Wednesday, January 30, 2019

যুক্তির আলোয় গীতা

গীতা বইটি আমি মোটামুটি পড়েছি ।  আমি শ্রদ্ধা নিয়েই বইটি পড়েছি এবং এর কাব্যিক গুণ উপভোগ করেছি। গীতা একটি অতুলনীয় গ্রন্থ বলে আমি মনে করি, তবে তা সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। গীতা মানুষের লেখা, ইহা অলৌকিকভাবে পৃথিবীতে আসেনি। গীতাকে বুঝতে হবে যুক্তির আলোয়। অন্ধভক্তি যেমন ক্ষতিকারক হতে পারে, তেমনি কেবলই সমালোচনা করার মানসিকতা নিয়ে গীতা পড়লে গীতার মর্ম্ম বুঝতে অসুবিধা হবে।
ইদানীং ফেসবুকে আমাদের বিশিষ্ট বন্ধু শ্রীমানব্রহ্মদ্বিট ঘোষ মহাশয় (নাম পরিবর্ত্তিত) আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে গীতার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ফেসবুকে তাঁর অনেক অনুগামী তার সঙ্গে সায় দিয়ে গীতাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে চলেছেন। আমি এখানে গীতা সম্বন্ধে তাঁর এবং আরও কারও কারও কতকগুলি অভিযোগ এবং সেসম্বন্ধে আমার বক্তব্য খুব সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে নক্ষত্রদের মধ্যে চন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। শ্রীমানব্রহ্মদ্বিট ঘোষ মহাশয় এর মানে করেছেন যে কৃষ্ণ এখানে চাঁদকে একটি নক্ষত্র বলে মনে করেছেন। কিন্তু চাঁদ যেহেতু নক্ষত্র নয়, একটি উপগ্রহমাত্র, সেহেতু কৃষ্ণের এই বাণী তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞানতাকে প্রকাশ করছে বলে শ্রীঘোষের মনে হয়েছে। গীতায় কৃষ্ণ, সাধককে পরমাত্মার ধ্যানে বায়ুহীন স্থানে নিষ্কম্প প্রদীপশিখার মতো অচঞ্চল থাকতে বলেছেন। কিন্তু বায়ুশূন্য স্থানে অক্সিজেনের অভাবে প্রদীপ তো জ্বলতেই পারে না, অতএব এখানেও কৃষ্ণের বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞানতা প্রকট বলে ঘোষ মহাশয় ঘোষণা করে দিয়েছেন। এছাড়া কৃষ্ণের অর্জ্জুনকে বিশ্বরূপ দেখানোর ব্যাপারটিতে এবং আরও কিছু কিছু ব্যাপারেও তার গুরুতর আপত্তি আছে। তার সমস্ত লেখাটির মধ্যে গীতার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাও নাই। তার সঙ্গে সায় দিয়ে তার বহু অনুগামী সদলবলে গীতার মুণ্ডপাত করার চেষ্টা করে চলেছেন। আমি এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়ে গীতার দর্শন সম্বন্ধে আরও কিছু কথা বলতে চাই, অবশ্যই আমার যোগ্যতা অনুযায়ী।


গীতায় চাঁদকে আদৌ নক্ষত্র বলা হয় নি। নক্ষত্রদের মধ্যে চাঁদ শোভা পায় এবং চাঁদকে তারাপতি বলে, সেই প্রসঙ্গই গীতায় উল্লিখিত হয়েছে। প্রসঙ্গত, রাশিচক্রে চাঁদের গতিপথে সাতাশ নক্ষত্র রয়েছে এবং চাঁদ রোজ এক এক নক্ষত্রে রাত কাটায়। এই জন্য চাঁদকে তারাপতি বলে। যে কেউ চাঁদের এই সাতাশ নক্ষত্রকে খালি চোখে আকাশে পর্য্যবেক্ষণ করতে পারেন। এই নক্ষত্রগুলির নাম অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা ইত্যাদি। চাঁদ কবে কোন নক্ষত্রে থাকে তা পঞ্জিকায় লেখা থাকে। ‘’ছাত্রে ভর্ত্তি ক্লাসের মধ্যে শিক্ষক প্রবেশ করলেন’’ বললে যেমন শিক্ষককে ছাত্র বলা হয় না তেমনি ‘’নক্ষত্রদের মধ্যে চাঁদ’’ বললে চাঁদকে নক্ষত্র বলা হয় না। জ্যোতির্বিজ্ঞান না জানার ফলে শ্রীঘোষ বিষয়টি ভুল বুঝেছেন।
বায়ুহীন স্থানে প্রদীপশিখার মতো পরমাত্মার ধ্যানে অচঞ্চল থাকার কথা গীতায় রয়েছে। এখানে ''বায়ুহীন'' বলতে বায়ুপ্রবাহ হীন বলেই বুঝতে হবে। বায়ুপ্রবাহে প্রদীপ শিখা নিভে যায়।‘’নিবাত-নিষ্কম্প প্রদীপশিখা’’ কথাটির প্রয়োগ বাংলায় আছে এবং এখানে নিবাত মানে বায়ুপ্রবাহহীন। অক্সিজেন ছাড়া প্রদীপশিখা জ্বলে না, কৃষ্ণ এইটুকু বিজ্ঞানও জানেন বলে অভিযোগ করলে নিজের মূর্খামিই প্রকাশিত হয়। আত্মা ও পরমাত্মার ধারণা আসে পৃথিবীতে প্রাণের প্রবাহকে বুঝে নিতে গিয়ে। আগ্রহী পাঠক এ ব্যাপারে বঙ্কিমবাবুর মনোজ্ঞ আলোচনা পড়ে নিতে পারেন।
গীতায় কৃষ্ণ বলছেন চন্দ্র ও সূর্য্য তাঁর দুই চোখ। এ'টি একটি কাব্যিক তুলনা। কিন্তু এতেও শ্রীমানব্রহ্মদ্বিট ঘোষ মহাশয়ের আপত্তি। প্রসঙ্গত, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য বলেছিলেন, ‘পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ বাস্তবে রুটি একটি খাদ্য, চাঁদ একটি উপগ্রহ এবং চাঁদ রুটির চেয়ে অনেক বড়। তবুও সুকান্ত অমন লিখেছেন। কবিদের অমন তুলনা করার দরকার হয়। শুধু বিজ্ঞান নয়, কবিতাও আমাদের দরকার। কবি সুকান্তর চাঁদকে রুটির সঙ্গে তুলনা করাটা ভাল হয়েছে না মন্দ হয়েছে সে সমালোচনা চলতেই পারে, কিন্তু কবির কথার মর্ম্মও বোঝা দরকার। প্রসঙ্গত, প্রাচীন কবিরা কাব্যপ্রতিভা ও কল্পনাশক্তিতে ন্যূন ছিলেন না।
প্রসঙ্গক্রমে আরও একটা কথা এখানে বলে রাখি। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে পঞ্চগ্রহ বলতে মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি; সপ্তগ্রহ বলতে রবি (সূর্য), সোম (চন্দ্র), মঙ্গল,বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি; নবগ্রহ বলতে রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতুকে বোঝায়। ইউরেনাস, নেপচুন প্লুটোকে খালি চোখে দেখাই যায় না। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বইয়ে ‘নয়ে নবগ্রহ’ বলতে রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতুকেই বুঝতে হবে। বিদ্যাসাগরের সময়ে নেপচুন প্লুটো ইত্যাদি আবিষ্কৃতই হয় নি। কেউ যদি বলেন যে বিদ্যাসাগর মহাশয় ‘পাঁচে পঞ্চগ্রহ’ না বলে ‘নয়ে নবগ্রহ’ বলে ভুল করেছেন তাহলে বিদ্যাসাগরের নয়, তার নিজের অজ্ঞতাই প্রকাশিত হবে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণও বলেছেন যে তার শরীরে পঞ্চগ্রহের অধিষ্ঠান। এখানে পঞ্চগ্রহ কথাটা বলায় গীতাকারের কোনো ভুল হয় নি এবং সমগ্র বিশ্বকেই কৃষ্ণের শরীর বলে ধরতে হবে। ঈশ্বর বলতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেই বুঝতে হবে, এটা গীতাকার বুঝতেন বলেই আমার মনে হয়েছে।
সূর্য্য ও চন্দ্রকে গ্রহ বলার কারণ হল ওরাও রাশিচক্রে (zodiac-এ) পশ্চিম থেকে পূর্ব্বে ঘূর্ণায়মান। আকাশে চোখ রাখলে খালি চোখেই আপনারা যে কেউ এসব দেখতে পাবেন। আজকের দিনে নিজস্ব আলোহীন এবং সূর্য্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান বৃহৎ জ্যোতিষ্কগুলিকে গ্রহ বলা হয়। আমাদের ভূগোল বইগুলিতে সূর্য্য ও চাঁদকে আর গ্রহ বলা হয় না। সেক্ষেত্রে আমরা সূর্য্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান বৃহৎ জ্যোতিষ্কগুলিকে বোঝাতে গ্রহ শব্দটির বদলে অন্য কোনো নতুন শব্দ সৃষ্টি করে নিতে পারতাম। কিন্তু তা আমরা করি নি। প্রাচীনদের সৃষ্টি করা গ্রহ শব্দটিই আমরা ব্যবহার করব এবং সূর্য্যচন্দ্রকে গ্রহ বলার জন্য তাদেরই দোষ দেব --- এমনটা করা অন্যায়। এখানে এত কথা বলছি কারণ বহু আত্মবিস্মৃত ব্যক্তি জ্যোতিষে ও পঞ্জিকায় সূর্য্যচন্দ্রকে গ্রহ বলার জন্য প্রাচীনদের তাচ্ছিল্য করে থাকেন। এরা ইতিহাস ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোনোটাই না জেনে, সরেজমিনে আকাশ না চিনে নিজেদের বিজ্ঞ ও প্রাচীনদের অজ্ঞ বলে মনে করে থাকেন। রাহু-কেতুকে গ্রহ বলার জন্য প্রাচীনদের তাচ্ছিল্য করে এরা গানও লিখেছেন (অবশ্য তাদের উদ্দেশ্য সাধু, তা হল জ্যোতিষীদের বুজরুকির বিরোধিতা করা)। এরা জানেন না যে রাহু মানে ascending node of lunar orbit এবং কেতু মানে descending node of lunar orbit। এই দুটি বিন্দু (ক্রান্তিবৃত্ত ও চন্দ্রকক্ষের দুই ছেদবিন্দু) সূর্য্য ও চন্দ্রের বিপরীতে প্রতি ১৮ বছরে রাশিচক্রে এক পাক খায়। রাহকেতুর সাহায্য নিয়ে সূর্য্য ও চন্দ্রগ্রহণের সঠিক ভবিষ্যতবাণী প্রাচীনেরা করতে পারতেন যা আজকের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকেরাও পারেন না।
এবার আসি কৃষ্ণ কর্তৃক অর্জ্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শন করানোর প্রসঙ্গে। গীতার এই অধ্যায়টি কাব্যিক সৌন্দর্য্যে অসাধারণ। এর সঙ্গে তুলনীয় উৎকৃষ্ট মানের কবিতার উদাহরণ আমার আর একটিও জানা নাই। এই বিশ্বরূপ দর্শন হল মনোজগতে বিশ্বতত্ত্বকে উপলব্ধি করার একটি রূপক। ভাষার আলোতেও বিশ্বরূপ দর্শন সম্ভব। শব্দব্রহ্মের উপলব্ধিই ব্যাকরণবিদের বিশ্বরূপ দর্শন তথা মোক্ষলাভ। আমার ''বর্ণসঙ্গীত'' গ্রন্থে বিষয়টি বিস্তারিত বলা হয়েছে। সেখানে বর্ণমালার আলোয় পুরাণাদি উদ্ভাসিত করে ভারতের ইতিহাসকে দেখানো হয়েছে এবং এক অখণ্ড বিশ্ববীক্ষার সন্ধান দেওয়া হয়েছে। আপনারা যে কেউ বিশ্বরূপ দর্শন করতে চাইলে বর্ণমালার জপ করে দেখতে পারেন। মৎপ্রণীত 'বর্ণসঙ্গীত' গ্রন্থে এই ব্যাপারে বলা হয়েছে যে,''বর্ণমালার জপ কর যদি শীঘ্র মোক্ষ পাবে।'' প্রসঙ্গত, অক্ষর শব্দের একটি অর্থ হল পরমব্রহ্ম। অক্ষর পরিচয় হলে (বর্ণমালার প্রতিবর্ণের অর্থ বুঝলে) ব্রহ্মজ্ঞান হয়।
অনেকে গীতাকে বর্ণাশ্রম প্রথার ধারক ও বাহক বলে মনে করেন। গীতায় গুণ অনুযায়ী বর্ণবিভাজন বা কর্ম্মবিভাগের কথা আছে। বর্ণবিভাজন (division of labor) ভালই, কিন্তু জন্মসূত্রে বর্ণ বিভাজন মোটেই কাম্য নয়। গীতা জন্মসূত্রে বর্ণবিভাজনকে সমর্থন করেছে বলে তো আমার মনে হয় নি। গীতার মতে যেকোনো বর্ণের মানুষই কৃষ্ণকে জানতে বা ঈশ্বর লাভ করতে পারেন। সে ব্যাপারে বাধা নাই। গীতায় কৃষ্ণের পদ থেকে শূদ্রের ও মুখ থেকে ব্রাহ্মণের জন্মের ব্য়াখ্যা আছে। এখানে মুখ মানে mouth এবং পদ মানে leg বুঝলে চলবে না (মানুষের মুখ থেকে বা পদ থেকে মানুষ জন্মায় না)। পদ মানে যা পালন (প) দান (দ) করে, মুখ মানে মুখ্য অংশ --- এইভাবে ভাবুন। আর কৃষ্ণ বলতে সমাজশরীরকে বুঝতে হবে। তাহলে শূদ্ররা সমাজকে গতি দেয়, চলনা করে। ব্রাহ্মণরা বুদ্ধি দেয়। আমরা গীতাকে বুঝলে গীতাকে কাজে লাগিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আমাদের শোষণ করতে পারবে না। ব্রাহ্মণ, শূদ্র, মুসলমান, খ্রীষ্টান --- যে কেউ গীতা পড়তে পারেন। স্ত্রী এবং শূদ্ররাও গীতা পড়ে পরাগতি লাভ করতে পারেন বলে গীতায় বলা হয়েছে। তাদের ছোটো করার জন্য এমন বলা হয়েছে বলে তো আমার মনে হয়নি। আমি চাই জাতপাত নিপাত যাক। জন্মসূত্রে বর্ণবিভাজন দুর হলেও সনাতন হিন্দুধর্ম্মের অনেক কিছুই অবশিষ্ট থাকে। কেউ যদি মনে করেন যে গীতা জন্মসূত্রে বর্ণবিভাজনকে সমর্থন করছে, তবে গীতার ওই অংশটি তাকে মানতে হবে না । মন্দকে মন্দ বললে তাতে দোষ দেখি না। আমাদের উচিৎ হবে পূর্ব্বসূরীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আরও এগিয়ে যাওয়া।
গীতায় কৃষ্ণ অর্জ্জুনকে যুদ্ধে প্ররোচনা দিয়েছেন বলেও কেউ কেউ অভিযোগ করতে পারেন। সে অভিযোগ চলতেই পারে। একইভাবে মার্কসের শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বটির বিরদ্ধেও অনেকে অভিযোগ করেছেন এবং সে অভিযোগ অসঙ্গত কিছু নয়। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আমরা অনেকেই মানতে পারি না। তবু এখানে গীতাকারের বক্তব্যটাও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সেটা হল অপশাসনের অবসান ঘটাতেই হবে, এজন্য সব রকম মোহ পরিত্যাগ করা ও পুরুষকার অবলম্বন করা দরকার। বিবেকানন্দ বলেন, ''গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের অধিকতর নিকটবর্ত্তী হইবে।'' কিন্তু তার পরের লাইনটা অনেকেই জানেন না। সেটা হল, ''কারণ ফুটবল খেলিয়া দেহমন শক্তপোক্ত হইলে তোমরা গীতার অর্থ সহজে বুঝিবে।'' এইভাবে ফুটবল খেলে দেহমন শক্তপোক্ত করে গীতার অর্থ বুঝে মোক্ষ লাভ করা যাবে, এই হল বিবেকানন্দের বক্তব্য। এখানে বলে রাখি বিবেকানন্দ রচনাবলী এখন হাতে না থাকায় বিবেকানন্দের ঐ লাইন দুটি এখানে ঠিক ঠিক ভাবে উদ্ধৃত করা গেল না। আপনারা কেউ সংশোধন করে দিলে ভাল হয়। তবে বিবেকানন্দের বক্তব্যটা এইরকমই বটে । গীতায় কৃষ্ণও বলতে চাইছেন যে নির্বীর্য্য ও দুর্বল হলে আমাদের চলবে না।
এখানে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখতে চাই। সেটা হল গীতার কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন ঐতিহাসিক ব্যক্তিবিশেষ নন এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটাও কোনো ঐতিহাসিক যুদ্ধবিশেষ নয়। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণাদিতে ব্যক্তি চরিত্রগুলি নয়, তাদের ক্রিয়াগুলিই প্রধান। কৌরবদের পরাজয় আর পাণ্ডবদের জয় মানে এক শাসন ব্যব্যস্থা গিয়ে আর এক শাসনব্যবস্থা আসার কাহিনী। কৌরবরা ছিল প্রাচীনপন্থী এবং সেতুলনায় পাণ্ডবরা ছিল উদীয়মান (এবং ফলত পাণ্ডুর) ধনতন্ত্রের প্রতিভু। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়, যেসব অন্ধ আইন রাষ্ট্রকে ধরে রাখে ধৃতরাষ্ট্র বলতে সেগুলিকেই বুঝতে হবে। অর্জ্জুন মানে যে শুক্ল ধন অর্জ্জন করে, তাকে ধনঞ্জয়ও (ধন জয় করে যে) বলে। দুঃশাসেনর রক্তপান মানে অপশাসনের শক্তি শোষণ করা, blood drink করা নয়। মহাভারত ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় লিখিত ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস যার কিছু কিছু ব্যাখ্যা আমরা ফেসবুকের ‘’বঙ্গযান’’ পেজে দিয়েছি। কৃষ্ণ বিষ্ণুর অবতার। বিষ্ণু বলতে নগদ নারায়ণকে বুঝতে হবে। আসলে বিষ্ণুর দশাবতার পুঁজির দশবিধ রূপ। দশাবতারের কাহিনীতে আছে ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের ইতিহাস। দশাবতারের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা থাকতেই পারে, কিন্তু এর অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাটাও বুঝে নেওয়া দরকার।
আমি শ্রীমানব্রহ্মদ্বিট ঘোষ মহাশয়ের গীতা সমালোচনাকে বালখিল্য আচরণ বলে উড়িয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু ফেসবুকে তার অনেক অনুগামী এবং তাদের মধ্যে প্রথাগত শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত বহু ব্যক্তি রয়েছেন যারা এই ধরণের সমালোচনাকে বাহবা দিচ্ছেন এবং ভুলগুলি ধরে দিতে গেলে ফোঁস করে উঠছেন। এজন্য আমাকে এখানে বিষয়টি কিঞ্চিত ব্যাখ্যা করতে হল। গীতার সমালোচনা চলতেই পারে। কিন্তু ভাল করে না বুঝে এবং মনে মনে শ্রদ্ধা না নিয়ে গীতার বা আর কোনো ধর্ম্মগ্রন্থের এই ধরণের সমালোচনা করতে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
গীতা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিদেশেও বহু মানুষ গীতা পড়েন। ইহা একটি দর্শনের বই যা পৃথিবীর সবাই পড়তে পারেন এবং তার রস আস্বাদন করতে পারেন।
যেসব আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী পাঠক গীতার মর্ম্ম বুঝতে চান তারা শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের লেখা গীতার টীকা পড়তে পারেন। অন্ধভক্তি নয়, আধুনিক পাঠকের উপযুক্ত যুক্তি দিয়েই সাহিত্যসম্রাট গীতার ব্যাখ্যা করেছেন। এখন আপনাদের মতামত কাম্য।

সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা ক...

Popular Posts