রাজা মহারাজারা শাস্তি হিসাবে সত্যিসত্যিই কিন্তু এককালে নাক কেটে দিতো। সেই কেটে দেওয়া নাকের চিকিৎসা দিয়েই এসেছে বর্তমান Rhinoplasty নামক বিশেষ চিকিৎসা। এই ধরনের শল্যচিকিৎসার প্রথম উল্লেখ দেখা যায় "সুশ্রুত সংহিতা" নামক গ্রন্থে। আজ এই বিশেষ গ্রন্থ এবং তার রচয়িতাকে নিয়েই বলবো।
আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে কাশীরাজের ঘরে জন্ম নেয় দেববৈদ্য ধন্বন্তরি, গরুড়পুরাণ (অধ্যায় - ১৩৯) মতে তার নাম ছিল দিবোদাস। মহর্ষি বিশ্বামিত্র যখন জানতে পারে দেব ধন্বন্তরি অবতীর্ণ হয়েছেন পৃথিবীতে এবং কাশীতে বাস করে চিকিৎসা বিদ্যা শিখাচ্ছেন, তিনি তার পুত্র সুশ্রুতকে তার নিকট প্রেরণ করেন৷ সেখানে সুশ্রুত তার চিকিৎসা শিক্ষা লাভ করে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং হয়ে উঠেন মহর্ষি সুশ্রুত। তার এই কাহিনির উল্লেখ গরুড় পুরাণ ছাড়াও শতপথ ব্রাহ্মণ এবং মহাভারতের অনুশাসন পর্বেও পাওয়া যায়।
কিছু মতান্তর আছে এমন যে, তিনি বিশ্বামিত্রের পুত্র নয় বরং তার বংশের তথা বিশ্বামিত্র গোত্রীয় ছিলেন। এমন কথাও শুনা যায় যে, মহর্ষি সুশ্রুত ১৫০০ বা ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের লোক ছিলেন, যা ভিত্তিহীন বলা চলে বহু করণে। যাই হোক, শাস্ত্রের কথাই বিশ্বাসে রাখলাম। এবার আসা যাক সুশ্রুতের কীর্তির দিক গুলিতে।
সাধারণ চিকিৎসা শাস্ত্রের / Medical Science এর সংজ্ঞা এমন, "the science of dealing with the maintenance of health and the prevention and treatment of disease" কিন্তু যখন আমরা আয়ুর্বেদের বিষয়ে আসি তখন দেখা যাবে "the medical treatise summarizing the art of healing and prolonging life" কেবল চিকিৎসাকে আয়ুর্বেদ বলা যায় না। আয়ুর্বেদ আয়ু বদ্ধির সকল প্রক্রিয়াকে নিয়ে গঠিত, যদিও প্রায় কাছাকাছি অর্থই দাঁড়ায়। অনেকে আবার এটাকে কেবল Herbal care মনে করে, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। প্রাচীণ কালে ব্যবস্থা যেমন ছিলো তাতে গাছগাছালী বেশি ব্যবহার হতো ঠিকই কিন্তু তার মানে এই না যে সব গাছপালার উপরই নির্ভরশীল ছিলো। আরও অনেক ধরনের ব্যবস্থা ছিলো যা এই বইগুলি পড়লে বুঝবেন। আমি ছোট একটা বর্ণনা দিচ্ছি কেবল।
সুশ্রুত সংহিতা মূলতঃ বৈদিক চিকিৎসা শাস্ত্র যাকে মহর্ষি সুশ্রুত একত্রিত এবং সুসজ্জিত ভাবে পুস্তকাকারে মুদ্রিত করেছেন। গ্রন্থের এক্কেবারে প্রথমেই দেখা যায় চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভাজন। ধন্বন্তরি অবতার দিবোদাস বলছেন - আয়ুর্বেদ যা অথর্ববেদের একটি অংশ মাত্র। এটি ব্রহ্মার মুখে বিশালাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু মানবমস্তিস্কের কথা ভেবে একে ৮ ভাগে ভাগ করা হলো। যথা - (১) শল্য তন্ত্র - Ulcer, পাথর, জমাট বাধা রক্ত, অতিরিক্ত হাড় ইত্যাদি মুক্তকরণ মূলত যেকোনো কিছু শরীর থেকে বের করা, (২) শালক্য তন্ত্র - চোখ, নাসিকা আদি গলার উপরের অঙ্গের চিকিৎসা, (৩) কায় চিকিৎসা - জ্বর, আমাশয়, Haemoptysis, উন্মাদনা, Hysteria, কুষ্ঠরোগ, মূত্রনালী থেকে অপ্রাকৃত স্রাব ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা, (৪) ভূত বিদ্যা - ভূতে ধরা ইত্যাদি মানসিক রোগমুক্তি, (৫) কৌমার ভৃত্য - শিশুপালন, (৬) অগদ তন্ত্র - Toxicology বা বিষবিদ্যা, (৭) রসায়ন তন্ত্র - আয়ু বৃদ্ধির বিভিন্ন প্রক্রিয়া, (৮) বাজিকরণ তন্ত্র - শুক্রাণু এবং তার বিষয়ে আলোচনা। তাছাড়া আছে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসক বা বৈদ্যের বর্ণনা, কে বৈদ্য হতে সক্ষম আদি আলোচনা।
সেই ব্যক্তিই সেবার জন্য বা রোগীর শয্যাতে যোগ দিতে উপযুক্ত, যিনি শান্ত মাথার এবং যার আচরণ আনন্দদায়ক। যে কারও সম্পর্কে খারাপ কথা বলেন না, অসুস্থ ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তার প্রতি দায়িত্বশীল এবং মনোযোগী এবং অনিবার্যভাবে চিকিৎসার নির্দেশ অনুসরণ করে। — সুশ্রুত সংহিতা, ১/৩৪
ধাত্রীবিদ্যা, দন্তচিকিৎসা (Dentistry), Lithotomic Operations, বিভিন্ন ধরনের কাটাছেঁড়া (Amputations, Dissection), হাড় জোড়া লাগানো, Anatomy, ভ্রুণতত্ত্ব (Embryology), Sexual Dimorphism, Anabolic and Catabolic occurances, রোগপ্রতিরোধ এবং সুস্থ থাকার সব রকম উপায় তিনি তার গ্রন্থে বলে গেছেন। রোগ গুলিকে তিনি মূলতঃ ত্রিবিধ দোষের ফল হিসাবে বর্ণনা করেছেন — ১. বাত, ২. পিত্ত, ৩. কফ (সাধারণ বাংলা শব্দের সাথে তুলনীয় নয়)। Ulcer, মধুমেহ (Diabetes), কুষ্ঠ, রক্তচাপ, Blood Fluids সম্পর্কিত তথ্য, হৃত শল (Heart Pain) ইত্যাদি রোগের বর্ণনাও পাওয়া যায় এতে। উৎস ইত্যাদি অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৩৬০টি হাড়ের বর্ণনা পাওয়া যায় যার মধ্যে Endo skeleton এর সাথে Exo skeleton যথা দাঁত নখকেও রেখেছেন তিনি। অনেকেই বিভ্রান্ত হন কারণ আমরা ২০৬টি হাড়ের যেই বর্ণনা পড়ি তা প্রাপ্তবয়স্ক মজবুত (Endo skeleton) হাড়ের কথা কেবল, এছাড়াও অনেক গভীর আলোচনা আছে এতে। Balanced Diet, য়োগসাধনা ইত্যাদি নিয়ে তিনি সম্পূর্ণ গ্রন্থটি মুদ্রিত করেছেন মোট ১৮৬ অধ্যায়ে। যা ৬ ভাগে বিভক্ত —
১. সুত্র স্থান - ৪৬ অধ্যায়
২. নিদান স্থান - ১৬ অধ্যায়
৩. শরীর স্থান - ১০ অধ্যায়
৪. চিকিৎসা স্থান - ৪০ অধ্যায়
৫. কল্প স্থান - ৮ অধ্যায়
৬. উত্তর তন্ত্র - ৬৬ অধ্যায়
এই গ্রন্থে তিনি ১১২০ ধরনের রোগের উল্লেখ করেছেন, ৭০০ ভেষজ, ৬৪ minerals এবং ৫৭ প্রাণিজাত ঔষধির কথা বলেছেন। তার শল্যচিকিৎসার কীর্তি এবং Cosmetic Surgery তে অবদানের জন্য তাকে Father of Surgery এবং Father of Plastic Surgery হিসাবে আক্ষায়িত করা হয়। তার বর্ণনাকৃত ৩০০ ধরনের অস্ত্র (surgical instruments) এখনো ব্যবহার হয় আমাদের মেডিকেল হাসপাতাল গুলিতে।
কিছু বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত শস্ত্রের নাম আর ছবি দিলাম। সুশ্রুত সংহিতায় চিকিৎসকের জন্য Anatomy শিক্ষার বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এবং মৃত দেহ থেকে তার জ্ঞান অর্জনের জন্য বলা হয়েছে। ছাত্রদের শল্যচিকিৎসা শিক্ষার জন্য বিভিন্ন কুমার জাতীয় ফল, মৃত প্রাণী ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।
এই গ্রন্থ যাকে ধর্মগ্রন্থের সাথে তুলনা করা হয়, তার প্রথম আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয় Kitab Shah Shun al-Hindi নামে, বাগদাদে এই বইয়ের নাম Kitab i-Susurud (অষ্টম শতকে অনুবাদিত) এর পর আরও পশ্চিমের দিকে এই বই প্রচারিত হতে থাকে কম্বোডিয়া আদি দেশগুলিতেও এই বই প্রচারিত হয়৷
অনেকে আবার এই ধারণায় থাকে যে এই বইগুলিতে যা আছে তাই করতে হবে। তাদের এই মতবাদ নিতান্তই হাস্যকর। উন্নয়ন ও যুগোপযোগী করে তোলাকে হিন্দুশাস্ত্র সর্বদা অগ্রাধিকার দিয়েছে। তার একটা কাহিনি বলি,
সাল ১৭৯৪, তখনো "রয়াল সোসাইটি অফ সার্জারি" প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ব্রিটেনে প্রথম প্রথম ম্যাগাজিন বের হচ্ছে তখন। The Gentleman's Magazine, October 1794 এর মুদ্রনে একটা লেখা উঠে আসে। ভারতের পুনেতে এক ব্যক্তি Nose Surgery করছে (Rhinoplasty নাম তখনও প্রচলিত হয় নি)। সে করছে এমন যে কপালের চামড়া কেটে তা দিয়ে নাক পুনর্নির্মাণ করছে, সুশ্রুত সংহিতায় যদিও বলছে গালের চামড়া দিয়ে করতে। বিশেষ উল্লেখ্য এই যে, সে চামড়া সুশ্রুতের মতো সম্পূর্ণ কেটে ফেলছে না, বরং এক ভাবে যুক্ত রেখেই লাগিয়ে দিচ্ছে যার ফলে চামড়া মরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে বুঝা তো গেলোই বর্তমান Medical Science কিভাবে আয়ুর্বেদের অংশ, বলতে গেলে উন্নত আয়ুর্বেদ। অনেকের মধ্যেই দেখেছি, Medical Science এর বদনাম করে আয়ুর্বেদের সুনাম করতে। তারা আবার এমন ধারণায় বিশ্বাসী যে আয়ুর্বেদ আসলে Herbal চিকিৎসা। কী আর বলবো! হাস্যকর।
যাই হোক, Surgery এর ইতিহাসে আসি। পুনের সেই লোকের নাম ছিল Cowsjee, এই ব্যপারে আমি YouTube এর একটা ভিডিও থেকে জেনেছি যদিও। এখন এই Cowsjee -র নাম থেকে Chirurgie এবং তা থেকে এসেছে Surgery নাম বলা হচ্ছে। এর কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে সেই সাধারণ গল্প, কাটাকাটি তো তৎকালের প্রতিটা যুদ্ধেরই ঘটনা। কিন্তু এই Rhinoplasty করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছিল। যা সফল ভাবে প্রয়োগ করছে ভারতের এই গাড়োয়ান কিম্বা কুমার৷ যার কারণে তার প্রতি এতো আগ্রহ ছিলো বিদেশিদের। এভাবেই সুশ্রুত সংহিতা পুনরায় প্রচারিত হতে শুরু করে।
আবার ১৮৯০ সালের দিকে স্যার হেমিলটনের আবিষ্কৃত রাশিয়া অঞ্চলের এক প্রাচীণ নথির কথাও বিশেষ শুনা যায় যা আত্রেয়, হরিত, পরাসর, বশিষ্ঠ, সুশ্রুত আদি কিছু বিশেষ চিকিৎসকের কথা উল্লেখ করছে। যা সুশ্রুত সংহিতাকে আরও আগ্রহের কেন্দ্র করে তোলে। এটার মূল কারণ বিদেশিরা মানতে নারাজ ছিল, উপমহাদেশের গেঁয়োরা কোনো ভাবেই এতো উন্নতি করতে পারে না। তারা শতপথ ব্রাহ্মণ ইত্যাদি দেখে শেষে এটাকে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের বলে চালিয়ে দেয়। তাও মহাভারতের আমালের ব্যক্তি হিসাবে সুশ্রুতকে মানতে পারে না। যাই হোক, তাও সুশ্রুত প্রাচীণতম চিকিৎসা বিদ্যার পণ্ডিত, শল্যচিকিৎসার জনক।
এতো কিছু তো জানলেন, কিন্তু বলুন তো Anesthesia তখন ছিলো কী ছিলোনা? না থাকলে Operation কিভাবে করতো?