Sunday, December 8, 2024

সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা করে। আর সঠিক শাস্ত্রজ্ঞানের অভাবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিশোর ও যুবক বয়সীরা এই কথায় বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয় এবং ধর্মান্তরিত হয়। হ্যাঁ, বেদে প্রত্যক্ষভাবে সাকার রূপের উল্লেখ নেই ঠিকই। সাকার প্রতীকোপসনা মূলত পুরাণ ও তন্ত্র শাস্ত্র কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু বেদ ও বৈদিক শাস্ত্র সমূহেও অসংখ্য জায়গায় ঈশ্বরের সাকার উপাসনা এবং সাকার রূপের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে এবং সাকার উপাসনার বিরোধিতা, নিষেধাজ্ঞাও কোথাও দেওয়া নেই। বেদ ও প্রামাণ্য বৈদিক শাস্ত্র থেকে রেফারেন্স সহ সাকার উপাসনা এবং প্রতিমা পূজার উল্লেখ দিয়ে বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার নিরোধই এই পোস্টের উদ্দেশ্য।


১.ছান্দোগ্য উপনিষদ ( ৭/১/৪০)
নামৈবৈতৎ, নামোপাসস্ব, ব্রহ্মেতি ব্রহ্মবুদ্ধ্যা, যথা প্রতিমায়াং বিষ্ণুবুদ্ধ্যা উপাস্তে তদ্বৎ।।

শাঙ্কর ভাষ্যঃ নামরূপে প্রসিদ্ধ ঋগ্বেদ, যজুর্ব্বেদ প্রভৃতি, এ সমস্ত নামই, প্রতিমাকে যেরূপ বিষ্ণুজ্ঞানে উপাসনা করে, তদ্রূপ উক্ত নামকেও ব্রহ্মরূপে অর্থাৎ ব্রহ্মবুদ্ধিতে উপাসনা কর।

২. বৃহদারণ্যক উপনিষদ ( ১/১/১)
কাল-লোক-দেবতাত্বাধ্যারোপণঞ্চ প্রজাপতিত্বকরণং
পশোঃ। এবংরূপো হি প্রজাপতিঃ; বিষ্ণুত্বাদিকরণমিব প্রতিমাদৌ। সূর্য্যশ্চক্ষুঃ, শিরসোহনস্তরত্বাৎ সূৰ্য্যাধিদৈবতত্বাচ্চ; বাতঃ প্রাণঃ

শাঙ্কর ভাষ্যঃ প্রজাপতিও কালাদির সমষ্টিস্বরূপ; সেইজন্য প্রতিমা প্রভৃতিতে যেরূপ বিষ্ণুত্বাদি সম্পাদন করা হয়, তদ্রূপ কাল, লোক ও দেবভাব সমারোপণ দ্বারা যজ্ঞীয় পশুরও প্রাজাপত্যত্ব অর্থাৎ প্রজাপতিদৈবতভাব সম্পাদন করা হইয়া থাকে।

৩.  বৃহদারণ্যক উপনিষদ ( ১/৩/১)
ভেদেন হি ব্রহ্মণো নামাদিবস্তু-প্রতিপন্নস্থ্য নামাদৌ বিধীয়তে ব্রহ্মদৃষ্টিঃ-প্রতিমাদাবিব বিষ্ণুদৃষ্টিঃ। আলম্বনতেন হি নামাদি-প্রতিপত্তিঃ, প্রতিমাদিবদেব, ন তু নামাস্তেব ব্রহ্মেতি।

শাঙ্কর ভাষ্যঃ যাহারা নামপ্রভৃতিকে ব্রহ্ম হইতে পৃথক্ বস্তু বলিয়া অবগত আছেন, তাহাদের সম্বন্ধেই নাম প্রভৃতিতে ব্রহ্মদৃষ্টির বিধান করা হইয়া থাকে-অর্থাৎ প্রতিমাপ্রভৃতিতে যেরূপ ব্রহ্মদৃষ্টির বিধান করা হইয়া থাকে, ইহাও ঠিক তদ্রূপই। আর নামপ্রভৃতিতে যে ব্রহ্মদৃষ্টি, তাহাও ঠিক প্রতিমাপ্রভৃতি আলম্বনে ব্রহ্মদৃষ্টির ন্যায় আলম্বনরূপেই (চিন্তার বিষয়রূপেই) বিহিত হইয়া থাকে।

৪. ব্রহ্মসূত্র ( ১/১/২০)
স্যাৎ পরমেশ্বরস্য অপি ইচ্ছাবশাৎ মায়াময়ং রূপং সাধকানু গ্রহাথম।
শাঙ্কর ভাষ্যঃ সাধককে অনুগ্রহ করিবার জন্য পরমেশ্বরেরও ইচ্ছাবশতঃ মায়াময়রূপ হয় সম্ভব।

৫.ব্রহ্মসূত্র ( ১/৩/৩৩)
অস্তি হি ঐশ্বর্য্যযোগাৎ দেব- তানাং জ্যোতিরাজ্যাত্মভিশ্চ অবস্থাতুং, যথেষ্টং চ তং তং বিগ্রহং গ্রহীতুং সামর্থ্যম্ ।

শাঙ্কর ভাষ্যঃ ঐশ্বর্য্যের যোগবশতঃ (-নানাপ্রকার শরীর ধারণ করিবার সামর্থ্যরূপ বিভূতিযুক্ত হন বলিয়া) দেবগণের জ্যোতির্মগুলাদিরূপে অবস্থান করিবার এবং ইচ্ছানুযায়ী তত্তৎ শরীর গ্রহণ করিবার সামর্থ্য আছে।

৬. ঈশোপনিষদ ( ১৫ নং মন্ত্র)

হিরন্ময়েন পাত্রেন সত্যস্যাপিহিতং মুখম্ তৎ ত্বং পুষন্নপাবৃনু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।
- হিরন্ময় পাত্র দ্বারা সত্যের ( পুরুষোত্তম বস্তুর) মুখ আচ্ছাদিত রয়েছে ( যোগমায়া সমাবৃত)। হে পোষণকারী দেবতা, সত্যধর্ম আমার দৃষ্টির জন্য, উপলব্ধির জন্য তাহা অপসারণ করো।

৭. বিষ্ণু সংহিতা ( পঞ্চষষ্টিতম অধ্যায়)

অথাতঃ সুন্নাত: সুপ্রক্ষালিতপাণিপাদঃ স্বাচান্তো
দেবতার্চ্চায়াৎ স্থলে  বা ভগবন্তমনাদিনিধনং বাসুদেব- মভ্যর্জয়েৎ। ১। অশ্বিনোঃ প্রাণন্তেীত ইতি জীবা- দানং দত্ত্বা যুঞ্জতে মনঃ ইত্যম্বুবাকেনাবাহনং রুহা জানুভ্যাং পাণিভ্যাং শিরসা চ নমস্কারং কুষ্যাৎ। ২। আপোহিষ্ঠেতি তিস্বভিরাং নিবেদয়েৎ। ৩।

অর্থাৎ, অনন্তর উত্তমরূপে স্নান, তদন্তে উত্তমরূপে হস্ত- পদ প্রক্ষালন ও তৎপরে উত্তমরূপে আচমন করিয়া, দেবপ্রতিমাতে কিংবা স্থলে (অর্থাৎ ঘটা- দিতে) জন্ম-মৃত্যুরহিত ভগবান্ বাসুদেবের পুজা করিবে। "আশ্বনোঃ প্রাণাস্তোত” এই মন্ত্র দ্বারা জীব দান করিয়া-"যুঞ্জতে মনঃ' এই অনুবাক দ্বারা আহবান করবে। " আপোহিষ্ঠাঃ " ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা অর্ঘ্য প্রদান করবে।
এখানে দ্রষ্টব্য যে এই " যুঞ্জতে মনঃ " মন্ত্রটি শুক্ল যজুর্বেদে পাওয়া যায়, যার প্রয়োগ করে সংহিতা'য় সাকার উপাসনা করার নির্দেশ দিচ্ছে। যথাঃ
যুঞ্জতে মন উত যুঞ্জতে ধিয়ো বিপ্রা বিপ্রস্য বৃহতো বিপশ্চিতঃ। বি হোত্রা দধে বয়নাবিদেক ইন্মহী দেবস্য সবিতুঃ পরিষ্টুতিঃ ॥ 8 ॥ -( শুক্ল যজুর্বেদ)
আবার ঋগ্বেদেও এই মন্ত্রটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
৮১ সূক্ত
[দেবতা: সবিতা। ঋষি: অত্রির অপত্য শ্যাবাশ্ব। ছন্দ: জগতী)

যুঞ্জতে মন উত যুঞ্জতে ধিয়ো বিপ্রা বিপ্রস্য বৃহতো বিপশ্চিতঃ। বি হোত্রা দধে বয়নাবিদেক ইন্মহী দেবস্য সবিতুঃ পরিষ্টুতিঃ। ১॥

আবার, " আপোহিষ্ঠাঃ " এই মন্ত্রটিও শুক্র যজুর্বেদে পাওয়া যায়, যার প্রয়োগ করে সংহিতা'য় বিষ্ণুমূর্তির পূজার নির্দেশ আছে।! যথাঃ
আপো হি ষ্ঠা ময়োভুবস্তা ন উর্জে দধাতন। মহে রণায় চক্ষসে ॥ ১৪॥

৮. বিষ্ণু সংহিতা -২
তম্বোপ্যর ন্যাসেৎ স্বর্ণপাত্রে দেবং সুরেশ্বরম্। সুবর্ণনিষ্কষটুকেন নিৰ্ম্মিতং বজ্রবারিণম্। ১৭ যজেৎ পুরুষসূক্তেন বাসবং বিশ্বরূপিণম্।.
- তদুপরি স্বর্ণপাত্র রাখিয়া তাহাতে ছয় নিষ্ক পরিমিত সুবর্ণ দ্বারা নিৰ্ম্মিত বজ্রহস্ত দেবরাজ-প্রতিমা স্থাপন করিয়া বিশ্বরূপী ইন্দ্রদেবকে পুরুষসূক্ত মন্ত্র দ্বারা  পূজা করবে। 
এখানেও ঋগ্বেদোক্ত পুরুষ সূক্ত দ্বারা ইন্দ্রের সাকার মূর্তির পূজার বিধান দেওয়া হচ্ছে। 

৯. শাতাতপঃ সংহিতা
নিষ্কহপম্রা তু কর্তব্যো দেবঃ শ্রীবৎসলাঞ্ছনঃ
পট্টবস্ত্রেণ সংবেষ্ট্য পূজয়েৎ তং বিধানত
- নিষ্কপরিমিত সুবর্ণ দ্বারা শ্রীবৎস লাঞ্ছন শ্রীকৃষ্ণের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে পট্টবস্ত্র দ্বারা ঐ মূর্তি বেষ্টিত করে উক্ত দেবের যথাবিধি পূজা করবে।
এছাড়াও গৃহ্যসূত্রাদিতে সাকার উপাসনার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। 

১০. শুক্ল যজুর্বেদ -( ১৬শ অধ্যায়)
নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ। বাহুভ্যামুত তে নমঃ।
 - হে রুদ্রদেব, আপনার ক্রোধের উদ্দেশ্যে আমি নমস্কার করি। আপনার বাণের উদ্দেশ্যে এবং আপনার বাহুযুগলের উদ্দেশ্যে আমি নমস্কার করি।
নমস্তে নীলগ্রীবায় সহস্রাক্ষায় মীঢুষে ( ৮ নং মন্ত্র)
 - তিনি নীলবর্ণের কণ্ঠবিশিষ্ট। সহস্র অক্ষিযুক্ত  তাঁকে আমি প্রণাম জানাই।
হস্তে বভূব তে ধনুঃ ( ১১ নং মন্ত্র) 
 - তিনি হস্তে ধনু ধারণ করেছেন। 




এভাবেই বেদে পরোক্ষভাবে দেবতার সাকার রূপের অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। 
অনেকের দাবি বাল্মিকী রামায়ণে সাকার উপাসনা বা প্রতিমাপূজার উল্লেখ নেই।  কিন্তু মূল বাল্মিকী রামায়ণেও পরোক্ষভাবে সাকার উপাসনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

স তত্র ব্রহ্মণঃ স্থানমগ্নেঃ স্থানং তথৈব চ ৷
বিষ্ণোঃ স্থানং মহেন্দ্রস্য স্থানং চৈব বিবস্বতঃ ॥১৭
 সোমস্থানং ভগস্থানং স্থানং কৌবেরমেব চ।
 ধাতুর্বিধাতুঃ স্থানে চ বায়োঃ স্থানং তথৈব চ ॥১৮
 নাগরাজস্য চ স্থানমনন্তস্য মহাত্মনঃ ॥
স্থানং তথৈব গায়ত্রা বসূনাং স্থানমেব চ ॥১৯
 স্থানং চ পাশহস্তস্য বরুণস্য মহাত্মনঃ ॥
কার্তিকেয়স্য চ স্থানং ধর্মস্থানং চ পশ্যতি ॥২০ ॥

গোবিন্দ রাজ স্বামীর ভাষ্য অনুসারে এর অনুবাদ:-

শ্রীরামচন্দ্র সীতা দেবী ও লক্ষ্মণের সাথে অগস্ত্য মুনির আশ্রমে প্রবেশ করে অনেক দেবপূজাগৃহাদি দর্শন করলেন। চতুর্মুখ ব্রহ্মার মন্দির বা পূজা স্থান, অগ্নি, বিষ্ণু, ইন্দ্র, চন্দ্র, ভগ, কুবের, ধাতা ও বিধাতা, বায়ু, নাগরাজ অনন্তশেষ, শষ, গায়ত্রী, বসু ও পাশহস্ত বরুণ দেবের বিগ্রহ সেবিত মন্দির, কার্তিকেয় ও ধর্মরক্ষক যমের মন্দির দর্শন করলেন।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, মূল শ্লোকে পাশহস্ত বরুণের উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এখানে বরুণ অর্থে বেদের নিরাকার শক্তি নন। হাতে পাশ ধারণ করে আছেন এমন সাকার প্রতিমূর্তি বরুণদেবের উল্লেখ পাই। 
এভাবেই বেদ, উপনিষদ, উনবিংশ সংহিতা, বাল্মিকী রামায়ণ সহ অন্যান্য বৈদিক শাস্ত্রে প্রতিমা পূজার মাধ্যমে সাকার উপাসনার উল্লেখ পাওয়া যায়।

সাকার উপাসনার কিছু রেফারেন্স

 নিরাকারবাদী এবং একদল বিধর্মীদের দাবি বেদাদি শাস্ত্রে প্রতিমা পূজা এবং সাকার উপাসনার উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেদবিরুদ্ধ মূর্তিপূজা ক...

Popular Posts