ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে মাধ্বাচার্য (১২৩৮–১৩১৭ খ্রি.) দ্বৈত দর্শনের প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত। তিনি তাঁর মতবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য, ভাস্করাচার্য প্রমুখ মাধ্ব-পূর্ব ভাষ্যকারদের তীব্র সমালোচনা করেন। তবে এই সমালোচনা শুধু দর্শনীয় পর্যায়েই সীমিত থাকেনি; তাঁদেরকে প্রকাশ্যে দৈত্য/অসুর আখ্যা দিয়ে এবং তাঁদের রচনাকে কু-ভাষ্য বলে দানবীকরণ করেছেন। পরবর্তীকালে মাধ্ব অনুসারী পণ্ডিতরাও একই রীতি বজায় রেখেছেন।
মহাভারত তাৎপর্য নির্ণয়
মাধ্বাচার্য তাঁর মহাভারত তাত্পর্য নির্ণয় গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—দ্বাপর যুগে ভীম সৌগন্ধিক বনে মনিমান প্রভৃতি দৈত্যকে হত্যা করেছিলেন। এরা ছিল প্রবল শক্তিশালী ও ক্রোধবশ দানব। পরে এরা কলি যুগে পুনর্জন্ম নিয়ে মিথ্যা দর্শন প্রচার করে, যার মধ্যে অদ্বৈত দর্শনও অন্তর্ভুক্ত। মাধ্বের মতে, ভ্রান্ত মত প্রচারকারীরা মৃত্যুর পর অন্ধতমস নামে নরকে পতিত হয়।
অন্যত্র তিনি উল্লেখ করেন—কিছু লোক প্রচার করেছিল, “জগৎ মিথ্যা, ঈশ্বর নেই; আমি সিদ্ধ, আমি ঈশ্বর।” ভীম তাঁদের বিতর্কে পরাস্ত করেন এবং হত্যা করেন এই ঘোষণা দিয়ে—“বিষ্ণুই সর্বোচ্চ।”
ভাগবত তাৎপর্য নির্ণয়
এখানে মাধ্বাচার্য একটি পুরাণ উদ্ধৃত করেছেন—যারা “অহং ব্রহ্মাস্মি” মত প্রচার করে, তারা আসলে অসুর ও রাক্ষস। তারা কলি যুগে ফিরে এসে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। এই দলের প্রধান হিসেবে মনিমানকে উল্লেখ করা হয়েছে। ইঙ্গিত করা হয়েছে, শঙ্কর, রামানুজ প্রমুখ মাধ্ব-পূর্ব ভাষ্যকাররাও এই অসুরদলের অন্তর্ভুক্ত।
মাধ্ব বিজয়
নারায়ণ পণ্ডিতের মাধ্ব বিজয় গ্রন্থে বলা হয়েছে, মাধ্ব-পূর্ব সব ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য কু-ভাষ্য। লেখক মোট ২১ জন ভাষ্যকারের নাম দিয়েছেন। এ তালিকায় রামানুজ, শঙ্কর, ভাস্কর, যাদবপ্রকাশ প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত। মাধ্ব মতে, ভীম যেসব দৈত্যকে হত্যা করেছিলেন, তারাই কলি যুগে জন্ম নিয়ে এসব ভাষ্যের রচয়িতা হয়েছে।
হারিকথামৃতসার
জগন্নাথদাস রচিত কন্নড় গ্রন্থ হারিকথামৃতসার শুরু হয় এই বক্তব্য দিয়ে—২১ জন দুরাত্মা ব্রহ্মসূত্রের কু-ভাষ্য লিখেছে, আর মাধ্ব তাঁদের খণ্ডন করার জন্য এসেছেন। এখানে রামানুজাচার্যের নামও রয়েছে। তাঁর শ্রীভাষ্য কু-ভাষ্য হিসেবে অভিহিত হয়েছে।
শ্রী হয়বদন পুরাণিক তাঁর টীকায় উল্লেখ করেছেন—২১টি ভাষ্যের মধ্যে বর্তমানে শঙ্কর, ভাস্কর ও রামানুজের ভাষ্য টিকে আছে, এবং এই তিনটিই শেষ পর্যন্ত বিষ্ণু-বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে।
বিষ্ণু-বিদ্বেষের রূপ
মাধ্ব গ্রন্থে বিষ্ণু-বিদ্বেষের (Viṣṇu-dveṣa) নয়টি রূপ বর্ণিত হয়েছে:
১. জীবার সঙ্গে ঈশ্বরের অভেদ মানা।
২. ঈশ্বরকে নির্গুণ বা নিরাকার ভাবা।
৩. ঈশ্বরের গুণে ত্রুটি ধরা।
৪. অন্য কারো তাঁহার সমান মনে করা।
৫. অন্য কারো তাঁহার ঊর্ধ্বে ভাবা।
৬. তাঁর দেহ, গুণ, কর্ম বা অবতারত্বে ভেদ খোঁজা।
৭. অবতার সম্পর্কে ভুল ধারণা রাখা।
৮. বিষ্ণু-ভক্তদের ঘৃণা করা।
৯. বিষ্ণু-সংক্রান্ত শাস্ত্রকে নিন্দা করা।
মাধ্ব মতে, শঙ্কর, ভাস্কর ও রামানুজের মতবাদ এই রূপগুলির অন্তর্ভুক্ত। তাই তাঁদের ভাষ্য কু-ভাষ্য এবং তাঁরা দুরাত্মা।
আধুনিক মাধ্ব পণ্ডিতদের মত
আধুনিক মাধ্ব পণ্ডিত বালগারু শ্রীনিবাসাচার্য তাঁর মণি মঞ্জরী বৈভবম (২০০৭)-এ উল্লেখ করেছেন—
-
একজন সত্যিকারের মাধ্বানুগামী হতে হলে মাধ্ব ব্যতীত অন্য সব দার্শনিককে দানব মনে করতে হবে।
-
যারা মাধ্বাচার্যের সমালোচনা করে, তারা অবৈধ জন্মের।
-
রামানুজ, শঙ্কর, ভাস্কর ও তাঁদের অনুসারীরা দানব এবং অবৈধভাবে জন্ম নিয়েছে।
মাধ্বাচার্য ও তাঁর অনুসারীদের লেখনী থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তাঁরা রামানুজ, শঙ্কর ও অন্যান্য ভাষ্যকারদের শুধু ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে দেখেননি, বরং তাঁদেরকে দানব বা অসুর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের রচনা কু-ভাষ্য হিসেবে নিন্দিত হয়েছে।
অতএব, মাধ্ব দর্শনে এক বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়—নিজ মতবাদকে সুরক্ষিত রাখতে অন্য সব মতবাদকে শুধু ভুল বা ভ্রান্ত বলা নয়, বরং আধ্যাত্মিকভাবে অবৈধ ও দানবীয় শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা।
রেফারেন্স
-
মহাভারত তাৎপর্য নির্ণয় (২২.২৮৪, ২২.২৯৫–২৯৭)
-
ভাগবত তাৎপর্য নির্ণয় (২৪.২৯)
-
মাধ্ব বিজয়, নারায়ণ পণ্ডিত
-
হারিকথামৃতসার, জগন্নাথদাস (ভাষ্য: হয়বদন পুরাণিক)
-
বালগারু শ্রীনিবাসাচার্য, মণি মঞ্জরী বৈভবম (২০০৭)