Friday, January 19, 2018

রাবণের প্রতিভা

রামচন্দ্র ছিলেন ক্ষত্ৰিয়কুলোদ্ভব, চার বর্ণের দ্বিতীয় বর্ণের মানুষ। সেকালের ক্ষত্রিয়রা ছিলো বংশগত যোদ্ধা, অর্থাৎ নরঘাতক। আর রাবণ ছিলেন ব্রাহ্মণ বংশীয়। এ কথাটা শুনে রামভক্ত হিন্দু ভাইয়েরা হয়তো আঁতকে উঠতে পারেন। ব্রাহ্মণ-এর সাধারণ সংজ্ঞা হলো – ব্রহ্মাংশে জন্ম যার, অথবা বেদ জানে যে, কিংবা বেদ অধ্যয়ন করে যে, নতুবা ব্রহ্মের উপাসনা করে যে — সে-ই ব্রাহ্মণ। ঋষিগণ সর্বত্রই উক্ত গুণের অধিকারী। তাই ঋষি মাত্রেই ব্রাহ্মণ। রাবণের দাদা পুলস্ত্য ছিলেন ব্ৰহ্মার মানসপুত্র এবং স্বনামধন্য ঋষি। কাজেই তিনি ছিলেন বংশে ও গুণে উভয়ত ব্রাহ্মণ। পুলস্ত্য ঋষির পুত্র অর্থাৎ রাবণের পিতা বিশ্ৰবাও ছিলেন একজন বিশিষ্ট ঋষি। কাজেই তিনিও ছিলেন বংশগত ও গুণগত ব্রাহ্মণ। তাই ব্রাহ্মণ ঋষি বিশ্ববার পুত্র রাবণ গুণগত না হলেও কুলগত ব্ৰাহ্মণ ছিলেন নিশ্চয়ই। এতদ্ভিন্ন নিম্নলিখিত আলোচনাসমূহে রাম ও রাবণের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার তুলনামূলক কিঞ্চিৎ পরিচয় পাওয়া যাবে।
১. রাবণের রাজমহলকে (কখনো লঙ্কাকেও) বলা হয়েছে ‘স্বর্ণপুরী। এতে রাবণের ঐশ্বর্য, শিল্প-নিপুণতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রুচিবোধ ইত্যাদি বহু গুণের পরিচয় মেলে। কিন্তু রামচন্দ্রের বাড়িতে এমন কিছুর উল্লেখ দেখা যায় না, যার দ্বারা তার ওসব গুণের পরিচয় পাওয়া যায়।


২ লঙ্কায় সীতাদেবী বন্দি হয়েছিলেন রাবণের তৈরী অশোক কাননে। তা ছিলো রাবণের প্রমোদ উদ্যান, যেমন আধুনিক কালের ইডেন গার্ডেন। সে বাগানটিতে প্রবেশ করলে কারো শোকতাপ থাকতো না। তাই তার নাম ছিলো অশোক কানন। সে বাগানটির দ্বারা রাবণের সুরুচি ও সৌন্দর্যপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। অধিকন্তু তিনি যে একজন উদ্ভিদবিদ্যা বিশারদ ছিলেন তা-ও জানা যায়। আর তার প্রমাণ মেলে একালের সুপ্রসিদ্ধ খনার বচনে। খনা বলেছেন –

“ডেকে কয় রাবণ, কলা-কচু না লাগাও শ্রবণ।”




শত শত জাতের ফল-ফুল ও লতাগুলেমর বৃক্ষরাজির একস্থানে সমাবেশ ঘটিয়ে তা লালনপালন ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়।

 
৩. রামচন্দ্র লঙ্কায় গিয়েছিলেন কপিকুলের (বানরের) সাহায্যে মাটি-পাথর কেটে বাঁধ নির্মাণ করে, দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায়। কিন্তু লঙ্কা থেকে ভারতের দণ্ডকারণ্য তথা পঞ্চবটী বনে রাবণ যাতায়াত করেছিলেন ‘পুষ্পক’ নামক বিমানে আরোহণ করে অতি অল্প সময়ে। রাবণ যে একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বা বৈমানিক এবং কারিগরিবিদ্যা-বিশারদ ছিলেন, তা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।


৪. রাবণ আবিষ্কার করেছিলেন এক অভিনব যুদ্ধাস্ত্র, যার নাম ‘শক্তিশেল। তা শক্তিতে ছিলো যেনো বন্দুকের যুগের ডিনামাইট। নিঃসন্দেহে এতে রাবণের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় মেলে।



৫. রামচন্দ্রের নিক্ষিপ্ত শরাঘাতে রাবণের মুমুধু সময়ে তার কাছে গিয়ে রামচন্দ্র রাজনীতি সম্বন্ধে তার উপদেশপ্রার্থ হয়েছিলেন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তিনি রামচন্দ্রের সে প্রার্থনা পূর্ণ করেছিলেন ধীর ও শান্তভাবে, সরল মনে। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাবণ সে যুগের একজন রাজনীতি-বিশারদ ছিলেন। অধিকন্তু ছিলেন ধৈর্য, সহন ও ক্ষমাশীল এবং প্রতিহিংসাবিমুখ এক মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী।


৬. রামায়ণ মহাকাব্যে রাবণকে বলা হয়েছে দশানন। কিন্তু বাস্তবে রাবণের দশটি মুণ্ড নিশ্চয়ই ছিলো না। তবে তার মাথার মজ্জা অর্থাৎ জ্ঞান ছিলো দশটা মুণ্ডের সমান।তিনি ১০টি মহা বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি এতটাই মেধাবী ছিলেন যে ১০ জন মানুষের বুদ্ধি আর জ্ঞান একসাথে উনার মাথায় ধরতে পারতেন। উনার ১০টি আলাদা মাথা ছিল এটা কাল্পনিক তত্ত্ব। 


৭. রাক্ষস বা নরখাদক বলা হয়েছে রাবণকে। উপরোক্ত আলোচনাসমূহের পরে এ বীভৎস বিশেষণটি সম্বন্ধে আর কিছু সমালোচনা আবশ্যক আছে বলে মনে হয় না। তবুও প্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে একটি প্রশ্ন না রেখে পারছি না। রাবণের দাদা হচ্ছেন পুলস্ত্য, পিতা বিশ্ৰবা, ভ্রাতা কুম্ভকৰ্ণ ও বিভীষণ, বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবের এবং পুত্র ইন্দ্রজিৎ (প্রসিদ্ধ বৈমানিক) ; এরা সকলেই ছিলেন সভ্য, ভব্য, সুশিক্ষিত, গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তি। এঁরা কেউই রাক্ষস বা কাচামাংসভোজী মানুষ ছিলেন না। রাবণও তার শৈশবকালাবধি মাতা-পিতার রান্না করা খাবারই খেয়েছেন নিশ্চয়। অতঃপর যৌবনে হঠাৎ করে একদিন তিনি খেতে শুরু করলেন জীবের কাচামাংস ৷ বিমান বিহার, শক্তিশেল নির্মাণ ও অশোক কানন তৈরী করতে জানলেও তিনি রান্নার পাকপাত্র গড়তে বা রান্না করতে জানেন নি। বেশ ভাল। কিন্তু তিনি কোথায় বসে, কোন দিন, কাকে খেয়েছেন – তার একটিরও নামোল্লেখ নাই কেন?


৮. সীতা রাবনের কাছে বন্দিনী হিসাবে থাকলেও রাবন সীতার সতীত্ব নষ্ট বা উনাকে অপমান করেন নাই। উপ্রন্তু উনার সুরক্ষার জন্য মহিলা পাহারাদার নিযুক্ত করেন। এবং সর্ব আহারাদির ব্যাবস্থা তথা সুযোগ সিবিধা নিশ্চিত করেন। এতে বোঝা যায় উনি নারীর প্রতি সম্মানশীল ছিলেন।


৯. রাবন ছিলেন পরমেশ্বর ভগবান দেবাদিদেব মহাদেব শিবের পরম ভক্ত। উনার মাধ্যমেই শিবতান্ডব স্তোত্র রচনা হয়। উনি সঙ্গীত ও জ্যতির্বিদ্যায় মহা পারদর্শী ছিলেন।





এবার আসি রামায়নের বানর প্রজাতি কি আসলেই বানর ছিলেন?
ভালো করে পড়ুন এই অংশটি। 

প্রথমত হনুমান — পবনদেবের ঔরসে মানবী অঞ্জনার গর্ভে এর জন্ম। কাজেই হনুমান দেব-মানবের বংশজাত একজন বীর্যবন্ত মানব।
দ্বিতীয়ত জাম্ববান – এ হচ্ছে দেবতা ব্ৰহ্মার পুত্র। জাম্ববানের কন্যার নাম জাম্ববতী এবং তাকে বিয়ে করেন হিন্দুদের পরম পূজনীয় শ্ৰীকৃষ্ণ। সুতরাং জাম্ববান হচ্ছে শ্ৰীকৃষ্ণের শ্বশুর। কাজেই সে ভালুক বা পশু হতে পারে না, সে ব্রহ্ম বংশের মানুষ ; সুতরাং ব্রাহ্মণ।
তৃতীয়ত বালী ও সুগ্ৰীব – দেবরাজ ইন্দ্রের (মতান্তরে সূর্যের) ঔরসে ও ব্রহ্মার মানসকন্যা রক্ষরজার গর্ভে বালী ও সুগ্ৰীবের জন্ম হয়। সুতরাং বালী ও সুগ্ৰীব হচ্ছে ইন্দ্রের বা সূর্যের পুত্র এবং ব্রহ্মার দৌহিত্র (নাতি)। বিশেষত ব্ৰহ্মার বংশজাত বলে তারা ব্রাহ্মণত্বের দাবীদার।
উপরোক্ত আলোচনাসমূহের দ্বারা অনুমান হয় যে, রামায়ণোক্ত বানররা পশু ছিলো না, তারা ছিলো ভারতের ‘কিঙ্কিন্ধ্যা’ নামক অঞ্চলের আদিম অধিবাসী এবং আলোচ্য ব্যক্তিরা ছিলো সেকালের বিশিষ্ট ব্যক্তি। কেননা রামায়ণ মহাকাব্যে অজস্র বানরের আভাস থাকলেও প্রাধান্য পেয়েছে এরাই।
এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী মর্গানের মতবাদ অনুধাবনযোগ্য। মর্গানের মতে – বেচে থাকার তাগিদেই মানুষকে জোট বাধতে হয়েছে। জোট মানে দল। কিন্তু কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে দল বাধবে? মৰ্গানের গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, সে সময় মানুষ দল বেঁধেছিলো জ্ঞাতি সম্পর্কের ভিত্তিতে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জ্ঞাতি, একই পূর্বপুরুষ থেকে তাদের জন্ম। মর্গান এমনি এক একটি দলের নাম দিয়েছিলেন গেনস (Gens)। মর্গানের পরের যুগের নৃবিদরা গেনস্ শব্দের বদলে ক্লান (Clan) শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং ক্লান শব্দটিই চলছে।
কয়েকটি ক্লান একসঙ্গে জোট বাধলে যে বড়ো দলটি গড়ে ওঠে, তার নাম দেয়া হয়েছে ট্রাইব (Tribe)। আবার অনেকগুলো ট্রাইব মিলে আরো বড়ো একটি সংগঠন, তার নাম কনফেডারেসি অব ট্রাইবস।
সাধারণত জন্তু-জানোয়ারের নাম থেকেই ক্লানের নাম হতো। যেমন – ভালুক, নেকড়ে বাঘ, হরিণ, কাছিম ইত্যাদি। আবার ফুল, ফল, লতাপাতার নাম থেকেও ক্লানের নামকরণ হতো। এধরণের নামকরণের মূলে যে বিশ্বাসটি রয়েছে, তাকে বলা হয় টোটেম বিশ্বাস।
পাক-ভারত উপমহাদেশের সাওতাল উপজাতির শতাধিক গোত্র বা টোটেম আছে, হো উপজাতির আছে ৫০টিরও বেশী। এরূপ মুণ্ডা উপজাতির প্রায় ৬৪টি, ভীল উপজাতির ২৪টি, ছোটাে নাগপুরের খারিয়া উপজাতির ৮টি এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার দৌড়ি উপজাতির মধ্যে ৪টি গোত্র বা টোটেম রয়েছে। এদের প্রত্যেক গোত্রই — পশু, পাখী, গাছপালা অথবা কোনো বস্তুর নামে পরিচিত। আমাদের দেশেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐরূপ বহু গোত্রের নাম দৃষ্ট হয়, যদিও এগুলোকে ঠিক টােটেম বলা যায় না। যেমন – সেন (শ্যেন = বাজপাখী), নাগ (সপ), সিংহ (পশুরাজ) ইত্যাদি। গোত্রের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে তার গোত্রের টোটেমের নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। যেমন – সিংহ গোত্রের সবাই সিংহ, বাঘ গোত্রের সবাই বাঘ, হরিণ গোত্রের সবাই হরিণ ইত্যাদি।
মর্গানের মতে বিশেষত আধুনিক বহু নৃতত্ত্ববিদের মতে – রামায়ণোক্ত ) জাম্ববান ও হনুমানাদি ভালুক ও বানররা পশু ছিলো না, তারা ছিলো সেকালের কিষ্কিন্ধ্যার (ভারতের দণ্ডকারণ্যের অংশবিশেষ, আধুনিক নাম নাশিক) অনার্য অধিবাসী (মানুষ)। বানরাদি ছিলো তাদের টােটেম বা বংশগত উপাধি মাত্র। অধিকন্তু এ-ও অনুমান হয় যে, হয়তো হনুমান ও সুগ্ৰীব ছিলো কোনো ক্লান ও ট্রাইব-এর অধিকর্তা এবং বালী ছিলো কোনো ‘কনফেডারেসী অব ট্রাইবস-এর অধিপতি, অর্থাৎ রাজা।
আমরা যারা সনাতন ধর্মের আছি এরা অনেকেই মধ্যযুগের মুসলিম শাসন, ব্রিটিশ কলনিয়াল এরা এবং উগ্র বৈষ্ণবদের দ্বারা বানানো কাল্পনিক তত্ত্বতে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছি। অবশ্য এতে আমাদের দোষ নেই। কারন ধর্ম বা স্বীয় কালচার সম্পর্কে জানার আগ্রহ কম। তথাপি আমরা নিজেদের অর্থ, শিক্ষা আর আল্ট্রা মর্ডানিজমের দিকে নজর দেই। আর যারা অল্প বিস্তর ধর্ম করতে চাই তারা মনে করেন স্থানীয় গৌড়ীয় আখড়াতে গিয়ে তিলক দিয়ে বগল তুলে নাচানাচি করলেই হল। কিন্তু আসলে সনাতন ধর্মে যে কি আকর রয়েছে আর আমাদের গৌরবজ্জল ইতিহাস রয়েছে তা জানি না। জানার চেষ্টাও করি না। স্রতের বিপরীতে ভাবতে আমরা বড্ড লজ্জা পাই বা ভয় পাই। কেন এমন ভীতু আর কাপুরুষতা?
যেখানে রাবন একজন ভিলেন হয়েও এতো গুনের অধিকারী আর শৌর্যের অধিকারী ছিলেন সেখানে আমরা কেন হীন-দ্বীন হয়ে শাকপাতা খেয়ে নিজেদের দুর্বল বানাচ্ছি? আসুন আমরা সনাতন নামধারী কিছু অসুরদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই। সঠিক ইতিহাস জানি। দর্শনের নামে আমাদের যা গেলানো হচ্ছে তা আর যাইহোক ধর্ম হতে পারে না। 
হর হর মহাদেব !  



শিব রাম নাম করেন তাহলে শিব কি রামের থেকে ছোট?

 সম্প্রতি রামায়েতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচুর রামায়েতের দেখা পাওয়া যাচ্ছে যারা শ্রীরাম চন্দ্রকে উপরে তুলতে গিয়ে পরমেশ্বর শিবকে ছোট করছেন...

Popular Posts