মহাভারতকে অনেক সময় হোমারের লেখা ইলিয়ড ও ওডিসের মত ফিকশন বলা হয়, কিন্তু বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য ও তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মহাভারত ও তার সময়কালের সপক্ষে জোড়ালো যুক্তি পাওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্ব মিথ্যা বলে না, তবে interpretation ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে ।
১৯৫২ সালে প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ বি বি লাল ইন্দ্রপ্রস্থ ও হস্তিনাপুরের খননকার্য করে বেশ কিছু তত্ত্ব আমাদের সামনে উপস্থাপনা করেন। এই সময় হস্তিনাপুর, কুরুক্ষেত্র, মথুরা, পানিপথ, তিলাপাত, বাগপাত, বৈরাত…এসমস্ত অঞ্চলে বেশ কিছু painted Grey wire pottery এর নিদর্শন তিনি পান, যার সময়কাল সি ১৪ কার্বন ডেটিং অনুযায়ী ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ। যা যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় এটি একটা কৃষি ও পশুপালন নির্ভর জনবসতি ছিল।
বি বি লাল।
মৎস ও বায়ু পুরান অনুযায়ী রাজা নিচাক্সু যিনি রাজা পরীক্ষিতের( অভিমন্যুর পুত্র ও অর্জুনের পৌত্র) পঞ্চম বংশধর, তাঁর সময় এক ভয়ঙ্কর বন্যা হয় হস্তিনাপুরে। ফলে জনবসতি হস্তিনাপুর পরিত্যাগ করে কৌশাম্বীতে(এলাহাবাদ/প্রয়াগরাজ) পলায়ন করে। সত্যি সত্যিই হস্তিনাপুরের খননকার্যের এক ভয়ঙ্কর সর্বগ্ৰাসী বন্যার নিদর্শন পাওয়া যায় যা মৎস ও বায়ু পুরানের বর্নিত বন্যার সত্যতা যাচাই করে।
আজকের দিল্লির পুরানা কিলা যা আফগান শাসক ও শূর বংশের প্রতিষ্ঠাতা শের শাহ শূরীর সময় তৈরি হয়, কথিত আছে সেইখানেই ছিল পান্ডবদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ। শুধু কি কথিত? সামস সিরাজ আলফির রচিত তারিখ ই ফিরোজশাহি তে ইন্দ্রপ্রস্থের উল্লেখ আছে, এই শহরকে একটি পরগনার মূল প্রশাসনিক ভবন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পশ্চিম দিল্লির নারায়না গ্ৰামের থেকে পাওয়া ১৪০০ শতাব্দীর সময়কালীন লিপিতে ইন্দ্রপ্রস্থের উল্লেখ আছে। এছাড়াও ১৬০০ শতাব্দীতে আকবরের সময়ে আবুল ফজলের লেখা আইন ই আকবরীতে লেখা আছে যেখানে এখন হুমায়ুনের দূর্গ আছে, সেখানে একসময় ইন্দ্রপ্রস্থ নামে একটি নগরী ছিল যা পান্ডবদের রাজধানী ছিল। এই ১৯০০ শতাব্দী পর্যন্ত পুরানা কিলার ভেতরে ইন্দ্রপাত বলে একটা ছোট্ট গ্ৰাম ছিল, এখন যার অস্তিত্ব নেই। এই পুরানা কিলা অঞ্চলে খননকার্য চালিয়ে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে যার বয়স প্রায় চারশত খ্রীষ্টপূর্বাব্দ।
বি বি লালের এই সময়কালকে সম্পূর্ণ নসাৎ করছে খুব সাম্প্রতিককালের একটি খননকার্য যা প্রত্নতত্ত্ববিদ সঞ্জয় মঞ্জুলের নেতৃত্বে হয়েছে। ২০১৯ অক্টোবর মাসে ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী এই নতুন খননকার্য দিল্লি থেকে ৬৮ কিলোমিটার দূরে সানাউলি নামের একটি জায়গায় করা হয়। এখানে একটি ঘোড়ায় টানা রথ পাওয়া গেছে, এছাড়া ochre coloured pottery, যুদ্ধের বর্ম, মশাল এবং তলোয়ার পাওয়া গেছে। এগুলোর এক্স রে পরীক্ষা, ত্রিমাত্রিক স্ক্যানিং, photogrammetry, GPR survey ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয়েছে নিদর্শনগুলোর সময়কাল সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য। তাতে যে সময়কাল উঠে আসছে তা চমকে দেওয়ার মত। নিদর্শনগুলো ১৫০০ থেকে ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পুরোনো, অর্থাৎ সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতার সমসাময়িক!
সানাউলির প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য।
যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তার মধ্যে ঘোড়ার লাগাম রয়েছে, রথের চাকা ও তাম্রনির্মিত ত্রিভুজাকৃতি বস্তু পাওয়া গেছে। সঞ্জয় মঞ্জুলের কথা অনুযায়ী এটা ঋকবৈদিক যুগ ও পরবর্তী যুগের সভ্যতার একটা মিসিং লিঙ্ক। হস্থিনাপুরের যে বন্যার কথা বললাম, বি বি লালের মতামত অনুযায়ী তা প্রায় ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের ঘটনা। এই বন্যার কবলে থেকে পালিয়ে কুরুবংশের বাকিরা কৌশাম্বীতে তাদের রাজধানী স্থাপনা করে, শুরু হয় ভাৎসা বা ভামসা রাজবংশের। এই বংশের রাজা উদয়ন ভগবান বুদ্ধের সমসাময়িক (৫৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। ইনি কুরুবংশের উনিশতম উত্তরাধিকারী। ভাসার লেখা স্বপ্নবাসবদত্তা নাটকে এনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
সঞ্জয় মঞ্জুল কুরু বংশের ক্রোনোলজি ঘেঁটে একটা তত্ত্ব দিয়েছেন। তাঁর কথায় প্রতিপা থেকে ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু, যুধিষ্ঠিরা হয়ে একেবারে কুরুবংশের ৩৬ তম উত্তরাধিকারী খেমাকা(তিনি ইরামিত্রর সন্তান) পর্যন্ত প্রতি রাজাকে পঞ্চাশ বছর করে সময় দিলেও মহাভারতের যুদ্ধের একটা মোটামুটি সময় পাওয়া যায় যা ১৭৫০ খ্রীষ্টপূর্বে গিয়ে দাঁড়াবে।
দ্বারিকার খননকার্য:- ভারতে সমুদ্র প্রত্নতত্ত্বের পথপ্রদর্শক এস আর রাও এর দ্বারিকা খননকার্য মহাভারতে সত্যতার পক্ষ সবথেকে বড় প্রমান। এস আর রাও লিখছেন:
"The discovery of the legendary city of Dwaraka which is said to have been founded by Sri Krishna, is an important landmark in the history of India. It has set to rest the doubts expressed by historians about the historicity of Mahabharata and the very existence of Dwaraka city. It has greatly narrowed the gap in Indian history by establishing the continuity of the Indian civilization from the Vedic Age to the present day."
এস আর রাও।
দ্বারিকা নগরীর থেকে উপবৃত্তীয়, ত্রিভুজাকৃতি, চতুর্ভুজাকৃতি বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া যায় যা সমুদ্রের তলদেশের ৬ মিটার গভীরে অবস্থিত। এছাড়া এই গভীরতায় প্রস্তর নির্মিত বেশ কিছু জাহাজের নোঙর পাওয়া গেছে যা দ্বারিকা নগরীর প্রাচীন ও সমৃদ্ধ সমুদ্রবন্দর হওয়াকেই ইঙ্গিত করছে। এই অঞ্চলে খননকার্যে যেমন underwater photography র ব্যবহার হয়েছে, তেমনি ৭৫ মাইক্রন পলিওস্টার ফিল্মের উপড় ড্রয়িং এর সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চলে গোমতী নদীর ধারায় গভীরতা বজায় রাখবার জন্য সরকার কর্তৃক নিয়মিত ড্রেজিং হয়, তাই এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির ওপড় sediment পড়ে গিয়েছিল, ফলে পরিস্কার করতে ব্রাশের ব্যবহার করতে হয়।
প্রাচীন দ্বারিকা নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
কি কি পাওয়া গেছে দ্বারিকায় সমুদ্রগর্ভ থেকে?
বালি পাথরের তৈরি প্রাচীন দুর্গের দেওয়াল, স্তম্ভ, ত্রিভুজাকৃতি নির্মাণের অংশ, পতাকা গাঁথার জন্য ব্যবহার হওয়া প্রস্থরনির্মিত ফ্ল্যাগপোস্ট। কিছু সীল ও কিছু লিপি পাওয়া গেছে যা ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব পুরাতন, কিছু pottery পাওয়া গেছে যার কার্বন ডেটিং করে জানা যাচ্ছে এগুলো ৩৫২৮ খ্রীষ্টপূর্ব পুরাতন। এস আর রাও কে যখন এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তিনি মজা করে বলেন কেবল শ্রীকৃষ্ণের নাম লেখা সাইনবোর্ড পাওয়া যায় নি।
প্রাচীন দ্বারিকা নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
স্যার এস আর রাও ২০০০ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রকের কাছে স্থানটিকে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান বলে ঘোষনা করার আবেদন জানান, ও জায়গাটিকে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ভ্রমনস্থান ও তীর্থক্ষেত্রে পরিণত করার আবেদন জানান। প্রস্তাবিত সম্পূর্ণ প্রজেক্টের খরচ ছিল ১৪ কোটি টাকা। সরকার খরচের ভয়ে আর উদ্যোগ নেয়নি।
এস আর রাও বলছেন:
" The fort walls of the first town of Dawarka said to have been founded at kurusthali in Bet Dwarka island have been traced onshore and in the sea and also dated by thermoluminescence dating method to 16th century B C".
১৯৭৯-১৯৮০ র সময়ে প্রথম দ্বারিকাধীশ মন্দিরের কাছে খনন শুরু হয়। এই সময় প্রথম এখান থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও pottery পাওয়া যা এই অঞ্চলে প্রায় নয় হাজার বছর আগে সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাওয়া নগরীর ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। পরে ১৯৮৮ সালে আবার খনন হয়। এর কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল…সমুদ্রনারায়ন মন্দির পর্যন্ত একটা বিস্তীর্ণ এলাকায় খোঁজ চালানো হয় প্রাচীন প্রস্তর নির্মিত নগর দুর্গের প্রাচীরের সন্ধান পাওয়া জন্য। এছাড়াও ঠিক কি কারনে এতবড় একটা নগরী সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গেল তাঁর কারণ জানা ও মহাভারতের হরিবংশ যাতে দ্বারিকা নগরীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিস্তারিত বর্ননা পর্যন্ত দেওয়া আছে তার সপক্ষে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় কিনা সেই চেষ্টা করা।
এস আর রাও দ্বারিকা নগরী সম্পর্কে বলছেন:
" There were two fortification walls. One in the lower terrace and another in the middle terrace. The walls which are extended over a length of 4 km on the eastern shore are mostly destroyed by sea action. The walls of the lower terrace are of massive dressed sand stone blocks while that of the upper terrace are of rubble. The houses and other public buildings, built of smaller size stones within the enclosure are all destroyed and levelled up by the encroachment of the sea. These structures lie in a depth of 7 to 19 meters, below the present mean sea level, during the last 5000 years".
মূল দ্বারিকা নগরী ৬ টি ব্লকের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দুটি ব্লক ডানদিকে ও চারটি ব্লক বামদিকে। ছটা সেক্টরই বালিপাথর নির্মিত প্রাচীর দ্বারা ঘেরা। এছাড়া জাহাজের নোঙরের উপস্থিতি দ্বারিকা নগরীর সমুদ্র বাণিজ্যের দিকে ইঙ্গিত করে। হরিবংশে দ্বারিকাকে বারো যোজন জুড়ে বিস্তৃত নগরী বলা হয়েছে। বর্তমান খননকার্যের ফলে পাওয়া দ্বারিকা নগরী অনেকটাই ওই মাপের। এখানে প্রস্তরে খোদাই করা বিষ্ণুমুর্তি পাওয়া গেছে ও একরকমের সীল পাওয়া গেছে। হরিবংশে বলা আছে প্রাচীন দ্বারিকা নগরীর নাগরিকেরা একরকম সীল ব্যবহার করত, খননকার্যের ফলে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক সীল অনেকটাই এই বর্নিত সীলের মত।
এই সেই সীল যা দ্বারিকা নগরীর সমুদ্রগর্ভ থেকে পাওয়া যায়।
শ্রী কোটাভেঙ্কাটাচালামের লেখা Age of Mahabharata বইতে চারটি প্রাচীন লিপির কথা উল্লেখ আছে।
প্রথম লিপিতে বলা হচ্ছে মহারাজ পরীক্ষিতের মৃত্যুর ( ৩০৪১ খ্রীষ্টপূর্ব) পর রাজা হন জনমেজয়া। ৩০১৩-৩০১৪ খ্রীষ্টপুর্বে এক পূর্ণ কৃষ্ণপক্ষের দিনে তিনি দুটি গ্ৰাম ও দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দান করছেন রামসীতার পূজোর পর।
দ্বিতীয় লিপি একটি তাম্রলিপি যা কেদারনাথ মন্দিরের কাছাকাছি হিমালয়ের থেকে পাওয়া গেছে, সেখানেও কেদারনাথ স্বামীর পূজোর পর রাজা জনমেজয়া দান করছেন এরকম উল্লেখ আছে।
তৃতীয় লিপিটি অবশ্য তত প্রাচীন নয়। ৬৩৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী আমলে একটি শিব মন্দিরের গায়ে এই লিপি পাওয়া যাতে মহাভারতের পরবর্তী রাজাদের উল্লেখ আছে। মন্দিরটি ধারোয়াড় জেলায় অবস্থিত।
চতুর্থ লিপিটি খ্রীষ্টপূর্ব ৪৭৭-৪৭৬ বছরের পুরনো। রাজা সুধন্যের উল্লেখ আছে এতে। রাজা সুধন্য কুরুবংশের বংশধর যিনি গুজরাট অঞ্চলে শাসন করতেন।
কিছু যৌক্তিক তর্ক….
১. প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে 'পুরান' ও 'ইতিহাসা'…এই দুটি শব্দ বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 'পুরান' অর্থে প্রাচীন ইতিহাস ও 'ইতিহাসা' অর্থে সাম্প্রতিক ইতিহাস। মহাভারত একটি 'ইতিহাসা'। যদি কোনো ফিকশন লিখতেই হতো তবে ব্যাসদেব 'কাব্য' বা 'কথা'..এই টার্মটি ইউজ করতে পারতেন।
২. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রভু শ্রীকৃষ্ণের ১৩৮ তম প্রজন্ম, আমি বলছি না…স্বয়ং মেগাস্থিনিস বলে গেছেন তাঁর ইন্ডিকা গ্ৰন্থে।
৩. আদিপর্বে ঋষি মনু থেকে শুরু করে ৫০ টি রাজবংশের পরপর উল্লেখ আছে। 'কাব্য'/ফিকশন লিখতে হলে এত বিস্তারিত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার প্রয়োজন থাকে না..ইত্যাদি।
কাজেই যুক্তি আছে, তাঁর খন্ডনও আছে, কিন্তু এত বড় একটা সাহিত্যিক ঐশ্বর্যকে স্রেফ ওয়ার্ক অফ ফিকশন বলে দেগে দেওয়াটা ঠিক নয়।
footnote:
https://m.economictimes.com/news/politics-and-nation/mahabharata-much-older-say-asi-archaeologists/amp_articleshow/71658119.cms
http://mahabharathascience.blogspot.com/p/material-evidence-supporting-time-of.html?m=1