বাংলাদেশ অগ্নিবীর সহ আর্য সমাজী ঘেষা বিভিন্ন
সংঘটন আজকাল প্রচার করে বেড়াচ্ছেন যে বেদের ব্রাহ্মণ ভাগ নাকি প্রক্ষিপ্ত এবং তা মান্য
নয়। যা অতি-বাতুলতা এবং সনাতন ধর্মের জন্য আশংকাজনক বটে। বিভিন্ন শাস্ত্র না জানা সহজ
সরল ছেলেমেয়রা এদের এইসব মিথ্যাচারে পা দিচ্ছেন। তাই আজ আমার এই লেখা।
মীমাংসকগন বলেন, মন্ত্র আর ব্রাহ্মণ এই নিয়েই বেদ। সংহিতা
মন্ত্রময়, ব্রাহ্মণে আছে তার দ্বারা সঙ্কেতিত সাধনার কথা আর মন্ত্রার্থ ভাবনার রহস্যময়
বিবৃতি। আরণ্যক এবং উপনিষদ এই ব্রাহ্মণভাগের অন্তর্গত; কেবল ঈশোপনিষংখানা পড়েছে শুরু
যজুর্বেদের শেষাংশে কর্ম আর জ্ঞানের মাঝে সেতুর মত। মন্ত্র ব্রাহ্মণ আরণ্যক উপনিষৎ
এই নিয়ে বৈদিক সাহিত্যের যে ভাগ, তা শ্রুতি। আর বেদাঙ্গ সুত্র এবং ইতিহাস পুরাণ নিয়ে
যে ভাগ, তা স্মৃতি। স্মৃতি শ্রুতির আশ্রিত। বেদমন্ত্র ঋক সাম যজু এবং অথর্ব এই চারিটি
সংহিতায় সংকলিত হয়েছে। প্রত্যেক সংহিতার সঙ্গে যুক্ত আছে তার ব্রাহ্মণ ভাগ। বর্তমান
সঙ্কলন এই শ্রুতির। সংহিতা বেদের আদি আর উপনিষদ তার অন্ত, উপনিষদের ভাবনা সংহিতার ভাবনার
প্রতিবাদ-আধুনিকদের এই দিগভ্রষ্ট উপস্থাপনা অপ্রমাণ এবং অশ্রদ্ধেয়। সংহিতায় যা রূপময়,
অধ্যাত্ম্য মননের অবিচ্ছিন্ন ধারায় বাহিত হয়ে উপনিষদে তা ভাবসিদ্ধ, সমগ্র বেদার্থে
একটি অখণ্ড মহাসত্যের ব্যঞ্জনা, এই দৃষ্টিই সমীচীন। এই বেদার্থ ই শতধার ভারত- সংস্কৃতির
অক্ষীয়মাণ উৎস। কোন সুদূর অতীতে রাজা সুদাসের যজ্ঞ- ভূমিতে দাড়িয়ে দ্যুলোক-ভূলোক
পরিব্যাপ্ত ইন্দ্রের অপরাজিতা শৌরষশ্রীর বন্দনাগানে মুখর হয়ে ঋষি বিশ্বামিত্র উদাত্ত
কণ্ঠে ঘাষোণা করেছিলেন
“ বিশ্বামিত্রস্য ব্রহ্মেদং রক্ষতি ভারতং জনম্ ”
-আমি বিশ্বামিত্র, আমারই বৃহৎ ভাবনার চিদবীর্য রক্ষা করছে ভারতজনকে। তার সেই সুপ্রাচীন
ব্ৰহ্মঘোষ এক কাস্তোজ্জল ভবিষ্য দিব্যদর্শনেরই মহাব্যাহৃতি, উত্তরাধিকার সুত্রে আমরা
যাকে সার্থক করার দায়কে আজ বহন করছি। সমগ্র বেদসংহিতায় বলতে গেলে কেবল দেবতার কথা।
যিনি বলছেন তিনি ঋষি, অর্থাৎ সত্যের পথে অভিযাত্রী তিনি, আঁধারকে বিদীর্ণ করে চলছেন
অগ্র্যাবুদ্ধির শাণিত ফলকে। চলিত কথায়, তিনি মন্ত্রদ্রষ্টা।
শুধু তাই নয়। দ্যুলোক অন্তরিক্ষ আর পৃথিবী সবই যে দেবতা। সংহিতায়
পাই
একং
বা ঈদং বি বভৃব সর্বম
সেই একই যে বিচিত্র রূপে হয়েছেন এই সবকিছু। উপনিষদে দেখি
সর্বং খলিদং ব্ৰহ্ম- সবই এই যা কিছু সবই এক বৃহৎ চৈতন্যমাত্র। যা বাইরে
তাই অন্তরে। বাইরে যে আকাশ তা-ই আবার এষ অন্তহৃদয়ে এই যে,আমার মধ্যে আমার হৃদয়ে।
যা দৃষ্টিতে, তাই আবার চেতনায়। প্রত্যক্ষ অনুভব করছি এই-যে বায়ু, সে তো বৃহতেরই নিঃশ্বসিত।
এই যে পৃথিবী, এতো শুধু মাটি নয়, এ যে হিরণ্যবক্ষা.. ..অদিতিঃ পরমে ব্যোমন--এযে পরম
ব্যোমের অখন্ডিতা অবন্ধনা চেতনা, মেলে রয়েছে তার সোনার বুকখানি।
এমনি করে সংহিতার দেববাদ আর উপনিষদের ব্ৰহ্মবাদ এক অখণ্ড অদ্বয়
চিন্ময় প্রতাক্ষেরই দুটি ভঙ্গিমাত্র। এই চিন্ময় প্রত্যক্ষবাদই বেদমন্ত্রের মর্মরহস্য।
অধিদৈবতদষ্টিতে বাইরে যাকে দেখছি বিশ্বরূপে তাকেই আবার অনুভব করছি অন্তশ্চেতনায়। পৃথিবীর
বুকে অগ্নিরূপে জলছেন যিনি, তিনিই আমার অন্তরে অভীপ্সার শিখা; অন্তরিক্ষে যিনি বায়ু,
অন্তরে তিনিই প্রাণ। বাইরে যিনি আদিত্য, অন্তরে তিনিই অধৃমক জ্যোতীরূপ পুরুষ। বাইরে
যা দেখছি তার মধ্যে যদি দেবতাকে বা আত্মাকে না দেখি, তাহলে সে দর্শন অচিত্তি বা অবিদ্যার
বিভ্রম মাত্র।
বেদবাণীর প্রবক্তা
ঋষি। তার তাত্বিক দৃষ্ট অধিদৈবত (spiritual), অথচ তার বাগভঙ্গি আশ্রয় করেছে অধিভূত
(phenomenal) দৃষ্টিকে। চিন্ময় প্রত্যক্ষবাদই যদি বেদবাদের মূলকথা হয়, তাহলে এতে
অসঙ্গতি বা নৃয়্যনতার কিছুই নাই। কেননা দেবতাকে প্রত্যক্ষ বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করা অধ্যাত্ম
উপলব্ধির শেষ কথা। কিন্তু গোল বেধেছে এইখানেই। ঋষির অধিদৈবত দৃষ্টির অধিভূত বিবৃতিকে
প্রাকৃতবুদ্ধি জড়প্রত্যক্ষের সঙ্গে ঘুলিয়ে ফেলতে এ দেশে দেববাদের প্রতি যারা অপ্রসন্ন,
তাদেরও কিন্তু এ মতিদ্রম ইয়নি। হয়েছে আধুনিক কালে, পাশ্চাত্য গবেষকদের কল্যাণে। এদের
অধিভূত দৃষ্টি বেদমীমাংসার একটা নৃতন পুর্বপক্ষ উপস্থাপিত করেছে। তার প্রভাবে এক শ্রেণীর
পণ্ডিতদের সমাজে বেদবাণী দূর্বাখ্যাবিষমুর্ছিতা। মনে হয়, প্রাচীন অধিদৈবত দৃষ্টিকে
অধ্যাত্মদৃষ্টির স্বারা আপুরিত করে সে পুর্বপক্ষের জবাব দেবার সময় আজ এসেছে।
বাংলাদেশ অগ্নিবীর এভাবেই বেদের নামে যাতা লিখে হিন্দু সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
যাস্ক বলেন, তিনি সাক্ষাৎকৃতধর্মা সত্যর যে শাশ্বতবিধান বিশ্বের
ধারক, প্রজ্ঞাচক্ষু দিয়ে তাকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। বেদের ভাষায় ঋষির্ষিপ্রঃ কাব্যেন
-তিনিই ঋষি, অলখের আকৃতিতে হৃলয় যার টলমল। এই আকৃতি আছে বলেই তিনি কবি। আবার বেদে
দেখি, যিনি পরম দেবতা তিনিও, কবি, এই বিশ্ব তার অজর অমর কাব্য। দেবতার আকৃতি প্রকাশের,
ঋষির আকৃতি উপলব্ধির । অলখের হৃদয় হতে আলোক ধারা ঝরে পড়ছে, তার ছোয়ায় ঋষির হৃদয়
জল মেলছে। দুটি কবির হৃদয়ে এই যে ছন্দদোলার বিনিময়, বেদমন্ত্র তার বাণীরূপ।
আমরা শুনে এসেছি, বেদমন্ত্রে কেবল কামনার উদগার। একদিক দিয়ে
কথাটা যেমন অংশত সত্য, আরেকদিক দিয়ে তেমনি ভয়ঙ্কর মিথ্যা অলখের কবি যিনি তাঁর আকুতিতে
ফোটে কামনার দিব্যরূপ। সে কামনায় বিশ্বপ্রাণের সেই আদিম আকৃতি : আমি জড়ত্বের বাধা
ভাঙব : আমি বৃহৎ হব। এই আকৃতিতে আত্মচেতনার যে বিষ্ফারণ, বেদের ঋষি তাকে বলেছেন ব্রহ্ম
বা বৃহতের ভাবনা। তার লক্ষ্য স্বর যার অর্থ পরম জ্যোতি বা পরাবাণী দুইই-হতে পারে। দুয়ের
অধিষ্ঠান হল দার্শনিকের ভাষায় আকাশের আনন্ত্য, ঋষির ভাষায়-পরম ব্যোম। ওই অঙ্গহীন
বৈপুল্যের মধ্যে অবগাহনেই তৃষ্ণার্ত জীবনের পরম তৃপ্তি। প্রাণষ্ফুরণের যে দুটি বাধা
জরা আর মৃত্যু, ওইখানে তারা পরাভূত। দেবতারা ওইখানে আছেন, তাঁরা অজর, তারা অমৃত। তাদের
সঙ্গে হৃদয়ের যে সাজুষা, সে-ই আমাদের কাম্য। বেদমন্ত্রে এই কামনাই ছন্দিত হয়েছে।
দেবতারা দ্যুলোকে বা আকাশে-ওই তাদের নিত্যধাম। সে আকাশ উরুরনিবাধঃ
সব ছাওয়া এক চিন্ময় মহাবৈপুল্য, যার মধ্যে স্বচ্ছন্দ বিচরণের কোন বাধা নাই। সেইখানে
দেবতারা স্বধয়া মদন্তি আত্মস্থিতির নিরঙ্কুশ
আনন্দে টলমল। আবার তারা আছেন অন্তরিক্ষেও। আকাশ দ্যুলোক বা আলোর রাজ্য, আকাশ চিন্ময়।
অন্তরিক্ষ বায়ুর রাজ্য, প্রাণময়। তার নীচে
এই পৃথিবী,সে অন্নময় বা জড়, কিন্তু অগ্নিবাসা এবং অগ্নিগর্ভা, দেবতারা সেখানেও আছেন,
আকাশ বাতাস পৃথিবীর সব দেবময় বা চিন্ময়।
খষি দেখছেন কবির দৃষ্টিতে। বে্দের ভাষা ছন্দময় ছবির ভাষা।
অনেক অর্থের ব্যঞ্জনায় তা ব্যাপক এবং গভীর। খষিকে ঘিরে শব্দম্পর্শ- রূপের় মেলা। কিন্তু
এক অলখের প্রভাসকে বহন করে প্রতিমুহর্তে তাঁর অনুভবে তারা প্রতীকী হয়ে উঠছে। অর্ধচ্ছন্ন
রহস্যের ইংগিতে প্রতীক হৃদয়কে উদ্বেল করে তোলে, সত্তার গভীরে সঞ্চারিত করে না-পাওয়াকে
পাওয়ার এক জালাময় অভীপ্সা। বেদমন্ত্র এই অভীগ্সার বাহন। মীমাংসক যদি বলে থাকেন ক্রিয়া
বা সাধনার প্রতি প্রেরণা দেওয়াই বেদপ্রতিপাদিত ধর্মের তাৎপর্য, তাহলে তিনি ভুল বলেন
নি। বেদমন্ত্রের বীর্য এই প্রচোদনাতে, তার এই সাবি্ত্রী শক্তিতে। এক কথায় বলতে গেলে
গভীর দর্শনকে ছবির ভাষায় রূপ দিয়ে অন্তরের আকুতিকে লেলিহান করে তোলা এই হল বেদমন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। সে বৈশিষ্ট্য
এখনও ক্ষু্ণ্ণ হয়নি। বরং অধ্যাত্ম সাধনাকে প্রত্যক্ষাবগম ও বিশ্বজনীন করবার জন্য বেদের
সাধনাকে ভারতবর্ষের আজ বিশেষ প্রয়োজন।