শৈববাদ সনাতন ধর্মের সব থেকে পুরোনো একটি শাখা যা তিন হাজার বছরেরও বেশী ইতিহাস বহন করে আসছে। মূলত প্রাচীন দক্ষিণ ভারতের শৈববাদের উত্থান। বৈদিক যুগের মূল ধারাই ছিল শৈববাদ। যা মূলত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ(যজুর্বেদের অন্তর্গত) থেকে অনুপ্রাণিত। এই দক্ষিণাত্য থেকে প্রভু পরমেশ্বর মহাদেবের অনেক ভক্ত এসেছেন। বিশেষ করে তামিল ধারার আচার্য্যগণ শৈববাদে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তার শুধু শৈববাদকেই নয় সনাতন ধর্মেরও উন্নতি সাধন করেছেন।
তারা উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ধর্মহীন সাধারণ মানবদের উনারা নির্বাণ লাভের পথে আনয়নের জন্য তাদের ভেতরকার আধ্যাত্মিক চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করেন। উনারা জৈন এবং বৌদ্ধধর্ম থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করেছেন। তখনকার সমাজের উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারা থেকে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদেরকে শৈববাদে এনে ধর্মান্তর হওয়া রোধ করেছেন। তারা সম্পূর্ণ নতুন ধারার ধর্মীয় দর্শন এর ভিত্তি স্থাপন করেন। যা সম্পূর্ণ উচ্চ মার্গের দর্শন এবং ভক্তিবাদ দ্বারা পরিভাষিত হয়। ভারতের অন্যান্য ঘটনাগুলোর মতই এসকল শৈবদের সম্পর্কে তথ্য খুব কম সংগৃহীত রয়েছে।আমরা সকলেই মহান ঋষি অগস্ত্য, কান্নয়াইর, কাহ্নপা সম্পর্কে অবগত আছি। ঋগবেদ বা বৈদিক যুগের পূর্ব থেকে তার পরবর্তী যুগেও তাদের বাস ছিল। এসকল ঋষিরা শৈব পন্থা এবং সনাতন ধর্মের শাস্ত্রের জন্য উজ্জ্বল নিদর্শন তৈরি করেছেন।
কাহ্নপাঃ
এই তিনের মধ্যে এখানে আমরা কাহ্নপা সম্পর্কে বলবো যিনি বর্তমানে অন্ধ্র প্রদেশের অন্তর্গত কালোহস্তি নামক স্থানে বসবাস করতেন। তিনি পেশায় শিকারী এবং প্রভু শিবের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।
তিনি প্রত্যহ শ্রদ্ধা এবং ভক্তির সহিত শিবের পূজা করতেন। তিনি পূজাতে মাঝেমধ্যে ফুল এবং কখনো কখনও মাংস উৎসর্গ করতেন। তিনি শিবের তীব্র ভক্তিতে আচ্ছন্ন থাকতেন, একদিন তিনি তার এক চোখ উৎপাটন করে শিবকে উৎসর্গ করার পর অপর চোখ উৎপাটন করতে গেলে পরমেশ্বর শিব সেখানে তার সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে তাকে এই কৃত্যে অগ্রসর হতে বাধা দেন।
তীরুমাল্লারঃ
তীরুমাল্লার হলেন শৈবদের মধ্যে একজন উজ্জ্বল পাথেয়।তিনি ৬ষ্ঠ শতাব্দীর সমসাময়িক সময় পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তিনি আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী ছিলেন এবং ৩০০০ হাজারের মতো কবিতা রচনা করেন।
মাণিক্যবাচকঃ
প্রাচীন চার জন আচার্য্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি সৎ মার্গ তথা সত্যের পথ এর পথ প্রদর্শন করেন। বাল্যকাল থেকেই তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে আসছিলেন । তিনি গৃহত্যাগের পূর্বে পান্ডা রাজ্যের বিচারকার্যে প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। তার কাব্যিক ক্ষমতার প্রতিভার কারণে তার নাম হয় মানিক্ককবচ অর্থাৎ, যার কথায় মুক্তা ঝড়ে। তিনি পরমেশ্বর শিবের উদ্দ্যেশে অসংখ্য গান রচনা করেন। তাঁর রচিত তিরুকবচম্ শৈব পন্থার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
আপ্পারঃ
জনন সম্বন্ধঃ
সুন্দরমূর্তিঃ
আম্মাইয়ার(কারিক্কল):
তার ভক্তি উত্তর ভারতের মীরাবাঈয়ের সমতুল্য।ইনি একটি ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং খুব অল্প বয়সেই ধন্যাঢ্য ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেন। ধর্মের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা পরিলক্ষিত হওয়ায় তার স্বামী অন্য একটি মেয়েকে বিবাহ করেন। বাল্যকাল থেকে যেহেতু তিনি শিবের ভক্ত ছিলেন তাই তিনি তার স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং টানকে অস্বীকার করতে পারেন নি। পরবর্তীতে উনি যখন দেখলেন উনার স্বামী অন্য নারীর প্রতি অনুরক্ত তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার সারা জীবন প্রভু শিবের উদ্দ্যেশে উৎসর্গ করেন। উনি অনেক কবিতা রচনা করেন যা অনেক আধ্যাত্মিক ভাবপূর্ণ।
আউবাঈঃ
মেইপ্পরুল নায়ানারঃ
দাক্ষিণাত্যের একজন রাজা যিনি শৈব ধারার প্রচার্থে বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং শৈববাদ প্রচারের জন্য অনেক অবদান রেখেছেন।
শাক্য নায়ানারঃ
তিনি প্রকৃত অবস্থায় বৌদ্ধধর্মালম্বী ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি শৈবমত সাদরে গ্রহণ করেন এবং কথিত আছে তিনি শেষ জীবনে মহেশ্বর এবং পার্বতীর দর্শন ও অনুগ্রহ লাভ করেন।
নন্দনারঃ
জন্মের পর থেকেই তিনি ভগবান শিবের প্রতি সমর্পিত ছিলেন। পরিণত বয়সে তিনি শাস্ত্রজ্ঞানে চর্চার জন্য পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিলেন এবং দক্ষিণের বিখ্যাত চিদাম্বরম মন্দিরে পূজারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।তখনকার যুগে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশাধিকারে অনেক বিচার বিবেচনা করা হত। তিনি পূজারী হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর নিম্ন বর্ণের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করেছেন।
মেকান্দারঃ
তিন বছর বয়সে শৈব মন্ত্রে দীক্ষা নেন। বিখ্যাত শিবজনবোধম উনার সৃষ্টি। তিনি সেখানে বারোটি সূক্ত রচনা করেন যা জগৎ বিখ্যাত।মেকান্দার শৈববাদের ইতিহাসে একটি জ্বাজল্যমান নক্ষত্রের ন্যায়। উনার সম্পূর্ণ জীবন ছিল জ্ঞান, অসাধারণ শাস্ত্র বিদ্যা এবং ভক্তিতে পূর্ণ।
অরুন্দার শিবাচার্য্যঃ
তিনি মেকান্দারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর পরমেশ্বরের সাক্ষাত তথা ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝতে পারেন। ফলে তিনি গুরুর নির্দেশে শিব-জনন-সিত্তিয়ার রচনা করেন।
মারাই জনন সাম্বান্দারঃ
অরুনদার শিবাচার্য্য মারাই জনন সাম্বান্দারকে শৈবধারাতে প্রেরিত করার কারণেও সুপরিচিত। যদিও তিনি নিম্নবর্ণের তথাপি তার মেধা শৈব সাহিত্য ও ভক্তি মার্গে অনস্বীকার্য।
উমাপতি শিবমঃ
মারাই জনন সামবান্দার আরেকজন বিখ্যাত শৈব সাধুর পথপ্রদর্শক যার নাম উমাপতি শিবম। তামিল শৈব সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি শৈবিক ধারার আটটি দার্শনিক নিবন্ধ রচনা করেন।
পতিনত্থরঃ
জন্মাবধী তিনি ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি কোন এক অজানা অলৌকিক কারণে অধ্যাত্মবাদের দিকে ঝুকে পরেন।উনি পরম সত্য পরবর্তীতে উপলব্ধি করতে পারেন যে মৃত্যুর পর ধন কেউই প্রাপ্ত হন না।উনি উনার আরেক বন্ধু ভদ্রগিরিকে নিয়ে বহু আধ্যত্মিক কবিতা কাব্য রচনা করেন এবং বহু মানবকে পরমেশ্বর শিবের সত্য ও সুন্দরের রাস্তায় নিয়ে আসেন। উনি দশম শতাব্দী পর্যন্ত তামিলনাড়ুতে জীবিত ছিলেন।
অরুণাগিরিঃ
পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি প্রচুর বিলাসী জীবনযাপন করেছেন। হেন কোন পাপ কাজ নেই যে তিনি করেন নি। কিন্তু পরবর্তীতে উনার ভুল বুজতে পারেন এবং শিবের অনুগ্রহে ভগবান ম্রুজ্ঞানের উপাসনায় নিজেকে নিযুক্ত করেন। তীরুপুজ্ঞাল তার এমন একটি বিখ্যাত রচনা যার মধ্য দিয়ে তার ভক্তির ভাব ও গভীরতা পরিভাসিত হয়।
তয়ুমনোবরঃ
সতের শতাব্দীতে তিনি জীবিত ছিলেন । তামিলনাড়ুর বিখ্যত বিদ্যারণ্য শিব মন্দিরের পুরোহিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।উনার শৈবজীবনধারায় প্রবেশের পূর্বে তিরুচিনাপল্লী নামক স্থানীয় আদালতের নায়েকের অধিনস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শৈবধারার দর্শনকে বেদান্তের আলোকে প্রচার করে শৈববাদ নিয়ে উপস্থিত বিতর্কের অবসান ঘটান।
লিঙ্গায়ত সন্ন্যাসীঃ
লিঙ্গায়ত সম্প্রদায় মূলত বীরা শৈব সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। ছারজন বিখ্যাত লিঙ্গায়ত সাধুর নামশিবপ্রকাশ(১),শান্ত লিঙ্গা,কুমার দেব,শিবপ্রকাশ(২)। এরা সকলেই অসংখ্য আধ্যাত্মিক গান ও কাব্য রচনা করে গেছেন।