আজ একটা গুরুতর বিষয়ে আলোচনা করব।
অনেকে এই একটা ধারণা পোষণ করে আসতেছেন যে,ভগবান শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদে জগৎ অসত্য,মিথ্যা বলে উড়ে দেওয়া হয়েছে।এই যে আমরা নগ-নদাদিসঙ্কুল বিচিত্র জগৎ দেখতেছি;এই যে আমরা প্রতি নিয়ত সুখ-দুঃখ হর্য-বিষাদাদি অনুভব করতেছি,--এ সকলই মায়াময়,অসত্য,অলীক।সকলই ভ্রান্ত-প্রতীতি মাত্র।একমাত্র ব্রহ্মই সত্য,আর সবই অসত্য।অনেকের চিত্তে,পাষাণে অঙ্কিত রেখার ন্যায়,এই সংস্কারটা,এই ধারণাটা,বদ্ধমূল হয়ে পড়েছে।শঙ্করাচার্য নাকি,তাঁর অদ্বৈতবাদে তাই শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন!এখন আমরা এই কথাটা ঠিক কিনা,প্রকৃতই শঙ্কর এই জগৎটাকে অলীক,মায়াময়,অসত্য বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কিনা,--তাই পরীক্ষা করে দেখতে অগ্রসর হব।শঙ্করাচার্য্য স্পষ্টবাক্যে,অনেক স্থানে জগৎকে অসত্য,মিথ্যা,অসার,মায়াময় বলে নির্দ্দেশ করেছেন,দেখতে পাওয়া যায়।কিন্তু তিনি কি ভাবে এই শব্দ গুলির ব্যবহার করেছেন,তা পরীক্ষা করে দেখা নিতান্তই আবশ্যক।
(১) কিন্তু এই বিষয়টির পরীক্ষা পূর্ব্বে,আমরা একটি তত্ত্ব পাঠকবর্গের মনে জাগিয়ে দিতে ইচ্ছা করি।দর্শনশাস্ত্রে "কার্য্য ও কারণ" শব্দটি পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হয়েছে।বস্তু বা জীব হতে "অভিব্যক্ত ধর্ম বা বিকারগুলি,এক অবস্থা হতে অবস্থান্তর ধারণ করে থাকে।বিকারগুলির প্রকৃতি এই প্রকার।পূর্ববর্তী অবস্থা বিনষ্ট হলে,পরবর্তী অবস্থায় পরিণত হয়।এই পূর্ববর্তী অবস্থাকে কারণ শব্দে নির্দেশ করা যায়।জড় বিজ্ঞান ও মনো-বিজ্ঞান এই অর্থেই 'কারণ' শব্দটিকে ব্যবহার করে থাকে।শঙ্করাচার্য অতি স্পষ্ট কথায় আমাদেরকে বলে দিয়েছেন যে,তিনি তাঁর ভাষ্যে কোথাও এরুপ অর্থে 'কারণ' শব্দের ব্যবহার করবেন না।বস্তুই বল,আর জীব বল,বা ব্রহ্মই বল,--সকলেরই এক একটা 'স্বভাব' বা 'স্বরুপ' আছে।এই স্বভাব হতেই কতকগুলি ধর্ম বা গুণ বা ক্রিয়ার অভিব্যক্তি হয়ে থাকে।অবশ্য এই ধর্ম বা গুণগুলি পুনঃপুন রুপান্তর ধারণ করে;এক অবস্থা হতে অপর অবস্থা গ্রহণ করে।পূর্ব্বাবস্থা বিনষ্ট হয়ে,বর্তমানাবস্থায় আসে।শঙ্কর বলেছেন যে যে স্বরুপ হতে ঐ সকল ধর্ম্ম বা গুণ উৎপন্ন হচ্ছে;সেই স্বরুপটি সকল অবস্থানন্তরের মধ্যেই আপনার স্বরুপ,আপন একত্ব বজায় রাখে।পূর্ব্বাবস্থা নাশের সঙ্গে,ঐ স্বরুপটা বিনষ্ট হয় না।পূর্ব্বাবস্থার মধ্যেও ঐ স্বরুপটা অনুগত ছিল:আবার বর্তমানাবস্থার মধ্যেও সেই স্বরুপটাই অনুগত রয়েছে।শঙ্কর বলে দিয়েছেন যে,তিনি এই স্বরুপটাকেই 'কারণ' শব্দে নির্দ্দেশ করবেন।এই 'কারণের' যত অবস্থান্তরই হোক না কেন,তা কোন অবস্থান্তরের মধ্যেই নিজকে হারায় না;তার স্বাতন্ত্র্য ও একত্ব(identity) ঠিক থাকে।তিনি এই স্বরুপ বা স্বভাবটাকেই 'কারণ' বলবেন।এই নিয়ম স্থির করে নিয়ে,শঙ্করাচার্য্য এই কারণ এবং তা হতে অভিব্যক্ত কার্য্য বা বিকার বা ধর্মগুলির মধ্যে সম্বন্ধ কিরুপ তার আলোচনা করেছেন।আমরা দেখতে পাই,তিনি এই সম্বন্ধটা বুঝাবার জন্য বেদান্তদর্শনের একটা সমগ্র 'পাদ' ব্যয়িত করেছেন।এত পরিশ্রম তিনি কেন করলেন?এই বিকারগুলি,ধর্মগুলি,ক্রিয়া ও গুণগুলি যদি তাঁর মতে মিথ্যা,অলীক,অসত্যই হয়;তা হলে একটা অলীক বস্তুর সম্বন্ধই বা কিরুপে হবে এবং সেই তথা-কথিত সম্বন্ধ নির্ণয়ের জন্য তিনি শ্রমই বা কেন করতে গেলেন?তিনি নিজেই এই মন্তব্য প্রকাশ করেছেন যে,---
"দুইটা বস্তুই যদি অলীক হয়,তা হলে সেই দুই অলীক বস্তুর মধ্যে পরস্পর কোন সম্বন্ধ হতে পারে না।আবার যদি,একটা অলীক বস্তু;আর,অপরটি সত্য বস্তু;---এরুপ হয়;তা হলেও উভয়ের সম্বন্ধ হতে পারে না।পরস্পর সম্বন্ধ হতে হলেই,দুইটা বস্তু আবশ্যক; এবং এই দুইটা বস্তুই সত্য হওয়া চাই।
(২) আমরা এই জগৎটাকেই সর্ব্বদা আমাদের ইন্দ্রিয়-পথে বিস্তারিত দেখতে পাই।অসংখ্য নাম-রুপাত্মক বিকার নিয়েই এই জগৎ।এই বিকারগুলোকে আমরা দেশে ও কালে অভিব্যক্ত দেখতে পাই।বিকারগুলো সর্ব্বদা পূর্ব্ববর্ত্তী একটা অবস্থা ত্যাগ করে,পরবর্তী অপর একটা অস্থানন্তর গ্রহণ করতেছে,দেখতে পাই।এইরুপে তারা পরস্পর কার্য্য-কারণ-সূত্রে আবদ্ধ হয়ে ক্রিয়া করে।সুতরাং আমরা এই নামরুপাত্মক জগৎকে,এই বিকার-গুলিকে স্বাধীন,স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলেই বিবেচনা করি।কিন্তু এই জগৎ যখন দেশে ও কালে অভিব্যক্ত,তখন তা অবশ্যই এমন একটা বস্তুর বিকাশ,যে বস্তুটি দেশ ও কালের অতীত।জগৎটা যখন আমাদের সম্মুখে অভিব্যক্ত দেখতেছি।তখন তা অবশ্যই এমন একটা বস্তুর বিকাশ,যে বস্তুটি দেশ ও কালের অতীত।জগৎটা যখন আমাদের সম্মুখে অভিব্যক্ত দেখতেছি,তখন তা অবশ্যই কোন বস্তু হতে অভিব্যক্ত হয়েছে।তা 'শূন্য'হতে আসে নাই।--এই প্রকাণ্ড কথাটা আমরা একেবারে ভুলে যাই।এই কথাটা ভুলে গিয়ে আমরা জগৎটাকে একটা স্বতন্ত্র বস্তু,স্বাধীন বস্তু,স্বতঃসিদ্ধ বস্তু বলেই গ্রহণ করি।আমরা মনে করে থাকি যে,জগতের বিকারগুলি অনন্তদেশে ও অনন্তকালে বিস্তৃত রয়েছে এবং এই প্রকারেই পরস্পর কার্য্য-কারণ-শৃঙ্খলে বদ্ধ হয়ে ক্রিয়া করে চলেছে।শঙ্করাচার্য আমাদেরকে বলে গিয়েছেন যে জগৎকে যদি এইরুপ স্বাধীন,স্বতন্ত্র,স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলে গ্রহণ কর,তা হলে তুমি প্রকাণ্ড ভুল করলে।এ প্রকার স্বাধীন জগৎ 'অসত্য','মিথ্যা'।এ জগৎ ব্রহ্মবস্তু হতে অভিব্যক্ত।ব্রহ্ম এই জগতের কারণ।যিনি দেশ,কালাতীত,এই জগৎ তাঁরই দেশ-কালে বিকাশ।এই জগৎ তাঁর স্বরুপের অভিব্যক্তি সুতরাং এই জগৎ,তা হতে স্বতন্ত্র হয়ে তাঁকে ছেড়ে স্বাধীন-ভাবে থাকতে পারে না।
এই কথাগুলো শিবাবতার ভগবান শঙ্করাচার্য্য কি প্রকারে বলে দিয়েছেন,নিম্নে আমরা তা প্রদর্শন করতেছি।তা হতে পাঠক দেখতে পাবেন যে ভাষ্যকার এই জগৎকে,নামরুপাত্মক বিকারগুলোকে,কিভাবে 'অসত্য' 'মিথ্যা' বলে নির্দ্দেশ করেছেন।
(১)জগতের নাম-রুপাত্মক বিকারগুলো আপনা আপনি আসে নাই।সুতরাং এই বিকার-গুলিও যে স্বয়ংসিদ্ধ,স্বাধীন 'বস্তু' তা হতে পারে না।যেখানেই কোন বিকার দেখবে সেখানেই দেখবে ঐ বিকার কোন বস্তুর বা জীবেরই বিকার।--কোন বস্তু বা জীবের স্বরুপ হতেই তা অভিব্যক্ত।সুতরাং তা কোন বস্তুবিশেষ হতে বা কোন জীব-বিশেষ হতে অভিব্যক্ত গুণ বা ধর্ম।তা হলেই,তুমি ঐ বিকার-গুলিই যে স্বতঃসিদ্ধ,স্বাধীন,বস্তু,তা বলবে কিরুপে?যেটি প্রকৃত বস্তু,তা হতেই অভিব্যক্ত হয়েছে এবং তাকেই আশ্রয় করে রয়েছে।
(২)যে বস্তু বা জীবের স্বরুপ হতে ঐ গুণ বা বিকার-গুলি অভিব্যক্ত হয়েছে,তাকে ছাড়িয়া,তা হতে 'বিভক্ত' হয়ে তা হতে স্বতন্ত্র হয়ে তা থাকতে পারে না।
(৩)বিকারগুলো যখন কোন বস্তু বা জীবের 'স্বরুপ' হতে অভিব্যক্ত,তখন তাদের নিজের কোন স্বতন্ত্র স্বরুপ থাকতে পারে না।এই জন্যই বিকারগুলি নিয়ত চঞ্চল,অস্থির,পুনঃপুন রুপান্তর প্রাপ্ত হয়।তারা যে বস্তু বা জীবের ধর্ম্ম বা গুণ,তারাই স্বরুপের পরিচয় প্রদান করে থাকে।কাজেই,সেই স্বরুপটাকে বাদ দিয়ে সেগুলোকে বুঝা যায় না।সুতরাং সেগুলোকে সেই স্বরুপ হতে 'স্বতন্ত্র' বস্তু বলবে কি প্রকারে?
এই প্রকারে শঙ্করাচার্য্য,এই জগৎকে বা এই জগতে অভিব্যক্ত বিকারগুলোকে,স্বতন্ত্র,স্বাধীন,স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলে গ্রহণ করতে পারেন নাই।এই জগৎ যাঁর অভিব্যক্তি,তা হতে এই জগৎকে স্বতন্ত্র করে নেওয়া যায় না।"মরুভুমি হতে স্বতন্ত্র করে নিয়ে কি মরীচিকাকে ভাবতে পারা যায়"?তাই,এ জগৎ ব্রহ্ম হতে স্বতন্ত্র বস্তু না।
(৪)এই সকল আলোচনা হতে বুঝতে পারা যাচ্ছে যিনি দেশ,কালাতীত ব্রহ্ম,---এ জগৎ তাঁর 'কার্য্য'।শঙ্কর এই কারণ ও কার্য্যের সম্বন্ধকে "অনন্য"শব্দে নির্দ্দেশ করেছেন।জগৎ যখন ব্রহ্ম হতে 'স্বতন্ত্র' হয়ে থাকতে পারে না,তখন জগৎ নিশ্চয়ই ব্রহ্ম হতে 'স্বতন্ত্র' বা অন্য কোন স্বাধীন স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু হতে পারতেছে না।এই জন্যই এই জগৎ--ব্রহ্ম হতে 'অনন্য'।শঙ্করের সিদ্ধান্ত এই যে,এই জগৎটা-ব্রহ্ম হতে অভিব্যক্ত।জগৎ--ব্রহ্মেরই অবস্থাবিশেষ,রুপান্তর।এজগৎ--তাঁরই স্বরুপের পরিচয় দিবে বলে অভিব্যক্ত হয়েছে।সুতরাং জগৎ ব্রহ্ম অপেক্ষা একটা একান্ত স্বতন্ত্র বস্তু,ভিন্ন বস্তু হবে কি প্রকারে?সুতরাং জগৎকে স্বতন্ত্র,স্বাধীন,স্বয়ংসিদ্ধ বস্তু বলে মনে করলে ভুল হলো।তা হতে স্বতন্ত্র করে নিলে,এই জগৎ মিথ্যা হলো,অসত্য হলো।এই রুপেই ভাষ্যকার সর্ব্বত্র জগৎকে মিথ্যা বলেছেন।এইজন্যই শঙ্কর বলেছেন।
"কার্য্যস্য কারণাত্মত্বং নতু কারণস্য কার্যাত্মত্বং"--কার্য্য,তার কারণের অভিব্যক্তিমাত্র এবং সেই কারণটি--কার্য্যের মধ্যে আপন স্বরুপের স্বাতন্ত্র্য ঠিক রাখে।
(৫)শঙ্করাচার্য্য এইভাবে কারণ ও কার্য্যের সম্বন্ধ নির্ণয় করেছেন।পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ এই "অনন্য"শব্দটিকে "identical" শব্দ দ্বারা অনুবাদ করেছেন।আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে,এই অনুবাদ অত্যন্ত অসঙ্গত ও ভ্রমপূর্ণ অনুবাদ।এই অনুবাদ গ্রহণ করলে,কার্য্য ও কারণ এক হয়ে উঠে।ব্রহ্ম ও জগৎ এক হয়ে উঠে।মূলে এই ভ্রম করাতেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ,শঙ্করের অদ্বৈতবাদকে Pantheism বলে বুঝেছেন।জগৎগুরু বারংবার বলে দিয়েছেন যে,'কারণ ও কার্য্য' তার সম্বন্ধ বুঝতে দুইটা কথা মনে করে রাখতে হবে।যদি 'কারণ ও তার কার্য্যকে--'এক'ই বস্তু বল--উভয়কে "identical" বল,-তা হলে,কারণ ও কার্য্য এই শব্দ দুইটির ভেদ উঠে যায়।পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা আজ যে ভুল করতেছেন,শঙ্করের টীকাকারগণও বহুশতাব্দী পূর্ব্বে এই আশঙ্কা করেছিলেন।কি জানি যদি লোকে,কার্য্য ও কারণকে identical বা এক বলেই মনে করে,এই আশঙ্কায় টীকাকারও বলে দিয়েছিলেন যে,
"কারণাৎ পৃথক-সত্তা-শূন্যত্বং সাধ্যতে,
ন ঐক্যাভিপ্রায়েণ"
"কার্য্য বা বিকার গুলি তাদের 'কারণ' হতে স্বতন্ত্র না।" শঙ্কর বলে দিয়েছেন যে কার্য্য ও কারণের সম্বন্ধ বুঝতে হলে এই একটা অংশ মনে রাখতে হবে।আবার,আর একটা অংশও মনে রাখতে হবে;সেই অংশটা এই "কারণ,তার কার্য্যগুলি হতে স্বতন্ত্র"।"কার্য্য গুলি কারণ হতে স্বতন্ত্র না"।এই দুটি কথা একত্র মনে রাখতে হবে।এমন স্পষ্ট কথা বলাতেও কেমন করে বড় বড় পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতেরা--কারণ ও কার্য্যের সম্বন্ধকে "identical" বলে ব্যাখা করলেন তা আমরা বুঝতে নিতান্তই অসমর্থ।শঙ্করের এই সিদ্ধান্তটা মনে রাখলে বেদান্তের সর্ব্বত্র ব্যবহৃত "সর্ব্বং খলিদ্বং ব্রহ্ম""ব্রহ্মবৈদং সর্ব্বং" "ইদং সর্ব্বং যদয়মাত্মা,""আত্মৈব ইদং সর্ব্বং" এই সকল বাক্যের অর্থ,এই এই সকল কথার প্রকৃত অভিপ্রায়,--অনায়াসে বুঝতে পারব।
যেখানেই বেদান্তে "সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম" এই প্রকারের উক্তি আছে,ভাষ্যকার সেখানেই বলে দিয়েছেন যে,এই প্রকার উক্তির তা অর্থ না যে,ব্রহ্মই এ বিশ্ব বা জগৎ;ব্রহ্মে ও জগতে কোন ভেদ নাই।এ সকল উক্তির অর্থ এই যে,--
(১)কার্য্য বা বিকারগুলি কারণ হতে স্বতন্ত্র না ও স্বতন্ত্র হয়ে থাকতে পারে না।
আর--
(২)কারণটি কিন্তু,তার কার্য্য হতে স্বতন্ত্র,ভিন্ন।কার্য্যাকার ধারণ করলেও কারণটি আপন স্বাতন্ত্র্য হারায় না;কোন স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে উঠে না।সকল বিকারের মধ্যে,সকল অবস্থান্তরের মধ্যে,কারণের একত্ব ঠিক থাকে।তবেই পাঠক দেখুন--ভগবান শঙ্করের মতে ঐ সকল উক্তির সেই অর্থ পাওয়া যাচ্ছে যে এই জগৎ ব্রহ্মেরই অবস্থান্তর,আকার-বিশেষ,রপান্তর মাত্র;তা ব্রহ্ম হতে কোন স্বতন্ত্র স্বাধীন বস্তু না।কিন্তু এই জগদাকার ধারণ করাতেও,এই জগতের মধ্যে ব্রহ্ম,আপন স্বাতন্ত্র্য ও একত্ব হারান নাই;কেননা তিনি জগৎ হতে স্বতন্ত্র।ভাষ্যকার বলেছেন যে, যারা ব্রহ্ম ও জগৎকে এক মনে করে তারা অবিদ্যাচ্ছন্ন।অবিদ্যাচ্ছন্ন লোকেরাই পরমাত্মার স্বাতন্ত্র্য ভুলে গিয়ে পরমাত্মা ও জগৎকে এক বা identical বস্তু বলে মনে করে।ভগবান কেন এ সকল লোকলে "অবিদ্যাচ্ছন্ন" বললেন এখন আমরা তাই দেখব।
(৬)অনেকের মুখে এরুপ একটা কথা সর্ব্বদাই শুনতে পাওয়া যায় যে,ভগবান শঙ্করাচার্য্য তাঁর ভাষ্যে আমাদের জাগরিতাবস্থাকে 'স্বপ্নাবস্থার' সঙ্গে তুলনা করলেন,উভয় অবস্থা তুল্য বলে নির্দ্দেশ করেছেন।সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে তাঁর মতে এ জগৎটা অসত্য,মিথ্যা,অলীক।তারা বলেন এই যে জাগরিতকালে বৃক্ষ,লতা,মনুষ্য,পশু প্রভৃতি বস্তুর আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি,এবং শব্দ স্পর্শ সুখ দুঃখাদির জ্ঞান লাভ করে থাকি।স্বপ্ন দর্শনকালে আমরা,এই জাগরিত কালের মত কত বস্তু প্রত্যক্ষ করি।এবং কত বিষয়ের জ্ঞান আমাদের হয়ে থাকে।তাঁরা বলেন যে,ভগবান এই দুই কালের অনুভূত বস্তুগুলি ও তদ্বিষয়ক জ্ঞানকে তুল্য বলে মীমাংসা করেছেন।কিন্তু তা কারোই অবিদিত নাই যে,স্বপ্ন-দৃষ্ট বস্তুগুলি অসত্য-মিথ্যা।তা হলেই দাঁড়াইতেছে যে,শঙ্কর মতে জাগরিতকালের বস্তুগুলিও তবে অসত্য মিথ্যা হচ্ছে।অনেকের নিকট এই কথাটা শুনতে পাওয়া যায়।আমরা পাঠকবর্গের সম্মুখে এ বিষয়ে ভগবান কি মীমাংসা করেছেন তা উপস্থিত করতেছি।পাঠক দেখতে পাবেন যে,এই তুলনায় বৃক্ষ,লতাদি বস্তুকে অলীক বলে উড়ে দেবার কোন কথা বলা হয় নাই
লোকে,ভাল করে শঙ্করের মন্তব্যগুলো তলিয়ে দেখে না।উপর উপর দেখেই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়!তাই এই প্রকার ধারণা প্রচলিত হয়ে পড়েছে।বৃহদারণ্যকে "অজাতশত্রু ও বালাকির" উপাখ্যানে জাগবিতাবস্থা ও স্বপ্নাবস্থার বিস্তৃত বিবরণ আছে।শঙ্করাচার্য্য এই উভয় অবস্থার তুলনা করে যা মীমাংসা করেছেন তাতে তিনি জগৎকে যে অর্থে মিথ্যা,অসত্য বলেছেন তা আপনারা সুস্পষ্ট বুঝতে পারবেন।তিনি বলছেন--স্বপ্নে,আমি রাজা হয়ে সিংহাসনে উপবিস্ট হয়ে আছি;সম্মুখ দাস দাসী প্রভৃতি পরিজনবর্গ আমার সেবা করতেছে;আমি নানারুপ সুখদুঃখাদি অনুভব করতেছি;--এই প্রকার বোধ করে থাকি।এস্থলে প্রশ্ন এই যে,স্বপ্নদর্শনকালে এই যে আত্মা,আপনাকে রাজা বলে বোধ করে পরিজনাদি দ্বারা পরিবৃত দেখতে পায়;সুখদুঃখাদি অনুভব করতে থাকে--এই সকল সুখ দুঃখাদি নানা ধর্মবিশিষ্ট বলেই ত তখন আত্মাকে বুঝা যায়।তবে কি আত্মার তাই স্বরুপ?অথবা,এই সকল সুখদুঃখাদি ধর্ম্ম বা অবস্থা হতে আত্মার একটি 'স্বতন্ত্র' স্বরুপ আছে?শঙ্কর বলেছেন যে কেউ কেউ মনে করেন যে,এই সকল অবস্থা বিশিষ্ট যে সেইত আত্মা রাজা বলে বোধ,দাস দাসী প্রভৃতির দর্শন,সুখ দুঃখাদির অনুভব এই সকল ধর্ম্ম বিশিষ্ট সেই ত আত্মা।এ সকল ছাড়া আবার আত্মার একটা স্বতন্ত্র স্বরুপ কোথায়?এগুলো নিয়েই তো আত্মা।ভগবান এই কথার উত্তরে সিদ্ধান্ত করেছেন যে 'না এই সকল সুখ দুঃখাদি বিবিধ ধর্ম,কখনই আত্মার স্বরুপ হতে পারে না।এই সকল দাস-দাসী প্রভৃতি পরিজন,রাজ্য ধনাদি বস্তু,সুখ দুঃখাদি বিবিধ ধর্ম কখনই আত্মার স্বরুপ হতে পারে না।স্বপ্নে এই সকল বস্তুর যে জ্ঞান হয়,এই সকল বস্তু ও বস্তুর বোধকে যদি আত্মার স্বরুপ বলে মনে কর;তা হলে আমরা বলব যে আত্মার স্বরুপ ভাবে এ সকল বস্তু সত্তা নাই তারা আত্মার উপরে মিথ্যা আরোপিত হয়ে থাকে মাত্র।আত্মার যেটি প্রকৃত স্বরুপ তা এই সকল বস্তু ও বস্তুর বোধ হতে স্বতন্ত্র।জাগরিতকালের বস্তু ও বস্তুর বোধ সম্বন্ধেও তাই বুঝতে হবে।তারও আত্মার স্বরুপ না।আত্মার স্বরুপ যেটা তা ঐ সকল ধর্ম্ম বা অবস্থান্তরের মধ্যেও আপন সাতন্ত্র্য ঠিক রাখে।পাঠক শঙ্করের এই সকল কথা হতে দেখছেন যে,শঙ্কর জাগরিতাবস্থায় দৃষ্ট বা অনুভূত বস্তু বা বস্তুর জ্ঞানকেই 'মিথ্যা' বা অবিদ্যমান বলতেছেন না।স্বপ্ন দৃষ্ট বস্তু বা বস্তুর বোধকেও তিনি অসত্য মিথ্যা বলতেছেন না।এস্থলে আর একটা বিষয় লক্ষ্য করা কর্তব্য।আত্মার স্বরুপটি যে ঐ সকল সুখ-দুঃখাদি বিবিধ ধর্ম্ম বা অবস্থা হতে স্বতন্ত্র;তারাই যে আত্মার স্বরুপ না,তা বলতে গিয়ে ভগবান শঙ্কর তিনটি সুন্দর যুক্তি দিয়েছেন।যুক্তি কয়েকটি এই--
(ক) "ব্যভিচারদর্শনাৎ"।--স্বপ্নে আত্মায় যে সকল ধর্ম উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছে;সেগুলোকে আত্মার স্বরুপ বলা যায় না।কেননা, তারা পরিবর্তিত হয়,রুপান্তরিত হয়।স্বপ্নে তাদের যে আকার,যে রুপ দেখতেছ জেগে উঠলে আর সেরুপ,সে আকার থাকবে না।কিন্তু যেটা যার স্বভাব বা স্বরুপ তা পরিবর্তন করা যায় না।সুতরাং তাদেরকে আত্মার স্বরুপ বলতে পার না।
(খ)দৃশ্যত্বাৎ:--ঐ সকল সুখ দুঃখাদি ধর্মকে আত্মা স্বপ্নে নিজের বিষয় রুপে object দৃশ্যরুপে,অনুভব করে থাকে।দৃশ্য বস্তু হতে তা 'দ্রষ্টা' অবশ্যই স্বতন্ত্র।সুতরাং তাদেরকে আত্মার স্বরুপ বলতে পার না।
(গ) বস্তুন্তর সম্বন্ধ জনিতত্বাচ্চ:--ঐ সকল ধর্ম বা বিকার যে আত্মাতে উদ্রিক্ত হয়েছে তা অন্য বস্তুর সহিত সংসর্গের ফলে কারণান্তর যোগে।যা অন্য কোন কারণের সর্ম্পলে আসায় উৎপন্ন হয় ,তাতো অনিত্য সেই কারণটি চলে গেলে আর তাও থাকবে না।সুতরাং ঐ ধর্ম-গুলিকে আত্মার স্বরুপ বলতে পারা যায় না।আমাদের জাগরিত কালেও,বিষয়ে ইন্দ্রিয়যোগে যে সকল ধর্ম্ম বা ক্রিয়া উদ্রিক্ত হয়,সেগুলিও এই সকল হেতুতে আত্মার স্বরুপ হতে পারে না।
শঙ্কর স্বপ্নদৃষ্ট বস্তুগুলিকে বা জাগ্রত দৃষ্ট বস্তুগুলিকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন নাই।আত্মার যেটি প্রকৃত স্বরুপ সেটা সকল ধর্ম বা গুণ হতে স্বতন্ত্র।যারা অবিদ্যাচ্ছন্ন তারাই ঐ ধর্ম্ম বা গুণ গুলিকে আত্মার উপরে "আরোপিত" করে নিয়ে এবং তাদেরকে আত্মার স্বরুপ বলে মনে করে।কারণান্তর যোগে আত্মায় যে সকল ধর্ম্ম বা ক্রিয়া বা গুণ উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে সে সকলের মধ্যে আত্মার একত্ব ও স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট থাকে।তা ভুলে অবিদ্যাচ্ছন্ন লোকেরা সেগুলোকে আত্মার স্বরুপ বলে মনে করর।তাকেই বেদান্তে "অধ্যারোপ" বলে।তা মিথ্যা,অসত্য।সর্ব্বত্র ভাষ্যকার এই ভাবেই ধর্ম্মগুলিকে মিথ্যা,অসত্য বলেছেন।
(৬) কার্য্য ও কারণের সম্বন্ধ নির্ণয় করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য্য বলে দিয়েছেন যে প্রত্যেক বস্তু বা জীবের একটি স্বতঃসিদ্ধ 'স্বরুপ';এবং তার একটি 'সম্বন্ধি রুপ' আছে।যখন একটা বস্তু বা জীবের,অপর একটা বস্তুর সহিত বা অবস্থার সহিত বা কোন ব্যক্তির সহিত সম্বন্ধ হয়,সেইটাই তার সম্বন্ধি রুপ।অপর কারও সাথে সম্পর্ক হলেই যে তদযোগে বস্তুর বা ব্যক্তির স্বরুপটা একটা স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে উঠে তা না।ঐ স্বরুপটির কোন হানি হয়।সুতরাং প্রত্যেক বস্তু বা জীব অপর কারোও সাথে সর্ম্পকে আসলেও তার আপন স্বরুপটি ঠিকই থেকে যায়।