আমার এই লেখাটা ঐসব মধ্যযুগীয় বিভেদকামী বৈষ্ণবদের জন্য , যারা মনে করে নারায়ণ , গোবিন্দ, কৃষ্ণ বড় আর পরমেশ্বর শিব ছোট। অদ্বৈতবাদীদের জ্ঞ্যাতার্থে জিনি হর তিনিই হরি।
পবিত্র
বেদশাস্ত্রে পরমেশ্বর শিবের সোমরূপ থেকেই শ্রীবিষ্ণুর সৃষ্টির তত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে -
ঋগ্বেদে
( নবম মণ্ডল / ৯৬ নং সুক্ত /৫ নং মন্ত্র) বলা হয়েছে -
সোমঃ
পবতে জনিতা মতীনাং জনিতা দিবো জনিতা পৃথিব্যাঃ।
জনিতাগ্নের্জনিতা
সূর্যস্য জনিতেন্দ্রস্য জনিতোত বিষ্ণোঃ।।
অর্থঃ
স্তুতি, দ্যুলোক,পৃথিবী, অগ্নি, সূর্য, ইন্দ্র এবং বিষ্ণুকে উৎপন্ন
বা সৃষ্টিকারী সোম সর্বদা শুদ্ধ
তথা সকল দোষাবহ গুণ
হইতে মুক্ত।
ঋগ্বেদ ৯/২৬/৫
.পরমেশ্বর
শিবের নিশ্বাস স্বরূপ নিগম তথা বেদশাস্ত্রে
সোম পদ দ্বারা একমাত্র
পরমেশ্বর শিব ও দেবী
উমার একত্র রূপকেই স্তুতি করা হয়েছে। এজন্যই
শুক্ল যজুর্বেদের অন্তর্গত শতরুদ্রিয় বা শ্রীরুদ্রমের ৮ম
অনুবাকে শিবকে সোমপদ দ্বারা স্তুতি করা হয়েছে। যথা-
নমঃ
সোমায চ রুদ্রায চ।১
.এই
মন্ত্রের ভাষ্যে আচার্য্য মহীধর বলেছেন- উমযা সহিতঃ সোমঃ
তস্মৈ।
অর্থঃ
উমা সহিত পরমেশ্বর রুদ্রের
রূপই হলেন সোম।
.বেদভাষ্যকার
উবটাচার্য এই মন্ত্রের ভাষ্যে
বলেছেন - নমঃ সোমায চ
রুদ্রায চ নামতো নমস্কারাঃ।
অর্থঃ
শিবকে সোম, রুদ্র এসব
নাম দ্বারা নমস্কার করা হয়েছে।
.বেদভাষ্যকার
সায়ণাচার্য এই মন্ত্রের ভাষ্যে
বলেছেন - উমযা সহ বর্তত
ইতি সোমঃ।
অর্থঃ
উমা সহিত রুদ্রের রূপই
হলেন সোম।
.বেদভাষ্যকার ভাষ্করাচার্য শতরুদ্রিয় এর ভাষ্যে বলেছেন
–
রুদ্রপশুপত্যাদিশব্দানাং
পুনরভিধানং দেবস্যানুগ্রাহকরূপতামপি প্রখ্যাপযিতুম্।
নমঃ সোমায চ।
উমযা সহিতঃ সোমস্তস্মৈ।
অর্থঃ
রুদ্র, পশুপতি ও অন্যান্য শব্দের
পুনরাবৃত্তির উদ্দেশ্য হলো পরমেশ্বরের অনুগ্রহ
রূপকে প্রকাশ করা।সোমকে প্রণাম, সোম হলো উমার
সহিত রুদ্র রূপ।
.এছাড়াও
শৃঙ্গেরী পূর্ব মঠাধিশ্বর অভিনবশঙ্করাচার্য শ্রীরুদ্রমের ভাষ্যে একই ধরনের কথা
বলেছেন-
(নমঃসোমাযেতিবিশেধিতম্, উমযা
সহিতঃ সোম)
সুতরাং
সোম যে পরমেশ্বর শিবেরই
একটি রূপের নাম তা বেদভাষ্যকারদের
দ্বারা প্রমাণিত।
.এছাড়াও
কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈতরীয় সংহিতার চতুর্থকাণ্ডে ( ৫/৮/১৭) যে
শ্রীরুদ্রম্ পাওয়া যায় সেখানেও রুদ্রকে.
নমঃ
সোমায
চ রুদ্রায চ প্রভৃতি মন্ত্রে
স্তুতি করা হয়েছে।
.অথর্ববেদের
অন্তর্ভুক্ত ভস্মজাবাল উপনিষদের ২য় অধ্যায়ে বলা হয়েছে -
ব্রহ্ম
সোমো'হং পবনঃ সোমো'হং পবতে সোমো'হং জনিতা মতীনাং
সোমো'হং জনিতা পৃথিব্যাঃ
সোমো'হং জনিতা'গ্নেঃ
সোমো'হং জনিতা সূর্যস্য
সোমো'হং জনিতেন্দ্রস্য সোমো'হং জনিতোত বিষ্ণোঃ
সোমো'হমেব জনিতা স
যশ্চন্দ্রমসো দেবানাং ভূর্ভুবঃস্বরাদীনাং সর্বেষাং লোকানাং চ || ৫
বিশ্বং
ভূতং ভুবনং চিত্রং বহুধা জাতং জাযমানং চ
যৎ |
সর্বস্য
সোমো'হমেব জনিতা বিশ্বাধিকো
রুদ্রো মহর্ষিঃ ||৬
অর্থঃ
আমি (শিব) সোম ( উমাসহিত
), ব্রহ্ম, পবন।আমি সেই সোম যা
সূত্ররূপ পবন
যা সকল কিছুকে পবিত্র
করে দেয়। আমি মতি
আদি জন্মদানকারী সোম ( উমাসহিত )। আমিই পৃথিবী,
অগ্নি, সূর্য, ইন্দ্র, বিষ্ণু প্রভৃতির জনক সোম তথা
উমাসহিত পরমেশ্বর।এই চন্দ্রমা ভূঃ র্ভুঃ স্বঃ-আদি সর্বলোক উৎপন্নকারী
সোম ( উমাসহিত পরমেশ্বর )। ৫
বিশ্ব,
ভূত, ভুবন, চিত্র আদি উৎপন্নকারী
আমিই সোম তথা উমাসহিত
পরমেশ্বর। আমি জন্মদাতা রূপে
বিশ্বের কারণ হয়েও কারণাতীত
বিশ্বাধিক রুদ্র,আমিই মহর্ষি।
.ঋগ্বেদের
৬ষ্ঠ মণ্ডলের ৭৪ নং সুক্ত
সমগ্রটাই সোমরুদ্রের প্রতি সমর্পিত।তথায় বলা হয়েছে -
সোমারুদ্রা
যুবমেতান্যস্মৈ বিশ্বা তনূষু ভেষজানি ধত্তম্।
অব স্যতং মুঞ্চতং যন্নো অস্তি তনূষু বদ্ধং কৃতোমেতো অস্মৎ।।৩
অর্থঃ
হে সোমরুদ্র,আপনি আমাদের শরীরের
উপকারকারী সকল ঔষধি ধারণ
করুন।আমাদের দ্বারা কৃত পাপ আমাদের
শরীরে বেঁধে আসে, এটিকে শিথিল
করে দূর করুন।
তিগ্মাযুধৌ
তিগ্মহেতী সুশেবৌ সোমরুদ্রাবিহ সু মূলতং নঃ।
প্র
নো মুঞ্চতং বরুণস্য পাশাদ্ গোপাযতং নঃ সুমনস্যমানা।।৪
অর্থঃ
হে সোমরুদ্র, আপনি দীপ্ত ধনুষের
ন্যায়, তেজ বাণের ন্যায়
এবং শোভন সুখ প্রদান
কারী।শোভন স্তোত্রের ইচ্ছা করতে আপনি এই
সংসারে আমাদের সুখী বানান, বরুণের
পাশ থেকে আমাদের মুক্ত
করুণ এবং আমাদের রক্ষা
করুন।
এজন্যই
পরমেশ্বর শিব বৈদ্যনাথ রূপে
খ্যাত। এবং তাঁকে শ্রুতিতে
পাশবিমোচক বলা হয়েছে।
.এছাড়াও
হংস উপনিষদে ( ১৪ নং মন্ত্র) এবং
একাক্ষর উপনিষদ ( ৫ নং মন্ত্র) অনুসারেও
শিবই সোম।
.সোম
থেকেই যে বিষ্ণুর উৎপত্তি
তা ইতিহাস শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত শিবরহস্য শাস্ত্রে ( ১২ তম অংশ/ ৩ নং অধ্যায় ) বলা হয়েছে -
সূর্যস্য
জনিতা সোম ইন্দ্রস্য জনিতা
শিবঃ।
বিষ্ণোর্বৈ
জনিতা সোমঃ সর্বেষাং জনিতা
হরঃ।।১৩
অর্থঃ
সূর্যের জন্ম সোমরূপ থেকে,ইন্দ্রের জন্ম শিব থেকে।
বিষ্ণুর জন্ম সোমরূপ ( উমাসহিত
শিব) থেকে, এবং সর্বোলোকের জন্ম
হর থেকে।
একই শাস্ত্রের
(১৩ তম অংশ / ৪
নং অধ্যায়) বলা
হয়েছে -
সোমো'যং জনিতা দেবো
বিষ্ণোশ্চাপি ত্রিযম্বকঃ।
এষো'ন্তরা মহাদেব আদিত্যে শ্রুযতে বিভুঃ।।২১
অর্থঃ
সোমদেব থেকে বিষ্ণুর সৃষ্টি,
যিনি ত্র্যম্বক নামেও পরিচিত। সেই বিভু মহাদেব
আদিত্যেরও অভ্যন্তরীণ আত্মাস্বরূপ যা শ্রুতিতে বর্ণিত।
মহাভারতে
( ৭/২০২/১৪১) বলা হয়েছে -
উরুভ্যামর্ধমাগ্নেযং
সোমার্থং চ শিবা তনুঃ।
আত্মতো'র্থে তথা চাগ্নি
সোমো'র্থেং পুনরুচ্যতে।।
অর্থঃ
শিব তনুর নিচের ভাগ
তথা উরুর হলো অগ্নি
এবং শিবতনুর উপরের ভাগ হলো সোম।অনেকের
মতে শিবের সমগ্র দেহের অর্ধেক হলো অগ্নি এবং
অর্ধেক হলো সোম।
.কূর্মপুরাণের ( উপরিভাগ /২৯
নং অধ্যায়) এ
বলা হয়েছে -
নমঃ
সোমায় রুদ্রায মহাগ্রাসায হেতবে।
প্রপদ্যেহং বিরূপাক্ষং শরণ্যং ব্রহ্মচারিণম্। ৪৫
অর্থঃ
হে শিব, তুমি সোম,
রুদ্র,মহাগ্রাসী, তুমি জগতের হেতু,
তুমি বিরুপাক্ষ, জগৎ এর শরণ্য
ও ব্রহ্মচারী, আমি তোমাতেই আশ্রয়
নিলাম।
.পদ্মপুরাণের ( পাতালখণ্ড / ৬৪ নং
অধ্যায় ) এ
বলা হয়েছে -
শিবস্য
শিবরূপ শিবতত্ত্বার্থবেদিনঃ।
সোমস্য
সোমভূষস্য সোমনেত্রস্ব রাজিসু।।১০৮
অর্থঃ
শিব মঙ্গলরূপী শিবতত্ত্বার্থবিৎ,সোম, চন্দ্রভূষিত, চন্দ্র
তার নেত্র।
.এছাড়াও
মহাভারতের অনুশাসন পর্বোক্ত শিবসহস্রনামে শিবকে সোম বলা হয়েছে।
.লিঙ্গপুরাণোক্ত
শিবসহস্রনামে শিবকে সোম বলা হয়েছে।
.বেদসারখ্য
শিবসহস্রনামে শিবকে সোম বলা হয়েছে।
.শিবপুরাণোক্ত
শিবসহস্রনামে শিবকে সোম বলা হয়েছে।
. স্কন্দপুরাণোক্ত
শংকর সংহিতায় শিবনামাষ্টোত্তরশতে শিবকে সোম বলা হয়েছে।
.শাক্ত
শ্রীকূলের আচার্য ভাস্করাচার্য শিবনামকল্পলতাবাল স্তোবে শিবকে সোম বলেছেন।
.অপ্পয়দীক্ষিতের
কনিষ্ঠ ভ্রাতা নীলকণ্ঠ দীক্ষিত শংকর সংহিতার শিবনামাষ্টোতত্তরশতের
শিবতত্ত্বরহস্য নামক ব্যাখ্যায় সোম
পদ বিশ্লেষণ করে বলেছেন -
উমযা
সহিত সোমঃ,উমাসহাযং পরমেশ্বরং
প্রভুম্ ইতি শ্রুতেঃ।.........সোমঃ
পবতে জনিতা মতীনাং জনিতা দিবো জনিতা পৃথিব্যাঃ।জনিতাগ্নের্জনিতা সূর্যস্য
জনিতেন্দ্রস্য জনিতোত বিষ্ণোঃ।"অযং সোম কপর্দিনে
"ইতি শ্রুতিরপ্যুপন্না।....তথা চোক্তং স্কান্দে
সনৎকুমারসংহিতাযাং কাশীগতাদাল্ভ্যেশ্বরলিঙ্গকথাপ্রস্তাবে-মতীনাং চ দিবঃ পৃথ্ব্যা
বহ্নেঃ সূর্যস্য বজ্রিণঃ।সাক্ষাদপি #বিষ্ণুোঞ্চ_সোমো_জনযিতেশ্বরঃ। এবং
জাতঃ পুনঃ সোমঃ পুনাপি
সকলাঘতঃ।সোমো বৈ হ্যাত্মনঃ সোমমাত্মনং
বেত্তি শঙ্করঃ,ইতি।...."রুদ্র আ হুতঃ "ইতি
সোমহুতে.....
.বেদসারখ্য
শিবসহস্রনামের ভাষ্যে শৃঙ্গেরী শঙ্করাচার্য শ্রীমৎপরমশিবেন্দ্র সরস্বতী সোম শব্দ বিশ্লেষণ
করে বলেছেন -
উমা
সংবিদ্রুপা পরা শক্তিঃ।তযা সহ
সর্বদা বর্তত ইতি সোম।
অর্থঃ
উমা পরাশক্তি রূপে বর্ণিত ।
তাহার সহিত সর্বদা শিবের
অবস্থানই সোম বলে কথিত।
.এছাড়াও
শিব মহাপুরাণের বায়বীয় সংহিতায় ( পূর্বখণ্ড / ২৭ নং অধ্যায়) সোম
রূপের সম্পূর্ণ বর্ণনা আছে।
.ব্রহ্মাণ্ড পুরাণেও ( ১/২/২৭/১১১-১১২) শিবকে সোম বলা হয়েছে।
উপরোক্ত
শাস্ত্র সিদ্ধান্ত অনুসারে পরমেশ্বর শিবের সোম রূপ থেকেই
বিষ্ণুদেবের সৃষ্টি হয়েছে।