Sunday, June 8, 2025

শিবতত্ত্বে সৃষ্টি, সংহার ও রক্ষা – শ্রীকণ্ঠ ও পুরাণসমূহের আলোক

শৈব দর্শনে শিব কেবল একজন উপাস্য দেবতা নন—তিনি নিজেই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পরম ব্রহ্ম। তিনিই এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূল কেন্দ্র। শ্রীকণ্ঠাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে একথাই প্রমাণ করেন এবং পুরাণসমূহও এই তত্ত্বকে পূর্ণ সমর্থন দেয়। এই প্রবন্ধে আমরা শৈব দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্ব, সংহারতত্ত্ব ও রক্ষাতত্ত্বের এক গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরব।

✦ শিব: কারণ ও কার্য উভয়ের আধার

◼ শ্রীকণ্ঠাচার্যের অভিমত

ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে (১.১.২) শ্রীকণ্ঠাচার্য বলেন:

"জগতকারণং শম্ভুরেভ"
(এই জগতের একমাত্র কারণ শম্ভু বা শিব।)

এই একটি বাক্যই শৈব দর্শনের মূলমন্ত্র—শিব কেবল কার্যকারণ নন, তিনিই উপাদান কারণ, নিমিত্ত কারণ এবং উপনির্মাতা। তিনি ছাড়া আর কেউ সৃষ্টির মালিক হতে পারে না।

◼ ব্যাখ্যা

শ্রীকণ্ঠ বলেন, শিব আত্মতত্ত্ব, বস্তুতত্ত্ব ও চেতনাতত্ত্ব—এই তিন ক্ষেত্রেই সর্বত্র বিস্তৃত। ত্রিমূর্তিতত্ত্বকে তিনি অব্যক্ত, ব্যক্ত এবং প্রব্যক্ত এই তিন অভিব্যক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চান।

✦ পুরাণসমূহে শিবের ত্র্যর্থরূপ

◼ লিঙ্গ পুরাণ (১.৬৯.৬৪)

“শিবাত্ প্রজাস্রষ্টা ব্রহ্মা, শিবাত্ পালনহরি:।
শিবাত্ সংহারকারী রুদ্রঃ, শিব: সর্বং প্রপঞ্চতে॥”

বাংলা অনুবাদ:
“শিব হতেই সৃষ্টি করেন ব্রহ্মা, শিব হতেই পালন করেন হরি, শিব হতেই সংহার করেন রুদ্র। শিবই সর্বভৌতিক জগতের মূল।”

এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, তিন দেবতা আসলে তিনটি কার্যরূপ মাত্র, মূলতত্ত্ব হলেন এক ও অদ্বিতীয় শিব।

◼ শিবপুরাণ: সর্বেশ্বরতত্ত্ব

শিবপুরাণে বলা হয়েছে:

"ন ত্বদ্ব্যতিতমস্ত্যন্যৎ, জগতঃ কারণং পরম্।"
(তোমার বাইরে এই জগতের আর কোনো কারণ নেই।)

এখানে শিবকে তত্ত্বগত “সর্বেশ্বর” হিসেবে দেখানো হয়েছে—তিনিই অনাদি ও অনন্ত, চৈতন্য ও স্থিতির উৎস।

AI created 


✦ ঈশ্বর গীতায় শিবতত্ত্বের আত্মপ্রকাশ

ঈশ্বর গীতা, যা কূর্ম পুরাণের অন্তর্গত, তাতে শিব নিজেই নিজের সর্বজ্ঞ ও সর্বব্যাপক রূপ তুলে ধরেন:

“অহং বিশ্বস্য কারণং, সৃষ্টিস্থিতিলয়ক্রিয়াঃ।
মম দ্বারা প্রসরন্তি, না অন্যঃ কারণমুচ্যতে॥”

অনুবাদ:
"আমি বিশ্বজগতের কারণ। সৃষ্টি, রক্ষা ও সংহার—এই কর্মসমূহ আমার দ্বারাই ঘটে; অন্য কোন কারণ নেই।"

এই শ্লোকটির ভাষ্য অনুসারে, শিবের ইচ্ছা বা ‘সঙ্কল্প’ থেকেই সৃষ্টি হয়, এবং তাঁর ‘নিশ্চয়’ থেকেই সংহার সংঘটিত হয়।

✦ শিবসূত্র: অভ্যন্তরীণ সৃষ্টি ও লয়ের ব্যাখ্যা

শিবসূত্রে (১.১):

“চিত্তং মন্ত্রঃ”
(“চৈতন্যই মন্ত্র।”)

শিবসূত্র (৩.১):

“জ্ঞানং বন্ধঃ।”
(“জ্ঞানই বন্ধন, যদি তা মুক্তিচেতনায় অভিজ্ঞ না হয়।”)

এখানে ‘সৃষ্টি’ বলা হয়েছে চেতনার অঙ্কুরোদ্গম, ‘সংহার’ বলা হয়েছে চেতনার নির্লিপ্ত অবস্থা, এবং ‘স্থিতি’ হচ্ছে ধারাবাহিক সত্তার অভিজ্ঞান।

✦ উপনিষদীয় আলোকে: গণপতি অথর্বশীর 

গণপতি অথর্বশীর উপনিষদে বলা হয়েছে:

“ত্বং ভূমিরাপোऽনলোনিলোনাভঃ।
ত্বং চত্বারী বাক্ পদানি॥”

অনুবাদ:
“তুমি ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—তুমি বাণীর চার রূপ।”

এখানে শিবরূপ গনেশকে বলা হয়েছে উপাদান ও উপনির্মাতা—এবং ভাষা বা শব্দতত্ত্বের উৎস।

✦ শৈব ত্র্যর্থতত্ত্ব বনাম ত্রিমূর্তি দর্শন

প্রচলিত ত্রিমূর্তি:

  • ব্রহ্মা – সৃষ্টি

  • বিষ্ণু – রক্ষা

  • রুদ্র – সংহার

শৈব বিকল্প:

এই তিন রূপই আসলে একক পরমতত্ত্ব শিব–এর তিনটি গুণপ্রকাশ (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ)। তাই তিনজন আলাদা ঈশ্বর নন, বরং এক শিব তিনভাবে প্রকাশমান।

লিঙ্গপুরাণে বলা হয়:
“ত্রিধা ভবতি শম্ভু:—ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও ঈশ্বর।”

✦ সৃষ্টি, রক্ষা ও সংহার: দার্শনিক ব্যাখ্যা

সৃষ্টি:

শিবের “ইচ্ছা শক্তি” (ইচ্ছে), “জ্ঞান শক্তি” (জ্ঞাতা) ও “ক্রিয়া শক্তি” (কর্তা)—এই ত্রিশক্তি থেকেই জগতের উৎপত্তি।

রক্ষা:

রক্ষাকর্ম হচ্ছে সেই সৃষ্টির নিয়ম রক্ষা করা। এই ধারাবাহিকতার জন্য শিব স্বয়ং নিজেকে ‘ধর্ম’ বলে ঘোষণা দেন ঈশ্বর গীতায়।

সংহার:

সংহার মানে ধ্বংস নয়, বরং মূলত্বে প্রত্যাবর্তন। সব সৃষ্টি যখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠে তখন তা তার উৎসে মিলিয়ে যায়—এই ধারণাই হল সংহারতত্ত্ব।

✦ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ: আত্মসৃষ্টি ও আত্মসংহার

মানব চেতনায় এই তিনটি কর্ম প্রতিফলিত হয়:

  • সৃষ্টি – জ্ঞান ও ধারণার উদ্ভব

  • রক্ষা – চর্চা ও অভ্যাস

  • সংহার – অহংকার ও ভ্রান্ত ধারণার বিলয়

এই প্রসঙ্গে শিবরূপ হলেন আত্মজ্ঞান, সত্ত্ব ও নির্গুণতত্ত্বের পূর্ণ প্রতীক

✦ উপসংহার

শিব কেবল সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবতা নন—তিনিই সৃষ্টি, তিনিই ধ্বংস, তিনিই ধ্রুবতা।
তিনি কোনো নির্দিষ্ট কালের বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঈশ্বর নন—তিনি হলেন সর্বজনীন চেতনা
শিবতত্ত্বের এই সৃষ্টি-স্থিতি-লয় চক্র শুধু পৌরাণিক আখ্যান নয়, বরং সমগ্র জীবনচক্র, জ্ঞানচক্র ও চৈতন্যচক্রের চিত্র

রেফারেন্স তালিকা:

  1. ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য – শ্রীকণ্ঠাচার্য (১.১.২, ২.১.১৪)

  2. লিঙ্গপুরাণ – অধ্যায় ১, ৬৯, ৭৫

  3. শিবপুরাণ – বিদ্যেশ্বর সংহিতা

  4. গণপতি অথর্বশীর্ষ উপনিষদ – শ্লোক ৫, ৮

  5. শিবসূত্র – সূত্র ১.১, ৩.১, ৩.৫

  6. ঈশ্বরগীতা – অধ্যায় ১, শ্লোক ১০-১৫

  7. স্কন্ধপুরাণ – কৈলাসখণ্ড, শিবগীতা অংশ

  8. দর্শন ও চৈতন্যতত্ত্ব – স্বামী চিন্ময়ানন্দের পাঠ্যভাষ্য

  9. Modern Physics & Advaita Comparison – Dr. Kapil Kapoor

Saturday, June 7, 2025

শৈবত্বের লক্ষণ ও শিবভক্ত চিনিবার উপায় — আগম ও পুরাণের আলোকে অষ্টবর্ণ ভিত্তিক বিশ্লেষণ

পরমেশ্বর ভগবান, আদিদেব, সকল দেবতা ও জাতির একমাত্র আরাধ্য—সাম্ব সদাশিব। যাঁর চরণাশ্রিত হয়েছেন, তিনি মাহেশ্বর; এবং যিনি মাহেশ্বর, তাঁকে চেনার একমাত্র পন্থা হলো "অষ্টবর্ণ"। এই আটটি মূল লক্ষণ একজন প্রকৃত শৈব ভক্তকে চিহ্নিত করে।

১. অষ্টবর্ণের শ্লোক ও ব্যাখ্যা

মূল শ্লোক:

অষ্টবর্ণং প্রপঞ্চয়েদ্যঃ শৈবঃ স্যাদধিগম্যতাম্।

গুরুলিঙ্গং চ জঙ্গমং ভস্ম মন্ত্রং রুদ্রাক্ষমেব চ।

পাদোদকং নির্মাল্যং চ—এতান্যষ্টবর্ণমুচ্যতে॥

অষ্টবর্ণং বিহীনস্য শৈবস্য নাস্তি কদাচন।

যঃ প্রপঞ্চয়েদষ্টবর্ণং স এব শৈব ইতি স্মৃতঃ॥

সূত্র: শৈব আগম, স্বচ্ছন্দ তন্ত্র, পূর্বখণ্ড ১.১


বাংলা অনুবাদ:

যিনি গুরুরূপ, লিঙ্গ, জঙ্গম, ভস্ম, মন্ত্র, রুদ্রাক্ষ, পাদোদক ও নির্মাল্য—এই আটটি গুণ দৈনন্দিন জীবনে মূর্ত করে তোলেন, তিনিই প্রকৃত শৈব; অন্যথায় শৈবতা অসম্পূর্ণ।


২. গুরু (Guru) — শিবের জীবন্ত প্রতিমূর্তি

শ্লোক ১:

শ্রীগুরুচরণপদ্মে সেবা কুরুতে সदा।

শিবায় তস্য নাস্তি ক্ষতির্নাম কদাচন॥

শ্লোক ২:

শ্রীগুরুরূপে শিবং বিজ্ঞায় সেবতে যত্নতঃ।

শৈবত্বং প্রপঞ্চয়েদ্যঃ সর্বকালেশ্বর ইতি স্মৃতঃ॥

শ্লোক ৩:

শ্রীগুরুচরণাম্ভোজে সেবা কুরুতে সदा যঃ।

তস্য শিবসমো ভাবঃ সর্বদা নির্মলঃ স্মৃতঃ॥

সূত্র: স্বচ্ছন্দ তন্ত্র, পূর্বখণ্ড ৮.১৬.১–৩


ব্যাখ্যা:

যিনি শ্রীগুরুর পদপদ্মে নিরন্তর সেবা করেন, তিনি কখনোই শিবের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন না। যে গুরুরূপে শিবকে উপলব্ধি করে সেবা করেন, তিনিই প্রকৃত শৈব, তাঁর হৃদয় নির্মল ও শিবসমান হয়ে ওঠে।


৩. লিঙ্গ (Liṅga) — শিবভক্তির বহিরপ্রকাশ

শ্লোক ১:

মূর্ধ্নি হৃদয়ে বাহৌ বা যঃ লিঙ্গং ধারয়ন্তি।

তেষাং কালঃ করোতি স্পর্ধামপি ভয়ঙ্করাম॥

সূত্র: গুরু গীতা, শ্লোক ১৬৪


শ্লোক ২:

যেষাং দেহে ন লিঙ্গস্পর্শঃ, তে শ্মশানসংস্থিতাঃ॥

ব্যাখ্যা:

যে ব্যক্তি শরীরে, হৃদয়ে বা মস্তকে শিবলিঙ্গ ধারণ করে, মৃত্যুও তার সামনে ভীত হয়। যাদের দেহে শিবলিঙ্গ নেই, তারা শ্মশানের মতো অপবিত্র বলে বিবেচিত।


৪. জঙ্গম (Jaṅgama) — শিবের সচল রূপ

শ্লোক:

যে জঙ্গমভাবনাভ্রষ্টাঃ কামনায় আসক্তাঃ।

ন তেষাং হৃদয়ে কদাচিদপি ত্রিপুরারী অবস্থিতঃ॥

সূত্র: রুদ্র যামল তন্ত্র, অধ্যায় ৮, শ্লোক ২২


ব্যাখ্যা:

যারা সাধুসঙ্গ বা জঙ্গম ভাবনা থেকে বিচ্যুত, তাদের হৃদয়ে কখনোই শিব বাস করেন না।





৫. ভস্ম (Bhasma) — শিবের চিহ্নস্বরূপ বিভূতি

শ্লোক ১:

যস্য দেহে ভস্মলেপনং নাস্তি, স যমদ্বারং প্রতি গচ্ছতি॥

শ্লোক ২:

ভস্মলেপনমিদং দেহমাশ্রিত্য, পশ্যতি কালঃ—ভয়াত্ত্রস্যতি॥

সূত্র: শিব মহাপুরাণ, রুদ্র সংহিতা, অধ্যায় ১৮

ব্যাখ্যা:

যে ব্যক্তি দেহে ভস্ম (ত্রিপুণ্ড্র) লেপন করেন না, মৃত্যু তার জন্য অবধারিত। আর যে এই ভস্ম ধারণ করে, তাকে মৃত্যু পর্যন্ত ভয় করে।


৬. মন্ত্র (Mantra) — পঞ্চাক্ষরী 'নমঃ শিবায়'

শ্লোক:

যস্য মুখে নাস্তি “নমঃ শিবায়” ইতি পঞ্চাক্ষরং।

তস্য মুখং শাপিতং শুষ্কমরুভূমিসমং স্মৃতং॥

সূত্র: গুরু গীতা, শ্লোক ৯৮


ব্যাখ্যা:

যে ব্যক্তির মুখে ‘নমঃ শিবায়’ ধ্বনিত হয় না, সেই মুখ অভিশপ্ত ও শুষ্ক মরুভূমির মতো নির্জীব।


৭. রুদ্রাক্ষ (Rudrākṣa) — ভক্তির অনিবার্য প্রতীক

শ্লোক ১:

যস্য সর্বাঙ্গে রুদ্রাক্ষঃ সন্নিবদ্ধঃ সदा।

ন তং হন্তি কো’পি, সম্পূর্ণং ত্রিলোক্যেষু চ॥

শ্লোক ২:

যঃ রুদ্রাক্ষবিদ্বেষী, স ত্রিলোকেষু ন রক্ষিতঃ॥

সূত্র: পদ্ম পুরাণ, উত্তর খণ্ড, শ্লোক ৫৪.৮৮


ব্যাখ্যা:

যিনি সর্বাঙ্গে রুদ্রাক্ষ ধারণ করেন, তাঁকে ত্রিলোকে কেউই ক্ষতি করতে পারে না। আর যারা রুদ্রাক্ষ অবজ্ঞা করে, তারা রক্ষাহীন হয়ে পড়ে।


৮. পাদোদক ও নির্মাল্য (Pādodaka & Nirmālya)

শ্লোক (পাদোদক):

যে আচার্যচরণাম্বুজাৎ নির্গতামৃতং পিবন্তি।

ন তং অজ্ঞানরূপং তমঃ স্পৃশতি কদাচন॥

সূত্র: গুরু গীতা, শ্লোক ২৮৫


শ্লোক (নির্মাল্য):

যে নির্মাল্যাত্পরিত্যক্তাঃ, শুষ্কাঃ তে মরুভূমিসমা ইতি।

যে দূরস্থাত্ অপি নির্মাল্যং প্রণমন্তি, তু তে শিবত্বং লভন্তে॥

 সূত্র: কুলার্ণব তন্ত্র, অধ্যায় ১২


ব্যাখ্যা:

যিনি গুরুর চরণামৃত পান করেন, তাঁকে অজ্ঞান ছুঁতে পারে না। আর যে ব্যক্তি দূর থেকেও নির্মাল্যকে প্রণাম করে, সেও শিবত্ব লাভ করেন।



এই অষ্টবর্ণ—গুরুসেবা, লিঙ্গধারণ, জঙ্গমসঙ্গ, ভস্মলেপন, পঞ্চাক্ষরী মন্ত্রজপ, রুদ্রাক্ষধারণ, পাদোদক পান ও নির্মাল্য প্রণাম—শিবভক্তির মূল চিহ্ন। এগুলো যার জীবনে দৃঢ়ভাবে বিরাজমান, তিনিই প্রকৃত শৈব এবং তিনি অদ্বিতীয় শৈবত্বে প্রতিষ্ঠিত হন।


Friday, June 6, 2025

শিবই পরম ব্রহ্ম – শ্রীকণ্ঠাচার্যের দর্শনের আলোকে

 

ভূমিকা

হিন্দু দর্শনে “পরম ব্রহ্ম” ধারণাটি হলো সেই চূড়ান্ত বাস্তবতা, যেখান থেকে সব সৃষ্টি উৎপন্ন, যার মধ্যে সবকিছু অবস্থান করছে এবং যার মধ্যেই সবকিছু বিলীন হয়। বেদান্ত দর্শনের মূল গ্রন্থ ব্রহ্মসূত্র এই ব্রহ্মতত্ত্বকে বিশ্লেষণ করে। শঙ্করাচার্য নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মরূপে তাঁর ব্যাখ্যা দেন। রামানুজাচার্য বিষ্ণুকে সগুণ পরম ব্রহ্মরূপে স্থাপন করেন।

কিন্তু অনেকেই জানেন না, দক্ষিণ ভারতের মহান শৈব দার্শনিক শ্রীকণ্ঠাচার্য এই ব্রহ্মসূত্রকেই ব্যাখ্যা করে শিবকে সর্বোচ্চ ব্রহ্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা দেখব – কিভাবে শ্রীকণ্ঠের দর্শনে শিব পরম ব্রহ্ম, এবং এই মত কিভাবে শাস্ত্রসম্মত।

শ্রীকণ্ঠাচার্যের শৈব-বিষিষ্টাদ্বৈত দর্শন

শ্রীকণ্ঠাচার্য "শৈব- বিষিষ্টাদ্বৈত" নামক একটি দার্শনিক অবস্থান প্রস্তাব করেন, যেখানে তিনি নিম্নোক্ত ধারণাগুলো স্পষ্ট করেন:

  • শিবই পরম ব্রহ্ম: ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্যে তিনি বলেন –

    “शिव एव परं ब्रह्म।”
    অর্থাৎ, শিবই পরম ব্রহ্ম।

  • জীব ও জগত শিবের গুণস্বরূপ: জীবাত্মা ও জড় প্রকৃতি, উভয়ই শিবের অধীন – তবে শিবের মত স্বয়ম্ভূ নয়।

  • সগুণ-নিগুণ সমন্বয়: শিবের এক দিকে নির্গুণ – কারণ তিনি অতীত, অনন্ত, রূপ-রহিত। কিন্তু তাঁর ইচ্ছাশক্তি, করুণাশক্তি, অনুগ্রহ ইত্যাদির কারণে তিনি সগুণ রূপেও প্রকাশিত।

এখানে, শিব কেবল “সৃষ্টিকর্তা” নন, বরং তিনিই সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান, পরম সত্তা

ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে শিব

ব্রহ্মসূত্রের প্রথম সূত্র –

“अथातो ब्रह्मजिज्ञासा।”
অর্থাৎ, “এবার ব্রহ্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা শুরু হোক।”

এখানে শ্রীকণ্ঠ বলেন –

"ब्रह्म शब्देन शिवपरमेश्वर उच्यते"
অর্থাৎ, “ব্রহ্ম শব্দে শিব পরমেশ্বরই বোঝানো হয়েছে।”

তিনি ব্রহ্মসূত্র ১.১.২-এ (জন্মাদ্যস্য যাতঃ) মন্তব্য করেন:

"यस्मात् शिवात् सर्वस्य उत्पत्तिरादिः"
"শিব হইতে সমস্ত জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়।"

এখানে ব্রহ্মতত্ত্বের তিনটি গুণ – সৃষ্টি, রক্ষণ, লয় – শিবের মধ্যে উপস্থিত, যা তাঁকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর ও ব্রহ্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে।




শাস্ত্রসমূহে শিবতত্ত্ব

১. ঈশ্বরগীতা (কূর্মপুরাণ)

"अहं ब्रह्म परमं, नान्यत् किञ्चित् अस्ति ततः।"
“আমি পরম ব্রহ্ম — এর বাইরে কিছুই নেই”

শিব নিজেই এই ঘোষণা দেন ঈশ্বরগীতায়। এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে শিবকে “পরম ব্রহ্ম” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

২. গণপতি অথর্বশীর্ষ উপনিষদ

"त्वं ब्रह्मा त्वं विष्णुस्त्वं रुद्रस्त्वं इन्द्रः..."
তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি রুদ্র, তুমি ইন্দ্র...

এখানে গণপতির রূপে মূলত রুদ্রতত্ত্বকেই ব্রহ্মরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে — যিনি সব দেবতার মধ্যমূলে বিরাজমান।

৩. লিঙ্গ পুরাণ

"शिवो निरगुणः शान्तः साक्षात् परब्रह्म परः।"
শিবই নিগুণ, শান্ত ও পরব্রহ্ম।

এটি পরিস্কারভাবে শিবকে সেই চূড়ান্ত, নির্গুণ পরম ব্রহ্ম বলে স্বীকৃতি দেয়।

৪. শিব পুরাণ

"शिवात् परं नास्ति किंचित्"
“শিবের ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই”

এটি শিবের সর্বোচ্চতা তুলে ধরে এবং তাঁকে চূড়ান্ত পরম সত্তা হিসেবে স্থাপন করে।

৫. স্কন্ধ পুরাণ – লিঙ্গোৎপত্তি খণ্ড

শিবলিঙ্গের উত্থানের কাহিনী যেখানে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু অনন্ত আলোর রূপ খুঁজে পান না, সেখানে বলা হয়:

"नास्ति तत् परं किंचिद् – यत् तद् लिङ्गं महेश्वरम्।"
এই লিঙ্গরূপই পরম — এর ঊর্ধ্বে কিছুই নেই।

এটি প্রমাণ করে, শিবলিঙ্গই সেই চূড়ান্ত রূপ – যা পরব্রহ্ম স্বরূপ।

দর্শনমূলক বিশ্লেষণ

শিব বনাম নির্গুণ ব্রহ্ম

শঙ্করাচার্যের ব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার, অনুভবের বাইরে — কিন্তু শ্রীকণ্ঠ বলেন, ব্রহ্ম যদি সম্পূর্ণ নির্গুণ হয়, তবে তিনি কিভাবে সৃষ্টি, সংহার বা করুণা করেন? তাই তিনি বলেন:

"ब्रह्म सत्-चित्-आनन्द स्वरूपं — तथा इच्छाशक्तियुतम् शिवम्।"

অর্থাৎ, পরম ব্রহ্ম শিব, যিনি সচ্চিদানন্দস্বরূপ ও ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন।

পরমেশ্বরের ব্যক্তিগততা

শ্রীকণ্ঠের দর্শনে শিব কেবল নিরপেক্ষ তত্ত্ব নয়, তিনি করুণাময়, উপাস্য, এবং মুক্তিদাতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি যোগ ও ভক্তিমূলক সাধনার সঙ্গে সমন্বিত

 শিব তত্ত্ব – আমাদের জীবনে

শিবকে কেবল “তাণ্ডবনৃত্যকারী দেবতা” হিসেবে দেখা নয়, বরং তাঁকে আমাদের নিজের অস্তিত্বের মূলে থাকা চেতনা হিসেবে উপলব্ধি করতে হবে। শিব মানে জ্ঞান, শিব মানে ত্যাগ, শিব মানে দয়া, আবার শিব মানে চিরন্তন শক্তি।

উপনিষদের সহিত সাযুজ্য

"एको रुद्रो न द्वितीयाय तस्थुः।" (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩.২)
“রুদ্র একাই আছেন — তাঁর দ্বিতীয় কেউ নেই।”

এই দৃষ্টিভঙ্গি শৈব অদ্বৈতবাদের মূলে। যেখানে শিবই জগত, জীব, কর্ম ও মুক্তির কেন্দ্রবিন্দু।

উপসংহার

শ্রীকণ্ঠাচার্যের দর্শন আমাদের একটি বিকল্প ও শক্তিশালী পথ দেখায় – যেখানে শিব পরম ব্রহ্ম, নিগুণ-সগুণের এককতায় অভিন্ন, এবং শাস্ত্রসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত।

এই দার্শনিক রূপরেখা শুধুমাত্র তাত্ত্বিক নয়, এটি উপাসক হৃদয়ে গভীর উপলব্ধির জন্ম দেয়। শিব শুধু দেবতা নন – তিনি চেতনার চূড়ান্ত স্তর, তিনি সেই পরম এক, যাঁর দ্বারা ও যাঁর মধ্যে সবকিছু।

শ্লোক স্মরণে রাখুন

"सच्चिदानन्द रूपाय, शिवाय ब्रह्मणे नमः।"
“সচ্চিদানন্দরূপ শিব, যিনি ব্রহ্ম — তাঁকেই প্রণাম।”


শিবতত্ত্বে সৃষ্টি, সংহার ও রক্ষা – শ্রীকণ্ঠ ও পুরাণসমূহের আলোক

শৈব দর্শনে শিব কেবল একজন উপাস্য দেবতা নন—তিনি নিজেই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও পরম ব্রহ্ম । তিনিই এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূল কেন্দ্র...

Popular Posts