আমার প্রাণ প্রিয় ভ্রাতা পশ্চিম বঙ্গের শ্রী জয় বিশ্বাসের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার এই লেখা।
শ্রীকৃষ্ণ কি সাধারণ মানব?
শ্রীকৃষ্ণ কি ভক্তের উপাস্য?
শ্রীকৃষ্ণ কি পরমাত্মা?
শ্রীকৃষ্ণ কি পরমেশ্বর??
বেদান্তবাদীদের দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক এরূপ প্রশ্নের উত্তর।
*ওঁ নমঃ ভগবতে বাসুদেবায়*
সনাতন ধর্মের এক কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রীকৃষ্ণ।
সনাতন ধর্মের এমন কোন আচার্য্য, পন্ডিত, মহাপুরুষ, যোগী, সসম্প্রদায়, মতবাদ কিংবা সাধারণ ব্যাক্তিবর্গ নেই যারা শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে মন্তব্য করেন নি। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার কৃষ্ণ চরিত্র গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণ এর এক শুদ্ধ চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
যেহেতু সকল সম্প্রদায় এবং ব্যাক্তিবর্গ শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে মন্তব্য করেছেন সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ যে এক বিশেষ চরিত্র এবং চর্চার বিষয় ইহাতে সন্দেহ নাই। আমি বেদান্তবাদী দৃষ্টিকোণ হতে শ্রীকৃষ্ণ কে বর্ণনা করার প্রয়াস করছি।
আচার্য্য শ্রীমৎ শংকরাচার্য শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে একাধিক স্ত্রোত্র রচনা করেছেন। সেই স্ত্রোত্র এর দ্বারা শুরু করছি।
অচ্চ্যুতং কেশবং রামনারায়ণং
কৃষ্ণদামোদরং বাসুদেবং হরিম্।।
শ্রীধরং মাধবং গোপিকাবল্লভং
জানকীনায়কং রামচন্দ্রং ভজে।।
অচ্চ্যুতং কেশবং সত্যভামাধবং
মাধবং শ্রীধরং রাধিকারাধিতম্।।
ইন্দিরামন্দিরং চেতসা সুন্দরং
দেবকীনন্দনং নন্দজং সন্ধধে।।
বিষ্ণবে জিষ্ণবে শংখিনে চক্রিণে
রুক্মীণিরাগীনে জানকীজানয়ে।।
বল্লবীবল্লভায়ার্চিতায়াত্মনে
কংসবিদ্ধংসিনে বংশিনে তে নমঃ।।
কৃষ্ণগোবিন্দ হে রামনারায়ণ
শ্রীপতে বাসুদেবজিতশ্রীনিধে।।
অচ্চ্যুতানংত হে মাধবাধোক্ষজ
দ্বারকানায়ক দ্রৌপদীরক্ষক।।
(অচ্চ্যুতাষ্টকম -আদি শংকরাচার্য স্ত্রোত্রম্)।
ব্রহ্ম নির্গুণ এবং সগুণ এই কথা শাস্ত্র সিদ্ধ। সেহেতু সগুণ ব্রহ্ম বিশেষ কোন যোগীর মধ্যে প্রকট হয়ে জগৎ কল্যাণ নিমিত্তে অবশ্যই অবতীর্ণ হতে পারেন। তার সৃষ্টি, তার কার্য, তার লীলা তিনি চাইলে যা খুশি করতে পারেন।
ব্রহ্মসূত্র ২-১-৩৩ বলছে –
লোকবত্তু, লীলাকৈবল্যম্।
অর্থাৎ ব্রহ্মের সৃষ্টি কার্যাদি তাঁহার লীলা মাত্র যাঁহা সাধারণ লৌকিক দৃষ্টান্তেও দেখা যায়।
গীতা ৪/৬ বলা হচ্ছে
অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতনামীশ্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।
অর্থাৎ আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই।
ব্রহ্মসূত্র ১-২-২৯
অভিব্যক্তেরিত্যাশ্মরথ্যঃ
অর্থাৎ আশ্মরথ্য মুনি বলেন, পরমাত্মা অসীম হলেও ভক্তের প্রতি কৃপা পরবশ হয়ে বিশেষ বিশেষ রূপে প্রকাশিত হন।
গীতা ৪/৭-৮ বলা হচ্ছে
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
অতঃপর গীতা ৪র্থ অধ্যায়ের ৯ম ও ১০ম শ্লোকে এমনও বলা হচ্ছে,
“হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না। একাগ্রচিত্তে আমার শরণাপন্ন হইয়া, আমার জন্মকর্মের তত্ত্বালোচনা রূপ জ্ঞানময় তপস্যা দ্বারা পবিত্র হইয়া অনেকে আমার পরমানন্দে চিরস্থিতি লাভ করিয়াছেন।”
★শ্রুতি এই মায়াবী শক্তিসমূহের সাহায্যে জগৎ শাসন করা এবং একই রূপ ভাবে সেই তত্ত্ব জানায় অমৃতলাভ এর কথা স্বীকার করেন৷ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩-১ দ্রষ্টব্য।
বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ১-৪-(৫-৬) নং শ্লোক
সোহবেদহং বাব সৃষ্টিরস্ম্যহং হীদং সর্বমসৃক্ষীতি ততঃ সৃষ্টির ভবৎ সৃষ্ট্যাং হাস্যৈতস্যাং ভবতি য এবং বেদ।।
অর্থঃ তিনি অবগত হইলেন, “আমিই সৃষ্টিরূপে বিদ্যমান; কারণ আমিই এই সমস্ত সৃজন করিয়াছি”। সেই জন্যই তাঁহার নাম হইল সৃষ্টি। যিনি এই সৃষ্টিকে জানেন তিনিও সৃষ্টা।
আর শ্রীকৃষ্ণ অবশ্যই সমগ্র সৃষ্টিকে জানতেন। এবং তিনি জানতেন বলেই সৃষ্টি বিষয়ক সমস্ত জ্ঞান ব্যাক্ত করেছেন।
কিন্তু শ্রুতিতে ঈশ্বর জন্ম রহিত বলে উল্লেখিত হয়েছে কিন্তু গীতায় আবার জন্মপ্রাপ্ত হওয়া বিরুদ্ধ আচরণ নয় কি?
আচার্য্য শংকর তার গীতা ভাষ্য ৪-৬-১ এ বলেছেন,
“শংকরভাষ্যঃ ‘অজঃ অপি’ জন্মরহিতঃ অপি ‘সন্’ তথা ‘অব্যয়াত্মা’ অক্ষীণজ্ঞানশক্তিস্বভাবঃ অপি সন্ তথা ‘ভূতানাং’ ব্ৰহ্মাদিস্তম্বপর্যন্তানাম্ ‘ঈশ্বরঃ’ ঈশনশীলঃ ‘অপি সন্, প্রকৃতিং স্বাং’ মম বৈষ্ণবীং মায়াং ত্রিগুণাত্মিকাং যস্যা বশে সর্বং জগৎ বর্ততে যয়া মোহিতং সৎ স্বম্ আত্মানং বাসুদেবং ন জানাতি, তাং প্ৰকৃতিং স্বাম্ ‘অধিষ্ঠায়’ বশীকৃত্য ‘সস্তবামি’ দেহবান্ ইব ভৰামি জাত ইব ‘আত্মমায়য়া’ আত্মানো মায়য়া ন পরমার্থতো লোকবৎ।। (৬/১)
ভাষ্যানুবাদঃ আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হয়েও, অব্যয়াত্মা অক্ষীণজ্ঞানশক্তি-স্বভাব হয়েও এবং ব্রহ্মা থেকে তৃণ পর্যন্ত ভূত সকলের ঈশ্বর অর্থাৎ নিয়ামক হয়েও স্বীয়া প্রকৃতি অর্থাৎ আমার ত্ৰিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, যাঁর বশে সমস্ত জগৎ বর্তমান, যার দ্বারা মোহিত হয়ে লোকে নিজের আত্মা বাসুদেবকে জানতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে অর্থাৎ তাঁকে বশীভূত করে সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহ ধারণ
করে জন্ম গ্রহণ করি, কিন্তু পরমার্থতঃ নয় ।
ভাষ্যবিবৃতিঃ “মম বৈষ্ণবীং মায়া” এখানে স্বীয় শক্তির অভেদ সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণ নিজের অবতরণের কথা বলছেন, কারণ সদসদাত্মিকা
অনির্বচনীয়া মহামায়াই ব্ৰহ্মাশ্রয়ে সব করেন ও হন, পরন্ত ব্ৰহ্ম ত্ৰিকালে অচ্যুত ভাবেই অবস্থান করেন। আবার শ্রীরামকৃষ্ণদেব ঐ অভেদ সম্বন্ধেই বলেছেন, “বেদে যাকে ব্ৰহ্ম বলেছে, আমি তাঁকেই ‘মা’ বলে উপাসনা করি।”
এখন অনেকেই আছেন যারা অবতারবাদ স্বীকার করেন না। সেহেতু তাদের ক্ষেত্রেও শ্রীকৃষ্ণ বেদান্তমতে পূজনীয় হতে পারেন এমন কিছু প্রমাণ দিচ্ছি।
মহর্ষি ব্যাস তার ব্রহ্মসূত্রের ১-১-৩০ নং সূত্রে বলেছেন-
শাস্ত্রদৃষ্ট্যা তূপদেশো বামদেববৎ
অর্থাৎ ইন্দ্রের উপদেশ এখানে বামদেব ঋষি বলেছিলেন। এইরূপ বলা শাস্ত্রসম্মত হয়েছে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের দ্বারা।
ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পর বলেছিলেন, “আমিই ছিলাম মনু, এবং আমিই ছিলাম আদিত্য”- ইত্যাদি। এই উক্তিতে শ্রুতির দ্বারা সমর্থন করা হচ্ছে। কারণ শ্রুতিতে বলা আছে,
“দেবগণের মধ্যে যিনিই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন তিনিই ব্রহ্ম হয়ে গেলেন। ”
বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ১-৪-১০
অহং ব্রহ্মাস্মীতি। তস্মাৎ তৎ সর্বমভবৎ তদ্ যো যো দেবানাং প্রত্যবুধ্যত স এব তদভবৎ তথর্ষীণাং তথা মনুষ্যাণাং তদ্ধৈতৎ পশ্যন্নৃষির্বামদেবঃ প্রতিপেদেহহং মনুরভবং সূর্যশ্চেতি।
মুণ্ডক উপনিষদ ৩-২-৯
স যো হ বৈ তৎ পরমং ব্রহ্ম বেদ
ব্রহ্মৈব ভবতি
অর্থাৎ যে কেহ সেই পরব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে থাকেন।
যেহেতু শ্রুতি ব্রহ্মজ্ঞানবিৎকে ব্রহ্মই আখ্যায়িত করেছেন। আর শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মজ্ঞানী ছিলেন না এমন কথা কেউ বলেন নাই। কারণ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যাতীত কেউই গীতার ন্যায় ব্রহ্মশাস্ত্র মুখনিঃসৃত করতে পারবে না।
★অনেকেই মনে করেন গীতা জ্ঞান শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে বলেছেন। গীতার শেষ অধ্যায়েও সঞ্জয় শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর সম্বোধন করেছেন। এখন
যোগ+ ঈশ্বর = যোগেশ্বর
যদি বলে হয় যোগী ঈশ্বরে যুক্ত কিংবা যোগ যুক্ত ঈশ্বর অথবা ঈশ্বর যোগীর সাথে যোগে যুক্ত উভয় ভাবেই যোগেশ্বর কথাটি সিদ্ধ। কোন সাধারণ মানব চাইলেই এরূপ যুক্ত হতে পারেন না। কেবল ব্রহ্মজ্ঞ বা সিদ্ধ যোগীর দ্বারা এরূপ যুক্ত হওয়া সম্ভব। সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ যে ব্রহ্মজ্ঞ ছিলেন এতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আর এরূপ ব্রহ্মজ্ঞকে শ্রুতি ব্রহ্ম বলে আখ্যায়িত করেছে। সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ অবশ্যই সকলের পূজনীয় এবং আরাধ্যও বটে।
অর্জুনও শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। তাই কেউ যদি যোগেশ্বর হিসেবেও শ্রীকৃষ্ণকে মান্য করে তাতেও দোষ নাই।
গীতা ১১/৪
মন্যসে যদি তচ্ছক্যং ময়া দ্রষ্টুমিতি প্রভো।
যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মানমব্যয়ম্।।
অর্থাৎ হে প্রভো, যদি তুমি মনে কর যে আমি সেই রূপ দর্শনের যোগ্য, তাহলে হে যোগেশ্বর, আমাকে তোমার সেই অক্ষয় আত্মরূপ প্রদর্শন করাও।
উল্লেখ্য যে কোন সিদ্ধ যোগী তার আত্মরূপ এর দ্বারা এরূপ বিশ্বরূপ দেখাতেও সক্ষম। কারণ ব্রহ্মনির্বাণপ্রাপ্ত যোগী স্বয়ং ব্রহ্মই হয়ে যান।
এবার আসি পরমাত্মা প্রসংগে। শ্রীকৃষ্ণকে পরমাত্মা সম্বোধন করা যাবে কিনা?
উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ।। (গীতা ১৩/২২)
অর্থাৎ এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলেও উক্ত হন।
ব্ররহদারণ্যক ৪-৪-৫ বলছে-
অয়মাত্মা ব্রহ্ম (আত্মাই ব্রহ্ম)
এছাড়াও মহর্ষি ব্যাস তার ব্রহ্মসূত্রে বলেছেন জীব আত্মাকে যথার্থরূপে জানলে তিনি পরমাত্মাই হন।
আত্মা, প্রকরণাৎ (ব্রহ্ম সূত্র ৪-৪-৩)
তিনি পরমাত্মা, কারণ ইহা প্রকরণ এর আলোচ্য বিষয় হতে বুঝা যায়।
অবিভাগেন, দৃষ্টত্বাৎ (ব্রহ্ম সূত্র ৪-৪-৪)
মুক্ত অবস্থায় জীব ব্রহ্মের সহিত অভিন্নভাবে বর্তমান থাকে। অর্থাৎ মুক্ত জীব ও পরমাত্মা একই। কারণ শাস্ত্রে আছে তত্ত্বমসি। ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মই হয়ে যান৷ অর্থাৎ যিনি পরমাত্মাকে জানেন তিনিই পরমাত্মা। এই অবস্থায় পরমাত্মার ন্যায় মুক্ত পুরুষ সর্বভুতে সমদর্শী হন। এবং সমস্ত ব্রহ্মান্ড নিজের হতে অভেদ দর্শন করেন।
পরম পুরুষ শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী মুক্তি লাভ এর পর বলেছিন-
আমার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আমি নিত্য, শুদ্ধ, মুক্ত। আমিই গীতায় বর্ণিত পরমাত্মা।
সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ আত্মতত্ত্ব অবগত ছিলেন এবং তিনিই পরমাত্মা ইহাতে সন্দেহ নাই। কারণ এরূপ পুরুষ ও পরমাত্মাতে কোন ভেদ দর্শিত হয় না।
আত্মানং চেদ্ বিজানীয়াদয়মস্মীতি পূরুষঃ
কেহ পরমাত্মাকে ‘আমিই ইনি (পরমাত্মা)’ এই রূপে জানেন। (বৃঃউপঃ ৪-৪-১২)
যিনি এইভাবে নিজেকে পরমাত্মা জানেন তিনি বিশ্বের কর্তা; কারণ তিনিই সকলের কর্তা, সকলেই তাঁহার আত্মা এবং তিনিই সকলের আত্মা। (বৃঃউপঃ ৪-৪-১৩)
গীতা ১১/৪১-৪৪ অর্জুন বলছেন-
তোমার এই বিশ্বরূপ এবং ঐশ্বর্যমহিমা না জেনে তোমাকে সখা ভেবে অজ্ঞানবশতঃ বা প্রণয়বশতঃ “হে কৃষ্ণ, হে যাদব, হে সখা”, এইরূপ তোমায় বলেছি; হে অচ্যুত, আহার, বিহার, শয়ন ও উপবেশনকালে একা অথবা বন্ধুজনসমক্ষে পরিহাসচ্ছলে তোমার কত অমর্যাদা করেছি; অচিন্ত্যপ্রভাব তুমি, তোমার নিকট তজ্জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
হে অমিতপ্রভাব, তুমি এই চরাচর সমস্ত লোকের পিতা, তুমি পূজ্য, গুরু ও গুরু হতে গুরুতর; ত্রিজগতে তোমার তুল্য কেহ নাই, তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ থাকবে কি প্রকারে?
হে দেব, পূর্বোক্তরূপে আমি অপরাধী, সেই হেতু দণ্ডবৎ প্রণাম পূর্বক তোমার প্রসাদ প্রার্থনা করছি। সকলের বন্দনীয় ঈশ্বর তুমি; পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, তুমিও তদ্রুপ আমার অপরাধ ক্ষমা কর।
★এক এক করে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বেদান্ত সিদ্ধান্ত সিদ্ধ হওয়ায় আমি শ্রীকৃষ্ণকে উপাস্য রূপে মান্য করছি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভক্ত অবশ্যই ভজনা করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণ তথা পরমাত্মার প্রতি শরণাগতিই জীবের পরমগতি। সমস্ত কিছু শ্রীকৃষ্ণে বা গোবিন্দে সমর্পণ করে কর্ম করাই প্রকৃত ভক্তের চিত্ত শুদ্ধির অন্যতম উপায়। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এর প্রকৃতি পরিচয় দেহধারী কৃষ্ণ নয়। কারণ যিনি মুক্ত ও পারমার্থিক সত্য তিনি কোন দেহের অধীন নন। পরমাত্মাকে দেহধারী মনে করে সেই দেহরূপ কৃষ্ণকে একমাত্র ঈশ্বর বা কারণ মনে করা বেদান্ত সম্মত নয়।
কারণ শ্রীকৃষ্ণ নিজেই গীতায় বলেছেন –
অব্যক্তং ব্যাক্তিমাপন্নং মন্যস্তে মামবুদ্ধয়ঃ।
পরং ভাবমজানস্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্।। (গীতা ৭/২৪)
অর্থাৎ অল্পবুদ্ধি ব্যাক্তিগণ আমার নিত্য, অব্যাক্ত, সর্বোৎকৃষ্ট পরম স্বরূপ না জানায় অব্যাক্ত আমাকে প্রাকৃত মনুষ্যবৎ ব্যাক্তিভাবাপন্ন মনে করে।
বেদান্ত ইহাই স্বীকার করে যে ব্রহ্ম এর নির্গুণ ও অব্যাক্ত অবস্থা নিত্য। কোন মনুষ্য দেহধারীকে বেদান্ত মায়া দ্বারা আখ্যায়িত করেন। সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ এর মনুষ্য দেহের নয় বরং সেই নির্গুণ পরমাত্মাকে চৈতন্য রূপে আরাধনা করাই বুদ্ধিমান এর কাজ। যারা কৃষ্ণকে দেহধারী মনে করে সেই মায়াময় দেহেরূপ এর ভজনা করে তারা মুর্খ এবং পরমেশ্বর এর পরম ভাব তাদের জ্ঞাত হয় না।
ওঁ গোবিন্দায় নমঃ
ভজ গোবিন্দং ভজ গোবিন্দং, গোবিন্দং ভজ মূঢ়্মতে।
সম্প্রাপ্তে সন্নিহিতকালে মরণে, নাহি নাহি রক্ষতি ডুকৃঞকরণে
শ্রীকৃষ্ণ কি সাধারণ মানব?
শ্রীকৃষ্ণ কি ভক্তের উপাস্য?
শ্রীকৃষ্ণ কি পরমাত্মা?
শ্রীকৃষ্ণ কি পরমেশ্বর??
বেদান্তবাদীদের দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক এরূপ প্রশ্নের উত্তর।
*ওঁ নমঃ ভগবতে বাসুদেবায়*
সনাতন ধর্মের এক কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রীকৃষ্ণ।
সনাতন ধর্মের এমন কোন আচার্য্য, পন্ডিত, মহাপুরুষ, যোগী, সসম্প্রদায়, মতবাদ কিংবা সাধারণ ব্যাক্তিবর্গ নেই যারা শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে মন্তব্য করেন নি। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার কৃষ্ণ চরিত্র গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণ এর এক শুদ্ধ চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
যেহেতু সকল সম্প্রদায় এবং ব্যাক্তিবর্গ শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে মন্তব্য করেছেন সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ যে এক বিশেষ চরিত্র এবং চর্চার বিষয় ইহাতে সন্দেহ নাই। আমি বেদান্তবাদী দৃষ্টিকোণ হতে শ্রীকৃষ্ণ কে বর্ণনা করার প্রয়াস করছি।
আচার্য্য শ্রীমৎ শংকরাচার্য শ্রীকৃষ্ণ নিয়ে একাধিক স্ত্রোত্র রচনা করেছেন। সেই স্ত্রোত্র এর দ্বারা শুরু করছি।
অচ্চ্যুতং কেশবং রামনারায়ণং
কৃষ্ণদামোদরং বাসুদেবং হরিম্।।
শ্রীধরং মাধবং গোপিকাবল্লভং
জানকীনায়কং রামচন্দ্রং ভজে।।
অচ্চ্যুতং কেশবং সত্যভামাধবং
মাধবং শ্রীধরং রাধিকারাধিতম্।।
ইন্দিরামন্দিরং চেতসা সুন্দরং
দেবকীনন্দনং নন্দজং সন্ধধে।।
বিষ্ণবে জিষ্ণবে শংখিনে চক্রিণে
রুক্মীণিরাগীনে জানকীজানয়ে।।
বল্লবীবল্লভায়ার্চিতায়াত্মনে
কংসবিদ্ধংসিনে বংশিনে তে নমঃ।।
কৃষ্ণগোবিন্দ হে রামনারায়ণ
শ্রীপতে বাসুদেবজিতশ্রীনিধে।।
অচ্চ্যুতানংত হে মাধবাধোক্ষজ
দ্বারকানায়ক দ্রৌপদীরক্ষক।।
(অচ্চ্যুতাষ্টকম -আদি শংকরাচার্য স্ত্রোত্রম্)।
ব্রহ্ম নির্গুণ এবং সগুণ এই কথা শাস্ত্র সিদ্ধ। সেহেতু সগুণ ব্রহ্ম বিশেষ কোন যোগীর মধ্যে প্রকট হয়ে জগৎ কল্যাণ নিমিত্তে অবশ্যই অবতীর্ণ হতে পারেন। তার সৃষ্টি, তার কার্য, তার লীলা তিনি চাইলে যা খুশি করতে পারেন।
ব্রহ্মসূত্র ২-১-৩৩ বলছে –
লোকবত্তু, লীলাকৈবল্যম্।
অর্থাৎ ব্রহ্মের সৃষ্টি কার্যাদি তাঁহার লীলা মাত্র যাঁহা সাধারণ লৌকিক দৃষ্টান্তেও দেখা যায়।
গীতা ৪/৬ বলা হচ্ছে
অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতনামীশ্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।।
অর্থাৎ আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করিয়া আত্মমায়ায় আবির্ভূত হই।
ব্রহ্মসূত্র ১-২-২৯
অভিব্যক্তেরিত্যাশ্মরথ্যঃ
অর্থাৎ আশ্মরথ্য মুনি বলেন, পরমাত্মা অসীম হলেও ভক্তের প্রতি কৃপা পরবশ হয়ে বিশেষ বিশেষ রূপে প্রকাশিত হন।
গীতা ৪/৭-৮ বলা হচ্ছে
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
অতঃপর গীতা ৪র্থ অধ্যায়ের ৯ম ও ১০ম শ্লোকে এমনও বলা হচ্ছে,
“হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করিয়া পুনর্বার আর জন্মপ্রাপ্ত হন না। একাগ্রচিত্তে আমার শরণাপন্ন হইয়া, আমার জন্মকর্মের তত্ত্বালোচনা রূপ জ্ঞানময় তপস্যা দ্বারা পবিত্র হইয়া অনেকে আমার পরমানন্দে চিরস্থিতি লাভ করিয়াছেন।”
★শ্রুতি এই মায়াবী শক্তিসমূহের সাহায্যে জগৎ শাসন করা এবং একই রূপ ভাবে সেই তত্ত্ব জানায় অমৃতলাভ এর কথা স্বীকার করেন৷ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩-১ দ্রষ্টব্য।
বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ১-৪-(৫-৬) নং শ্লোক
সোহবেদহং বাব সৃষ্টিরস্ম্যহং হীদং সর্বমসৃক্ষীতি ততঃ সৃষ্টির ভবৎ সৃষ্ট্যাং হাস্যৈতস্যাং ভবতি য এবং বেদ।।
অর্থঃ তিনি অবগত হইলেন, “আমিই সৃষ্টিরূপে বিদ্যমান; কারণ আমিই এই সমস্ত সৃজন করিয়াছি”। সেই জন্যই তাঁহার নাম হইল সৃষ্টি। যিনি এই সৃষ্টিকে জানেন তিনিও সৃষ্টা।
আর শ্রীকৃষ্ণ অবশ্যই সমগ্র সৃষ্টিকে জানতেন। এবং তিনি জানতেন বলেই সৃষ্টি বিষয়ক সমস্ত জ্ঞান ব্যাক্ত করেছেন।
কিন্তু শ্রুতিতে ঈশ্বর জন্ম রহিত বলে উল্লেখিত হয়েছে কিন্তু গীতায় আবার জন্মপ্রাপ্ত হওয়া বিরুদ্ধ আচরণ নয় কি?
আচার্য্য শংকর তার গীতা ভাষ্য ৪-৬-১ এ বলেছেন,
“শংকরভাষ্যঃ ‘অজঃ অপি’ জন্মরহিতঃ অপি ‘সন্’ তথা ‘অব্যয়াত্মা’ অক্ষীণজ্ঞানশক্তিস্বভাবঃ অপি সন্ তথা ‘ভূতানাং’ ব্ৰহ্মাদিস্তম্বপর্যন্তানাম্ ‘ঈশ্বরঃ’ ঈশনশীলঃ ‘অপি সন্, প্রকৃতিং স্বাং’ মম বৈষ্ণবীং মায়াং ত্রিগুণাত্মিকাং যস্যা বশে সর্বং জগৎ বর্ততে যয়া মোহিতং সৎ স্বম্ আত্মানং বাসুদেবং ন জানাতি, তাং প্ৰকৃতিং স্বাম্ ‘অধিষ্ঠায়’ বশীকৃত্য ‘সস্তবামি’ দেহবান্ ইব ভৰামি জাত ইব ‘আত্মমায়য়া’ আত্মানো মায়য়া ন পরমার্থতো লোকবৎ।। (৬/১)
ভাষ্যানুবাদঃ আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হয়েও, অব্যয়াত্মা অক্ষীণজ্ঞানশক্তি-স্বভাব হয়েও এবং ব্রহ্মা থেকে তৃণ পর্যন্ত ভূত সকলের ঈশ্বর অর্থাৎ নিয়ামক হয়েও স্বীয়া প্রকৃতি অর্থাৎ আমার ত্ৰিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, যাঁর বশে সমস্ত জগৎ বর্তমান, যার দ্বারা মোহিত হয়ে লোকে নিজের আত্মা বাসুদেবকে জানতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে অর্থাৎ তাঁকে বশীভূত করে সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহ ধারণ
করে জন্ম গ্রহণ করি, কিন্তু পরমার্থতঃ নয় ।
ভাষ্যবিবৃতিঃ “মম বৈষ্ণবীং মায়া” এখানে স্বীয় শক্তির অভেদ সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণ নিজের অবতরণের কথা বলছেন, কারণ সদসদাত্মিকা
অনির্বচনীয়া মহামায়াই ব্ৰহ্মাশ্রয়ে সব করেন ও হন, পরন্ত ব্ৰহ্ম ত্ৰিকালে অচ্যুত ভাবেই অবস্থান করেন। আবার শ্রীরামকৃষ্ণদেব ঐ অভেদ সম্বন্ধেই বলেছেন, “বেদে যাকে ব্ৰহ্ম বলেছে, আমি তাঁকেই ‘মা’ বলে উপাসনা করি।”
এখন অনেকেই আছেন যারা অবতারবাদ স্বীকার করেন না। সেহেতু তাদের ক্ষেত্রেও শ্রীকৃষ্ণ বেদান্তমতে পূজনীয় হতে পারেন এমন কিছু প্রমাণ দিচ্ছি।
মহর্ষি ব্যাস তার ব্রহ্মসূত্রের ১-১-৩০ নং সূত্রে বলেছেন-
শাস্ত্রদৃষ্ট্যা তূপদেশো বামদেববৎ
অর্থাৎ ইন্দ্রের উপদেশ এখানে বামদেব ঋষি বলেছিলেন। এইরূপ বলা শাস্ত্রসম্মত হয়েছে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের দ্বারা।
ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পর বলেছিলেন, “আমিই ছিলাম মনু, এবং আমিই ছিলাম আদিত্য”- ইত্যাদি। এই উক্তিতে শ্রুতির দ্বারা সমর্থন করা হচ্ছে। কারণ শ্রুতিতে বলা আছে,
“দেবগণের মধ্যে যিনিই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন তিনিই ব্রহ্ম হয়ে গেলেন। ”
বৃহদারণ্যক উপনিষদঃ ১-৪-১০
অহং ব্রহ্মাস্মীতি। তস্মাৎ তৎ সর্বমভবৎ তদ্ যো যো দেবানাং প্রত্যবুধ্যত স এব তদভবৎ তথর্ষীণাং তথা মনুষ্যাণাং তদ্ধৈতৎ পশ্যন্নৃষির্বামদেবঃ প্রতিপেদেহহং মনুরভবং সূর্যশ্চেতি।
মুণ্ডক উপনিষদ ৩-২-৯
স যো হ বৈ তৎ পরমং ব্রহ্ম বেদ
ব্রহ্মৈব ভবতি
অর্থাৎ যে কেহ সেই পরব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে থাকেন।
যেহেতু শ্রুতি ব্রহ্মজ্ঞানবিৎকে ব্রহ্মই আখ্যায়িত করেছেন। আর শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মজ্ঞানী ছিলেন না এমন কথা কেউ বলেন নাই। কারণ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যাতীত কেউই গীতার ন্যায় ব্রহ্মশাস্ত্র মুখনিঃসৃত করতে পারবে না।
★অনেকেই মনে করেন গীতা জ্ঞান শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে বলেছেন। গীতার শেষ অধ্যায়েও সঞ্জয় শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর সম্বোধন করেছেন। এখন
যোগ+ ঈশ্বর = যোগেশ্বর
যদি বলে হয় যোগী ঈশ্বরে যুক্ত কিংবা যোগ যুক্ত ঈশ্বর অথবা ঈশ্বর যোগীর সাথে যোগে যুক্ত উভয় ভাবেই যোগেশ্বর কথাটি সিদ্ধ। কোন সাধারণ মানব চাইলেই এরূপ যুক্ত হতে পারেন না। কেবল ব্রহ্মজ্ঞ বা সিদ্ধ যোগীর দ্বারা এরূপ যুক্ত হওয়া সম্ভব। সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ যে ব্রহ্মজ্ঞ ছিলেন এতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আর এরূপ ব্রহ্মজ্ঞকে শ্রুতি ব্রহ্ম বলে আখ্যায়িত করেছে। সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ অবশ্যই সকলের পূজনীয় এবং আরাধ্যও বটে।
অর্জুনও শ্রীকৃষ্ণকে যোগেশ্বর হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। তাই কেউ যদি যোগেশ্বর হিসেবেও শ্রীকৃষ্ণকে মান্য করে তাতেও দোষ নাই।
গীতা ১১/৪
মন্যসে যদি তচ্ছক্যং ময়া দ্রষ্টুমিতি প্রভো।
যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মানমব্যয়ম্।।
অর্থাৎ হে প্রভো, যদি তুমি মনে কর যে আমি সেই রূপ দর্শনের যোগ্য, তাহলে হে যোগেশ্বর, আমাকে তোমার সেই অক্ষয় আত্মরূপ প্রদর্শন করাও।
উল্লেখ্য যে কোন সিদ্ধ যোগী তার আত্মরূপ এর দ্বারা এরূপ বিশ্বরূপ দেখাতেও সক্ষম। কারণ ব্রহ্মনির্বাণপ্রাপ্ত যোগী স্বয়ং ব্রহ্মই হয়ে যান।
এবার আসি পরমাত্মা প্রসংগে। শ্রীকৃষ্ণকে পরমাত্মা সম্বোধন করা যাবে কিনা?
উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমাত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেহস্মিন্ পুরুষঃ পরঃ।। (গীতা ১৩/২২)
অর্থাৎ এই দেহে যে পরম পুরুষ আছেন, তিনি উপদ্রষ্টা, অনুমন্তা, ভর্তা, ভোক্তা, মহেশ্বর ও পরমাত্মা বলেও উক্ত হন।
ব্ররহদারণ্যক ৪-৪-৫ বলছে-
অয়মাত্মা ব্রহ্ম (আত্মাই ব্রহ্ম)
এছাড়াও মহর্ষি ব্যাস তার ব্রহ্মসূত্রে বলেছেন জীব আত্মাকে যথার্থরূপে জানলে তিনি পরমাত্মাই হন।
আত্মা, প্রকরণাৎ (ব্রহ্ম সূত্র ৪-৪-৩)
তিনি পরমাত্মা, কারণ ইহা প্রকরণ এর আলোচ্য বিষয় হতে বুঝা যায়।
অবিভাগেন, দৃষ্টত্বাৎ (ব্রহ্ম সূত্র ৪-৪-৪)
মুক্ত অবস্থায় জীব ব্রহ্মের সহিত অভিন্নভাবে বর্তমান থাকে। অর্থাৎ মুক্ত জীব ও পরমাত্মা একই। কারণ শাস্ত্রে আছে তত্ত্বমসি। ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মই হয়ে যান৷ অর্থাৎ যিনি পরমাত্মাকে জানেন তিনিই পরমাত্মা। এই অবস্থায় পরমাত্মার ন্যায় মুক্ত পুরুষ সর্বভুতে সমদর্শী হন। এবং সমস্ত ব্রহ্মান্ড নিজের হতে অভেদ দর্শন করেন।
পরম পুরুষ শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী মুক্তি লাভ এর পর বলেছিন-
আমার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আমি নিত্য, শুদ্ধ, মুক্ত। আমিই গীতায় বর্ণিত পরমাত্মা।
সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ আত্মতত্ত্ব অবগত ছিলেন এবং তিনিই পরমাত্মা ইহাতে সন্দেহ নাই। কারণ এরূপ পুরুষ ও পরমাত্মাতে কোন ভেদ দর্শিত হয় না।
আত্মানং চেদ্ বিজানীয়াদয়মস্মীতি পূরুষঃ
কেহ পরমাত্মাকে ‘আমিই ইনি (পরমাত্মা)’ এই রূপে জানেন। (বৃঃউপঃ ৪-৪-১২)
যিনি এইভাবে নিজেকে পরমাত্মা জানেন তিনি বিশ্বের কর্তা; কারণ তিনিই সকলের কর্তা, সকলেই তাঁহার আত্মা এবং তিনিই সকলের আত্মা। (বৃঃউপঃ ৪-৪-১৩)
গীতা ১১/৪১-৪৪ অর্জুন বলছেন-
তোমার এই বিশ্বরূপ এবং ঐশ্বর্যমহিমা না জেনে তোমাকে সখা ভেবে অজ্ঞানবশতঃ বা প্রণয়বশতঃ “হে কৃষ্ণ, হে যাদব, হে সখা”, এইরূপ তোমায় বলেছি; হে অচ্যুত, আহার, বিহার, শয়ন ও উপবেশনকালে একা অথবা বন্ধুজনসমক্ষে পরিহাসচ্ছলে তোমার কত অমর্যাদা করেছি; অচিন্ত্যপ্রভাব তুমি, তোমার নিকট তজ্জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
হে অমিতপ্রভাব, তুমি এই চরাচর সমস্ত লোকের পিতা, তুমি পূজ্য, গুরু ও গুরু হতে গুরুতর; ত্রিজগতে তোমার তুল্য কেহ নাই, তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ থাকবে কি প্রকারে?
হে দেব, পূর্বোক্তরূপে আমি অপরাধী, সেই হেতু দণ্ডবৎ প্রণাম পূর্বক তোমার প্রসাদ প্রার্থনা করছি। সকলের বন্দনীয় ঈশ্বর তুমি; পিতা যেমন পুত্রের, সখা যেমন সখার, প্রিয় যেমন প্রিয়ার অপরাধ ক্ষমা করেন, তুমিও তদ্রুপ আমার অপরাধ ক্ষমা কর।
★এক এক করে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বেদান্ত সিদ্ধান্ত সিদ্ধ হওয়ায় আমি শ্রীকৃষ্ণকে উপাস্য রূপে মান্য করছি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভক্ত অবশ্যই ভজনা করতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণ তথা পরমাত্মার প্রতি শরণাগতিই জীবের পরমগতি। সমস্ত কিছু শ্রীকৃষ্ণে বা গোবিন্দে সমর্পণ করে কর্ম করাই প্রকৃত ভক্তের চিত্ত শুদ্ধির অন্যতম উপায়। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এর প্রকৃতি পরিচয় দেহধারী কৃষ্ণ নয়। কারণ যিনি মুক্ত ও পারমার্থিক সত্য তিনি কোন দেহের অধীন নন। পরমাত্মাকে দেহধারী মনে করে সেই দেহরূপ কৃষ্ণকে একমাত্র ঈশ্বর বা কারণ মনে করা বেদান্ত সম্মত নয়।
কারণ শ্রীকৃষ্ণ নিজেই গীতায় বলেছেন –
অব্যক্তং ব্যাক্তিমাপন্নং মন্যস্তে মামবুদ্ধয়ঃ।
পরং ভাবমজানস্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্।। (গীতা ৭/২৪)
অর্থাৎ অল্পবুদ্ধি ব্যাক্তিগণ আমার নিত্য, অব্যাক্ত, সর্বোৎকৃষ্ট পরম স্বরূপ না জানায় অব্যাক্ত আমাকে প্রাকৃত মনুষ্যবৎ ব্যাক্তিভাবাপন্ন মনে করে।
বেদান্ত ইহাই স্বীকার করে যে ব্রহ্ম এর নির্গুণ ও অব্যাক্ত অবস্থা নিত্য। কোন মনুষ্য দেহধারীকে বেদান্ত মায়া দ্বারা আখ্যায়িত করেন। সেহেতু শ্রীকৃষ্ণ এর মনুষ্য দেহের নয় বরং সেই নির্গুণ পরমাত্মাকে চৈতন্য রূপে আরাধনা করাই বুদ্ধিমান এর কাজ। যারা কৃষ্ণকে দেহধারী মনে করে সেই মায়াময় দেহেরূপ এর ভজনা করে তারা মুর্খ এবং পরমেশ্বর এর পরম ভাব তাদের জ্ঞাত হয় না।
ওঁ গোবিন্দায় নমঃ
ভজ গোবিন্দং ভজ গোবিন্দং, গোবিন্দং ভজ মূঢ়্মতে।
সম্প্রাপ্তে সন্নিহিতকালে মরণে, নাহি নাহি রক্ষতি ডুকৃঞকরণে