Thursday, December 31, 2020

৩০০টি ভিন্ন ভিন্ন রামায়ণ

 মনুষ্য সমাজে সর্ব পরিচিত হিসাবে "শ্রীমদ্বাল্মীকীয়রামায়ণম্" থাকলেও ছোট বড় প্রায় তিনশতের মতো রামায়ণ পাওয়া যায় সমগ্র পৃথিবীতে।

দস্যু রত্নাকরের বাল্মিকী হওয়ার ঘটনা তো সবাই জানেন। হিরণ্যগর্ভ বিষ্ণু যেই ১০০ শ্লোকের "মূল রামায়ণ"(১) ব্রহ্মাকে বলেছিলেন তাই ব্রহ্মা থেকে অবগত হয়ে নারদ বাল্মিকীকে বলে তাকে অনুপ্রাণিত করে পূর্ণ রামায়ণ রচনার জন্য। সেই থেকেই মহর্ষি বাল্মিকী হয়ে উঠলেন আদি কবি বাল্মিকী, আদি কাব্য রামায়ণের রচয়িতা। এটিই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীণ মহাকাব্য "শ্রীমদ্বাল্মীকীয়রামায়ণম্"।(২)

আমাদের আশেপাশের মানুষগুলিকে জিজ্ঞাসা করলে, "রামায়ণ কতটা আছে?" সাধারণ উত্তর হবে, "২ টা, বাল্মিকী রামায়ণ আর কৃত্তিবাসী রামায়ণ"। কেউ এটাই বলতে পারবে না রামায়ণ মূল হিসাবেও আরও ২টা আছে। এর মধ্যে একটা দিব্যলোকে যার নাম "মূল রামায়ণ(৩)" (১০০ কোটি শ্লোকের) আর অন্যটা তো বললামই বিষ্ণু বর্ণিত "মূল রামায়ণ" (১০০ শ্লোকের)।

তা ছাড়া একই ঘটনার বিভিন্ন দিকতো থাকেই। কাহিনীর এক এক চরিত্রের দৃষ্টি থেকে দেখা ঘটনাও আলাদা হয়, কথার উপকথা থাকে, গল্পের পার্শ্ব কাহিনি থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। রামের গুরু মহর্ষি বশিষ্ঠের দৃষ্টিতে দেখা ঘটনাগুলিও ঋষি বাল্মিকী রচনা করে গেছেন "য়োগ বাসিষ্ঠ মহারামায়ণম্"(৪) নামক গ্রন্থে। আবার রামের আধ্যাত্মিক রূপ বর্ণনা মূলক "অধ্যাত্ম রামায়ণম্"(৬) আছে, রামায়ণের পার্শ্ব কাহিনী বর্ণনা মূলক " আনন্দ রামায়ণম্"(৭) আছে, মাতা সীতার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা "অদ্ভুত রামায়ণম্"(৮), "হনুমান রামায়ণম্"(৯) সহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা এবং লেখা আরও অনেকগুলি আছে।



রামায়ণ গ্রন্থাবলী (Extras)

সংস্কৃত রামায়ণ গ্রন্থাবলী

(১) ভগবান বিষ্ণু বর্ণিত মূল রামায়ণ - ১০০ শ্লোকের। শ্রীমদ্বাল্মীকীয়রামায়ণমের প্রথম কাণ্ডের প্রথম সর্গ এটি। মুলতঃ আদি কবি মহর্ষি বাল্মিকী এটা তার অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে যুক্ত করে গেছেন।

(২) শ্রীমদ্বাল্মীকীয়রামায়ণম্ - বাল্মিকী রামায়ণ অনুযায়ী,

চতুর্বিংশৎসহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবানৃষিঃ৷

তথা সর্গশতান্পঞ্চ ষট্কাণ্ডানি তথোত্তরম্ ৷৷

(শ্রীমদ্বাল্মিকীরামায়ণ, ১-৪-২)

বঙ্গানুবাদ : চব্বিশ হাজার শ্লোক উচ্চারণে ঋষি বাল্মিকী রামায়ণ রচনা করলেন, যার মধ্যে পাঁচশত(-এর অধিক) সর্গে ৬ কাণ্ড ও অতিরিক্ত উত্তরকাণ্ড-ও রচনা করেছেন।

বিঃদ্রঃ - প্রথম ছয়টি কাণ্ডকে মূল ধরা হয়। যথা -

১. বালকাণ্ড - ৭৭ সর্গ

২. অযোধ্যাকাণ্ড - ১১৯ সর্গ

৩. অরণ্যকাণ্ড - ৭৫ সর্গ

৪. কিষ্কিন্ধাকাণ্ড - ৬৭ সর্গ

৫. সুন্দরকাণ্ড - ৬৮ সর্গ

৬. যুদ্ধকাণ্ড -১২৮ সর্গ, মতান্তরে ১৩১ সর্গ

সবমিলিয়ে মূখ্য ভাগে রয়েছে ৫৩৪ সর্গ, মতান্তরে ৫৩৭ সর্গ। তাছাড়াও বাল্মিকী এটাও উল্লেখ করেন অতিরিক্ত উত্তরকাণ্ড আছে, যার মধ্যে আমরা ১১১টি সর্গ পাই। অর্থাৎ সবমিলিয়ে শ্রীমদ্বাল্মিকীরামায়ণে রয়েছে ৬৪৫টি সর্গ বা ৬৫৮টি সর্গ।

(৩) দিব্য মূল রামায়ণম্ - ১০০ কোটি শ্লোকের। হর-পার্বতীর কোনো এক কথোপকথনের সময় রামায়ণের বিষয় উঠে আসলে মহাদেব তা পূর্ণরূপে বর্ণনা করেন। এই কথোপকথন বিশাল এক গ্রন্থের আকারে স্বর্গে আছে বলে ধারণা করা হয়।

(৪) য়োগবাসিষ্ঠ - এটি বাল্মিকী রচিত দ্বিতীয় রামায়ণ বলা চলে। এটি মূলতঃ মহর্ষি বশিষ্ঠ ও ভগবান রামের কথোপকথন যেখানে বশিষ্ঠ রামকে অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষা দেয়। এটিতে শ্রীমদ্বাল্মীকীয়রামায়ণম্ অপেক্ষা চার হাজারেরও বেশি শ্লোক থাকায় এটিকে "মহারামায়ণম্"-ও বলা হয়। শ্লোক সংখ্যা - ২৯,০০০ বা ৩২,০০০ বা ৩৬,০০০ বলা হয়, কিন্তু ২৯,৬৮৩টি শ্লোক পাওয়া যায়। গ্রন্থটির ৪৫৮টি সর্গ ৬ ভাগে বিভক্ত, যথা

১. বৈরাগ্য প্রকরণম্ - ৩৩ সর্গ

২. মুমুক্ষু ব্যবহার প্রকরণম্ - ২০ সর্গ

৩. উৎপত্তি প্রকরণম্ - ১২২ সর্গ

৪. স্থিতি প্রকরণম্ - ৬২ সর্গ

৫. উপশম প্রকরণম্ - ৯৩ সর্গ

৬. নির্বাণ প্রকরণম্ - পূর্বার্ধ ১২৮ সর্গ, উত্তরার্ধ ২১৬ সর্গ

তাছাড়া এটিকে আর্ষ রামায়ণম্, জ্ঞানবাসিষ্ঠ, বসিষ্ঠ গীতাও বলা হয়।

(৫) লঘুয়োগবাসিষ্ঠ - কাশ্মীরি পণ্ডিত - ৯ম শতকে য়োগবাসিষ্ঠ মহারামায়ণমের একটি ক্ষুদ্র পুস্তক প্রণয়ন করেন যাকে লঘুয়োগবাসিষ্ঠ নাম দেওয়া হয়। শ্লোক সংখ্যা ৬০০০। ভাগ পূর্ববৎ ৬টি, সর্গ সংখ্যা কম।

(৬) অধ্যাত্ম রামায়ণম্ - এই রামায়ণ ভগবান শঙ্কর মাতা পার্বতীকে শুনিয়েছিলেন। সেই স্থানে কাকভুশুণ্ডি উপস্থিত ছিলো। সেও গল্পটি শুনে ফেলে। পুনর্জন্মেও কাকভুশুণ্ডি সেই গল্প মনে রাখতে সক্ষম হয়। যা সে তার শিষ্যদের শেখায় এবং এভাবে প্রচারিত হয়। এটিও অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষা মূলক গ্রন্থ এবং ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের অংশ। শ্লোক সংখ্যা ৪৫০০, অধ্যায় সংখ্যা ৬৫, শ্রীমদ্বাল্মীকীয়রামায়ণম্বৎ ৭ কাণ্ড। রচয়িতা মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস।

(৭) আনন্দ রামায়ণম্ - মহর্ষি বাল্মিকী রচিত তৃতীয় রামায়ণ এটি যা রামায়ণের মূল ঘটনার পাশাপাশি আর কী কী ঘটছিলো তা বর্ণনা দেয়। এক কথায় বলা যায় যারা আনন্দ পেয়ে উৎসাহে আরও জানতে চায় তাদের জন্য এটি। স্তোত্রগানের জন্য এই গ্রন্থটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মোট নয়টি কাণ্ডে বিভক্ত আনন্দ রামায়ণ কিছুটা এমন,

১. সারকাণ্ড

২. য়াত্রাকাণ্ড

৩. য়াগকাণ্ড - এখানে আছে রাম অষ্টোত্তর শতনাম স্তোত্র

৪. বিলাসকাণ্ড - রাম স্তোত্রম্ বিশেষ উল্লেখ্য

৫. জন্মকাণ্ড - রামরক্ষা মহামন্ত্রম্

৬. বিবাহকাণ্ড

৭. রাজ্যকাণ্ড - রামসহস্রনামস্তোত্রম্ বিশেষ উল্লেখ্য

৮. মনোহরকাণ্ড - এখানে আছে হনুমান কবচম্, রাম কবচম্, সীতা কবচম্, লক্ষ্মণ কবচম্, ভরত কবচম্ ও শত্রুঘ্ন কবচম্

৯. পূর্ণকাণ্ড

(৮) অদ্ভুত রামায়ণম্ - মূল রামায়ণ শত কোটি শ্লোকের এই ব্যাপারে অবগত হয়ে মহর্ষি ভরদ্বাজ আসেন মহর্ষি বাল্মিকীর কাছে। জানতে চান আরও গূঢ় সব তথ্য। ঋষি বাল্মিকী এবার তুলে আনলেন অদ্ভুত সব তথ্য যা দেবী সীতাকে কেন্দ্র করে বলা হয়েছে। দেবী সীতার মাহাত্ম্য গাঁথাও বলা যায় এটি, ২৭ সর্গে মহর্ষি বাল্মিকী রচিত চতুর্থ রামায়ণ এটি।

(৯) হনুমান রামায়ণম্ - হনুমান তার প্রভুর কীর্তি তার নিজস্মৃতি থেকে লিপিবদ্ধ করে একটি রামায়ণ রচনা করেছিল সাতটি কলাপাতায়, মতান্তরে একটি বিশাল পাথরে। যা তিনি বাল্মিকীকে দেখান, বাল্মিকী তা দেখে অভিভূত হন এবং কেঁদে ফেলেন। তার অতিসুন্দর রামায়ণের কাছে বাল্মিকীর রামায়ন অতি নগন্য বলে ফেলেন বাল্মিকী, একথা শুনে হনুমান বাল্মিকীর কষ্ট দূর করতে তা লুপ্ত করে দেন। ধারণা করা হয় এটি দেবলোকে এখনো আছে, কিন্তু এবিষয়ে কোথাও কোনো স্পষ্ট তথ্য দেওয়া হয় নি।

তাছাড়া "অগস্ত্য রামায়ণম্"(১০) নামক একটি রামায়ণ থাকতে পারে যার ব্যাপারে আমার অতো ধারণা নেই। ষষ্ঠ শতকের একটি সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় যার নাম "দশ গ্রীবা রাক্ষস চরিত্রম্ বধ"(১১)। এটি ৫ কাণ্ডে বিভক্ত, বাল্মিকী রামায়ণের মতোই কিন্তু বালকাণ্ড আর উত্তরকাণ্ড নেই। এছাড়া বিভিন্ন গ্রন্থে রামায়ণের কথা তো আছেই যেমন - শ্রীমদ্ভাগবতম্ নবম স্কন্ধ, বিষ্ণুপুরাণ, অগ্নিপুরাণাদি এবং মহাভারতের বনপর্ব।

আধুনিক রামায়ণ গ্রন্থাবলী

আধুনিক রামায়ণগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হচ্ছে "কৃত্তিবাসী রামায়ণ"(১২)-এর কথা। এতে শ্রীমদ্বাল্মীকীয়রামায়ণম্ অপেক্ষা সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়। বাঙালির পরমারাধ্যা দেবী দুর্গার কথা ফুঁটে উঠে সুন্দর করে। রচনাকাল - পঞ্চদশ শতক।

সর্বপ্রথম রামায়ণ অনুবাদ করা হয় তেলেগু ভাষায়, একাদশ শতকে রচিত "রঙ্গনাথ রামায়ণমু"(১৩), এরপর উল্লেখ্য হিসাবে আসে চতুর্দশ শতকে নারী কবি আতুকুরি মোল্লা রচিত তেলেগুভাষায় "রামায়ণমু"(১৪)। এরপর একে একে,

(১৫) রামচন্দ্র চরিত পুরাণ (কর্ণাটক, দ্বাদশ শতক)

(১৬) কম্বা রামায়ণ (তামিল, দ্বাদশ শতক)

(১৭) কুমুদেন্দু রামায়ণ (জৈন রামায়ণ, কর্ণাটক, ত্রয়োদশ শতক)

(১৮) সপ্তকাণ্ড রামায়ণ (আসাম, চতুর্দশ শতক)

(১৯) বিলঙ্কা রামায়ণ (উড়িস্যা, পঞ্চদশ শতক)

(২০) রামায়ণু (কোংকণীভাষা, গোয়া, পঞ্চদশ শতক)

(২১) রামচরিতমানস - অযোধ্যার আওয়াধীভাষা, রচয়িতা - গোস্বামী তুলসীদাস। হনুমান চালিসা এই রামায়ণেরই অংশ। ষোড়শ শতকের।

(২২) জগমোহন রামায়ণ (উড়িস্যা, ষোড়শ শতক)

(২৩) কুমার বাল্মিকী তোরাভে রামায়ণ (কর্ণাটক, ষোড়শ শতক)

(২৪) কান্নাস্সা রামায়ণ (মালায়ালাম্, ষোড়শ শতক)

(২৫) অধ্যাত্ম রামায়ণম্ কিলিপাট্টু (মালায়ালাম্, ষোড়শ শতক)

(২৬) রঘুনাথ বিলাস (উড়িস্যা, সপ্তদশ শতক)

(২৭) বৈদেহীশ বিলাস (উড়িস্যা, সপ্তদশ শতক)

(২৮) রামাবতার চরিত (কাশ্মীরি, উনবিংশ শতক)

(২৯) মিথিলাভাষা রামায়ণ

(৩০) তুলসী কৃত রামায়ণ (গুজরাটিভাষা)

(৩১) টিকা রামায়ণ (উড়িস্যা)

(৩২) বিচিত্র রামায়ণ (উড়িস্যা)

(৩৩) কোশালী রামায়ণ (উড়িস্যা)

(৩৪) দেশীয় রামায়ণ (উড়িস্যা)

(৩৫) পাহাড়িয়া রামায়ণ (উড়িস্যা)

(৩৬) রামচরিতম্ (মালায়ালাম্)

(৩৭) শ্রীমদ্ রামায়ণ কল্পবৃক্ষমু (তেলেগুভাষা)

(৩৮) মাপ্পিলা রামায়ণম্ (কেরালার মুসলিমদের)

(৩৯) আকবরি রামায়ণ (ফার্সিভাষা, আকবরের রাজসভায়)

(৪০) পুঁথি রামায়ণ (উর্দু, ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ)

ভারতীয় অন্যান্য ধর্মবিশ্বাস থেকে রচিত রামায়ণ গ্রন্থাবলী

জৈনদের কুমুদেন্দু রামায়ণ ছাড়াও আরও অনেকগুলি রামায়ণ আছে, যেমন

বিমলাসুরীর সংস্করণ

(৪১) বিমলাসুরীর পৌমচরয়ু (প্রাকৃতভাষা)

(৪২) শিলঙ্কাচার্যের চৌপান্নমহাপুরুষ চরিয়ম্ (প্রাকৃতভাষা)

(৪৩) হরিভদ্রের ধূর্তখ্যান (প্রাকৃতভাষা)

(৪৪) ভদ্রেশ্বরের খাভালি (প্রাকৃতভাষা)

(৪৫) শিলঙ্কাচার্যের চৌপান্নমহাপুরুষ চরিয়ম্ (প্রাকৃতভাষা)

(৪৬) রবিসেনের পদ্মপুরাণ (সংস্কৃত)

(৪৭) য়োগশায়াত্র বৃত্তির হেমচন্দ্র (সংস্কৃত)

(৪৮) হেমচন্দ্রের ত্রিষষ্টিসালকপুরুষ চরিত্র (সংস্কৃত)

(৪৯) ধনেশ্বরের শত্রুঞ্জয় মহাত্মন্ (সংস্কৃত)

(৫০) স্বয়ম্ভুর পৌমচরয়ু (অপভ্রংশভাষা)

গুণভদ্রের সংস্করণ

(৫১) গুণভদ্রের উত্তরপুরাণম্ (সংস্কৃত)

(৫২) কৃষ্ণের পূর্ণচন্দ্রোদয় (সংস্কৃত)

(৫৩) পুষ্পদন্তের মহাপুরাণ (অপভ্রংশভাষা)

সংঘদাসের সংস্করণ

(৫৪) সংঘদাসের বসুদেবহিন্দি (প্রাকৃতভাষা)

(৫৫) হরিসেনের কথাকোষ (প্রাকৃতভাষা)

তাছাড়া আরও আছে,

(৫৬) নাগচন্দ্রের পদ্মরামায়ণ (কান্নাডাভাষা, ১১ শতক)

(৫৭) জিনাদাসের রামায়ণ (১৫ শতক)

(৫৮) রাইধুর পদ্মপুরাণ (অপভ্রংশভাষা, ১৫ শতক)

(৫৯) সোমপ্রভার লঘুত্রিষষ্টিসালকপুরুষ চরিত্র (১৫ শতক)

(৬০) পদ্মদেববিজয়ের রামচরিত্র (১৬ শতক)

(৬১) সোমদেবের রামচরিত্র (১৬ শতক)

(৬২) মেঘবিজয়ের লঘুত্রিষষ্টিসালকপুরুষ চরিত্র (১৭ শতক)

(৬৩) দেববিজয়গনিরের রামচরিত্র (১৫৯৬)

বৌদ্ধদের আছে "দশরথ জাতক" (৬৪)।

নেপাল - সিদ্ধি রামায়ণ(৬৫), ভানুভক্তকো রামায়ণ(৬৬)

শ্রীলঙ্কা - জানকীহরণ(৬৭)

(৬৮) China, Tibet – Langka Sip Hor (Tai Lü language)

(৬৯) Japan – Ramaenna or Ramaensho

(৭০) Cambodia – Reamker

Indonesia,

(৭১) Bali – Ramakavaca

Java – Kakawin Ramayana (৭২), Yogesvara Ramayana (৭৩)

Sumatera – Ramayana Swarnadwipa (৭৪)

Laos – Phra Lak Phra Lam (৭৫), Gvay Dvorahbi (৭৬)

Malaysia – Hikayat Seri Rama(৭৭), Hikayat Maharaja Wana (৭৮)

(৭৯) Myanmar (Burma) – Yama Zatdaw (Yamayana)

(৮০) Philippines,Mindanao – Maharadia Lawana , 

(৮১) Darangen (Moro) 

(৮২) Thailand – Ramakien

(৮৩) Kingdom of Lan Na, Thailand – Phommachak

প্রায় সব পুরাণেই একটু আধটু রামের বর্ণনাতো আছেই, তাছাড়াও আরও অনেক ভাষায় বর্তমানে রামায়ণ পাওয়া যায়, অনেক বিভিন্নতা থাকে সংস্কৃতি ভেদে। গদ্যে, নাটকাদিতে তো আছেই। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ ভিন্ন ভিন্ন রামায়ণ হিসাব করা যাবে। আমি এখানে ৮৩টা দিয়েই শেষ করলা। পরে আরও পেলে দিবো ক্ষণ। যাই হোক রামায়ণের মূল রচিতা বাল্মিকীর রামায়ণ গুলিকেই মূল হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।

Tuesday, December 8, 2020

আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস কি এবং এই নিয়ে কিছু কথা

পৃথিবীতে কতশত দিবস আছে, সেটা হয়তো আপনি নিয়ম করে মনে রাখেন না। তবে আপনি যদি পুরুষ হয়ে থাকেন, তবে আজকের দিনটি অবশ্যই আপনাকে মনে রাখতে হবে। কারণ, দিনটি শুধুই আপনার। আজ ১৯ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস।পুরুষদের মধ্যে সমতা, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতেই বিশ্ব পুরুষ দিবসের উদ্‌যাপন।

আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের সূচনা হয় ১৯৯২-এর ৭ ফেব্রুয়ারি। টমাস অস্টার নামে এক ব্যক্তি দিবসটি পালন শুরু করেন। পরিকল্পনা হয়েছিল তারও একবছর আগে, অর্থাৎ ১৯৯১-এর ৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯৯৯-এ ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে এ বিশেষ দিন উদযাপন পুনরায় শুরু হয়।

পুরুষ দিবস পালনের প্রস্তাব প্রথম করা হয় ১৯৯৪ সালে। তবে ইতিহাস বেশ পুরোনো।

১৯২২ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে পালন করা হতো রেড আর্মি অ্যান্ড নেভি ডে। এই দিনটি পালন করা হতো মূলত পুরুষদের বীরত্ব আর ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে। ২০০২ সালে দিবসটির নামকরণ করা হয় ‘ডিফেন্ডার অফ দ্য ফাদারল্যান্ড ডে’। রাশিয়া, ইউক্রেনসহ তখনকার সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে এই দিবসটি পালন করা হতো।

বলা যায়, নারী দিবসের অনুরূপভাবেই দিবসটি পালিত হয়। ষাটের দশক থেকেই পুরুষ দিবস পালনের জন্য লেখালেখি চলছে। ১৯৬৮ সালে আমেরিকান সাংবাদিক জন পি হ্যারিস নিজের লেখায় এ দিবসটি পালনের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

নব্বই দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও মাল্টায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারিতে পুরুষ দিবস পালনের জন্য বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যদিও অনুষ্ঠানগুলো খুব একটা প্রচার পায়নি। অংশগ্রহণও ছিল কম। পরবর্তী সময়ে ১৯ নভেম্বর পুরো বিশ্বে পুরুষ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এবছরের থিম ছিল, পজিটিভ পুরুষ রোল মডেল গড়ে তোলা ও পুরুষজীবনের কিছু অনালোচিত সমস্যা নিয়ে আলোচনা— যেমন পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য, টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটি, পুরুষের ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার হার৷ লক্ষ করুন, টক্সিক ম্যাসকুলিনিটিকে কিন্তু ‘সমস্যা’ হিসেবেই চিহ্নিত করা হচ্ছে৷ অফিসিয়াল ওয়েবসাইট বলছে, এ’বছর ফোকাস করা হয়েছে ‘men’s and boy’s health, improving gender relations, promoting gender equality, and highlighting positive male role models’-এর উপর।

এই দিনকে ঘিরে জীবনধারা ও ফ্যাশনবিষয়ক ওয়েবসাইট ব্লোডস্কাই জানিয়েছে মজার তথ্য। এই সমাজে পুরুষেরাও বেশ কিছু কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে। সেই কথাগুলোর কয়েকটি তালিকাও প্রকাশ করেছে তারা। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই কথাগুলো—

‘আসল পুরুষ কাঁদে না’

আমাদের সমাজ এই ধারণায় বিশ্বাস করে, কেবল নারী ও শিশুরা কান্নাকাটি করে। সম্ভবত তারা এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারে না যে একজন পুরুষেরও দুঃখবোধ থাকতে পারে, কষ্ট থাকতে পারে। এর সঙ্গে লিঙ্গের কোনো যোগসূত্র নেই।

‘পুরুষেরা গোলাপি ও হলুদ পোশাক পরে না’

পুরুষেরা গোলাপি ও হলুদ রঙের পোশাক পরলে এই সমাজে বাঁকা চোখে দেখা হয়। এর কী কারণ সেটা অজানা, তবে কোনো নির্দিষ্ট রং কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গের জন্য সৃষ্টি হয়েছে, এমন ইতিহাস নেই।

‘পুরুষেরা ব্যথা অনুভব করে না’

সত্যি? ঈশ্বর কি পুরুষদের ব্যথা এড়াতে আলাদা কোনো বিশেষ ব্যবস্থা তৈরি করেছেন? এমনটি যদি না হয়ে থাকে, তাহলে পুরুষেরা ব্যথা অনুভব করবেন না কেন? তাদের শরীর ও মনে তো ব্যথা অনুভব করার সমস্ত উপকরণ আছে।

‘গোঁফ ও দাড়ি প্রকৃত পুরুষ করে তোলে’

এই সমাজ গোঁফ ও দাড়ি না রাখলে পুরুষই ভাবতে চায় না। আপনার সমস্ত পুরুষত্ব যেন ফুটে ওঠে ওই গোঁফ ও দাড়িতে। যদিও এই ব্যাখ্যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

‘পুরুষের উচিত নারীর দায়িত্ব নেওয়া’

আপনার মা, স্ত্রী, কন্যা, বোন এবং বান্ধবীর যত্ন নিঃসন্দেহে আপনি নিতে পারেন। এগুলো সেরা কাজ। তবে উপার্জন করে তাদের দায়িত্ব পুরুষদের গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করে আমাদের সমাজ, যেটা ঠিক নয়। পুরুষ যদি স্বনির্ভর হতে পারে, তবে নারীও পারে।

‘খেলাধুলায় আগ্রহ না থাকলে আপনি পুরুষ নন’

আপনি খেলাধুলায় আগ্রহী নন, এর অর্থ এই সমাজে আপনি পুরুষ নন। অথচ খেলাধুলা পছন্দ বা অপছন্দ ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাপার।

‘সিনেমা দেখে কাঁদলে আপনি পুরুষ নন’

সিনেমার কোনো দৃশ্য পুরুষ ও নারী উভয়ের কাছে সংবেদনশীল হতে পারে, সেটার জন্য যে কেউ আবেগে ভাসতে পারে। সিনেমা দেখে কাঁদা মেয়েশিশুর বৈশিষ্ট্যযুক্ত, এ কথার কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নেই।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

এই দিবসের উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছেঃ

  • পুরুষ ও বালকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি;
  • নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ক প্রচারণা;
  • নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক সাম্যতার প্রচার;
  • পুরুষদের মধ্যে ইতিবাচক আদর্শ চরিত্রের গুরুত্ব তুলে ধরা;
  • পুরুষ ও বালকদের নিয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংস্কার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরী;
  • পুরুষ ও বালকদের অর্জন ও অবদানকে উদযাপন;
  • সমাজ, পরিবার, বিবাহ ও শিশু যত্নের ক্ষেত্রে পুরুষ ও বালকদের অবদানকে তুলে ধরা।

Monday, November 9, 2020

গন্ধ নিয়ে বিস্তারিত

 আমরা অনেক সময়ে দামী scent কিনে, ব্যবহার করে, মনোক্ষুণ্ণ হই, কারণ তাঁর গন্ধ বেশিক্ষন থাকছে না বলে। এর কারণ হিসেবে আগে আপনাকে জানতে হবে আপনি কোন ধরনের scent ক্রয় করেছেন।Scent বা fragrance কে তাঁর strength/ক্ষমতা অনুযায়ী নিম্নলিখিত ভাবে ভাগ করা হয়ে থাকে।

উপরোক্ত ছবি দেখে আপনি নিশ্চই একটা ধারণা পেয়েছেন। Fragrance কে মোটামুটিভাবে, পারফিউম ওয়েলের ঘনত্বের ওপর বিচার করে, এই চার ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।

Eau de Parfum এ, এই ওয়েল থাকে মোটামুটি ১০–২০%, তাই এর গন্ধ প্রায় ৭-৮ ঘন্টা থাকে। Eau de Toilette, যেটা সবথেকে widely ব্যবহ্রত হয়, এতে পারফিউম ওয়েল থাকে ওই ৫-১৫% এবং এটির ৪-৫ ঘন্টা মত গন্ধ থাকে। এরপর আসে, Eau de Cologne, এটা মূলত after shave splash, cologne। এতে পারফিউম ওয়েল থাকে ২-৪%, এবং তা ২-৩ ঘন্টার বেশী গন্ধ থাকে না।যাদের smell এলার্জি বা গন্ধ সহ্য হয় না, তাঁদের জন্য খুব mild ধরনের scent পাওয়া যায়, যাতে পারফিউম ওয়েল নামমাত্র থাকে এবং এঁকে Eau Fraiche বলা হয়।

এবার আসুন দেখেনি, Fragrance Family কে।

Fragrance কে গন্ধের বিচারে মূলত Fresh, FloralOriental আর Woody এই চারভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে, বাকি গুলো এদেরই derivatives।

একটা ভালো fragrance এর মূলত তিনটে note থাকে। Top, Middle/Heart আর Base

স্প্রে করার সাথে সাথেই যে গন্ধ প্রথমেই আপনি পান, সেটাই হল Top note। Top note আসতে আসতে মিলিয়ে গেলে, অন্য যে গন্ধ আসে সেটা হল Middle। এই middle বা heart note ই হল পারফিউমের আসল গন্ধ যা top note মিলিয়ে গেলেও অনেকক্ষণ থাকে। এই দুই যখন মিলিয়ে যায়,সবশেষে থাকে Base note, যেটা আপনার নাসিকারন্ধ্র অনেক্ষন ধরে রাখে।

এবারে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই Top, Middle আর Base notes এ কি ব্যবহার করা হয়? নিচের ছবিটা দেখলে আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে এই ব্যাপার।

এতক্ষন যা আলোচনা করা হল, তা মূলত একটা ভালো scent তৈরীর ক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে, সেগুলো। এবার, এই ব্যবহৃত ingredients, যেটা যত দুষ্প্রাপ্য, এবং তাঁর blend বা mixing যত appropriate, সেই পারফিউমের দাম তত বেশী।

আমি বিশাল কিছু দামী পারফিউমের উদাহরণ দেব না, বরং দুটো অত্যন্ত জনপ্ৰিয় এবং বহুল ব্যবহ্রত পারফিউমের উদাহরণ দেব।

Ladies first, তাই প্রথম উদাহরণ মহিলাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় Chanel N°5 ।

এই পারফিউম ১৯২১ সালে Coco Chanel বাজারে launch করেন এবং এর কম্পোজিশন তৈরী করেন Ernest Beaux। এবারে এক ঝলক দেখে নি, এতে ব্যবহার করা notes।

এর দাম, ১.৭ আউন্স বা ৫০ মিলি বোতলের, ১০৫ মার্কিন ডলার। আমি যখন কিনেছিলাম, তখন অবশ্য একটু কম ছিল, ৮০ ডলার মত, এক্সচেঞ্জ রেটও কম ছিল।

আমি আমার প্রাক্তন প্রেমিকাকে এটা দিয়েছিলাম, ও খুব চেয়েছিল এটা। ওকে এই পারফিউমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে বলত, মনে হয় সদ্য বৃষ্টিতে ভেজা কোন বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলে যেমন লাগে, এর গন্ধ নাকি ওইরকম।

ছেলেদের জন্য আমার নিজের ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো পারফিউম ছিল, Dior Fahrenheit


১.৭ আউন্স বা ৫০ মিলি বোতলের দাম এখন বোধহয় ৭৫ মার্কিন ডলার।

Sunday, November 8, 2020

পাগড়ী নিয়ে বিস্তারিত

‘পাগড়ি’ শব্দটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটু সেকেলেই বলা চলে। কিন্তু ইতিহাসের বইয়ের পাতায় আর বিয়ে বাড়িতে বরের মাথায় পাগড়ির শোভা এখনও কোন অংশে মলিন নয়। সে প্রেক্ষিতে এই পাগড়ির ছবি আমাদের সকলের চোখেই মূর্তিমান। সে কাবুলিওয়ালা হোক আর কোন দেশের রাজাই হোক, পাগড়ির বাহ্যিক জৌলুস কোন অংশেই কম নয়। দেশ বা অঞ্চলভেদে পাগড়ি বাঁধার নিয়ম-কানুন আলাদা, ভিন্ন তার কাপড়ের বুনন, রঙের বৈচিত্রতাও অপার সেখানে।

বিভিন্ন সিনেমাতে নায়কদের মাথায় পাগড়ির শোভাবর্ধনকারক চিত্র; Image Source: http://nguoitapviet.info

আভিধানিক অর্থের দিকে লক্ষ্য করলে মনে হবে এ তো মাথায় এক ফালি কাপড় জড়ানো ছাড়া অন্যকিছু নয়। কিন্তু তা বললে চলবে কেন? এর পেছনের ইতিহাস এত মলিন নয়। সেই প্রাচীনকাল থেকে পাগড়ি ব্যবহারের হদিস মেলে। মরুভূমি অঞ্চলে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পেতে আরব অঞ্চলে পাগড়ির ব্যবহার শুরু হয়। আঁকা সংস্কৃতির বদৌলতে আপাতপক্ষে এমন মনেই হতে পারে যে পাগড়ি শুধু শিখ বা পাঞ্জাবিদের মধ্যেই প্রচলিত। তা কিন্তু নয়। প্রায় প্রতিটি ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুগামী ব্যক্তিদের মধ্যে পাগড়ির ব্যবহার রয়েছে। প্রাচীন ব্যাবিলন সভ্যতার আমলে ব্যাবিলনীয়রা যেমন পাগড়ি ব্যবহার করতেন, তেমনি খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম এবং হিন্দুধর্মের মানুষদের মধ্যেও পাগড়ির ব্যাপক ব্যবহার দর্শনীয়।

মরুভূমি অঞ্চলের মানুষ পাগড়ির একটা অংশ দিয়ে মুখমন্ডল ঢেকে রাখেন; Image Source: Create unique experiences with interactive images, videos & 360° media — ThingLink

মুসলমানদের পাগড়ির সঙ্গে একটি ঐতিহ্যগত সম্পর্ক রয়েছে। আরব দেশে জাতীয় পোশাকের অপরিহার্য অংশ এই পাগড়ি। পরে তা অন্যান্য মুসলিম দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় প্রত্যেক মুসলিম শাসকই পাগড়ি পরতেন, পরবর্তী সময় মুসলিম সামরিক কর্মচারী এবং বেসামরিক লোকজনও পাগড়ি পরতে শুরু করেন।

সৌদিআরব ও মধ্য প্রাচ্যের পাগড়ি; Image Source: Reference.com - What's Your Question

প্রাচীনকালে আইন-আদালত যখন চালু হয়নি কিংবা পুলিশ-প্রশাসন বলতে তেমন কিছু ছিল না তখন শত্রু বা অপরাধীদের ধরে আনার জন্য এই পাগড়ি ব্যবহার করা হত। রাজস্থানের অধিকাংশ লোকেরা পাগড়িকে একটি ছোট স্টোর হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। রাজস্থানীরা তাদের বিশেষ ‘গাভারিয়া’ পাগড়ির ভিতর আয়না, চিরুনি, তামাক প্রভৃতি অনেক ছোটখাটো জিনিস রেখে ঘোরাফেরা করেন।

পাগড়ির আকার আয়তনের দিক থেকে তুরস্কের নাম প্রথমে চলে আসে। একসময় তুরস্কের সম্রাটদের পাগড়ি বিশাল আকারের জন্য বিখ্যাত ছিল। উচ্চ পদস্থ ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা বিশাল গম্বুজ আকৃতির পাগড়ি ব্যবহার করতেন। এসব পাগড়ি সাধারণত পাতলা বেতের তৈরি গোলাকৃতির কাঠামোর হত, ভিতরটা থাকত ফাঁকা। আর কাঠামোর উপর দামী কাপড় জড়িয়ে শিল্প সমৃদ্ধভাবে তৈরি হত এই পাগড়ি। এই পাগড়ির শীর্ষদেশটির নাম ‘সারিক’।

তুর্কি অটোম্যান সুলতান সুলেমান বিখ্যাত ছিলেন তার বিশালাকার পাগড়ির জন্য। সুলতানের পাগড়িটি দেখতে ছিল অনেকটা কুমড়ো সদৃশ। প্রায় ৪-৫ ফুট উঁচু ছিল এই পাগড়ি। দূর থেকে দেখলে মনে হত একটি বিশাল হাড়ি মাথার উপরে চাপানো রয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীতে তুরস্কের সুলতান যুবরাজ সালিম প্রায় ৩৯ ফুট দামী মখমলের কাপড় দিয়ে তৈরি পাগড়ি ব্যবহার করতেন।

অটোম্যান সুলতানদের পাগড়ি; Painting Courtesy: Titian

মোঘল সাম্রাজ্যে পাগড়ির কদর বিশেষভাবে লক্ষনীয়। মোঘল সম্রাট বাবর যখন আগ্রা দখল করেন তখন সেই রাজ্যের রাজাকে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের জন্য এক মহামূল্যবান হিরে উপহার পান। বাবর সেই হিরে পাগড়ির শীর্ষদেশে ধারন করতেন যা তাকে আরও বেশি মহিমান্বিত করে রাখতো।

পরবর্তীতে মোঘল সম্রাট শাহ রঙ্গিলা (১৭১৯-১৭৪৮) অত্যন্ত মহার্ঘ ‘কোহিনুর’ হিরাটিকে তার পাগড়ির সামনের দিকে লাগিয়ে রাখতেন। তারও পরবর্তী সময়ে নাদির শাহ কৌশলে ‘পাগড়ির বিনিময় সৌহার্দের প্রতীক’ এই ছলে পাগড়ি বিনিময় করেন এবং কোহিনুরটি হস্তগত করেন।

তুখোড় সম্রাট আহমদ শাহ আহমদ শাহ দুররানি; Image Source: Wikimedia

খ্রিস্টান এবং ইহুদীদের মধ্যেও পাগড়ি ব্যবহারের প্রচলন ছিল। হারুন-উর রশীদের সময় খ্রীস্টানদের পাগড়ি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। তবে শর্ত ছিল যে, তারা শুধু হলুদ রঙের পাগড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। কোনভাবেই সাদা বা অন্যকোনো রঙের পাগড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না। অন্যদিকে ফাতেমীয় বংশের খলিফা হাকিম খ্রীস্টানদের কালো রঙের পাগড়ি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন।

রাজস্থানের লোকদের মধ্যে আবার নানা ধরনের পাগড়ির প্রচলন রয়েছে। ১২ মাইল অন্তর অন্তর এসব এলাকার মানুষের পাগড়ির স্টাইল পরিবর্তিত হয়। এমনকি ঋতুভেদে পাগড়ির রঙও পরিবর্তিত হয়। এসব পাগড়ির নামও যেমন অদ্ভূত, তেমনি এগুলোর তৈরি এবং ব্যবহারেও বৈচিত্র্যময়তা বেশ লক্ষণীয়।

রাজস্থানের অধিবাসীদের ব্যবহৃত রঙবেরঙের পাগড়ি; Image Source: Rajasthan Diary 

'Holiday in Rajasthan'

বসন্তকালে রাজস্থানীরা সাদা ও লালরঙের পাগড়ি পরেন যাকে বলা হয় ‘ফাল্গুনিয়া’ আর বর্ষাকালে তারা পরেন রঙিন ঢেউ খেলানো পাগড়ি। এই পাগড়িকে বলা হয় ‘লহরিয়া’। রাজস্থানীরা শুভ ও আনন্দময় অনুষ্ঠানে রঙিন, দামি সিল্কের কাপড় দিয়ে তৈরি সৌন্দর্যমন্ডিত পাগড়ি পরিধারণ করে থাকেন। তারা অনেক সময় এধরনের পাগড়িতে রঙিন চুনরি ব্যবহার করেন। তবে, দু:খ বা শোকের অনুষ্ঠানে সাদা-কালো রঙের পাগড়ি পরাই এসব এলাকার রীতি।

দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এ স্থানের লোকদের মধ্যে ‘দেশান্তরী’ নামের পাগড়ি পরিধানের প্রচলন রয়েছে। রাজস্থানের লোকেরা সাধারণ যে পাগড়ি পরেন তা ৮০ ফুট লম্বা এবং ৮ ইঞ্চি চওড়া কাপড় দিয়ে তৈরি হয়। ‘সাফা’ নামের একরকম পাগড়ি এসব এলাকার মানুষ ব্যবহার করে থাকেন যা ৩৫ ফুট লম্বা ও ৩ ফুট চওড়া কাপড় দিয়ে তৈরি। ‘বলধিয়াভাট পাগড়ি’ নামক রাজস্থানের লোকেরা ধাতুর তৈরি এক ধরণের পাগড়ি পরিধান করেন। এটি একটি হেলমেটের মতন বস্তুর উপর বাঁধা হয়।

বলধিয়াভাট পাগড়ি; Image Courtesy: flickr/monicalewinsky

শিখদের মধ্যে পাগড়ি পরাটা দায়িত্ববোধের পরিচায়ক। শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘শিখ পাগড়ি’ বা ‘দাসতার’ পরা বাধ্যতামূলক।

ভারত সহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পাগড়ি বাঁধার ধরন ও ব্যবহার ভিন্নরকম। শুনলে আশ্চর্য হতে পারেন এই জেনে, পাগড়ির কাপড়, তার বাঁধার ধরন দেখে বোঝা যায় সেই ব্যক্তি কোন অঞ্চলে বাস করেন, তার পেশা বা সে কোন সমাজের প্রতিনিধি।

শিখ সম্প্রদায়ের পাগড়ি পরিধানের স্টাইল; Image Source: RDB Music Band

পাগড়ি বাঁধার বিষয়ে যোধপুরবাসীদের জুড়ি মেলা ভার। এটা যে একটা শিল্প তা এখানে এলে আপনি বুঝতে পারবেন। পাগড়ি বেঁধে দেয়ার জন্য যোধপুরে রয়েছে অনেক পাগড়ি বিশেষজ্ঞ যাদের বলা হয় ‘পাগড়ি ব্যান্ড’। জনশ্রুতি রয়েছে, এই বিশেষজ্ঞদের পূর্বসূরীরা কোন এক সময় এই এলাকার রাজ পরিবারের সদস্য ছিলেন।

রাজস্থানে পাগড়ি বাঁধা উপলক্ষে প্রতিবছর এক বড় ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই উৎসবকে বলা হয় ‘পুষ্কর উৎসব’। এই জনপ্রিয় উৎসবে বিভিন্ন স্থান থেকে পাগড়ি বাঁধায় দক্ষ এমন প্রতিযোগীরা অংশগ্রহণ করে।

পুস্কর উৎসবে পাগড়ি বাঁধা প্রতিযোগিতা; Image Source: HOBO25 Everyday Backpack- LTP Designs

উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতেও পাগড়ি বাঁধার এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। সেই উৎসবটির নাম ‘রসম পাগড়ি’। মহীশূরের মানুষ যে পাগড়ি পরেন, সেই পাগড়ির নাম ‘মাইশোর পেতা’।

বিশ্বে বড় আকারের পাগড়ির প্রচলন রয়েছে মূলত ভারতীয়দের মধ্যে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাগড়ির রেকর্ডটাও তাই তাদেরই ঘরে। পাগড়িটি তৈরিতে ৪০০ মিটার (১৩০০ ফুট) দৈর্ঘ্যের কাপড় ব্যবহার করা হয়েছিল এবং ওজন ৩৫ ছিল কিলোগ্রাম। ভারতের উদয়পুরে ‘Bagore Ki Haveli’ মিউজিয়ামে এটি সংরক্ষিত আছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় আকারের পাগড়ী; Image Source: Home

পাগড়ি অনেক গুনী ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিশেষত্ব হয়ে আছে। এখন এক প্রবাদ পুরুষের কথা বলব যার বাহ্যিক অবয়বে পাগড়ির এক বিশেষ স্থান আছে আর তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এই নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে গেরুয়া পরিহিত, মাথায় পাগড়ি দেয়া আত্মবিশ্বাসী এক দৃঢ় পুরুষ যার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় মানবধর্মের কথা।

স্বামী বিবেকানন্দ; Image Source: Wikimedia

এভাবেই সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতায়, আবার নিজেদের সামাজিক মযার্দা প্রকাশ করার জন্য পাগড়ি ব্যবহার করে আসছেন। আর এভাবেই সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পাগড়ি।

সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা ক...

Popular Posts