Tuesday, December 10, 2019

হিন্দু সমাজে পদবী প্রচলন

হিন্দুধর্ম অতি প্রাচীন বলেই বিভিন্ন সময় এর পথ পরিক্রমায় বিচিত্র পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যা বাস্তবক্ষেত্রের ধর্মীয় নিয়ম নীতির সাথে কোন সামঞ্জস্যতা নেই। সনাতনী হিন্দু সমাজে  তথাকথিত পদবী প্রচলন হওয়ায় পর থেকে বর্ণভেদের চেয়ে আরও অধিকতর ভেদাভেদ বিভিন্ন পদবী ভেদের লোকরাই সৃষ্টি করতে শুরু করে। পদবী ব্যবহারের ঐতিহাসিক প্রমাণ ও তথ্য --- ১৫১০ খ্রীস্টাব্দে আনন্দ ভট্ট রচিত 'বল্লাল চরিত' যা ১৯০৪ খ্রীস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। এই বল্লাল চরিত পুস্তকে হিন্দু সমাজে পদবী প্রচলন সর্ম্পকে বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে। উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে গৌড়ের বৈদ্য বংশীয় রাজা বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯) নিজ সহধর্মিনী থাকা অবস্থায় অধিক বয়সে পদ্মিনী নাম্মী এক সুন্দরী ডোম নর্তকীকে বিবাহ করেন। এতে দেশজুড়ে রাজার সুনাম নষ্ট হয় এবং এ কুকীর্তি নিয়ে প্রজারা সমালোচনা শুরু করে দেন। রাজা এ কলংক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য রাজ্য মধ্যে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের প্রজাদের এক সম্মিলিত ভোজ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু প্রায় সকল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা উপস্থিত থাকলেও নমঃশূদ্র পারশব বিপ্রগণ এই ভোজ অনুষ্ঠানে যোগদানে বিরত থাকেন। অর্থাৎ রাজার এ কুকীর্তিকে সমর্থন করে ভোজ সভায় অংশ নেন নি। নমঃশূদ্র বংশের কিছু পরিচয় এখানে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। মহামুনি কশ্যপের পুত্র ছিল নমস্। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে ব্রহ্মজ্ঞ মুনিবর নমস্ এর পত্নী (ব্রহ্মার মানসপুত্র রুচির কন্যা) সুলোচনা গর্ভজাত পুত্র কীর্তিবান ও উরুবান নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের পিতা। মুনিবর নমস্ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তিনটি বরও লাভ করেছিলেন ।
এগুলো হচ্ছে --- 1> তার পুত্রগণ বেদাচার ব্রাহ্মণাচার অধিকারী হবে এবং পরবর্তীতে হোমযজ্ঞ ও পূর্জাচনায় অধিকারী হয়ে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করবে।
2> তাঁর বংশ তাঁরই নামে খ্যাত হবে। পুত্রদ্বয় শূদ্রাকে বিয়ে করায় নমস্ নামের সাথে শূদ্র যোগ হয়ে নমঃশূদ্র নামে খ্যাত হবে।
3> তাঁর বংশধরদের চরিত্রগুন ও কীর্তি গৌরবে তাঁর নামের মহিমা ক্রমোজ্জ্বল হবে।
নমঃশূদ্র সম্প্রদায় বল্লাল সেনের পদবীভেদ করার আগে কুলীন ব্রাহ্মণ ও জ্ঞানী ছিলেন। যেহেতু নমঃশূদ্ররা বল্লাল সেনের ভোজসভার অংশ গ্রহণ করেন নি, সেহেতু রাজা তাঁদের ব্যবহারে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হন এবং নিজেকে অপমানিত বোধ করেন। রাজার আদেশে সকল নমঃশূদ্র লোকদের চাকুরীচ্যুত করা হলো এবং এমনকি নতুন নিয়োগও বন্ধ করে দেয়া হলো। শুধু তাই নয় তাঁদের যজ্ঞসূত্র ছিন্ন করে চন্ডাল বলে গালাগাল দিয়ে নগর বন্দর থেকে উৎখাত করা হল। অনন্যোপায় হয়ে এই নমঃশূদ্ররা সেদিন পাহাড়, বনাঞ্চলে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে অনেকটা নিভৃত জীবনযাত্রা শুরু করলেন এবং প্রকৃতি নির্ভর বৃত্তি অবলম্বন করেন। অন্যদিকে রাজার আয়োজিত উক্তভোজ  অনুষ্ঠানে যোগদানকারী সম্প্রদায়ভুক্তরা নমঃশূদ্রগণের প্রতি রাজার এই ব্যবহারে উৎসাহিত হয়ে নিজেদের নিম্ন সামাজিক মর্যাদা ঢাকবার চেষ্টায় তাঁদের প্রতি অধিক মাত্রায় দুর্ব্যবহার শুরু করে। তারা রাজার সকল কর্মকে নির্বিচারে সমর্থন করে রাজার অনুগ্রহ লাভ করতে যত্নবান হয়।  রাজাও এসব সম্প্রদায়কে সাহায্য করেন এবং অনেক সম্প্রদায়কে কৌলিন্য তথা পদবী দান করেন।
বল্লাল সেনের আগে পাল রাজাদের আমলে বাংলাতে বৌদ্ধ এবং লোকায়েত অনেক ধর্মই ছিল-যার মধ্যে তান্ত্রিক, কালীভক্ত এবং নানান স্থানীয় 'যোগী' সংস্কৃতিই পাওয়া যাবে। বৌদ্ধ ছিল রাজধর্ম। কিন্ত কোন জাতিভেদ পাওয়া ছিল না।




বল্লাল সেনের (1160–1179) আগে বাংলায় বৈদিক ধর্মের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। কোন ব্রাহ্মনই ছিল না বাংলায়।
বল্লালসেন সেন রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা। ১১৬০ খ্রিষ্টাব্দে সেন রাজবংশের প্রথম রাজা বিজয়সেন (১০৯৭-১১৬০ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মৃত্যুর পর বল্লালসেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজলাভের পর তিনি রাজ্য বিস্তারের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ সংস্কারকার্যে অধিকতর মনোনিবেশ করেন। তিনি পিতার মতোই ‘অরিরাজনিশঙ্ক শঙ্কর’ এবং অন্যান্য সম্রাটসুলভ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় জগদেকমল্লের কন্যা রামাদেবীকে বিবাহ করে সেনবংশের সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। বল্লালসেনের রাজত্বকালের ইতিহাস পুনর্গঠন করার জন্য কয়েকটি মূল্যবান উপকরণ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে যথাক্রমে ‘নৈহাটি তাম্রশাসন’ ও ‘সানোখার মূর্তিলিপি’, বল্লালসেন কর্তৃক রচিত ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ ছাড়াও বল্লাল চরিত নামে দু’খানি গ্রন্থ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথমটি বল্লাল সেনের অনুরোধে তাঁর শিক্ষক (গোপাল ভট্ট) ১৩০০ শকাব্দে দুই খণ্ডে রচনা করেন এবং বল্লাল চরিতের তৃতীয় খণ্ড নবদ্বীপাধিপতির আদেশে গোপালভট্টের বংশধর আনন্দভট্ট ১৫০০ শকাব্দে রচনা করেন। উপরোক্ত বইগুলি সমসাময়িক।
সেন রাজারা এসে প্রথমে বাংলার সব প্রজাদের শুদ্র বানালেন! কনৌজ থেকে ব্রাহ্মন ধরে এনে তাদের দিয়ে বাংলায় ব্রাহ্মন্য ধর্ম, বৈদিক মতে পূজা অর্চনা চালু করলেন। ব্রাহ্মনদের বংশ বৃদ্ধি করতে এদেরকে অনেকগুলি গ্রাম দিলেন। কুলীন ব্রাহ্মনদের অসংখ্য বিবাহে উৎসাহ দেওয়া হল যাতে ব্রাহ্মনদের বংশ বৃদ্ধি হয়। এরাই আজকের তথাকথিত 'ব্রাহ্মণ'। এক অদ্ভুত হিন্দু যুগের সুচনা হল বাংলায়। কিছু ব্রাহ্মণ, বাকী সবাই শুদ্র, বাংলাতে আজো ক্ষত্রিয় বৈশ্য নেই। বাংলার ব্যবসায়ী শ্রেনী সাহারাও শুদ্র আবার ঘোষ-বোসের মতন রাজকরনিক শ্রেনীও শুদ্র!! ...... বাংলার জনগন তখন এই বহিরাগত ব্রাহ্মন আর সেনদের প্রতি বেজায় বিক্ষুব্ধ। ফলে মাত্র দুহাজার সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার খিলজি যখন নবদ্বীপ আক্রমন করলেন (১২০২), লক্ষন সেনের পালানো ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। এর পরবর্তীকালে বাংলায় লোকজন দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে থাকে ব্রাহ্মন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণায় আবার চতুর ইসলামিক ফকিরদের শঠতা ও জংগী ইসলামিক শাসকের দমনপীড়নে। হজরত শাহ জালালের (১৩০৬) মতন সুফীদের প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালী দলে দলে ইসলাম গ্রহন করতে থাকে চোদ্দশ শতক পর্যন্ত।

সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা ক...

Popular Posts