Wednesday, January 3, 2018

চৈতন্য মহাপ্রভুকে নিয়ে কিছু কথা

পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের মধ্যে একটা ভীষণ প্রবাদ চালু আছে, মালীবুড়োর শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য বইটা আমাদের জানাচ্ছে। এই পাণ্ডারা অনেকেই গর্ব করে বলে যে চৈতন্যকে তাদের পূর্বপুরুষেরা হত্যা করেছিল।
কেন করেছিল? এরা বলে, এর কারণ চৈতন্য নাকি বাংলার মুসলমান শাসকের চর ছিলেন! আর তাই চৈতন্যর উড়িষ্যায় আগমনের পরেই প্রথমবারের জন্য গৌড়ের মুসলমান শাসক উড়িষ্যায় সফলভাবে হামলা করতে পেরেছিল। সাহসীজন এ ব্যাপারে পুরীতে গিয়ে উড়িয়া পাণ্ডাদের মধ্যে খোঁজখবর করে দেখতে পারেন এরকম একটা কথা চালু আছে কি না ।
অনেককেই বলতে শুনি মহাপ্রভু নাকি হরে কৃষ্ণ নাম প্রচার করে বলেছেন এই নাম ছাড়া নাকি কলিতে মুক্তি নাই। উনার রচিত চৈতন্য চরিতামৃততেও একি কথা লেখা। কিন্তু বাস্তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়,  উনি কখনো ধর্মকে সেক্টেরিয়ান করতে চান নাই। আর তাই এই অশাস্ত্রীয় হরে কৃষ্ণ নাম প্রচার করার প্রশ্নই আসে না। আরও জানা যায় মহাপ্রভু মারা যাবার অনেক বছর পর চৈতন্য চরিতামৃত রচনা হয়! আরও অবাক বিষয় হল এই চরিতামৃতের শেষ ভাগ খুজে পাওয়া যায় না। বাঙ্গালী হিন্দু তাঁর ইতিহাস আর গোঁড়া নিয়ে উদাসীন। আর তাই এসব ঘাটে না আর ঘাটতে গেলেও ভয়ে প্রকাশ করে না কিনা লোকে কি বলবে??
যাইহোক , মহাপ্রভু নিয়ে আমার কিছু বিশ্লেষণ এখানে তুলে ধরবো। বিচক্ষণ চক্ষু বিবেচনা করবেন। একটা আগ্রাসনকে বুঝতে গেলে তার ইতিহাসকে বুঝতে হয়।
চৈতন্য আন্দোলনের ফলে উড়িষ্যায় মুসলমান হামলা হয়েছিল, এই বক্তব্য এমনই জোরালো হয়ে ওঠে ক্রমে, যে প্রভাত মুখার্জি তার মেডায়েভাল বৈষ্ণবিজম ইন ওড়িশা গ্রন্থে এটিকে রীতিমত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন, অর্থাৎ এটি উড়িয়ে দেওয়ার মত অকিঞ্চিতকর প্রলাপ নয়, অনেক উড়িষ্যাবাসী এতে বিশ্বাস করেন। ইন ফ্যাক্ট খোঁজ নিলে দেখবেন, অনুরূপ চাপা চৈতন্যবিদ্বেষ বাংলাভাষী হিন্দুত্ববাদীদের অনেকের আছে, এরাও একইরকম মনে করে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে চৈতন্যর সাম্যময় ভক্তি আন্দোলনের ফলে পাণ্ডাদের মৌরসীপাট্টায় খুবই বাধা পড়ছিল। তাছাড়াও সে যুগেও এক শ্রেণীর উড়েদের ভেতরে বাঙালিবিদ্বেষ পুরোমাত্রায় ছিল। এজন্য চৈতন্যের নামে এই অপবাদটি ছড়ানো হয়েছিল এবং তাকে হত্যা করা হয় মন্দিরের ভেতরেই। অনেকে আবার এও ধারনা করেন যে উনার কাছের পার্ষদ শ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভু নিজেই ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতার লোভে উনাকে হত্যা করার সাথে জড়িত ছিলেন। 

সেযুগের উৎকল বৈষ্ণবেরা প্রেম ও ভক্তির উৎস হিসেবে রাধা-কৃষ্ণকে মানতেন না। বলতেন রাধা ও কৃষ্ণের সম্পর্ক ভাই বোনের। সেটাও আরেকটা বড় পার্থক্য ঘটায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের সঙ্গে। একসময় মনান্তর এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে গৌড়ীয় ভক্তরা সবাই পুরী ত্যাগ করে বৃন্দাবনে চলে যান, চৈতন্যের জীবদ্দশাতেই। 

চৈতন্যর পূর্বপুরুষ সিলেট থেকে এসেছিলেন, সমসাময়িক সমস্ত জীবনীকার তাই বলছেন। উড়িষ্যার যাজপুর থেকে তারা সিলেটে গেছিলেন, এরকম কোনও কথা চৈতন্যের সমসাময়িক কোনও বাঙালি জীবনীকার বলেন নি। মধ্যযুগের উড়িষ্যার কবি মাধব পট্টনায়ক প্রথম বললেন, যে চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষ উড়িষ্যার যাজপুর থেকে সিলেট গেছিলেন। এই মাধব পট্টনায়কই কবি জয়দেবকে উড়িয়া বলে দাবী করেছিলেন প্রথম। দু-দুটো বৃহৎ মিথ্যার প্রথম জন্মদাতা এই মাধবের বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও, এই লোকটি চৈতন্যের সময়ে উড়িষ্যার পঞ্চসখা বৈষ্ণবদের দলেরই একজন অনুগামী ছিলেন, সেটা জানা যায়।এরপর বাঙালি কবিদের মধ্যে প্রথম জয়ানন্দই "চৈতন্যের পূর্বপুরুষ উড়িয়া ছিলেন" মাধবের এই বক্তব্যটি রিপিট করেন, তারপর থেকে ওই যাজপুরের কথাটা চলেছে। প্রসঙ্গত, এই জয়ানন্দই বলেছিলেন যে চৈতন্যর মৃত্যু ইঁটের খোঁচায় হয়েছিল, আর কোথাও সে বক্তব্য পাওয়া যায় না।
চৈতন্য যে শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন, অর্থাৎ পাশ্চাত্য বৈদিক, সে শ্রেণীর ব্রাহ্মণ উড়িষ্যায় মেলে না, যদিও মিশ্র পদবী দেখা যায়, সেখান থেকেই জালসাজির সূত্রপাত।

শ্রী চৈতন্য কি সত্যই পুরীর সমুদ্রে অথবা জগন্নাথের দারু অঙ্গেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন ...??

সালটা ছিল ২০০০...। পুরীর বিখ্যাত শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের সংস্কার কার্য্য চলার সময় হঠাৎ-ই গর্ভগৃহ থেকে উদ্ধার হল একটি আস্ত নরকঙ্কাল! দৈর্ঘ্য’তে যা ছিল প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি।

গর্ভগৃহে কঙ্কাল...!! চারিদিকে হৈ-হৈ পড়ে গেল। কিন্তু কার দেহাস্থি এটি? চারিদিক জুড়ে মাসাধিক কাল ধরে চলল প্রবল বিতর্ক। পরীক্ষা করে জানা গেল মৃত ব্যক্তি ছিলেন অত্যান্ত দীর্ঘাঙ্গী এবং যার মৃত্যু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে।

পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচার করে বেশিরভাগ মানুষ তখন এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হলেন যে কঙ্কালটি আর যার-তার কারও নয়, এই বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ... স্বয়ং শ্রী চৈতন্য দেবের!! একই সঙ্গে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শ্রীচৈতন্যের সমুদ্রে লীন হবার তত্ত্বও খারিজ হবার পাশাপাশি পুরীর মন্দিরে তাঁকে হত্যা করবার বিষয়’টিও আরও একবার জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সে যাই হোক, জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে শ্ৰীচৈতন্যকে ‘গুমখুন’ করা হয়েছিল, এই অভিমত সর্বপ্রথম প্রচার করেন, ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায়। ৫-৮-১৯৭৬ , তারিখে, পুরীর আনন্দময়ী আশ্রমের ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে ড. রায় লিখলেন, শ্ৰীমহাপ্ৰভু চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল। তিনি আরও লিখেছেন ‘ওই গুমখুনের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বহুদিনের চিন্তিত, বহুজন সমৰ্থিত চক্রান্তের ফল। কে বা কারা ওই চক্রান্ত করেছিলেন, সে সম্পর্কে আমার একটা অনুমান আছে, কিন্তু তা বলতে পারব না। কারণ এখনও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই। চৈতন্যদেব, গান্ধী martyr হতে পারেন, কিন্তু আমার martyr হওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই”।






দীনেশচন্দ্ৰ সেন তাঁর ‘চৈতন্য অ্যান্ড হিজ এজ' - গ্রন্থে লিখেছেন, “শ্ৰীচৈতন্য যদি বিকেল ৪’টের সময় মন্দিরের মধ্যে দেহত্যাগ করে থাকেন, আমরা জানি, ওই দিন রাত ১১টা পর্যন্ত মন্দিরের দরজা খোলেনি। এই সময়টা লেগেছিল তাঁর দেহ (মন্দিরের মধ্যে) পুঁতে ফেলে মন্দিরের মেঝে আবার আগের মত করতে। রাত ১১’টায় দরজা খুলে বলা হল, প্ৰভু জগন্নাথের দেহে চৈতন্য লীন হয়ে গেছেন।” 
শুধু ডঃ রায় বা ডঃ সেনই নন, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরি, ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন, ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়, মালীবুড়ো, ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু - এঁদের সবার ধারণা, চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, চৈতন্যদেবের মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করতে গেলে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও ডঃ দীনেশ সেন নিন্দিত হয়েছিলেন। ড. অমূল্য সেনের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছিল। তবুও শত বিপদ ও মৃত্যুভয়ের মাঝেও ওঁরা চৈতন্যের মৃত্যুর ঘটনাটিকে ‘হোমিসাইড’ বলেছিলেন।

ড. দীনেশচন্দ্ৰ সেনের ধারণা ছিল, জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা চৈতন্যকে পিটিয়ে মেরেছে। কিন্তু কেন ? – কী এমন মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ তিনি করেছিলেন?

ঐতিহাসিক মতপার্থক্য অনুযায়ী, সংসার করবেন না প্রচার করেও দুই বিবাহের অধিকারী চৈতন্য ঠিক ততদিন-ই ঠিকঠাক “শ্রী চৈতন্য” হতে পারেননি, যত দিন না ... কাজীর বাড়ি ঘেরাওয়ের সফল আন্দোলন করতে সক্ষম হন। তাঁর সেদিনের সেই সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় পেয়ে প্রমাদ গোনেন তৎকালীন বাংলার মুসলমান শাসনকর্তা হুসেন শাহ।

প্রতিপক্ষের মাথা কিনে নেবার ব্যাপারে ইসলামের সমকক্ষ এই বিশ্বে যেমন আজও কেউ নেই, তেমনি আগেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মনে করা হয়, ছলে বলে কৌশলে বা ভীতি প্রদর্শন করে যেমন ভাবেই হোক হুসেন শাহও তেমনি সেদিন শ্রী চৈতন্যকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। খুব সম্ভবত তারই অঙ্গ হিসেবে পরবর্তীকালে একদিকে যেমন হুসেন শাহ তাঁর তীব্র হিন্দু বিরোধিতা ত্যাগ করেন, অন্যদিকে চৈতন্যও প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্ধী’তায় সারা বাংলা জুড়ে প্রবলভাবে হরিনাম প্রচার চালাতে থাকেন। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সে’কালে যা ছিল একান্তই অসম্ভব।

অস্ত্রধারী ভগবান শ্রীবিষ্ণু’কে শ্রীচৈতন্য সম্পূর্ন নিরস্ত্র রূপে এই বাংলা’র সামনে নবভাবে উপস্থাপিত করেন। তাঁরই প্রভাবে রাধা-তত্ত্ব ও প্রেমরসে নতুন ভাবে শ্রীকৃষ্ণ’কে গ্রহন করে মন্ত্রমুগ্ধ বাঙ্গালী হিন্দু সমাজ। শ্রী চৈতন্যের আহ্বানে তারা দলে দলে অস্ত্র পরিত্যাগ করে; ত্যাগ করে আমিষ খাদ্যদ্রব্য! পরিবর্তিত হয় এক সম্পূর্ন যুদ্ধ-বিমুখ আত্মরক্ষার কৌশল বিবর্জিত ভগবৎ-মুখাপেক্ষী এক আত্মঘাতী জাতীসত্ত্বায়।

বাংলার হিন্দুদের উপর তাঁর নৈতিক বিজয়ের পর, হুসেন শাহের দৃষ্টি পড়ে উড়িষ্যার উপর। খুব সম্ভবত তাঁরই নির্দেশে শ্রী চৈতন্য উড়িষ্যায় গমন করেন এবং সেখানে অষ্টাদশ বছর অবস্থানকালে সেখানকার রাজা প্রতাপ রুদ্রদেব’কে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহনে সমর্থ্য হন। শুধু কি তাই? উড়িষ্যার রাজাকে নিরস্ত্র করতেও তিনি সক্ষম হন। এমনকি হুসেন শাহের উড়িষ্যা আক্রমণকালেও তাঁর নির্দেশ ছিল, প্রতাপ রুদ্র যেন হুসেন শাহের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করেন! বরং অদ্ভুত ভাবে তাঁর কারনেই নাকি সে-সময় দক্ষিণের একমাত্র হিন্দু রাজ্য বিজয়নগরের সাথে উড়িষ্যার সম্পর্কের অবনতি’র সূত্রপাত ঘটে!!

ফলস্বরূপ উড়িষ্যার হিন্দুরা, চৈতন্যের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে, তাঁকে সেখান থেকে অতিস্বত্বর সরিয়ে দেবার চক্রান্ত করে। চৈতন্যের নিরুদ্দেশ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রতাপ রুদ্র কটকে পলায়ন করেন এবং সেখানে তাঁর প্রধান সেনাপতি ভারু কতৃক পদচ্যুত ও নিহত হন। ইসলামিক আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা পায় উড়িষ্যা। বেঁচে যান সেখানকার হিন্দুরা।

মানুষ মরণশীল। শ্ৰীচৈতন্যও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তারও মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু কী বঙ্গীয়, কী ওড়িয়া- সব চরিত্কারই তাঁর মৃত্যুর ধরন, স্থান, সময় ও তারিখ সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। অবশ্য মনে রাখতে হবে, স্বরূপ দামোদর, রায় রামানন্দ, গোদাধর পণ্ডিত ও অচ্যুতানন্দ এবং শিখী মাহাতি ছাড়া বাকিরা কেউই মহাপ্রভুর শেষলীলার প্রত্যক্ষদর্শী নন। অন্যরা কেউ কেউ আবার ১০০-১৫০ বছর পরের লোক। কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন, ‘চৈতন্যের শেষলীলা রহিল অবশেষ'। অপর স্থানে বলেছেন, ‘প্রভুর যে শেষলীলা স্বরূপ দামোদর/সূত্র করি গাঁথিলেন গ্রন্থের ভিতর।’ আশ্চর্যের ব্যাপার, স্বরূপ দামোদরের সেই পুঁথি বেমালুম বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল পুরী থেকে। আজ পর্যন্ত তার কোনও খোঁজ মেলেনি। ঐতিহাসিকদের মতে, এই পুঁথিতে নিশ্চয়ই এমন কিছু স্বরূপ দামোদর লিখেছিলেন, যেটা ‘চৈতন্য-বিরোধী’রা মেনে নিতে পারেন নি। সে জন্যই তারা সেই পুঁথি লোপাট করে দিয়েছিলেন। যাই হোক, চরিতকারগণ একই চৈতন্যদেবকে নিয়ে লিখেছেন, অথচ এই মৃত্যুর ব্যাপারে এদের গরমিল চোখে পড়ার মত। পুরীতে চৈতন্যের কোনও সমাধি মন্দির নেই। যত গোলমাল এখানেই!




- এখন দেখা যাক, তার চরিত্কারগণ তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে কে কী বলেছেন।
১। অচ্যুতানন্দ, দিবাকর দাস, ঈশ্বর দাস, ঈশান নাগর, লোচন দাস – এঁদের মতে শ্ৰীচৈতন্য জগন্নাথের কালো অঙ্গে ‘লীন’ হয়ে গেছেন।
২। জয়ানন্দ, নরহরি, সদানন্দ, - এঁদের মতে, বাঁ পায়ে ইটের আঘাত পেয়ে চৈতন্য তোটা গোপীনাথের মন্দিরে আশ্রয় নেন, পরে সেখানেই তিনি ‘অন্তর্হিত' হন। কিন্তু, তাঁর মায়াশারীর পড়েছিল।
৩। বৃন্দাবন দাস এ সম্পর্কে সম্পূৰ্ণ নীরব। কৃষ্ণদাস কবিরাজ, খালি ‘অন্তর্ধান' কথাটি বলেছেন। সম্প্রতি বৃন্দাবন দাসের পুঁথির সেনের কিছু অংশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাতে তিনিও ‘অন্তর্ধান' কথাটিই বলেছেন ।
৪। সমূদ্রতীরে বিদ্যুতের মত ‘অন্তর্হিত’ হওয়ার কথা বলেছেন গোবিন্দ।
৫। আদি চরিতকার মুরারী গুপ্ত, কবি কর্ণপুর এ সম্পর্কে কিছুই বলেননি। আবার, এঁদের কেউ কেউ বলেছেন, মহাপ্ৰভু দেহত্যাগ করেছেন বৈশাখ মাসের সন্ধ্যায়, কেউ বলেছেন আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীতে, কেউ বলেছেন , আষাঢ় শুক্লা সপ্তমীতে রবিবার তৃতীয় প্রহরে, কেউ বলেছেন ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। লোচনদাস তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে বলেছেন, “একদিন প্ৰভু, একমাত্র গোদাধর’কে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন। কিন্তু প্ৰভু একাই মন্দিরে প্রবেশ করার পর ‘কপাট’ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। পিছনে ভক্তরা এসে কান্নাকাটি শুরু করতে একজন পান্ডা ভেতর থেকে এসে খবর দিল যে প্ৰভু জগন্নাথে লীন হয়ে গেছেন।” তাঁর ডক্তরা কেউ এ ঘটনার সাক্ষী হতে পারল না। সাক্ষী হলেন তাঁরই বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী পান্ডাদের একজন।

এ সম্পর্কে বর্তমান ঐতিহাসিকদের মতে, সে দিন কী ঘটেছিল দেখা যাক। তা হলে পরিস্কার একটা আভাস পাওয়া যাবে যে চৈতন্যের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ঐতিহাসিকদের প্রশ্ন, কেন তিনি একাকী জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করলেন, যখন বিগ্রহগুলি গুণ্ডিচা মন্দিরে অবস্থান করছে? তা হলে কি তাঁরই কোনও ঘনিষ্ঠ পার্ষদ ‘জুডাস’-এর ভূমিকা নিয়েছিল? লোচন বলেছেন, প্ৰভু যখন একাকী মন্দিরে প্রবেশ করলেন তখন ‘দুয়ারে নিজ লাগিল কপট’। জগন্নাথ মন্দিরের ওই বিশাল বিশাল দরজাগুলি কীভাবে নিজেই লেগে গেল তা একমাত্র জগন্নাথদেবেই বলতে পারবেন। ঐতিহাসিকদের মতে, সে সময় মন্দিরের ভেতরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই চট করে দরজা বন্ধ করেন। তা যদি না থাকত, তা হলে পিছনে পিছনে তাঁর ভক্তরা যখন ‘ঘুচাহ কপাট প্ৰভু দেখি বড় ইচ্ছা' বলে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছেন, তখন নিজে লেগে যাওয়া কপাট' খুলে গেল না কেন? কিন্তু শ্ৰীচৈতন্যের সঙ্গে ছিলেন গোদাধর। বৃন্দাবনদাস ঠাকুর তাঁর অপ্রকাশিত চৈতন্য ভাগবতের অবশিষ্ট অংশে বলেছেন, “আচম্বিতে গোদাধর হইল অন্তর্ধান”। কীভাবে গোদাধর আচমকা ‘অন্তর্হিত’ হলেন? তাঁর তো অন্তৰ্হিত হওয়ার কথা ছিল না। তা ছাড়া তিনিও কি জগন্নাথের অঙ্গে লীন হলেন ? কে জানে? তা হলে কি অন্ধকার মন্দিরে লুকিয়ে থাকা শত্রুর দল তাঁকেও গুম করে দিয়েছিল? সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত ওড়িয়া কবি বৈষ্ণব দাসের পুঁথিতে আছে, রাত্রি দশ দন্ডের সময় চৈতন্যের মৃতদেহ গরুড় স্তম্ভের পিছনে পড়েছিল, এটা নাকি তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। এই যে প্রায় সমস্ত পন্ডিত বলছেন, শ্রীচৈতন্যকে হত্যা করা হয়েছিল, স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কে হত্যা করেছিল চৈতন্য’কে? পণ্ডিতদের মতে, এই ঘৃণ্য কাজের দায়িত্ব ছিল জগন্নাথ মন্দিরের দ্বাররক্ষী বাহিনীর তৎকালীন প্রধান দলপতির ওপর। তার নাম ছিল, ‘দীনবন্ধু প্রতিহারী’। সে নাকি, ‘বুকের ওপর বসে, গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরেছিল প্রভুকে’।

এখন প্রশ্ন হল, চৈতন্যের শবদেহটা কীভাবে ও কোথায় হত্যাকারীরা পাচার করল? পুরীর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রাক্তন কর্মসচিব স্বামী অভিনবানন্দজির মতে, মহাপ্রভুর দেহটিকে মণিকোঠার রত্নবেদীর নিচেই ‘সমাধিস্থ’ করা হয়েছিল। ড. দীনেশ সেনের ধারণাও তাই। ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মতে 'কইলি বৈকুণ্ঠ’ অথবা , ‘তোটা গোপীনাথে’র মন্দিরে সমাধী দেওয়া হয়েছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও চৈতন্য বিশেষজ্ঞ পদ্মশ্ৰী সদাশিব রথ শর্মার মতে, তোটা গোপীনাথের বাঁধানো উঠানের বাম পাশ ঘেঁষে যে দুটি ছোট তুলসী মন্দির আছে, তার অপেক্ষাকৃত পুরনোটি হল চৈতন্যের সমাধি মন্দির।

শেষে কয়েকটি ঘটনার পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব, চৈতন্যের মৃত্যু আদৌ স্বাভাবিকভাবে হয়নি। 
১। চৈতন্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্যশিষ্য পুরীর রাজা প্ৰতাপ রুদ্র রথযাত্রা ফেলে প্রাণভয়ে কটকে পালিয়ে গেলেন কেন?
২। চৈতন্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাবৎ চৈতন্যপন্থী ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা উৎকল ছেড়ে চলে গেলেন কেন? 
৩। চৈতন্যের অন্তর্ধানের পর তাঁর অন্যতম পার্ষদ স্বরূপ দামোদরকে আর জীবিত অবস্থায় দেখা গেল না কেন? দেখা গেল দামোদরের ‘হৃদয় ফেটে প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে’। প্রকৃত অর্থে শত্রুর অস্ত্রের আঘাতে তো হৃদয় বিদীর্ণ হওয়ারই কথা। 
৪। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে উৎকলের সিংহাসনে বসলেন ষড়যন্ত্রকারী গোবিন্দ বিদ্যাধর ভোই। 
৫। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ‘চৈতন্য অ্যান্ড হিজ এজ’ গ্ৰন্থ থেকে জানা যাচ্ছে, চৈতন্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ ৫০ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে ও উৎকলে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সমস্ত রকম প্রচার, এমনকি নূন্যতম ‘কীর্তন গান’ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল!

চৈতন্য যদি জগন্নাথের দারু অঙ্গেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন, তা হলে তো সেই ঘটনা মানুষের মনে চৈতন্য এবং বৈষ্ণবপন্থার প্ৰস্ফুরণ ঘটাবার কথা। কিন্তু কাৰ্যত তা দেখা গেল না। উপরন্তু এক নিদারুণ আতঙ্কে| উৎকল ও বঙ্গের বৈষ্ণবমণ্ডলী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মতে, সেই কারণেই চৈতন্যদেবের ওপর লেখা সমস্ত বৈষ্ণব গ্রন্থ ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেছে চৈতন্যের তিরোধানের শেষ মুহূর্তের বর্ণনাতীত, “অসহ্য বর্ণনাকে” ।

তবে হ্যাঁ,... এই কঙ্কাল যে শ্ৰীচৈতন্যের, তা না-ও হতে পারে। হতে পারে – তা গোদাধর পণ্ডিত বা অন্য কোন ব্যক্তির। একমাত্র সঠিক পদ্ধতিতে ও নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেই এর যথার্থ সত্য উদ্ঘাটিত হওয়া সম্ভব। মন্দির কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ঐতিহাসিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ভারত সরকারকেও এই কাজে এগিয়ে আসতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই।

কৃতজ্ঞতাঃ শ্রী ভুবন গায়েন...
শ্রী Kaushik Bhattacharya
প্রয়াত শ্রী Radhasyam Brahmachari

শ্রী Tapan Ghosh





সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা ক...

Popular Posts