনী দলে নাম লেখানোর ছাড়পত্র। এক সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী, কাঞ্চনীরা এমন ঝলমলে আর জমকালো পোশাক পরত, দেখে মনে হত যেন রক্তমাংসের নারী নয়, এরা সব বেহেস্তের হুরি।

জাহাঙ্গিরের আমলে বাদশার পেয়ারের লোক বার্নার্ড সাহেব এমনই এক কাঞ্চন-সুন্দরীর প্রেমে পড়েছিলেন। টাকার অভাব নেই, রোজগারের অর্ধেকটাই তিনি ব্যয় করতেন সুন্দরী নর্তকীদের পিছনে। বাড়িতে এক দিন কাঞ্চনীদের আসর বসাতে না পারলে তাঁর মন ভরে না।

এ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এক কাঞ্চনীর নাজুক অদা-র ফাঁদে পড়ে গেলেন বার্নার্ড। আর তখনই হল মুশকিল। প্রেমে পড়তে না পড়তেই সাহেব উদ্‌ভ্রান্ত। সারা ক্ষণ বুক আনচান করে। মন পড়ে থাকে কাঞ্চনীর চরণতলে। কিন্তু কাঞ্চনী যে নিষ্ঠুর! প্রেমিকের এই হাল দেখেও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সাহেবের প্রেম প্রত্যাখ্যান করার সময় এক বারও বুক কাঁপেনি সুন্দরীর। গুস্তাকি অবশ্য কাঞ্চনীর নয়, তাঁর দলের উসুলের। কাঞ্চনীরা চিরকুমারী। সাহেবের প্রেমে সাড়া দিয়ে সেই নিয়ম নর্তকী ভাঙে কী করে!

সাহেব জানেন, এই নিয়ম ভঙ্গ করলে কেয়ামত হয়ে যাবে। মনমরা হয়ে এ দিক-ও দিক ঘুরে বেড়ান। দরবারিরা লক্ষ করেন সব। সাহস করে দু’এক জন তার কারণ জানার চেষ্টাও করেছিলেন। দায়সারা উত্তর মিলেছে, তবিয়ত ঠিক নেই আজকাল। ডাক্তার সাহেবের নিজেরই কিনা তবিয়ত ঠিক নেই! এ যে আজব তামাশা! আমিরদের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।

বিষণ্ণ মনে রোজই সাহেব হাজিরা দেন দরবারে। এক বুধবারে হাজির হয়েছেন, সে দিন কী কারণে বাদশার মনটা ভারী প্রফুল্ল। হঠাৎ বার্নার্ড সাহেবের দিকে তাকিয়ে জাহাঙ্গির ঘোষণা করলেন, সাহেবের কাজকর্মে খুব খুশি তিনি। হারেমের এক বেগমকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন বার্নার্ড। দরবারে, সবার সামনে তাই তাঁর এই একনিষ্ঠ খাদিমকে ইনাম দিতে চান বাদশা।

আমির-ওমরাহরা ‘কেয়া বাত, কেয়া বাত’ করে উঠলেন। ইনামের কথা শুনে খুশি ছলকে উঠেছে সাহেবের চোখেমুখেও। দরবারিরা সব সাহেবের শুকনো মুখে হাসি ফুটতে দেখে অবাক। ইনামের কথা শুনেই তবে সাহেবের মুখে হাসি!

কথাটা মিথ্যে নয়। তবে আশরফির প্রতি কোনও মোহ নেই বার্নার্ডের। তাঁর মনে তখন অন্য চিন্তা। নিজের কিসমত পালটানোর এই তো মস্ত সুযোগ! সেই সুযোগ বার্নার্ড নষ্ট করবেন কেন! কপাল ঠুকে বলেই ফেললেন কথাটা বাদশাকে। আগে অবশ্য ঘটা করে তসলিম করলেন, সকরিয়া জানালেন। এর পরেই পাড়লেন আসল কথা। বাদশার দোয়ায় তাঁর এই বান্দার আজ আর কোনও কিছুরই অভাব নেই। তবে আজকাল ঘরে ফিরলে বড় সুনা-সুনা লাগে। মনে হয়, আহা! তাঁরও যদি এক জন বেগম থাকত, বেশ হত। নিকাহ করার জন্য একটি মেয়েকে ইতিমধ্যে তিনি পছন্দও করে ফেলেছেন। সে দাঁড়িয়ে আছে বাদশার সামনেই, ওই কাঞ্চনী দলে। এখন শাহেনশা যদি দয়া করে কাঞ্চনী দলের ওই খুবসুরত মেয়েটিকে তাঁর হাতে তুলে দেন, তা হলে সাহেবের জীবনটা ধন্য হয়ে যায়।

শুনে আমির-ওমরাহদের সে কী হাসি! সাহেবটা সত্যিই বোকা থেকে গেল। এত দিনেও দরবারি আদব-কায়দার কিছুই রপ্ত করতে পারেনি বেচারা। বাদশার ইনাম প্রত্যাখ্যান করা যে মস্ত অপরাধ। সেই জ্ঞানটুকু যদি থাকত, তবে কি আর এমন গুস্তাকি করে বসে! আর এ দিকে সে যে খ্রিস্টান, এ কথাটাও বুঝি বেমালুম ভুলে গেল! খ্রিস্টান হয়েও কিনা এক মুসলমান কন্যার দিকে নজর দেয়! এত স্পর্ধা তাঁর! এ বার বুঝি আর ছাড় নেই, বাদশার কোপে পড়তেই হবে তাঁর প্রিয় বান্দাকে। বার্নার্ডের শাস্তির কথা ভেবে অনেকেরই তখন বুক ধুকপুক। কারও ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি! কাঞ্চনীর প্রতি লোভ, শাস্তি তো পেতে হবেই।

দরবার জুড়ে খামোশি। যেন ছুঁচ পড়লেও শোনা যাবে তার শব্দ। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে হোহো করে হেসে উঠলেন বাদশা। তাঁর চোখে-মুখে কৌতুক। সাহেবের আর্জি মঞ্জুর করছেন তিনি। কিন্তু একটা শর্ত আছে— দরবার থেকে এই কাঞ্চনীকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে বার্নার্ড সাহেবকে। তাই হল। সভাসুদ্ধ লোক হইহই করতে করতে কাঞ্চনীকে নিয়ে এসে বসিয়ে দিল বার্নার্ডের কাঁধে। সাহেবও হাসতে হাসতে বীরদর্পে তাঁর মেহবুবাকে কাঁধে নিয়ে ছুটলেন বাড়ির দিকে। এই প্রথম কোনও কাঞ্চনবালা বেগম হল। সাগরপারের এক ভিনদেশির বেগম। বন্ধুর সম্মানে দীর্ঘ দিনের পুরনো নিয়ম ভঙ্গ করে তাঁর অভিলাষ সে দিন মঞ্জুর করেছিলেন বাদশা জাহাঙ্গির।

  • মুঘল হারেমের অভ্যন্তরে রাজনীতি

মুঘল হারেমের অভ্যন্তরে একেকটি মহল ছিল জটিল রাজনৈতিক কেন্দ্র। প্রত্যেক উজির-আমীর তাদের একটা দুটো মেয়েকে মহলে ঢুকিয়ে দিতে উদগ্রীব থাকব এবং এর জন্য হারেমের মহলদারের সাথে মিলে নানা দুরভিসন্ধির আশ্রয়ও তারা নিত। কারণ, একবার যদি কন্যা স্বয়ং বাদশাহর চোখে পড়ে যায় তাহলেই কেল্লা ফতে! এভাবেই যে হারেম মুঘল বাদশা ও রাজপুত্রদের মনোরঞ্জনের কাজে একদা ব্যবহৃত হতো বা হচ্ছিল তা ক্রমশ রাজনীতিক আবর্তের মধ্যে পড়ে যায়, এর রাজকীয় মর্যাদা কলুষিত হতে থাকে।

  • ভারতীয় তথা বিশ্বসভ্যতায় মুঘল হারেমের প্রভাব ও তার দান:

মুঘল পুরুষেরা তাদের দোর্দন্ড প্রতাপে ভারতবর্ষকে শাসন করেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী, তারা যেভাবে শাসনের উত্তাপ ছড়িয়েছে, তেমনি মুঘল হারেমের নারীরাও ছিলেন দারুন অগ্রসর, কেউ কেউ নিজেদের বিচার-বুদ্ধি দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাদশাহ বা শাহজাদার বিকল্প নীতিনির্ধারকও।

কোনও এক সময় রাজপুরুষের নজরে পরে চিরকালের জন্য হারেমে বন্দী হয়েছিলেন এই সব নারীরা। বাইরের জগতের দরজা চিরকালের জন্যই বন্ধ তাঁদের জন্য। কেউ কেউ আবার উপহার হিসাবে হাত বদল হয়ে কিংবা রাজকর্মচারীদের বদান্যতায় সম্রাট ও তাঁর পরিবারের পুরুষদের কামনার রসদ হতে এসেছিলেন এই হারেমে। তাই বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন সংস্কৃতি এক হয়েছিল এই হারেমের অন্দরে। ফলে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তৎকালীন মুঘল হারেমে।

হারেমের নারীরা, প্রয়োজনীয় প্রাথমিক শিক্ষা তারা হারেম গৃহের অভ্যন্তরেই পেতেন, অনেক মুঘল নারীই বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষত সাহিত্য, কাব্য ও শিল্পকলায় উচ্চতর শিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়েছিলেন যার পরিচয় মুঘল সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্থাপত্য শিল্পে আজও ভাস্বর। তাছাড়া হারেমের নারীগণ মধ্য এশীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রায় সকলেই অশ্বারোহণ করতেন এবং এটি সেসময় খুবই স্বাভাবিক ছিল। তারা পোলো খেলতেন এবং স্বামীর সহগামীরূপে শিকারে গমন করতেন।

মুঘল হেরেমের যেসব নারী সুবিখ্যাত হয়ে আছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাবর-কন্যা গুলবদন বেগম, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, শাহজাহান-পত্নী সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল, দারাশিকোর স্ত্রী নাদিরা বেগম, আওরঙ্গজেব কন্যা জেবুন্নেসা, শাহজাহান-কন্যা রওশন আরা, শাহজাহান দুহিতা জাহানারা এবং বাহাদুর শাহ জাফরের স্ত্রী জিনাত মহল।

বিশেষত, নূরজাহান বা ‘জগতের আলো’ নামে খ্যাত এই মুঘল রমণী কেবল ভারতবর্ষ বা মুঘল ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব ইতিহাসেরই এক বিস্ময়কর নারী ব্যক্তিত্ব। স্বরচিত কাব্যপাঠ বা ‘মুশায়েরা’ তার সময় থেকেই উপমহাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। নূরজাহানেরই পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকাই মসলিনের একটি নতুন ধরন ও নকশা প্রবর্তন করা হয়, যাকে বলা হতো ‘আবে রাওয়াঁ’ বা ‘জলের ইন্দ্রজাল’।ভোজের সময় দস্তরখানের ব্যবহার, চোলি বা আধুনিক ব্লাউজের প্রচলন, পোশাকে বোতাম, অন্তর্বাস, নৈশবেশ, কুর্তা,কামিজ এবং জরির লেসের প্রচলন করেন এই নূরজাহান।

সৌন্দর্য চর্চায় নূরজাহানের সবচেয়ে খ্যাতিমান আবিষ্কার গোলাপের আতর, ‘আতরে জাহাঙ্গীরী’। নূরজাহানের স্নানঘরে বিশাল টবে গোলাপ মিশ্রিত পানিতে তরলাকার ভাসমান পদার্থের মধ্যে গোলাপের নির্যাস ছড়িয়ে রাখা হতো। সাথে আরো থাকত আতর, চন্দন, উপটান ও অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী।

  • অন্যান্য রাজা মহারাজাদের হারেম:

বাংলার স্বাধীন নওয়াবগণও মুঘল ঐতিহ্য অনুসারে হারেম প্রথা প্রবর্তন করেন। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীতে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পরও হারেম ব্যবস্থা অপরিবর্তিত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মকর্তা ও ইংরেজ বণিকগণ নওয়াবদের মতো হারেম রীতি অনুসরণ করে। তবে তাদের হারেমে আর্মেনীয়, পর্তুগিজ, বাঙালি, এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের সমাবেশ ঘটত।

দাক্ষিণাত‍্যের গুলবর্গার মুসলিম শাসক ফিরোজ শাহ বাহমনী ভীমা নদীর তীরে ১৩৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দুর্গের আকারে পাথরের হারেম তৈরি করেন। নদী থেকে খাল কেটে হারেমের ভেতরে জল সরবরাহের ব‍্যবস্থা ছিল। হারেমের ভেতরে সুন্দরীদের জন্য ছিল নির্দিষ্ট কক্ষ।

টিপু সুলতানের হারেমে ছিল ৬০১ জন নারী। এর মধ্যে পিতা হায়দার আলীর ২৬৮ জন, টিপুর ৩৩৩ জন। এদের মধ্যে মহীশূরের হিন্দু রাজপরিবারের দুই কন্যা ছিলেন। এর মধ্যে ৮০ জন ছিলেন উচ্চ সম্মানের জায়গায়, বাকিরা দাসী পর্যায়ের। (-- তথ্যসূত্র: ক‍্যাপ্টেন হ‍্যারিয়ট, চিফ সেক্রেটারি অব্ মাদ্রাজ, ০২/০৭/১৮০০ তারিখের রিপোর্ট।)

মুহম্মদ বিন তুঘলক যখন ইবনে বতুতাকে চীনের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন তখন সুলতান তাকে ১০ জন এবং চীনের সম্রাটের জন্য ১০০ জন দাসী উপহার হিসেবে প্রেরণ করেন। পথিমধ্যে ডাকাতি ও নৌকাডুবির ফলে ইবনে বতুতার সে যাত্রায় চীনে যাওয়া হয়নি। তিনি মালদ্বীপ, জাভা, শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলায় আসেন (১৩৪৬ খ্রি.)।

মিসরে ফাতেমীয় বংশের এক খেয়ালি বাদশাহ ছিলেন। নাম তার আবু আলী আল মনসুর (৯৯৬-১০২১)। তিনি তার হারেমের গেট বন্ধ করে ২৮০০ বালিকাকে না খাইয়ে মেরে ফেলেন। খলিফা হারুনুর রশিদের ১২ সন্তানের ১১ জনই ছিল উপপত্নীদের ঘরের। বহুবিবাহ করা, উপপত্নী ও দাসী রাখা ছিল যেন ঐতিহ্যের ব্যাপার।

সুবে বাংলার নবাবদেরও হারেম ছিল। জানা যায়, হারেমে জনৈকা হারেম সুন্দরীর সঙ্গে মদিরা পানে সময় কাটাতেন নবাব আলিবর্দী খান। তবে এত সুখের আয়োজন থাকা সত্ত্বেও অনেক নারীরা হারেমমুখী হতে চান নি। তাঁরা জহরব্রত পালন করে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, কিন্তু হারেমের সুখ নিতে চান নি।

হারেমের নারীদের ভাত কাপড়ের অভাব হয়তো ছিল না। কিন্তু তাদের ব্যক্তিজীবন বলে কিছু ছিল না। যৌনজীবনের কষ্টের সীমা ছিল না। এমনকি রাজার পত্নীরা তাদের জীবনে রাজাকে কয়দিন কাছে পেয়েছে? নারীরা যে মানুষ, তাদের যে ক্ষুধা, তৃপ্তি, আনন্দ, ভালোবাসা আছে তা বিবেচনা করা হতো না। আভিজাত্যের চিড়িয়াখানায় বন্দি থাকতেন মুঘল হারেমের নারীরা !

নারীদের দাসী হিসেবে হাটে-বাজারে বিক্রি করা হতো।
ব্যবসায়ীরা সুন্দর যৌন আবেদনময়ী নারীদের দাসী হিসেবে বেছে নিতেন এবং বিক্রি করতেন। তারপরেও যৌনজীবন যুৎসই না হলে তাকে ফেরত দেওয়া হত। তখন পণ্যের মতো নারী উপহার দেওয়া হতো।যৌবন চলে গেলে হারেম থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হতো। কখনো বেচে দেওয়া হতো, আবার কখনো আমির-ওমরাহদের উপহার দেওয়া হতো এইসব বিগত যৌবনা হারেমবাসিনীদের। তাদের জায়গায় আনা হতো নতুন যৌবনবতীদের। কাজেই হারেমে ছিল শুধুমাত্র যৌবনের দাম, যুবতীদের কদর।

হারেম মানে তাই, যেন শুধু, যৌবনকালের যৌন জীবন এর ঝলকানি মাত্র। যা কিছুক্ষণ আলো দিয়েই অন্ধকারে পর্যবসিত হতো। এবং এর ফল বয়ে বেড়াতে হতো হারেম থেকে বিতাড়িত , ভাগ্যহীনা ঐসব মহিলাদের। যাদের অসহায়তার কান্না, আর্ত চিৎকার আজও মুঘল হারেমের দেওয়াল গুলিতে যেন অনুরণনিত হতে থাকে।


Source: 

1. https://en.wikipedia.org/wiki/Mughal_Harem

2. https://www.outlookindia.com/outlooktraveller/tag/mughal-harem

3.http://www.kholakagojbd.com/public-opinion/698

4.https://www.newindianexpress.com/cities/bengaluru/2013/nov/28/Inside-the-harem-of-the-mughals-542659.html

5. https://www.daily-bangladesh.com/colorful-life/44139

6.https://www.dailyo.in/variety/mughal-royal-harem-voyeurism-erotic-instincts-shah-jahan-14650

7. https://risingbengal.in/history-of-india/life-of-harem-beauties

8.https://www.anandabazar.com/rabibashoriyo/doctor-bernard-fall-in-love-with-an-indian-girl-at-jahangir-badshah-s-harem-1.7688689. 

9. https://amp.scroll.in/article/960434/the-making-of-akbars-complicated-harem-where-rajput-women-played-a-critical-role#amp_tf%3DFrom%20%251%24s%26aoh%3D16623044109424%26referrer%3Dhttps%3A%2F%2Fwww.google.com

10. https://amp.scroll.in/article/960434/the-making-of-akbars-complicated-harem-where-rajput-women-played-a-critical-role#amp_tf%3DFrom%20%251%24s%26aoh%3D16623044109424%26referrer%3Dhttps%3A%2F%2Fwww.google.com

11. https://servantspasts.wordpress.com/2019/08/12/third-gender-and-service-in-mughal-court-and-harem/

12. https://medium.com/lessons-from-history/the-sex-lives-of-women-inside-a-mughal-emperors-harem-10124c18260b

13. https://www.tandfonline.com/doi/abs/10.1080/00856400903049457?scroll=top&needAccess=true&journalCode=csas20

সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা ক...

Popular Posts