Saturday, December 2, 2023

অভিনবগুপ্ত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা


৭৬১ সালের আগে, ৭২৪ সালের পরে কোনো এক সময়ে আজকের উত্তরপ্রদেশের গঙ্গ-যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চল, যাকে পূর্বে মধ্যদেশ বা অন্তর্বেদী বলা হত, সেই অন্তর্বেদী থেকে কাশ্মীরের মহারাজ মুক্তাপীড় ললিতাদিত্য (৭২৪-৭৬০) নিয়ে আসেন সপরিবার এক শৈব ব্রাহ্মণকে। তিনি অত্রিগুপ্ত। গোত্র – অত্রি। এঁর উত্তরপুরুষই হলেন মহামাহেশ্বর আচার্য অভিনবগুপ্ত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাঁর শিষ্য প্রশিষ্যাদিক্রমে তাঁকে অভিনবগুপ্তপাদ বা অভিনবগুপ্তনাথও বলা হয়ে থাকে। অভিনবগুপ্ত তাঁর এই পূর্বপুরুষ সম্বন্ধে বলছেন (তন্ত্রালোক, ৩৭.৩৮) – 

নিঃশেষশাস্ত্রসদনং কিল মধ্যদেশ-

স্তস্মিন্নজায়ত গুণাভ্যধিকো দ্বিজন্মা ।

কোঽপ্যত্রিগুপ্ত ইতি নামনিরুক্তগোত্রঃ

শাস্ত্রাব্ধিচর্বণকলোদ্যদগস্ত্যগোত্রঃ ॥

মধ্যদেশ হল সমস্ত শাস্ত্রের (বিদ্যার) আলয়। সেখানে একজন অতিগুণবান কোনো এক বিপ্র জন্ম গ্রহণ করেছিলেন যাঁর নাম ছিল অত্রিগুপ্ত। তাঁর নামই তাঁর গোত্রকে বলে (অর্থাৎ তাঁর গোত্র অত্রি, বা তিনি অত্রিগোত্রীয় ব্রাহ্মণ)। (কিন্তু) শাস্ত্রের সাগরকে তিনি যেভাবে গিলে ফেলেছিলেন তাতে তিনি অগস্ত্যেরই গোত্রীয় বটে।

অভিনবগুপ্ত কত সংখ্যক উত্তরপুরুষ তা জানা যাচ্ছে না। অত্রিগুপ্তের পরেই নাম পাওয়া যাচ্ছে অভিবগুপ্তের ঠাকুরদা বরাহগুপ্তের। এঁর পুত্র নরসিংহগুপ্ত। কাশ্মীর লোকসমাজে এঁর নাম ছিল চুখুলক। ডাক নাম গোছের। নরসিংহগুপ্তের বিবাহ হয় বিমলাদেবীর সঙ্গে। এঁদের সন্তান অভিনবগুপ্ত।

এঁদের নামের সঙ্গে গুপ্তটি এখনকার অমুকচন্দ্র-অমুকনাথ-গোছের। বংশধারায় এমন নাম চলে এসেছে। প্রসঙ্গে বলে রাখি, অভিনবগুপ্তদের পারিবারিক মানুষদের নাম ছাড়াও সমসাময়িক এবং অভিনবপূর্ববর্তী অনেক নাম মেলে যাদের নামের শেষে গুপ্ত-শব্দটি রাখার চল ছিল। এরা একই পরিবারের বিভিন্ন শরিক বা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের একথা চিন্তনীয়। কেউ কেউ শিবসূত্রের রচয়িতা বসুগুপ্তকে অভিনবগুপ্তের একজন পূর্বপুরুষরূপে বলেছেন বটে, তবে এই বিষয়ে কোনো তথ্য প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তাই সেটি গুপ্ত-গুপ্ত-পরিবার গোছের কথা। যাক, এই প্রসঙ্গ নিয়ে আরও বিস্তার করার প্রয়োজন হলে শৈবধারার আলোচানায় করা যাবে।

প্রাচীন আচার্যদের মধ্যে এই আত্মচরিত কথনে বিরত, তাতে অভিনবগুপ্ত নিতান্ত একজন বিলক্ষণ ব্যক্তি। তাঁর মত এত ব্যক্তিগত তথ্যের উপস্থানে তৎপর কষ্টে শিষ্টে কেউ মেলে।








তিনি কাশ্মীরের বর্ণনা দিচ্ছেন, সেখানকার গাছ-নদী-খাদ্যের। তিনি অনেক রাজা ও স্বীয় শিষ্যদের কথা বলছেন। তিনি তাঁর গুরুদের। কার কাছ থেকে কী পেয়েছেন সেই কথাও বলছেন। ন তু এতেনৈব অলম্। এই যথেষ্ট নয়, তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় রচনাকাল উল্লেখ করে গেছেন। এতো! এতো! এতোটা তো দেখা যায় না। সেই বুদ্ধের বিষয়ে অনেক পর্যাপ্ত তথ্য আছে, তবে সেখানে পরমুখগত আত্মকথা আছে, এখানে সাক্ষাৎ আত্মকথা। আর তাও এতো।

এখানে সব থেকে মজার বিষয়। বিস্ময়ই বটে! বিখ্যাত রাজতরঙ্গিণীকার, এ নিতান্ত অতিশয় নয় তিনিই ভারতীয় তথ্যাবলম্বী রাজকীয় দেশজ ইতিহাসের জনক, পণ্ডিত কল্হণ একটি বারও অভিনবগুপ্তের উল্লেখ করেননি। বিষয়টি এমন একদমই হতে পারে না যে কল্হণ অভিনবগুপ্তকে চিনতেন না। চিনতেন না বলা ভুল হবে, কারণ অভিনবগুপ্তের অন্তর্ধানের অনেক পরে প্রায় ১০৯৫ সালে কল্হণের জন্ম। তিনি অভিনবগুপ্তের শিষ্য বিখ্যাত কবি ক্ষেমেন্দ্রের নৃপাবলি পড়েছেন। এবং সেটির সমালোচনাও করেছেন। আর ক্ষেমেন্দ্রের থেকেই আমরা জানছি অভিনবগুপ্ত তাঁর গুরু। তাঁর কৃপাতেই ক্ষেমেন্দ্র নাট্যাদি সাহিত্যশাস্ত্র এবং কবিত্ব লাভ করেছেন। তাই কল্হণের অভিনবগুপ্ত সংক্রান্ত অজ্ঞতার কোন বীজ থাকাই সম্ভব নয়। যেখানে অভিনবগুপ্ত তাঁর জীবদ্দশাতেই শিবাবতার, ভৈরবের অবতার বলে প্রখ্যাত। যিনি সিদ্ধান্ত, বাম, কুল, ত্রিক, প্রত্যভিজ্ঞা, ক্রম আদি অদ্বৈত শৈববাদের, শুধু তাই নয় কলার প্রভূত দিক, বিশেষত সঙ্গীতশাস্ত্র, সমগ্র ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র, অলঙ্কারশাস্ত্র, ধ্বনিসম্প্রদায়, রসসম্প্রদায়, অন্যদিকে ব্যাকরণ, তাঁকে অনেকে শেষনাগ পতঞ্জলির অবতার মনে করেছেন তাই তাঁর নাম অভিনবগুপ্তপাদ, গুপ্তপাদ-লুকানো পা অর্থাৎ সাপ অর্থাৎ নাগেশ্বর অনন্ত শেষ অর্থাৎ পতঞ্জলি তিনি অভিনব হয়ে এসেছেন তাই অভিনবগুপ্তপাদ, তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর তন্ত্রালোকে তিনি বেদ থেকে প্রসঙ্গ তুলে তার তান্ত্রিক ব্যাখ্যা করছেন, যে পূর্বপক্ষীরা এই ভৈরবসম্প্রদায়ের শৈবদের কৌলদের অবৈদিক বলে নাক ঊঁচু করছে তিনি সেই সব উড়িয়ে দিচ্ছেন কলমের খোঁচায়, এমন উদ্ভট পাণ্ডিত্য নিয়ে যিনি মূর্ধন্য আচার্য তাঁর সমাজে নিঃসন্দেহে এক প্রতিষ্ঠা এবং বহুজনবিদিততা ছিল।

আমার স্বকীয় একটি বিচার এই প্রসঙ্গে আছে। সেই গুলি কাশ্মীরের রাজপরিবার, কাশ্মীরীয় শৈব-শাক্ত তন্ত্রের পরম্পরা এই সবের সঙ্গে যুক্ত।

সমুদ্রপুত্র রাজা গৌড় গোবিন্দ ও শ্রীহট্ট

  সিলেটের   ‎ গৌড় গোবিন্দ এবং আজকের   ‎ শাহজালাল বিভিন্ন তথ্যপঞ্জী এবং পরবর্তিতে আবিষ্কৃত তাম্রফলক ও শিলালিপি থেকে সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস স...

Popular Posts